দুজনে সিঁড়ি বেয়ে একসঙ্গে উপরে উঠলাম। সেনতেস এবং আমি। তারপর আমি যখন ঘরের দিকে মোড় নিচ্ছি তখন সে বলল, আমার সঙ্গে খাবে খানিকটা? ঘরে একটা কালো পুডিং আর মদ আছে কিছু।
আমার তখন খেয়াল হল, এর ফলে আমাকে আর রাতের খাবার তৈরি করতে হবে না, সুতরাং বললাম, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ।’
তারও ঘর একটা। সঙ্গে রান্নাঘর। জানালা নেই। দেখলাম, তার খাটের মাথায় গোলাপি আর শাদা প্লাস্টারের একটা পরী আর ওপাশের দেয়ালে কিছু চ্যাম্পিয়ান অ্যাথলেট ও নগ্ন মেয়ের ছবি সঁটা। বিছানাটা এলোমেলো, ঘরটা অপরিচ্ছন্ন। প্যারাফিনের একটা বাতি জ্বালাল সে; তারপর পকেট হাতড়িয়ে একটা ময়লা ব্যান্ডেজ বের করে ডানহাতে জড়াল। ‘ব্যাপারটা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে জানাল, এক ছোকরা তাকে খানিকটা বিরক্ত করায় তার সঙ্গে একচোট হয়ে গেছে।
‘গণ্ডগোল করার মতো লোক আমি নই’, বোঝাল সে, ‘শুধু খানিকটা রগচটা।‘ ছোকরা আমায় বলল, চ্যালেঞ্জ করল এভাবে, ‘যদি ব্যাটাছেলে হয়ে থাকো তবে। ট্রাম থেকে নেমে এসো।‘ বললাম, “চুপ থাকো। আমি তোমার কিছু করিনি।” তখন সে বলল, আমার সাহস নেই। ব্যস, তারপর মীমাংসা হয়ে গেল সবকিছুর। ট্রাম থেকে নেমে তাকে বললাম “ভালো চাও তো মুখ বন্ধ করো নয়তো তোমার ভালোর জন্য মুখ বন্ধ করে দেব।” “চেষ্টা করেই দ্যাখো-না!” বলল সে। তারপর মুখে এক জবর ঘুসি মেরে ভালো করে শুইয়ে দিলাম তাকে। খানিকপর তাকে ওঠাতে গেলাম। এর বদলে শুয়ে থেকেই সে আমায় লাথি মারল। সুতরাং একবার হাঁটু দিয়ে এবং তারপর হাত দিয়ে তাকে আরও খানিকটা ধোলাই দিলাম। যখন ধোলাই শেষ করলাম তখন শুয়োরের মতো তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “হয়েছে?” সে বলল, “হ্যা”।
সেনতেস কথা বলছিল আর ব্যস্তভাবে হাতে ব্যান্ডেজ জড়াচ্ছিল। আমি বসেছিলাম ওর বিছানায়।
‘সুতরাং তুমিই দ্যাখো, বলল সে, দোষটা আমার নয়। সে-ই চাচ্ছিল ব্যাপারটা, ঠিক না?’ আমি মাথা নাড়লাম এবং সে যোগ করল, ‘আসল কথা তোমার কাছে একটা পরামর্শ চাচ্ছি, এ-ব্যাপারটার জন্যেই। তুমি তো সংসারের কিছু জানো, সুতরাং তুমিই পারো আমায় সাহায্য করতে। তা হলে সারাজীবন আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকব। কেউ যদি আমার উপকার করে তার কথা আমি ভুলি না।’
আমি যখন কোনো উত্তর দিলাম না তখন সে জিজ্ঞেস করল বন্ধু হিসেবে নিতে তাকে কোনো আপত্তি আছে কি না। উত্তরে যখন জানালাম আপত্তি নেই তখন মনে হল সে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে। কালো পুডিংটা বের করে সে ফ্রাইং প্যানে গরম করল, তারপর দু-বোতল মদ বের করে টেবিল সাজাল। এসব করার সময় সে। চুপ করে ছিল।
খেতে বসলাম আমরা। তারপর খানিক ইতস্তত করে সে পুরো ঘটনাটা আমাকে বলল। ‘সচরাচর যা হয়ে থাকে, তেমনি এ-ঘটনার সঙ্গে একটি মেয়ে জড়িত। প্রায়ই আমরা একসঙ্গে ঘুমোতাম। বলতে গেলে আমি তাকে রেখেছিলাম কারণ সে মোটামুটি মানানসই টাকা চাইত। যে-ছোকরাটিকে ধোলাই করেছি সে ওর ভাই।‘
লক্ষ করল সে আমি চুপ করে আছি। তখন বলল, প্রতিবেশীরা তার সম্পর্কে কী বলে তা সে জানে। কিন্তু কথাগুলি জঘন্য রকমের মিথ্যে। অন্য সবার মতো তারও নিজস্ব একটা নীতি আছে আর আছে গুদামঘরে একটা চাকরি।
‘হ্যাঁ’, বলল সে, ‘তারপর কী হল বলি… হঠাৎ একদিন দেখি মেয়েটা আর আগের মতো আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। চলার মতো সে তাকে যথেষ্ট টাকা দিত, তবে হয়তো তা তেমন বড় অঙ্কের নয়; তার ঘরের ভাড়া গুনত, প্রতিদিনের খাওয়ার জন্যে দিত কুড়ি ফ্রা। তিনশো ফ্রা ভাড়া, আর ছ’শো ফ্রা খাওয়া এবং যখন-তখন ছোটখাটো উপহার, কখনও একজোড়া মোজা, কখনও-বা অন্যকিছু। ধরো মাসে এক হাজার ফ্রা। কিন্তু আমার ভদ্রমহিলার জন্যে তাও যথেষ্ট নয়। সবসময় প্যানপ্যান করে বলত, যা দিচ্ছি তাতে সে কুলোতে পারছে না। সুতরাং একদিন তাকে বললাম, ‘দিনে ঘণ্টাখানেকের জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করো না কেন? তাতে আমারও সুবিধা হয়। এ-মাসে আমি তোমায় একটা নতুন ফ্রক কিনে দিয়েছি। শুনছি ঘরভাড়া আর প্রতিদিন কুড়ি ফ্রা তো দিচ্ছিই। কিন্তু তুমি একদঙ্গল মেয়ে নিয়ে কাফেতে গিয়ে সব উড়িয়ে দাও। তাদের তুমি কিনে দাও কফি, চিনি। আর পয়সাগুলি তো আসে আমার পকেট থেকে। আমি তোমার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করি আর প্রতিদানে এই পাই।‘ কিন্তু সে কোনো কাজ করবে না। অথচ প্রতিদিন বলবে আমি যা দিচ্ছি তাতে আর কুলোচ্ছে না। তারপর একদিন দেখলাম সে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
সে ব্যাখ্যা করতে লাগল। একদিন তার ব্যাগে একটা লটারির টিকিট দেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল, লটারির টিকিট কেনার টাকা সে পেল কোত্থেকে? মেয়েটি চুপ করে রইল। তারপর আরেকবার তার কাছে পেয়েছিল সে দুটি ব্রেসলেট বন্ধক দেয়ার রসিদ। অথচ, ব্রেসলেট দুটি সে কোনোদিন দেখেনি পর্যন্ত।
‘সুতরাং বুঝলাম, ভিতরে ভিতরে নোংরা কিছু-একটা চলছে। তাই তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হওয়া উচিত। তবে তার আগে তাকে নিয়ে নিলাম একচোট, শক্ত শক্ত কিছু কথাবার্তাও শোনালাম। বললাম, একটিমাত্র জিনিসই তার প্রিয়, তা হল সুযোগ পেলে যার-তার সঙ্গে ঘুমানো। সোজাসুজি বললাম তাকে, বুঝলে বোকা মেয়ে, আমার জন্যে কষ্ট পেতে হবে একদিন। তখন আমার কাছেই ফিরে আসতে চাইবে। রাস্তার সব মেয়ে তোমাকে হিংসে করে, কেন জানো? খালি এজন্যে যে আমি তোমাকে রাখছি।’