আমরা থানায় গিয়েছিলাম আগের দিন বিকেলে, সেখানে রেমন্ডের হয়ে সাক্ষী দিয়ে আমি বলেছিলাম–মেয়েটা ঠকিয়েছিল রেমন্ডকে। সুতরাং তারা তাকে সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছিল। আমার বিবৃতিটাকে খতিয়েও দেখেনি।
দরোজার সামনে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ঠিক করলাম বাসে যাব আমরা। অতি সহজে সেখানে হেঁটেও যাওয়া যায়। তবে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি তত ভালো। আমরা যখন বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছি তখন রেমন্ড আমার জামার হাত ধরে টান দিয়ে বলল রাস্তার অপরদিকে তাকাতে। দেখলাম, কয়েকজন আরব দাঁড়িয়ে আছে তামাকঅলার জানলার সামনে। তারা নীরবে আমাদের দেখছিল যেন আমরা পাথরের চাঙড় বা মরা গাছ। ফিসফিস করে রেমন্ড বলল, বামদিকের দ্বিতীয় লোকটিই হল তার সেই লোক এবং মনে হল। সে বেশ চিন্তিত। যাহোক, বোঝাতে চাইল সে, এগুলি সব পুরনো ব্যাপার। মারি এ-মন্তব্যটা ধরতে পারেনি তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললে?’
ব্যাখ্যা করে বললাম, রাস্তার ওপাশের আরবগুলি রেমন্ডের ওপর খেপে আছে। মারি আমাদের সেখান থেকে জলদি চলে যাওয়ার ওপর জোর দিল। রেমন্ড তখন হাসল, কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ভদ্রমহিলা ঠিকই বলেছেন’, বলল সে, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।’ বাসস্টপে যাওয়ার অর্ধেক রাস্তায় পিছন ফিরে তাকাল সে এবং বলল, লোকগুলি অনুসরণ করছে না। আমিও ঘুরে তাকালাম। তারা ঠিক আগের মতোই আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিকে তাকিয়ে আছে একইভাবে।
বাসে ওঠার পর স্বস্তি পেয়ে রেমন্ড মারিকে হাসাবার জন্যে ঠাট্টা করতে লাগল। মনে হল, মারিকে তার ভালো লেগেছে। কিন্তু মারি তাকে পাত্তাই দিল না। যখন-তখন সে হাসছিল আমার চোখে চোখ রেখে।
আলজিয়ার্সের ঠিক বাইরে নামলাম আমরা। সমুদ্র বাসস্টপ থেকে খুব দূরে নয়; শুধু মালভূমির মতো একটা উঁচু জায়গা পেরুতে হয় যার ওপর থেকে দেখা যায় সমুদ্র। তার পরেই মালভূমি ঢালু হয়ে মিশে গেছে বালিতে। এখানকার জমি ভরা। বন্য লিলি আর হলদে নুড়িতে। নীল আকাশের পাশে বন্য লিলিগুলিকে লাগছিল শাদা। তুষারের মতো। গরমের দিনে আকাশটা যেভাবে ঝলসায় ঠিক সেভাবে ঝলসাচ্ছিল। মারি ফুলগুলির ওপর ব্যাগ দুলিয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছিল আর ফুলের পাপড়িগুলি ব্যাগের বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ছিল চারদিকে। তারপর আমরা দুপাশে সবুজ বা শাদা খুঁটির বেড় দেয়া, কাঠের ব্যালকনিসুদ্ধ ছোট ছোট বাড়ির মাঝ দিয়ে হেঁটে এলাম। কিছু আবার ঝাউঝোঁপের আড়ালে আধা-লুকানো। আমরা সে-সারি পেরুতে-না পেরুতে সমুদ্র পুরো শরীর নিয়ে দেখা দিল; কাঁচের মতো মসৃণ হয়ে পড়েছিল সমুদ্র; কিছুদূরে একটা বড় অন্তরীপ বেরিয়ে এসেছে তার কালো ছায়া নিয়ে। মৃদু বাতাসে ভেসে আসছিল একটা মোটর-এঞ্জিনের অস্পষ্ট গুঞ্জন এবং দেখলাম, বহুদূরে একটা জেলে-নৌকা অতীন্দ্রিয়ভাবে সেই ঝলসানো মসৃণতার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। মারি কিছু ছোট নুড়ি কুড়োল। সমুদ্রে যাবার ঢালুপথ ধরে নামবার সময় দেখলাম সৈকতে ইতোমধ্যে বেশকিছু মানার্থী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।
সৈকতের প্রায় শেষ মাথায় রেমন্ডের বন্ধুর নিজের কাঠের বাড়ি। টিলার কোলে বাংলোটি, সামনের দিকটা স্থাপিত কাঠের স্তম্ভের ওপর, সমুদ্রের জল স্পর্শ করছিল তখন যেখানে। রেমন্ড তার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আমাদের। নাম তার ম্যাসন। কাধ তার প্রশস্ত, দেখতে সে লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। বউ তার মোটাসোটা ছোটখাটো এক হাসিখুশি মহিলা, কথা বলেন প্যারিসীয় ঢঙে।
ম্যাসন তক্ষুনি তার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে নিতে বলল। বলল সে, সকালে উঠেই প্রথম সে গিয়েছিল মাছ ধরতে। আমাদের দুপুরের খাবারে মাছভাজা থাকবে। আমি তার ছোট বাংলোটার জন্যে তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং বলল সে, তার সপ্তাহান্ত এবং ছুটিছাটা এখানে কাটায়। ‘অবশ্যই বউয়ের সঙ্গে’ যোগ করল সে। আমি তার বউয়ের দিকে তাকালাম, দেখলাম মারি এবং তার মধ্যে বেশ খাতির হয়ে গেছে; কথা বলছে তারা, হাসছে। এই প্রথম। বোধহয় সিরিয়াসলি আমি চিন্তা করলাম তাকে বিয়ে করার।
ম্যাসন তখুনি সাঁতার কাটতে যেতে চাইছিল কিন্তু তার বউ বা রেমন্ডের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সুতরাং আমরা তিনজন মারি, আমি এবং সে সৈকতের দিকে এগোলাম। মারি সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে কিন্তু আমি আর ম্যাসন অপেক্ষা করলাম খানিকক্ষণ। কথা বলে সে ধীরে ধীরে এবং কথার ফাঁকে ফাঁকে এবং তা ছাড়া কথাটা বলবেই সংগতি থাকুক বা না থাকুক। মারি সম্পর্কে সে বলল, সে খুব সুন্দর মেয়ে এবং তা ছাড়া মিষ্টিও।
এরপর আমি আর তার এ-ধরনের কথাবার্তার প্রতি নজর দিলাম না; নিজেকে ছেড়ে দিলাম রোদের কাছে এবং তাতেও বেশ ভালো লাগতে লাগল। পায়ের নিচে তপ্ত হয়ে উঠছিল বালি, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য হয়ে উঠেছিলাম উগ্রীব, কিন্তু তবুও আরও মিনিট দুএক অপেক্ষা করলাম। শেষে ম্যাসনকে জিজ্ঞেস করলাম, এবার আমরা নামব কি?’ এবং ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। ম্যাসন হাঁটতে লাগল ধীরস্থিরে এবং যখন আর থই পেল না তখন ধীরে ধীরে সাঁতার কাটা শুরু করল, সুতরাং আমি তাকে ছাড়িয়ে চলে এলাম মারির কাছে। পানিটা ঠাণ্ডা এবং সেজন্য বেশ ভালো লাগছিল। আমি আর মারি সাঁতার কাটলাম। বেশ দূর পর্যন্ত পাশাপাশি এবং আমাদের একই রকম সাঁতার কাটার ভঙ্গি দেখে ভালো লাগছিল। মনমেজাজ দুজনেরই ছিল একই রকম এবং প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছিলাম।