যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন রেমন্ড বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আমার করমর্দন করে বলল যে, মানুষ সবসময় একে অন্যকে বুঝতে পারে। দরজা ভেজিয়ে ল্যান্ডিঙে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সমস্ত বাড়িটা কবরের মতো নিঃশব্দ। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ। আমি আমার কানে রক্তের দপদপানি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তা ই শুনলাম। তারপর বুড়ো সালামানোর ঘরে তার কুকুরটা ফোঁপাতে লাগল। এবং এই ঘুমন্ত বাড়ির মাঝে শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল, অন্ধকার আর নৈঃশব্দে একটি ফুল ফুটে ওঠার মতো।
.
৪.
পুরো সপ্তাহটা বেশ ব্যস্তভাবে কাটল অফিসে। রেমন্ড একবার এসে বলে গেল যে, চিঠিটা সে ডাকে দিয়েছে। ইমানুয়েলের সঙ্গে দুবার গিয়েছিলাম সিনেমায়। পরদায় কী ঘটছে তা সে প্রায়ই বুঝতে পারে না এবং অনবরত তাকে তা বুঝিয়ে বলার অনুরোধ করে। গতকাল ছিল শনিবার এবং কথামতো মারি এল। পরনে তার চমকার লাল-শাদা ডোরাকাটা পোশাক, পায়ে স্যান্ডেল, এত সুন্দর লাগছিল যে, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল তার ছোট দৃঢ় স্তনরেখা আর তার রোদে-পোড়া মুখটাকে লাগছিল বেগুনি বাদামি রঙের ফুলের মতো। বাসে করে, আলজিয়ার্স থেকে কয়েক মাইল দূরে এক পরিচিত সৈকতে গেলাম আমরা। দুপাশে ছোট টিলার মাঝে বালির একটা টুকরো যেন, জলের ধার-ঘেঁষে পেছনে নল-খাগড়ার ঝোঁপ। গরম লাগছিল না তেমন আর পানিটাও ছিল কুসুম কুসুম। ছোট ছোট ঢেউগুলি অলসভাবে হামাগুড়ি খাচ্ছিল বালির ওপর।
মারি আমাকে নতুন এক খেলা শেখাল। খেলাটা হল, সাঁতার কাটার সময়, ঢেউ থেকে ফেনাটা মুখে নেয়া এবং মুখভরতি ফেনা নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুলকুচা করা। পানিটা শূন্যে কেমন একটা আবছায়া ভাব সৃষ্টি করত, নয়তো উষ্ণ প্রস্রবণের স্রোতের মতো মুখে এসে পড়ত। কিন্তু শীঘ্রই নুনের জন্যে আমার মুখ জ্বালা করতে লাগল; তারপর মারি এসে জলের ভিতর আলিঙ্গন করে আমায় চুমো খেল। তার জিভ শীতল করে তুলল আমার ঠোঁট এবং সাঁতরে তীরে ফেরার আগে মিনিট দুএক ঢেউগুলিকে খেলা করতে দিলাম আমাদের নিয়ে।
কাপড় পরা হলে পরিপূর্ণ চোখে মারি তাকাল আমার দিকে। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ। চুমো খেলাম তাকে; তারপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কথা বললাম না। মারির কোমর জড়িয়ে এগোতে লাগলাম। দুজনই ব্যস্ত ছিলাম বাস পরার জন্যে। এবং বাসায় ফিরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। আমি আমার জানালা খুলে রেখেছিলাম, এবং খুব আরাম লাগছিল যখন অনুভব করলাম আমাদের সূর্যস্নাত শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া।
মারি জানাল, আগামীকাল সকালে তার কোনো কাজ নেই, সুতরাং দুপুরের খাবারটা আমার সঙ্গেই সারার প্রস্তাব করলাম। রাজি হল সে, এবং আমি নিচে নেমে গেলাম কিছু মাংস কিনতে। ফেরার সময় রেমন্ডের ঘরে এক মেয়ের গলা শুনলাম। কিছুক্ষণ পর বুড়ো সালামানো শুরু করল তার কুকুরের ওপর হম্বিতম্বি এবং খানিক পরই কাঠের সিঁড়িতে বুট এবং থাবার শব্দ, তারপর ‘নোংরা জানোয়ার! চল ব্যাটা খেকি কুত্তা। তারা দুজনই বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। মারিকে বুড়োর এই অভ্যাসের কথা জানালাম এবং তা শুনে সে হাসল। পরনে তার আমার একটা পাজামা সুট এবং জামার হাতা গোটানো। সে যখন হাসল তখন আমি তাকে আবার চাইলাম। খানিক পর সে আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। বললাম, এরকম প্রশ্নের সত্যিই কোনো মানে হয় না; তবে আমার মনে হয় না তাকে আমি ভালোবাসি। একথা শুনে সে কিছুক্ষণের জন্যে মুখভার করে রইল। কিন্তু যখন আমরা দুপুরের খাবার ঠিক করছিলাম তখন সে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং হাসতে শুরু করল। সে যখন হাসে তখন তাকে আমার চুমো খেতে ইচ্ছে করে। আর ঠিক তখন রেমন্ডের ঘরে শুরু হল চাচামেচি।
প্রথমে শুনলাম গলা চড়িয়ে উত্তপ্তস্বরে একটি মেয়ে যেন কী বলল; তারপর রেমন্ডের তর্জনগর্জন, তুই আমাকে অপমান করেছিস্ কুত্তি। এর শোধ কীভাবে নিতে হয় তা তোকে শেখাচ্ছি। ধুপধাপ কিছু আওয়াজ শোনা গেল, তারপর এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ-এ-ধরনের চিৎকার মানুষের রক্ত হিম করে দেয়–কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যান্ডিঙে ভিড় জমে গেল। মারি এবং আমি বের হলাম দেখতে। মেয়েটা তখনও চাঁচাচ্ছিল এবং রেমন্ড তখনও তাকে পেটাচ্ছিল। মারি বলল, ব্যাপারটা কি বীভৎস নয়? উত্তরে কিছুই বললাম না। তারপর সে আমায় বললে পুলিশ ডেকে আনতে, কিন্তু আমি জানালাম, পুলিশ আমি মোটেই পছন্দ করি না। যাহোক, একজন এল অবশেষে, তার সঙ্গে দোতলার বাসিন্দা এক মিস্ত্রি। দরোজায় টোকা পড়তেই ভেতরের হৈচৈ থেমে গেল। আবার সে টোকা দিল, কয়েক মুহূর্ত পর মেয়েটা ফের কান্না শুরু করল এবং রেমন্ড খুলে দিল দরজা। ঠোঁটে তার আলগোছে ধরা একটা সিগারেট, মুখে পাঞ্জু হাসি। তোমার নাম?’ নিজের নাম বলল রেমন্ড। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মুখের সিগারেট নামাও।’ বিরক্তির সঙ্গে বলল পুলিশটা। ইতস্তত করল রেমন্ড, তাকাল আমার দিকে এবং সিগারেট মুখেই রাখল। পুলিশটা নিপুণভাবে তার বা চোয়ালে ঘুসি চালাল। সিগারেটটা তার ঠোঁট থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল কয়েক গজ দূরে। বিনীতভাবে তারপর সে জিজ্ঞেস করল, সিগারেটটা কি সে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে পারে? অফিসারটি বলল, ‘নাও’, এবং যোগ করল, ‘খেয়াল রেখো, এরপর এধরনের কোনোকিছু সহ্য করতে আর আমরা রাজি নই, বিশেষ করে তোমার মতো ব্যাটাচ্ছলে থেকে।‘