তখন সে বলল, বিয়েটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার।
উত্তরে আমি বললাম : ‘না’।
তারপর সে নিঃশব্দে বিচিত্র দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। এবং খানিক পর জিজ্ঞেস করল :
‘আরেকটি মেয়ে এসে যদি তোমাকে বিয়ে করতে বলে তাকে, মানে, এমন একটি মেয়ে যাকে তুমি আমার মতোই পছন্দ করো তা হলে কি তুমি “হাঁ” বলবে?’
‘স্বাভাবিকভাবেই।‘
তখন সে বলল, ভেবে সে অবাক হচ্ছে সত্যিই কি সে আমাকে ভালোবাসে, না বাসে না। আমার পক্ষে এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে ‘আমি যে এক অদ্ভুত লোক’ সে-সম্পর্কে সে কিছু বলল। বলতে বাধ্য হচ্ছি যে সেজন্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি’, বলল সে, কিন্তু একদিন এজন্যেই বোধহয় তোমাকে ঘৃণা করা শুরু করব।’
এর উত্তরে আমার আর কিছুই বলার ছিল না, সুতরাং আমি কিছুই বললাম না।
কিছুক্ষণ চিন্তা করল মারি। তারপর হাসতে শুরু করল এবং আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, সে অত্যন্ত আন্তরিক; সত্যিই সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
‘ঠিক আছে’, বললাম আমি, ‘তুমি যে-সময় বলবে সে-সময়ই আমাদের বিয়ে হবে।’ তারপর আমার কর্তা আমাকে যে-প্রস্তাব জানিয়েছেন মারিকে তা বললাম। এবং মারি জানাল, প্যারিস যেতে পারলে সে খুবই খুশি হবে।
আমি যখন তাকে জানালাম, প্যারিসে আমি কিছুদিন ছিলাম তখন সে জিজ্ঞেস করল, শহরটা দেখতে কেমন। শহরটা ঘিঞ্জি বলেই তো আমার মনে হয়। বিষণ্ণ প্রাঙ্গণ এবং অসংখ্য কবুতর। লোকগুলোর মুখ ফ্যাকাশে যেন সবাই ব্যর্থ হয়েছে সব কাজে।
তারপর শহরের মাঝ দিয়ে যে সদর রাস্তা চলে গেছে সে-রাস্তা ধরে আমরা বেড়াতে বের হলাম। মহিলারা বেশ সেয়ানা এবং মারিকে জিজ্ঞেস করলাম এটা সে লক্ষ করেছে কি না। হ্যাঁ, বলল সে, আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা সে বুঝেছে। এরপর কয়েক মিনিট আমরা কোনো কথা বললাম না। যাহোক, আমি চাচ্ছিলাম না মারি আমাকে এখন ছেড়ে যাক। তাই প্রস্তাব করলাম, সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে। আমার সঙ্গে খেতে পারলে খুবই খুশি হত সে, জানাল মারি, কিন্তু আগে থেকেই বিকেলে তার প্রোগ্রাম করা আছে। আমরা প্রায় আমার বাসার কাছাকাছি এলে আমি বললাম; তা হলে বিদায়!
আমার চোখে চোখ রাখল সে।
তুমি কি জানতে চাও না আজ বিকেলে আমি কী করছি?
জানতে চাচ্ছিলাম না আমি এবং সেটা তাকে জিজ্ঞেস করতেও আমার মনে ছিল না, কিন্তু মনে হল এজন্যে বুঝি মারি অভিযোগ জানাচ্ছে। নিশ্চয় আমাকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল কারণ হঠাৎ সে হাসতে শুরু করল এবং আমার দিকে নুয়ে চুমোর জন্যে ঠোঁট বাড়িয়ে দিল।
সেলেস্তের ওখানে আমি একাই গেলাম। তখন মাত্র আমি খাবারে হাত দিয়েছি। এমন সময় কুৎসিত ছোটখাটো এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি আমার টেবিলে বসতে পারেন কি না। নিশ্চয় পারেন। মুখ তার গোলগাল, পাকা আপেলের মতো। উজ্জ্বল চোখ, এবং চলাফেরা করছিলেন তিনি অদ্ভুত এক লাফানোর ভঙ্গিতে, যেন দাঁড়িয়ে আছেন তারের ওপর। নিজের আঁটসাট জ্যাকেটটা খুলে তিনি বসে মনোযোগের সঙ্গে খাবারের দাম দেখছিলেন। তারপর সেলেস্তেকে ডেকে অর্ডার দিলেন বেশ দ্রুতভাবে, কিন্তু পরিষ্কার করে; প্রত্যেকটি শব্দ বোঝা যায় মতো। হর্স দ্য অভরের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তিনি তার ব্যাগ খুলে একটা পেনসিল আর একটুকরো কাগজ বের করে খাবারের দাম হিসেব করলেন। তারপর আবার ব্যাগ হাতড়িয়ে ছোট একটি পার্স বের করে নির্দিষ্ট দামের সঙ্গে অল্পকিছু বখশিশ যোগ করে রাখলেন নিজের সামনে কাপড়ে।
ঠিক তখুনি ওয়েটার ‘হর্স দ্য অভর’ এনে হাজির করলে মহিলা প্রায় নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে তা খেতে শুরু করলেন। তারপর দ্বিতীয় পদের জন্যে অপেক্ষা করার সময় আরেকটা পেনসিল, এবারেরটা নীল রঙের এবং সামনের সপ্তাহের একটা রেডিও ম্যাগাজিন বের করে প্রতিদিনের প্রায় প্রতিটি প্রোগ্রামের পাশে দাগ দিতে লাগলেন। ম্যাগাজিনে প্রায় ডজনখানেক পৃষ্ঠা ছিল এবং খাবারের পুরোটা সময় তিনি তা দেখলেন অতীব মনোযোগের সঙ্গে। আমি যখন আমার খাবার শেষ করলাম তখনও তিনি সেই অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে দাগ দিয়ে চলেছেন। তারপর উঠলেন, ঠিক আগের মতোই রোবটের ভঙ্গিমায় জ্যাকেট গলিয়ে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
কিছুই করার ছিল না বলে আমি তাকে খানিকটা পথ অনুসরণ করলাম। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে সোজা তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন, পিছন না-ফিরে, কোনো দিকে না-তাকিয়ে এবং ছোটখাটো আকার সত্ত্বেও যেরকম দ্রুতভাবে তিনি হাঁটছলেন তা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। আসলে তার গতির সঙ্গে আমি তাল রাখতে পারছিলাম না এবং শীঘ্রই আমি তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। তাই ফিরে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণের জন্যে এই ‘ছোট রোবট’ (তাঁকে দেখে আমার তা-ই মনে হয়েছিল) আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু শীঘ্রই আমি তার কথা ভুলে গেলাম।
যখন আমি আমার ঘরের দিকে এগোচ্ছি তখন দেখা হল সালামানোর সঙ্গে। আমি তাকে ঘরে আসতে বললাম এবং সে জানাল তার কুকুরটা নিশ্চয় হারিয়ে গেছে। সে গিয়েছিল খোয়াড়ে খোঁজ নিতে কিন্তু ওখানে কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এবং কর্মচারীরা জানিয়েছে, কুকুরটা বোধহয় মারা পড়েছে রাস্তায়। যখন সে জিজ্ঞেস করল, থানাতে খোঁজ নিলে কোনো লাভ হবে কি না তখন তারা জানাল, রাস্তার কুকুর মারা পড়ল কি পড়ল না তার খোঁজ রাখার চেয়েও জরুরি কাজ তাদের করতে হয়। আমি প্রস্তাব করলাম আরেকটি নতুন কুকুর আনতে। কিন্তু যুক্তিসহ সালামানো বোঝাল এটার সঙ্গে থাকতে থাকতে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল; আর নতুন একটা আনলেও ঠিক আগের মতো হবে না।