সোফায় ভালো করে হেলান দিয়ে চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বার্গার বলল,-বেশ। এবার বলো, মেরি সন্ডারসনের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক ছিল।
প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কেনেডি চেঁচিয়ে উঠল,–এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?
বার্গার স্বাভাবিকভাবে বলল,–না বন্ধু, এটা ঠাট্টা নয়। আমি তমাকে চিনি আর ওই মেরি নামের মেয়েটিকেও দেখেছি। তাই তোমার মুখ থেকে জানতে চাই, তোমাদের দুজনের মধ্যে ঠিক কী হয়েছিল।
–আমি তোমাকে একটি কথাও বলব না।
–তা হলে তো ব্যাপারটা মিটেই গেল। রাত দশটা বাজল, এবার চলি।
কেনেডি ব্যাকুলভাবে বলে উঠল,–না, না বার্গার, একটু অপেক্ষা করো। এখনই যেও না। যে ব্যাপারটা নিয়ে জানতে চাইছ, সেটাতো বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। এখন সে সম্বন্ধে কিছু জানতে চাওয়া প্রায় পাগলামির পর্যায়ে পড়ে।
বার্গার উঠে দাঁড়িয়ে তার বেতের ঝুড়িটা হাতে নিয়ে বলল,–ঘটনাটা শুধু তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, এ নিয়ে পুরো রোমে অনেক আলোচনা হয়েছিল। যা হোক, শুভরাত্রি।
প্রায় দরজার কাছ থেকে বার্গারের হাত ধরে ওকে ভেতরে এনে কেনেডি বলল,–বলো, কী জানতে চাও?
একটা চুরুট ধরিয়ে আবার বসে পড়ে বার্গার জিগ্যেস করল,-মেরি সন্ডারসনের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল?
–ও তো দেশে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। ইংল্যান্ডে।
–কিন্তু ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না? তোমার সঙ্গে বেশ কিছুকাল মেরির বন্ধুত্ব ছিল। তা হলে ও হঠাৎ এমন করে চলে গেল কেন? আর তোমার সঙ্গে যদি ওর বন্ধুত্ব না হয়ে থাকে, তা হলে ওকে আর তোমাকে জড়িয়ে এত গুজব কেন?
কেনেডি ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলল, হয়তো তুমি ঠিকই বলছ। মেরিকে আমি বেশ পছন্দই করতাম। কিন্তু এখন বুঝি, ব্যাপারটা তার বেশি কিছুই নয়। আসলে ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটা করেছিলাম খানিকটা অ্যাডভেঞ্চার-এর নেশায়। মেরি তো একজন অভিজাত ঘরের মহিলার সঙ্গিনী ছিল। ওর সঙ্গে নাকি একজনের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছল। এতসব বাধা সত্ত্বেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা আর বন্ধুত্ব পাতানো একটা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে দেখেছিলাম।
–কিন্তু মেয়েটির হবু স্বামীর কী হল?
–কে জানে কী হয়েছে। লোকটা নিশ্চয়ই আমার তুলনায় অত্যন্ত সাধারণ মানের ছিল।
–আর একটা প্রশ্ন। এত তাড়াতাড়ি তুমি কীভাবে মেয়েটিকে বিদায় করলে?
–আমাদের ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর মেয়েটি আর রোমে থাকতে চাইল না। এদিকে আমার পক্ষে রোম। ছাড়া অসম্ভব। তা ছাড়া, ওর বাবাও খুব রাগারাগি করছিলেন। তাই আমি ধীরে ধীরে নিজেকে এই সম্পর্কের থেকে সরিয়ে নিলাম। আর আমার কিছু বলার নেই।
-ভাই কেনেডি, আমি পুরো ব্যাপারটা অবশ্যই গোপন রাখব। তবে একটা কথা বলি। তোমার আর আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। এবার বলো, আমার আবিষ্কার করা জায়গায় কবে যেতে চাও?…চলো না, আজ রাতেই যাওয়া যাক। একটু শীত হলেও আজকের রাতটা ভারী সুন্দর।
জায়গাটা কত দূরে?
–বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলেই ভালো। এত রাতে গাড়ি ভাড়া করলে গাড়িওয়ালা সন্দেহ করবে। আমি বরং আমার বাড়ি থেকে মোমবাতি, দেশলাই ও আর কয়েকটা দরকারি জিনিস নিয়ে শহরের বড় গেটটার কাছে ঠিক রাত বারোটার সময় তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
–ঠিক আছে। আমিও পৌঁছে যাব।
শহরের ঘড়িঘর-এ যখন রাত বারোটার ঘণ্টা বাজছে, ঠিক তখনই হাতে একটা লণ্ঠন ঝুলিয়ে ওভারকোট পরা বার্গার নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির হল। একটু দূরেই অপেক্ষারত কেনেডি এগিয়ে এল বার্গারের কাছে।
রাতের হাওয়া বেশ ঠান্ডা। শরীর গরম রাখতে দুজনেই পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত চলতে লাগল। রাস্তায় দু একজন বিক্ষিপ্ত পথচারী ছাড়া আর জনমানুষের চিহ্ন নেই। রাস্তার দুধারে কবরখানা ও অনেক স্মৃতিসৌধ। বেশ খানিকটা গিয়ে সেন্ট ক্যালিস্টাসের সমাধির কাছে বার্গার থামল।
বার্গার বলল,–দাঁড়াও। এর খুব কাছেই আমার আবিষ্কৃত সমাধি। এই যে এদিকে এসো। এই সরু রাস্তাটা দিয়ে যেতে হবে। তুমি আমার পেছনে এসো।
কাঠের তৈরি একটা ফাঁকা গোয়ালঘরের কাছে গিয়ে বার্গার পকেট থেকে চাবি বের করল।
কেনেডি বলল,–একী! তোমার ভূগর্ভের ভাণ্ডার এই বাড়ির মধ্যে না কি?
–হ্যাঁ, এটাই রাস্তা। এই ঘরটির জন্য লোকে ভাবতেই পারবে না যে এর নীচে কী আছে। এমনকী এই বাড়ির মালিকও জানে না যে তার বাড়ির নীচে আছে পুরাতত্ত্বিক রত্ন ভাণ্ডার। এই বাড়িটা আমি ভাড়া নিয়েছি। ভেতরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দাও।
যদিও বাড়িটা জনহীন, বার্গার তবুও লণ্ঠনের বেশির ভাগটাই ওভারকোট দিয়ে ঢেকে রাখল, যাতে বাইরে থেকেও কেউ তাদের উপস্থিতি টের না পায়। ঘরে এক কোণে কাঠের মেঝেটা ঢিলে ছিল। দুজনে মিলে সেখান থেকে কয়েকটা তক্তা তুলে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। মেঝের ফোকরটা থেকে নীচে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে। বার্গার আগে হাতে আলো নিয়ে নামল–পেছনে কেনেডি। নীচে নেমে মনে হল এটা যেন বুনো খরগোশের গর্ত–অর্থাৎ অজস্র অলিগলিতে ভরা। একবার রাস্তা হারিয়ে ফেললে সঠিক রাস্তা খুঁজে বাইরে বেরিয়ে আসা অসম্ভব বললেই হয়।
কেনেডি বলল, তুমি কী করে এই গোলকধাঁধায় চলাফেরা করো?