আমি আমার বিছানায় বসেছিলাম পা তুলে আর সালামানো বসেছিল টেবিলের পাশে হাঁটুতে হাত রেখে। তার জীর্ণ ফেল্টহ্যাটটা ছিল তার কাছেই এবং ধুলোটে ও হলদেটে গোঁফের আড়ালে সে বিড়বিড় করছিল। আমার কাছে বিরক্তিকর লাগছিল তার সান্নিধ্য, কিন্তু কিছুই করার ছিল না এবং ঘুমও আসছিল না। সুতরাং কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি তাকে তার কুকুর সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম–কতদিন কুকুরটা তার কাছে ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলল সে, তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরই কুকুরটা পেয়েছিল সে। বিয়ে করেছিল সে বেশ বয়সে। যুবক থাকাকালীন সে চেয়েছিল অভিনেতা হতে; সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার সময় প্রায়ই সে সৈন্যদের মঞ্চে অভিনয় করত এবং অভিনয় মোটামুটি ভালোই করত, অন্তত লোকে তা-ই বলত। শেষে সে চাকরি নিয়েছিল রেলওয়েতে এবং সেজন্যে তার মনে কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ এ-চাকরির জন্যেই সে এখন ছোটখাটো একটা পেনশন পাচ্ছে। স্ত্রীর সঙ্গে বনাবনি তার ছিল না, কিন্তু তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল একে অন্যের সঙ্গে থাকতে এবং স্ত্রী মারা গেলে সে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকে। তার রেলওয়ের এক বন্ধুর কুকুরের কয়েকটা বাচ্চা হওয়াতে সে তাকে একটি বাচ্চা দিতে। চেয়েছিল এবং সঙ্গী হিসেবে তখন সে তা গ্রহণ করেছিল। প্রথমে সে বাচ্চাটাকে বোতলে করে দুধ খাওয়াত। কিন্তু মানুষের চাইতে কুকুরের জীবন ছোট, তাই বলতে গেলে তারা বুড়ো হয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে।
‘কুকুরটা ছিল বদমেজাজি’, বলল সালামানো, ‘যখন-তখন আমাদের মধ্যে একচোট হয়ে যেত, কিন্তু তবুও বদমাশটা ছিল ভালো।’ বললাম, কুকুরটাকে দেখে বেশ ভালো জাতের মনে হত এবং একথা বুড়োকে বেশ সন্তুষ্ট করল।
‘আহ্, তার অসুখের আগে তাকে দেখা তোমার উচিত ছিল’, বলল সে, ‘যা চমৎকার পশম ছিল ওর এবং ঐটেই ছিল দেখার জিনিস। অনেক চেষ্টা করেছি তাকে ভালো করতে। চর্মরোগ হওয়ার পর প্রতিরাতে তার চামড়ায় আমি মলম লাগাতাম। কিন্তু আসল কথা হল বয়স এবং তার কোনো ওষুধ নেই।’
ঠিক সে-সময় আমি হাই তুললাম। এবং বুড়ো বলল, তার এবার ওঠা উচিত। তাকে বললাম, আরও খানিকটা সে বসতে পারে এবং তার কুকুরের ব্যাপারটার জন্যে আমি দুঃখিত। ধন্যবাদ জানিয়ে সালামানো জানাল, আমার মা কুকুরটাকে খুব পছন্দ করতেন। মাকে সে ‘তোমার বেচারি মা’ বলে উল্লেখ করল এবং বলল তাঁর মৃত্যু নিশ্চয় আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। আমি যখন বললাম, না, তখন সে খানিকটা দ্রুত এবং খানিকটা অপ্রতিভভাবে বলল, রাস্তায় কিছু লোক আমার সম্পর্কে বেশ আজেবাজে কথা বলছে যেহেতু মাকে আমি আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো জানে আসল ব্যাপারটা; মা’র আমি কী দারুণ ভক্ত ছিলাম।
উত্তর দিলাম–কেন, আমি এখনও জানি না লোকদের মনে যে আমার। সম্পর্কে এরকম বাজে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা আমাকে অবাক করছে। আমি যেহেতু তাঁকে এখানে রাখতে পারছিলাম না সেহেতু বাধ্য হয়েই তাঁকে আশ্রমে পাঠাতে হয়েছিল। সে যাহোক, বললাম, বহু বছর ধরে আমাকে বলার আর তার কোনো কথা ছিল না এবং আমি লক্ষ করছিলাম কথাবলার লোকের অভাবে তিনি। সদা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন।
‘হ্যাঁ’, বলল সে, ‘আশ্রমে যে-কেউ সহজেই বন্ধু যোগাড় করে ফ্যালে।
উঠে দাঁড়াল সে। বলল, অনেক রাত হয়েছে। এখন তার ঘুমানো দরকার। এবং এই নতুন ব্যবস্থা তার জীবনে খানিকটা জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এতদিনের পরিচয়ের মধ্যে এই প্রথম সে হাত বাড়িয়ে দিল–খানিকটা লাজুকভাবে–তাই মনে হল আমার এবং আমি তার চামড়ার কর্কশতা অনুভব করতে পারছিলাম। দরজার বাইরে পা রাখার সময় ঘুরে দাঁড়াল সে, একটু হেসে বলল : ‘আশা করি আজ রাতে কুকুরগুলি আর চাচাবে না। আমার সবসময় মনে হয় আমারটার ডাকই বোধহয় শুনছি—’
.
৬.
রোববার সকালে ওঠা যে কী কষ্টকর; মারিকে তো আমার খানিকক্ষণ নাম ধরে কাঁধ ঝাঁকাতে হল। ভোরে-ভোরেই আমরা পানিতে নামতে চাচ্ছিলাম, তাই নাশতার ঝামেলা আর করলাম না। মাথাটা আমার একটু কামড়াচ্ছিল এবং প্রথম সিগারেটের স্বাদ বিস্বাদ লাগল। মারি বলল, আমাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোককারীদের মতো লাগছে এবং আমার সত্যিই অবসাদ লাগছিল। মারির চুল খোলা এবং পরনে শাদা পোশাক। আমি বললাম, এ-পোশাকে তাকে দারুণ লাগছে এবং এতে সে খুশি হয়ে হাসল।
যাবার পথে ধাক্কা মারলাম রেমন্ডের জায়গায় এবং সে চিৎকার করে বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নামছে। রাস্তায় নেমে এলাম আমরা। আমার ঘরের পরদা ছিল টানা আর তা ছাড়া এ আবহাওয়ায় খানিকটা অস্বস্তিও লাগছিল, তাই সকালের সূর্য যেন মুষ্ট্যাঘাতের মতো বাড়ি মারল আমার চোখে।
মারি কিন্তু আনন্দে প্রায় নাচছিল এবং বারবার বলছিল, ‘কী চমৎকার দিন!’ কিছুক্ষণ পর ভালো লাগতে লাগল আমার এবং নিজেকে মনে হল ক্ষুধার্ত। মারিকে কথাটা জানালাম কিন্তু সে তা কানেই তুলল না। হাতে তার একটা অয়েলক্লথের ব্যাগ যার মাঝে আছে আমাদের স্নানের পোশাক আর একটা তোয়ালে। একসময় শুনলাম রেমন্ড তার ঘরের দরজা বন্ধ করল। পরনে তার নীল প্যান্ট, শাদা হাফশার্ট এবং মাথায় খড়ের টুপি। লক্ষ করলাম হাতটা তার বেশ লোমশ কিন্তু হাতের নিচের দিকটা ফরসা। খড়ের টুপি দেখে মুচকি হাসল মারি। তার পোশাকআশাক দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, বেশ স্ফুর্তিতেই আছে সে এবং শিস দিতে দিতে সে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। আমাকে ‘কী খবর ইয়ার’ আর মারিকে ‘মাদমায়োজেল’ বলে সম্বোধন করল সে।