রেমন্ড হেসে ঢুকে পড়ল হলে। দোতলা পর্যন্ত আমি অনুসরণ করলাম তাকে এবং ল্যান্ডিঙের কাছে এসে আলাদা হলাম দুজনে। মিনিট দুএক পর সিঁড়িতে শোনা গেল সালামানোর পদশব্দ। তারপর আমার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
আমি যখন দরজা খুলোম তখন সে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।
‘মাপ করো… আমি বোধহয় তোমাকে বিরক্ত করছি না।’
ভিতরে আসতে বললাম তাকে, কিন্তু সে মাথা নাড়ল। সে তাকিয়ে ছিল তার পায়ের দিকে এবং শিরাবহুল হাতটা তার কাঁপছিল। আমার চোখ এড়িয়ে সে বলতে লাগল :
‘তারা নিশ্চয় আমার কাছ থেকে তাকে নিয়ে যাবে না, তাই না সঁসিয়ে মারসো? নিশ্চয় তারা ও-ধরনের কোনো কাজ করবে না। যদি তারা তা করে তবে আমার যে কী হবে তা আমি ভাবতেও পারছি না।’
তাকে বললাম, যদুর জানি, হারানো কুকুর তারা তিনদিন খোয়াড়ে রাখে তাদের মনিবদের জন্য। তারপর তাদের ইচ্ছেমতো কুকুরগুলির ব্যবস্থা করে।
একমুহূর্ত নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘শুভরাত্রি’। তারপর বেশ কিছুক্ষণ তার ঘরে পায়চারির আওয়াজ পেলাম। এরপর তার বিছানার শব্দ। দেয়ালের ওপাশ থেকে শোনা গেল ফোঁপানির আওয়াজ। অনুমান করলাম, সে কাঁদছে। কী কারণে জানি না, হঠাৎ আমি আমার মার কথা ভাবতে লাগলাম, কিন্তু আগামীকাল আমাকে উঠতে হবে খুব ভোরে, এবং খিদে যেহেতু ছিল না, সেহেত খাবার না-খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
.
৫.
অফিসে টেলিফোন করল রেমন্ড। তার এক বন্ধুর কাছে আমার কথা বলেছিল সে, জানাল রেমন্ড, এবং সেই বন্ধু আলজিয়ার্সের বাইরে সমুদ্রতীরে তার ছোট বাংলোয় আমাকে আগামী রোববারটা কাটাতে নিমন্ত্রণ করেছে। জানালাম আমি, যেতে পারলে খুবই খুশি হতাম, কিন্তু একটি মেয়েকে কথা দিয়েছি রোববারটা তার সঙ্গে কাটাব বলে। সঙ্গে সঙ্গে রেমন্ড জানাল, তাকে নিয়ে এলেও ক্ষতি নেই। আসলে মেয়েটিকে নিয়ে এলে তার বন্ধুর বউ খুবই খুশি হবে, পুরুষদের পার্টিতে একা মেয়ে না-হওয়ার জন্যে।
তখুনি আমি ফোনটা রেখে দিতে চাচ্ছিলাম। কারণ, আমার কর্তা ব্যক্তিগত আলাপের জন্যে অফিসের ফোন ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। কিন্তু রেমন্ড আমায় ধরে রাখতে বলল; আমাকে আরও কিছু তার বলার আছে এবং সেজন্যেই আসলে টেলিফোন করা, নয়তো নিমন্ত্রণটা পৌঁছে দেয়ার জন্যে বিকেল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারত। ব্যাপারটা হল, বলল সে, সকাল থেকে কয়েকটা আরব আমাকে অনুসরণ করছে। তার মধ্যে সে-মেয়েটির ভাইও আছে যার সঙ্গে আমার। একচোট হয়ে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে যদি তাকে তুমি বাসার সামনে ঘোরাফেরা করতে দ্যাখো, তা হলে আমাকে জানিয়ো।’
বললাম, ঠিক আছে।
আর ঠিক ঐ সময়ই কর্তা আমাকে ডেকে পাঠালেন। অল্পক্ষণের জন্যে অস্বস্তি লাগল, কারণ মনে হল, তিনি আমায় ডেকে বলবেন বন্ধুর সঙ্গে গালগল্প করে অযথা সময় নষ্ট না করে নিজের কাজ করতে। যাহোক, সেরকম কিছুই হল না। একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তিনি আমায় ডেকেছিলেন, কারণ তিনি নিজে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলেন না। পরিকল্পনাটা হল, ডাকের ঝামেলা এড়িয়ে, বড় বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাৎক্ষণিক লেনদেনের জন্যে প্যারিসে একটা শাখা খোলা হবে এবং তিনি জানতে চান, আমি সেখানে কাজ করব কি না।
‘তোমার বয়স কম’, বললেন তিনি, ‘এবং আমি নিশ্চিত যে প্যারিসে তুমি চমৎকারভাবে দিন কাটাতে পারবে। তা ছাড়া বছরের কয়েক মাস তো ফ্রান্সের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারছই।’
বললাম, যেতে আমার বিশেষ কোনো আপত্তি নেই, তবে সত্যি বলতে কি আমাকে পাঠানো হোক বা না-হোক তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।
তারপর তিনি, জীবন বদলানো, কথাটাকে ওভাবেই বললেন তিনি, কি আমার কাছে কোনো আবেদন সৃষ্টি করে না। উত্তরে বললাম, কেউ কারো সত্যিকার জীবন বদলাতে পারে না; যাহোক, এক জীবন আরেক জীবনের মতোই ভালো এবং আমার বর্তমান চমৎকারভাবে খাপ খাচ্ছে আমার সঙ্গে।
এতে মনে হল, তিনি ক্ষুব্ধ হলেন এবং বললেন, আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না এবং কোনো উচ্চাশাও নেই আমার, যা তার মতে অতি মারাত্মক দোষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে।
নিজের কাজে ফিরে এলাম। তাকে অসন্তুষ্ট করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই, কিন্তু জীবন-বদলাবার’ কোনো কারণও খুঁজে পেলাম না। আমার বর্তমান জীবন মোটেই অসুখী নয়। তিনি যে-ধরনের উচ্চাশার কথা বলেছিলেন, ছাত্র থাকাকালীন সে-ধরনের প্রচুর উচ্চাশা আমার ছিল। কিন্তু পড়াশোনায় যখন ইস্তফা দিতে হল তখন শীঘ্রই বুঝলাম এ সবকিছুই নিরর্থক।
মারি সেদিন বিকেলে এসে আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে বিয়ে করব কি না। জানালাম, আমার কোনো আপত্তি নেই; বিয়েতে সে যদি এতই ইচ্ছুক হয় তা হলে আমরা বিয়ে করব।
তখন সে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। প্রায় আগের মতোই আমি উত্তর দিলাম, তার প্রশ্নের সত্যিই কোনো মানে হয় না– তবে আমার মনে হয় তাকে আমি ভালোবাসি না।
‘তুমি যদি তাই মনে করো’, বলল সে, ‘তবে আমায় বিয়ে করছ কেন?’
বললাম, এর কোনো গুরুত্ব নেই। তবে বিয়েটা যদি তাকে আনন্দ দেয় তা হলে এক্ষুনি আমরা বিয়ে করতে পারি। তাকে জানালাম, প্রস্তাবটা তার কাছ থেকেই এসেছে; আমার কথা ধরলে আমি শুধু বলব ‘হ্যাঁ।‘