সাঁতারশেষে বালুতে শুয়ে পড়লাম, তাকালাম আকাশের দিকে এবং অনুভব করছিলাম সূর্য আমার ঠোঁটের গালের লবণজল শুষে নিচ্ছে। দেখলাম, ম্যাসন সাঁতার কেটে তীরে ফিরে সূর্যের নিচে শুয়ে পড়ল। দূর থেকে তাকে লাগছিল অনড় এক বিশাল তিমির মতো। তারপর মারি প্রস্তাব করল আমাদের আগুপিছু সাঁতার কাটা উচিত। মারি আগে, পিছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরেছি আমি এবং সে যখন হাত দিয়ে পানি ঠেলে সামনে এগোচ্ছিল তখন আমি পিছন থেকে পা মেরে তাকে সাহায্য করছিলাম।
জল ছিটাবার আওয়াজ এতক্ষণ ধরে কানে বাজছিল যে, মনে হল যথেষ্ট হয়েছে। সুতরাং মারিকে ছেড়ে দীর্ঘ এবং গভীর শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে ফিরে এলাম। তীরে পা ঠেকতেই ম্যাসনের পাশে বালিতে মুখ রেখে উলটো হয়ে শুয়ে পড়লাম। তাকে বললাম, জায়গাটা বেশ চমৎকার এবং সে একমত হল। একসময় ফিরে এল মারি। তাকে দেখার জন্যে মাথা তুললাম। চুল তার পিছে ঠেলে দেয়া এবং নোনাজলের জন্যে তাকে দেখাচ্ছে চকচকে। তারপর সে শুয়ে পড়ল আমার পাশে এবং সূর্য ও আমাদের শরীরের মিলিত উত্তাপের জন্যে মনে হল আমি ঘুমিয়ে পড়ব।
কিছুক্ষণ পর আমার হাত টেনে ধরে মারি বলল, ম্যাসন তার বাসায় চলে গেছে; এবং এখন নিশ্চয় দুপুরের খাবার সময়। ক্ষুধার্ত থাকায় আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু মারি বলল, সকাল থেকে তাকে আমি একটি চুমোও খাইনি। কথাটা আসলে ঠিক–যদিও কয়েকবার তাকে আমার চুমো খাবার ইচ্ছে হয়েছিল। চলো ফের জলে নামি’, বলল সে এবং দৌড়ে সমুদ্রে নামলাম ও ছোট ছোট ঢেউয়ের মাঝে কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে পড়ে রইলাম।
ফিরলাম যখন, তখন দেখি ম্যাসন তার বাংলোর সিঁড়িতে বসে আমাদের ফিরে আসতে বলে চিৎকার করছে। বললাম তাকে আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং সে তখুনি তার বউয়ের দিকে ফিরে বলল আমাকে তার বেশ মনে ধরেছে। রুটিটা ছিল চমৎকার আর আমার ভাগের পুরো মাছই আমি সাবাড় করলাম। তারপর আনা হল ‘স্টিক’ এবং চিপস’। খাবার সময় আমরা ছিলাম নিশ্চপ। ম্যাসন প্রচুর মদ খেল এবং যখনই আমার গ্লাস খালি হতে লাগল তখুনি সে তা পুরো করে দিতে লাগল। সবাইকে যখন কফি দেয়া হচ্ছিল তখন আমার কেমন ঝিমঝিম লাগছিল এবং আমি একটার পর একটা সিগারেট খাওয়া শুরু করলাম। ম্যাসন, আমি এবং রেমন্ড সবাই মিলে খরচা ভাগ করে পুরো আগস্ট মাসটা এখানে কাটাবার একটা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলাম।
হঠাৎ মারি অবাক সুরে বলল, এই দ্যাখো! বলো তো কটা বাজে? মাত্র সাড়ে এগারো।
একথায় আমরা অবাক হয়ে গেলাম এবং ম্যাসন মন্তব্য করল, আমাদের খাওয়াটা খুব সকাল-সকাল হয়ে গেছে, কিন্তু যা-ই বলো লাঞ্চ হল ‘মোভেবল ফিস্ট’, যখন যার ইচ্ছে তখন সে খেল।
একথায় মারি হাসতে লাগল। জানি না কেন। মনে হল বেশ একটু টেনেছে।
তারপর ম্যাসন জিজ্ঞেস করল, সৈকতে তার সঙ্গে আমি একটু বেড়াতে বের হব কি না।
‘দুপুরের খাবারের পর আমার স্ত্রী সবসময় একটু ঘুমোবে’, বলল সে, ‘আমার আবার তা পছন্দ নয়, আমার দরকার অল্প একটু বেড়ানো। সবসময় তাকে বলে আসছি স্বাস্থ্যের জন্যে এটা ঢের উপকারী। কিন্তু স্বভাবতই সে নিজের মত আঁকড়ে থাকে।‘
মারি জানাল সে ঘরেই থাকবে এবং ধোয়ামোছায় সাহায্য করবে। ম্যাসনের বউ হাসল, বলল, ‘তা হলে সবচেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে পুরুষদের বের করে দেয়া।’ সুতরাং একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম আমরা তিনজন।
রোদ এখন প্রখর এবং জলের ওপর তার প্রভাব যে-কোনো লোকের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেবে। সৈকত প্রায় খালি। তীরের বাংলো থেকে খালি ছুরি-কাটা, বাসনকোসনের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিলাগুলি থেকেও যেন ভাপ বেরুচ্ছে এবং বেশ কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে।
প্রথমে রেমন্ড এবং ম্যাসন এমন সব লোকের কথা আলোচনা করল যাদের আমি চিনি না। মনে হল তারা বেশ কিছুদিন ধরে পরস্পরের পরিচিত, এমনকি একসঙ্গে থেকেছেও কিছুদিন। জলের ধার ঘেঁষে আমরা হাঁটতে লাগলাম, যখন-তখন ঢেউ এসে আমাদের ক্যানভাসের জুতোগুলি ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কিছুই ভাবছিলাম না আমি। সূর্যের পুরো উত্তাপ আমার খালিমাথায় পড়ায় তন্দ্রালস হয়ে উঠলাম।
ঠিক তখন রেমন্ড ম্যাসনকে কিছু বলল যা আমি ধরতে পারলাম না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম দূর-সৈকতে দুজন আরব নীল পোশাক পরে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। রেমন্ডের দিকে তাকালাম এবং সে মাথা নেড়ে বলল, এই সে’। আমরা দৃঢ়ভাবে হাঁটতে লাগলাম। কীভাবে তারা আমাদের খুঁজে পেয়েছে সেকথা ভেবে ম্যাসন অবাক হল। আমার মনে হল তারা আমাদের বাসে চড়তে দেখেছিল এবং মারির স্নানের অয়েলক্লথ ব্যাগও নজরে পড়েছিল তাদের, কিন্তু কিছু বললাম না।
আরবরা যদিও হাঁটছিল আস্তে আস্তে কিন্তু তবুও তারা প্রায় চলে এসেছিল আমাদের কাছে। আমরা হাঁটার গতি পরিবর্তন করলাম না; কিন্তু রেমন্ড বলল :
‘শোনো যদি কিছু হয়, ম্যাসন তুমি দ্বিতীয়টাকে সামলিয়ো, আমার পিছনে যে লেগেছে তাকে আমি সামলাব। আর যদি আরেকটা আসে তা হলে মারসো। তুমি সামলাবে।‘
বললাম, ঠিক আছে। এবং ম্যাসন পকেটে তার হাত পুরল।
বালু আগুনের মতো গরম এবং শপথ করে বলতে পারি সবকিছু কেমন লালচে ঠেকছিল। আমাদের সঙ্গে আরবদের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। যখন আমরা মাত্র কয়েক পা দূরে তখন তারা থামল। ম্যাসন আর আমি পদক্ষেপ ধীর করলাম আর রেমন্ড সোজা এগোল তার প্রতিপক্ষের দিকে। কী বলল সে তা শুনতে পেলাম না, কিন্তু দেখলাম লোকটা মাথা নিচু করছে যেন রেমন্ডের বুকে গুতো মারবে। রেমন্ড সঙ্গে সঙ্গে চড় লাগিয়ে ম্যাসনকে ডাকল। ম্যাসন এতক্ষণ যার দিকে নজর রাখছিল তার বরাবর গিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে দুবার ঘুসি মারল। লোকটা সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল এবং সেকেন্ড কয়েক চারপাশে ফেনিয়ে-ওঠা বুদবুদ নিয়ে পড়ে রইল। ইতিমধ্যে রেমন্ড বেশ করে দাবড়াচ্ছিল বাকিটাকে এবং তার মুখ ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। লোকটার ঘাড়ের ওপর দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল :