রক্ত বের না-হওয়া পর্যন্ত পিটিয়েছিল সে মেয়েটিকে। এর আগে কখনও সে তাকে মারেনি। ‘মানে খুব জোরে নয় আর-কি, অনেকটা আদরের মারের মতো। কিছুক্ষণ চাঁচাত এবং আমাকে জানালাগুলি বন্ধ করে দিতে হত। তারপর সচারাচর যা হয় তেমনি ব্যাপারটার ইতি হত। কিন্তু এবার যা-ই বলো, তার থেকে আমার মন উঠে গেছে। খালি মনে হচ্ছে তাকে ভালো করে শাস্তি দেয়া হল না। আমি কী বলছি, বুঝছ তো?’
সে জানাল, এ-ঘটনাটার জন্যেই আমার পরামর্শ চাচ্ছে। ধোঁয়া বেরুচ্ছিল বাতি থেকে। বাতির সলতেটা কমিয়ে দেয়ার জন্যে সে পায়চারি করতে করতে থামল। আমি কিছু না বলে খালি শুনলাম। পুরো এক বোতল মদ খেয়েছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। কারণ, আমার ব্রান্ডের সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ায় রেমন্ডেরটা খাচ্ছিলাম। রাতের শেষ ট্রাম চলে গেল, এবং এর সঙ্গে রাস্তার কলরবও থেমে গেল। রেমন্ড কথা বলে চলছিল। যে-জিনিসটা তাকে খোঁচাচ্ছিল তা হল মেয়েটার ওপর তার খানিকটা ঝোঁক ছিল। কিন্তু মেয়েটিকে যে একচোট শিক্ষা দিতে হবে সে-ব্যাপারে সে দৃঢ়।
তার প্রথম পরিকল্পনা হল, বলল সে, মেয়েটিকে একটি হোটেলে নিয়ে তোলা এবং স্পেশাল পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশদের সে তাল দেবে যাতে মেয়েটার। নাম খাতায় সাধারণ পতিতা হিসেবে তোলা হয়। মেয়েটা তা হলে নিশ্চয় খেপে যাবে। তারপর, অন্ধকার জগতের বাসিন্দা তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে সে। পরামর্শ চেয়েছিল যারা মেয়ে রাখে তাদের থেকে যা পারে নিংড়ে নেয়ার জন্যে। কিন্তু, তারাও এমন কোনো পরামর্শ দিতে পারেনি। তবুও সে দেখল, তারা যা বলছে তা তাদের লাইনে হয়তো ঠিক; কিন্তু যখন তুমি জানো না, তোমার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকে কী করবে তখন ঐ লাইনে গিয়ে লাভ কী? এটা যখন সে তাদের জানাল তখন তারা পরামর্শ দিল তার শরীরে ‘দাগ’ দিয়ে দিতে। কিন্তু এটাও সে চাচ্ছে না। এর জন্যে অনেক চিন্তাভাবনা দরকার…কিন্তু, প্রথমে, সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। তবে তা জিজ্ঞেস করার আগে যে কাহিনীটা সে শোনাল সে-সম্পর্কে সাধারণভাবে সে আমার মতামত জানতে চায়।
বললাম, আমার কোনো মতামত নেই তবে গল্পটা বেশ মজাদার।
তোমার কি মনে হয় মেয়েটা সত্যিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
আমাকে স্বীকার করতে হল যে ব্যাপারটা অনেকটা ঐরকমই বইকি। তখন সে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার শাস্তি হোক এ যদি আমি না চাই তবে তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম। বললাম, এ-অবস্থায় পড়লে কী করা উচিত সে-সম্পর্কে কেউই কিছু বলতে পারে না। তবে আমি এটা বুঝেছি যে সে চায় মেয়েটা কষ্ট পাক।
আমি আরও কিছু মদ খেলাম আর রেমন্ড আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে সে কী করতে চায় তার ব্যাখ্যা শুরু করল। সে তাকে একটা চিঠি লিখতে চায়, সত্যিকারের জঘন্য ভাষায় যা তাকে অকূল পাথারে ফেলবে আর সঙ্গে সঙ্গে এটা পড়ে সে আগের ঘটনার জন্যে অনুশোচনা করবে। তারপর মেয়েটি যখন ফিরে আসবে তখন সে তার সঙ্গে বিছানায় যাবে এবং মেয়েটি একটু তেতে উঠলেই সে তার মুখে থুতু দিয়ে ঘরের বার করে দেবে। আমি তার সঙ্গে একমত হয়ে বললাম, প্ল্যানটা মন্দ নয়; এই তার উপযুক্ত শাস্তি।
কিন্তু রেমন্ড বলল, যেরকমভাবে চিঠিটা লেখা উচিত সেরকমভাবে তা সে লিখতে পারছে না এবং এখানেই আমি তাকে সাহায্য করতে পারি। যখন আমি চুপ করে রইলাম তখন সে বলল, এটা করতে কি আমি কিছু মনে করব। বললাম, ‘না’। চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।
এক পাত্তর মদ খেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্লেট এবং কিছু ঠাণ্ডা পুডিং যা পড়ে ছিল সরিয়ে টেবিলে জায়গা করে দিল। এরপর যত্ন করে অয়েলক্লথটা মুছে বেডসাইড টেবিল থেকে একটুকরো কাগজ আনল। তারপর আনল একটি খাম, ছোট লাল কলমদানি এবং চৌকো এক দোয়াতদানি যাতে কালো কালি ভরা। যে মুহূর্তে সে মেয়েটার নাম বলল সে-মুহূর্তে বুঝে ফেললাম যে মেয়েটি একজন মুর।
লিখলাম চিঠিটা। খুব বেশি ঝামেলা হল না। কিন্তু রেমন্ডকে আমি খুশি করতে চাইছিলাম যেহেতু ওকে অখুশি করার কোনো কারণ নেই। তারপর আমি কী লিখছি তা পড়লাম। সিগারেট টানতে টানতে এবং মাথা নাড়তে নাড়তে শুনল সে। ‘দয়া করে আবার পড়ো’, বলল সে। মনে হল সে খুশি হয়েছে। ‘আহ্ এই তো চাই।’ জিভ দিয়ে শব্দ করল সে। আরে ইয়ার তোমার তো দারুণ বুদ্ধি, কত ধানে কত চাল তা দেখি তুমি জানো।
‘ইয়ার’ শব্দটি প্রথমে খেয়াল করেনি। সেটা খেয়াল করলাম তখন, যখন সে আমার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘এখন থেকে আমরা বন্ধু, কী বলো?’ চুপ করে রইলাম। কথাটা আবার বলল সে। অবশ্য এতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন সে কথাটার উপর জোর দিল তখন মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ’।
চিঠিটা সে খামে পুরল এবং আমরা মদ শেষ করলাম। তারপর নিঃশব্দে আমরা কয়েক মিনিট সিগ্রেট টানলাম। রাস্তা বেশ শান্ত, খালি কখনও কখনও দুএকটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ। অবশেষে বললাম, রাত হয়ে যাচ্ছে। রেমন্ডও তা স্বীকার করল। ‘আজকের বিকেলটা বেশ দ্রুত কেটে গেল’, যোগ করল সে, এবং একদিক থেকে কথাটা সত্যি। আমি বিছানায় যেতে চাইছিলাম যদিও মনে হচ্ছিল ওঠার কোনো শক্তি নেই। আমাকে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, কারণ রেমন্ড বলল, ‘একজনকে অযথা বিরক্ত করা উচিত নয়।‘ প্রথমে কথাটার মানে বুঝলাম না। তখন সে জানাল আমার মায়ের মৃত্যুর খবর সে শুনেছে; যাক, বলল সে, এটা একসময়-না-একসময় ঘটতই। কথাটা আমার পছন্দ হল এবং তাকে তা জানালাম।