‘খালি নজর রেখো; আমি এখনও একে শেষ করিনি।’
‘সাবধান!’ চিৎকার করে বললাম, ‘ওর কাছে ছুরি আছে।’
চিৎকারটা একটু দেরিতে হয়েছে। লোকটা ইতিমধ্যে রেমন্ডের হাতে এবং মুখে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।
ম্যাসন লাফিয়ে এগিলে এল। অন্যজন পানি থেকে উঠে এসে দাঁড়াল ছুরি হাতে-ধরা লোকটার পিছে। নড়বার সাহস পেলাম না আমরা। আমাদের দিক থেকে নজর না সরিয়ে এবং ছুরিটা সামনে ধরে লোকদুটো আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগল, যখন তারা বেশ নিরাপদ দূরত্বে তখন পিছন ফিরে দে দৌড়। প্রখর রোদের নিচে আমরা নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রক্ত ঝরছিল রেমন্ডের হাতের ক্ষত থেকে এবং মোচড়াচ্ছিল সে কনুইয়ের উপরদিকটা।
ম্যাসন বলল, একজন ডাক্তার আছেন যিনি প্রতি রোববার এখানে কাটান। রেমন্ড বলল, বেশ, চলো তার কাছে যাওয়া যাক। কথা বলতে পারছিল না সে, কারণ তার মুখের অন্য ক্ষত থেকে রক্তের বুদবুদ উঠছিল।
আমরা দুজন দুদিক থেকে ধরে তাকে বাংলোয় নিয়ে এলাম। সেখানে পৌঁছলে সে বলল, ক্ষতটা তত গভীর নয় এবং ডাক্তারের কাছে সে হেঁটেই যেতে পারবে। মারি বেশ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল আর মাদাম ম্যাসন তো কাঁদছিলেন।
ম্যাসন এবং রেমন্ড চলে গেল ডাক্তারের কাছে এবং আমি রয়ে গেলাম মহিলাদের কাছে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করার জন্যে। এ-ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না, তাই কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম।
ম্যাসনের সঙ্গে রেমন্ড ফিরে এল প্রায় দেড়টার সময়। হাতে তার ব্যান্ডেজ বাধা এবং মুখের এককোণে একটা স্টিচিং প্লাস্টার। ডাক্তার তাকে আশ্বাস। দিয়েছেন জখম তেমন গুরুতর কিছু নয়, কিন্তু তাকে বেশ বিষণ দেখাচ্ছিল। ম্যাসন তাকে হাসাবার চেষ্টা করে বিফল হল।
খানিক পর রেমন্ড বলল, সে একটু সৈকতে বেড়াতে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছে সে। এতে একটু আমতা আমতা করে বলল, এই একটু হাওয়া। খেতে যাচ্ছি। তখন আমরা ম্যাসন এবং আমি বললাম, তা হলে আমরাও তার সঙ্গে যাব। কিন্তু সে চটে উঠে আমাদের নিজের চরকায় তেল দিতে বলল। ম্যাসন তার অবস্থা দেখে বলল আমাদের জোর করা উচিত নয়। যাহোক, যখন সে বের হল তখন আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
ঘরের বাইরের অবস্থা তখন জ্বলন্ত চুল্লির মতো এবং সূর্যের আলো আগুনের ফুলকির মতো সমুদ্র আর বালিতে ঝরছে। নিচুপে আমরা হাঁটলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল আমার, রেমন্ড কোথায় যাবে সে-সম্পর্কে নিশ্চয় সে কিছু ভেবেছে; কিন্তু এ-সম্পর্কে আমার ধারণা বোধহয় ছিল ভুল।
সৈকতের শেষমাথায় একটা ছোট ঝরনার সামনে এসে পৌঁছলাম যেটা বেশ বড় একটা টিলার পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেখানে আমরা আরব দুজনকে দেখলাম নীল আলখাল্লা পরে শুয়ে আছে বালিতে। যে-লোকটি রেমন্ডকে ছুরি মেরেছিল সে নীরবে তাকাল রেমন্ডের দিকে। অন্যজন ছোট এক বাঁশিতে একটি সুরের তিনটি গত বাজাচ্ছে। বারবার সে এটা বাজাচ্ছিল এবং আড়চোখে দেখছিল আমাদের।
কিছুক্ষণ আমরা কেউই নড়লাম না। শুধু ঝরনার কলতান এবং বাঁশির সেই তিনটি বিরহী শব্দ ছাড়া চারদিকে শুধু সূর্যের আলো আর নৈঃশব্দ। তারপর রেমন্ড হাত দিল তার রিভলবার-রাখা পকেটে, কিন্তু আরব দুজন নড়ল না বিন্দুমাত্র। খেয়াল করে দেখলাম, যে-লোকটা বাঁশি বাজাচ্ছিল তার বিরাট পায়ের পাতা ডান কোণ-বরাবর পায়ের কাছে উলটানো।
তখনও তার প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে রেমন্ড আমায় জিজ্ঞেস করল : ‘শোধটা নিয়ে নেব নাকি?’
দ্রুত চিন্তা করলাম। যদি না’ বলি তা হলে সে যে-অবস্থায় আছে তাতে চটে উঠে হয়তো রিভলবার ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং মাথায় এখন যা এল তা ই বললাম, ‘সে এখনও তোমায় কিছু বলেনি। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় তাকে গুলি করা অতি নীচ কাজ হবে।‘
আবার কয়েক মুহূর্ত সব চুপ, খালি উষ্ণ ধীর বাতাসে বাঁশির শব্দ আর ঝরনার কলতান।
‘বেশ, বলল রেমন্ড আমাকে, যদি তুমি তা-ই মনে করো তবে প্রথমে তাকে কিছু অপমানকর কথা বলব। এবং সে যদি উত্তর দেয় তবে গুলি করব।’
‘বেশ’, বললাম আমি, ‘কিন্তু যতক্ষণ-না সে ছুরি বের করছে ততক্ষণ গুলি ছোঁড়ার কোনো অধিকার তোমার নেই।’
রেমন্ড অস্থির হয়ে উঠেছিল। যে-লোকটা বাজাচ্ছিল সে তখনও বাজিয়ে চলছে। এবং দুজনই নজর রাখছে আমাদের অবস্থানের দিকে। ‘শোনো’, বললাম রেমন্ডকে, তুমি ডান দিকেরটাকে সামলাও আর রিভলবারটা দাও আমাকে। যদি অন্যজন কিছু করে বা ছুরি বের করে তা হলে আমি গুলি করব।
রেমন্ড রিভলবারটা যখন আমার হাতে দিল তখন তা সূর্যের আলোয় ঝকমক করে উঠল। কিন্তু তখনও কেউ কিছু করেনি। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন চেপে বসছে আমাদের ওপর এবং তাই যেন কেউ নড়তে পারছি না। চোখ না-নামিয়ে শুধু আমরা নজরে রাখছি একে অপরের প্রতি : পুরো পৃথিবী যেন এসে থেমে গেছে সূর্যের আলো আর সমুদ্রের মাঝখানে এই ছোট সৈকতে, নলখাগড়া এবং ঝরনার দ্বিগুণ নৈঃশব্দে। এবং ঠিক তখন আমার মনে হল গুলি করা বা না-করা সমান, কারণ ফলাফল একই হবে।
তারপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল লোক দুজন; টিলার আড়ালে মিলিয়ে গেছে দুজন গিরগিটির মতো। সুতরাং আমি আর রেমন্ড আবার পিছু ফিরে হাঁটা শুরু করলাম। বেশ খুশি মনে হচ্ছিল তাকে এবং আমাদের ফেরার বাস সম্পর্কে সে কথা বলতে লাগল।