- বইয়ের নামঃ রক্ত সমীক্ষা
- লেখকের নামঃ আর্থার কোনান ডয়েল
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, গল্পের বই
রক্ত সমীক্ষা
০১. মিঃ শার্লক হোমস
রক্ত সমীক্ষা
অধ্যায় ০১
[সামরিক চিকিৎসা বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত জন এইচ, ওয়াটসন, এম, ডি-র স্মৃতি-চারণা থেকে পুনর্মূদ্রণ]
০১. মিঃ শার্লক হোমস
১৮৭৮ সালে আমি লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রী লাভ করি এবং সেনাবিভাগে সার্জনদের জন্য নির্ধারিত পাঠক্রমে যোগদানের জন্য নেট্লি যাত্রা করি। সেখানকার পাঠ শেষ করে যথারীতি সহকারী সার্জনরূপে পঞ্চম নর্দাম্বারল্যাণ্ড রেজিমেণ্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। সিএ সময়ে ঐ রেজিমেণ্টের কর্মস্থল ছিল ভারতবর্ষ। আমি সেখানে যোগদান করবার আগেই দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ বেধে যায়। বোম্বাইতে জাহাজ থেকে নেমেই জানতে পারলাম আমার রেজিমেণ্ট গিরিবর্ত্মের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের দেশে প্রবেশ করেছে। আমার মত আরও অনেক অফিসারের সঙ্গে যাত্রা করে নিরাপদেই কান্দাহার পৌঁছলাম এবং আমার রেজিমেণ্টকে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্মভার গ্রহণ করলাম।
সেই অভিযান অনেকের জন্যই এনে দিল সম্মান আর পদোন্নতি, কিন্তু দুর্ভাগ্য আর বিপদ ছাড়া আমাকে সে আর কিছুই দিল না। আমার বাহিনী থেকে সরিয়া আমাকে বার্কশায়ার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হলে এবং তাদের সঙ্গেই মাইওয়ান্দের মারাত্মক যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করলাম। সেখানেই একটি ‘যেজাইল’ বুলেট আমার কাঁধে বিদ্ধ হয়ে একখানা হাড় ভেঙে চুরমার করে দিল আর সাবক্লেভিয়ান ধমনীটা ঘেসড়ে গেল। আমার আর্দালি মারের প্রভুভক্তি আর সাহসের জন্যই খুনে গাজীদের হাত থেকে কোনরকমে বেঁচে গেলাম। একটা ভারবাহী ঘোড়ায় চাপিয়ে সে আমাকে নিরাপদে বৃটিশ লাইনে নিয়ে এল।
যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট এবং দীর্ঘস্থায়ী কষ্টভোগের ফলে দুর্বল অসহায় অবস্থায় একদল আহত সৈনিকের সঙ্গে আমাকে পেশোয়ারের বেস-হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানেই ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলাম। ক্রমে ওয়ার্ডের ভিতরে হাঁটাচলা করা আর বারান্দায় রৌদ্রে একটু-আধটু বেড়াবার মত স্বাস্থ্যও ফিরে পেলাম। হঠাৎ ভারতের অভিশাপ আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। কয়েক মাস আমার জীবনের কোন আশাই ছিল না। অবশেষে আমার যখন সেরে উঠলাম তখন আমি এতই দূর্বল ও শীর্ণকায় হয়ে পড়লাম যে একটা মেডিক্যাল বোর্ড স্থিত করলেন,–আর একটি দিনও নষ্ট না করে আমাকে লণ্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। তদনুসারে আমাকে সৈন্যবাহী জাহাজ ‘ওরোণ্টেস’-এ তুলে দেওয়া হল এবং তার এক মাস পরে পোর্টসমাউথ জেটিতে নামলাম। নষ্টস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের কোন আশাই তখন ছিল না, তবু স্নেহময় সরকার স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য নয় মাস সময় দিলেন।
ইংলণ্ডে আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না। কাজেই আমি তখন বাতাসের মত স্বাধীন, অবশ্য দৈনিক এগারো সিলিং ছয় পেনি আয়ে একজন লোক যতটা স্বাধীন হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই আমি লণ্ডনে হাজির হলাম, কারণ লণ্ডন হচ্ছে এমন একতা বড় ডোবা যেখানে সারা সাম্রাজ্যের যত ভ্রমণবিলাসী আর আলস্যপরায়ণ লোকেরা এক দূর্বার টানে এসে মিলিত হয়। স্ট্রাণ্ড-এর একটা প্রাইভেট হোটেলে আরামহীন অর্থহীন জীবন কাটতে লাগল। পকেটে যা টাকা ছিল তার তুলনায় একটু বেশী স্বাধীনভাবেই চলতে লাগলাম। ফলে ক্রমে আর্থিক অবস্থা এতই ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল যে অবিলম্বেই বুঝতে পারলাম হয় মহানগরী ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে হবে, আর না হয় জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ পাল্টাতে হবে। শেষের বিকল্পটাই বেছে নিলাম। স্থির করলাম, হোটেল ছেড়ে কোন স্বল্পব্যয়সাধ্য অঞ্চলে একটা বাসা নেব।
যেদিন এই সিদ্ধান্ত করলাম সেইদিনই ‘ক্রাইটেরিয়ন বার’-এ দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় কে যেন কাঁধে হাত রাখল। ফিরে দাঁড়িয়েই চিনতে পারলাম—স্ট্যামফোর্ড, বার্টস-এ আমার অধীনে ড্রেসার ছিল। লণ্ডনের বিপুল জনারণ্যে পরিচিত মুখের দর্শন পাওয়া একজন সঙ্গীহীন লোকের কাছে খুবই সুখকর। এর আগে স্ট্যামফোর্ড আমার বিশেষ বন্ধুস্থানীয় ছিল না, কিন্তু সেদিন তাকে আমি সাগ্রহে অভ্যর্থনা জানালাম। সেও আমাকে দেখে খুশিই হল। আনন্দের আতিশয্যে তাকে ‘হোলবর্ণ’ এ মধ্যাহ্ন ভোজনের আমন্ত্রণ জানালাম এবং একটা এক্কাগাড়ি নিয়ে দুজনে যাত্রা করলাম।
লণ্ডনের জনবহুল রাজপথ দিয়ে সশব্দে যেতে যেতে সবিস্ময়ে সে প্রশ্ন করল, ‘শরীরটাকে কি করে ফেলেছ ওয়াটসন? বাখারির মত শুকিয়ে গেছ, গায়ের রঙ হয়েছে বাদামের মত।‘
আমার অভিযানের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ তাকে দিলাম। সে বিবরণ শেষ হতেই আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী শুনে সমবেদনার সুরে সে বলল, ‘আহা বেচারি! এখন কি করবে?’
‘একটা বাসা খুঁজছি’, আমি জবাব দিলাম। ‘যুক্তিসঙ্গত ভাড়ায় একটা আরামদায়ক বাসা পাওয়া যায় কিনা সেই সমস্যারই সমাধান করতে চেষ্টা করছি।‘
আমার সঙ্গী মন্তব্য করল, ‘খুব আশ্চর্য তো! তুমিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যে ঐ কথাগুলি আজ আমাকে বললে।‘
‘প্রথম ব্যক্তিটি কে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘লোকটি হাসপাতালের কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাজ করে। আজ সকালেই সে দুঃখ করছিল। একটা ভাল বাসা সে পেয়েছে। কিন্তু ভাড়াটা তার আয়ত্তের বাইরে। অথচ একজন অংশীদারও সে পাচ্ছে না।‘
আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘সে যদি বাসার এবং ভাড়ার এজজন অংশীদার সত্যিই চায়, তাহলে আমিই সেই লোক। সঙ্গীহীন থাকার চাইতে একজন অংশীদার আমারও পছন্দ।’
মদের পাত্রের উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘শার্লক হোমসকে তুমি এখনও চেন না। স্থায়ী সঙ্গী হিসাবে তুমি হয় তো তাকে পছন্দ করবে না।‘
‘কেন? তার বিরুদ্ধে কি বলবার আছে?’
‘না, এর কোন দোষের কথা আমি বলছি না। তবে তার চিন্তাভাবনাগুলো একটু অদ্ভুত ধরনের—বিজ্ঞানের কতকগুলি শাখায় বেশ উৎসাহী। আমি যতদূর জানি, লোকটি বেশ ভদ্র।’
‘ডাক্তারী ছাত্র নিশ্চয়’, আমি বললাম।
‘না—সে যে কি হতে চায় সেবিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। আমার বিশ্বাস সে শরীর-সংস্থান বিদ্যায় বেশ পারদর্শী। একজন প্রথম শ্রেণীর রসায়নবিদও বটে। কিন্তু আমি যতদূর জানি সে কোনকালে নিয়মিত কোন ডাক্তারীশাস্ত্রের পাঠ নেয় নি। তার পড়াশুনাও অত্যন্ত আগোছালো আর খামখেয়ালি। কিন্তু নানা বিষয়ে জ্ঞান সে এত সঞ্চয় করেছে যে তার অধ্যাপকদেরও তাক লেগে যায়।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি কোনদিন জানতে চাও নি সে কি হতে পারে?’
‘না। তার মনের হদিস করা সোজা কাজ নয়। তবে খেয়াল জাগলে তার মুখে কথার খই ফোটে।’
আমি বললাম, ‘তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। যদি কারও সঙ্গেই বাস করতে হয়, আমি পড়াশুনা-করা চুপচাপ লোকই পছন্দ করি। অত্যধিক গোলমাল বা উত্তেজনা সহ্য করবার মত শক্তি এখনও ফিরে পাই নি। ও দুটো বস্তুই আফগানিস্থানে এত বেশী পেয়েছিলাম যে আর যতদিন বেঁচে থাকব ওতেই চলে যাবে। তোমার ওই বন্ধুর সঙ্গে কেমন করে দেখা হতে পারে?’
সঙ্গী উত্তরে বলল, ‘নিশ্চয় সে লেবরেটরিতে আছে। হয় সে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সে স্থানই মাড়ায় না, আর না হয় তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করে। তুমি চাও তো খাওয়া শেষ করে একসঙ্গেই সেখানে পারি।’
‘নিশ্চয় যাব’ আমি বললাম। তারপরই আলোচনা অন্য পথে মোড় নিল।
যে ভদ্রলোকের সহ-বাসিন্দা হবার প্রস্তাব এইমাত্র করলাম, হোলবর্ণ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাবার পথে তার সম্পর্কে আরও কিছু বিবরণ স্ট্যামফোর্ড আমাকে জানান। বলল, ‘তার সঙ্গে যদি মানিয়ে চলতে না পার, তাহলে কিন্তু আমাকে দোষ দিও না। মাঝে মাঝে লেবরেটরিতে দেখা-সাক্ষাতের ফলে তার যেটুকু পরিচয় পেয়েছি তার বেশী কিছু আমি জানি না। তুমিই এক প্রস্তাব করেছ, কাজেই আমাকে যেন দায়ী করো না।’
আমি বললাম, ‘মানিয়ে চলতে না পারলে সরে গেলেই হবে। তারপর সঙ্গীর দিকে একটু কড়া চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘দেখ স্ট্যামফোর্ড, মনে হচ্ছে বিশেষ কোন কারণে তুমি এ ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চাইছ না। লোকটির মেজাজ খুব খাপ্পা নাকি? না আর কিছু? রেখে-ঢেকে কথা বলো না।’
সে হেসে বলল, ‘অনির্বচনীয়কে ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। আমার বিচারে হোমস একটু অতি-বৈজ্ঞানিক ধাতের লোক—প্রায় অনুভূতিহীন। অনিষ্টসাধনের উদ্দেশ্য নয়, শুধুমাত্র ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের গবেষণার খাতিরেই সে তার বন্ধুকে একচিমটে উদ্ভিজ্জ উপক্ষার ক্ষেতে দিচ্ছে, তাও কল্পনা করা যায়। তার প্রতি সুবিচার করতে হলে বলতে হয়, ওই একই কারণে সমান তৎপরতার সঙ্গে সে নিজেও ওটা খেতে পারে। নির্দিষ্ট ও সঠিক জ্ঞানার্জনের প্রতি তার একটা নেশা আছে বলে মনে হয়।’
‘এটা তো খুব ভালো কথা।’
‘ভাল, তবে বাড়াবাড়ি ঘটতে পারে। যখন কেউ ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে মৃত প্রাণীকে লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করে, তখন সে ব্যাপারটা বড়ই কিম্ভুতকিমাকার হয়ে ওঠে।’
‘মৃত প্রাণীকে লাঠির বাড়ি!’
‘হ্যাঁ। মৃত্যুর পরে শরীরে আঘাতের দাগ কতটা পড়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাকে এরকম করতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘তারপরেও তুমি বলছ, সে মেডিক্যালের ছাত্র নয়?’
‘না। ইশ্বর জানেন তার পড়াশুনার উদ্দেশ্য কি। কিন্তু আমরা তো এসে পড়েছি। তার সম্পর্কে নিজেই তোমার ধারণা গড়ে নিও।’ বলতে বলতে একটা সংকীর্ণ গলিতে মোড় নিয়ে ছোট পাশের দরজার ভিতর দিয়ে হাসপাতালের একটা অংশে প্রবেশ করলাম। এ জায়গা আমার পরিচিত। বিনা সাহায্যেই ঠাণ্ডা পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে লম্বা বারান্দা ধরে এগোতে লাগলাম। দুই পাশে সাদা দেওয়াল আর বাদামী দরজার সারি। প্রায় শেষ প্রান্তে নীচু খিলানওয়ালা যে পথটা বেরিয়ে গেছে সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই কেমিক্যাল ল্যাবরেটারি।
উঁচু ঘর। চারদিকে অসংখ্য বোতল। কতক সাজানো, কতক ছড়ানো। এখানে-সেখানে চওড়া নীচু টেবিল। তার উপর বকযন্ত্র, টেস্ট-টিউব আর ছোট বুনসেন বাতি, তার থেকে নীল কাঁপা-কাঁপা শিখা বেরুচ্ছে। ঘরে একটিমাত্র ছাত্র কোণের টেবিলে উপুড় হয়ে কাজ করছে। আমাদের পায়ের শব্দ শুনে যে একবার ফিরে তাকাল। তারপর সোজা দাঁড়িয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। আমার সঙ্গীর দিকে চোখ ফেলে ‘পেয়েছি! পেয়েছি!’ বলে চীৎকার করতে করতে সে একটা টেস্ট-টিউব হাতে নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে এল। ‘এমন একটা রি-এজেন্ট আমি পেয়েছি একমাত্র হিমোগ্লোবিন দ্বারাই যার থেকে তলানি পড়ে, আর কিছুর দ্বারাই নয়।‘ একটা সোনার খনি আবিষ্কার করলেও বোধ হয় এর চাইতে বেশী আনন্দে তার চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হত না।
‘ডাঃ ওয়াটসন, মিঃ শার্লক হোমস’, আমাদের দু-জনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল।
বেশ জোরের সঙ্গে আমার হাত চেপে ধরে সে সাদরে বলল, ‘কেমন আছেন? মনে হচ্ছে, আপনি আফগানিস্থানে ছিলেন?’
‘সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে?’ আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
মুচকি হেসে সে বলল, ‘ও কথা থাক।’ এখন সমস্যাটা হচ্ছে হিমোগ্লোবিন নিয়ে। আমার এই নতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?’
আমি জবাব দিলাম, ‘রসায়নের দিক থেকে নিঃসন্দেহে ইণ্টারেস্টিং, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে—‘
‘বলেন কি? চিকিৎসা-আইনের ক্ষেত্রে এতবড় আবিষ্কার গত কয়েক বছরের মধ্যে হয় নি। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে রক্তের দাগের বিষয়ে আমরা একটা অভ্রান্ত পরীক্ষা পেয়ে যাচ্ছি। চলুন তো ওখানে!’ আগ্রহের আতিশয্যে আমার কোটের আস্তিন চেপে ধরে যে টেবিলে সে কাজ করছিল সেখানে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। ‘কিছুটা তাজা রক্ত নেওয়া যাক,’ বলে একটা লম্বা ভোঁতা সূঁচ আঙুলে ঢুকিয়ে দিল, আর ফোঁটা কয়েক রক্ত একটা পাত্রে ধরে নিল। ‘এবার এইটুকু রক্ত এক লিটার জলে মিশিয়ে দিলাম। দেখতে পাচ্ছেন, মিশ্রণটার রঙ বিশুদ্ধ জলের মত হয়ে গেল। এতে রক্তের অনুপাত দশ লক্ষে একের বেশী হবে না।’ কথা বলতে বলতে সে ঐ পাত্রে কয়েক টুকরো সাদা স্ফটিক ফেলে দিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা স্বচ্ছ তরল পদার্থ যোগ করল। দেখতে দেখতে মিশ্রণটায় মেহগেনি রঙ ধরল, আর কাঁচের পাত্রটার নীচে কিছু বাদামী রঙের তলানি পড়ল।
‘হাঃ! হাঃ!’ সে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, যেন ছোট শিশু একটা নতুন খেলনা পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ‘এটা কি বলুন তো?’
‘একটা কোন সূক্ষ্ম পরীক্ষা বলে মনে হচ্ছে,’ আমি বললাম।
‘সুন্দর! সুন্দর! পুরনো “গুয়াইকাম” পরীক্ষাটা যেমন গোলমেলে তেমনি অনিশ্চিত। রক্ত কণিকার অনুবীক্ষণিক পরীক্ষাটাও তাই। রক্তের দাগটা কয়েক ঘণ্টা পুরনো হয়ে গেলে তো পরের পরীক্ষাটা একেবারেই মূল্যহীন। অথচ এই পরীক্ষাটা তাজা বা বাসি উভয় রক্তের বেলায়ই সমান কার্যকরী। এই পরীক্ষাটা যদি আগে আবিষ্কৃত হত, তাহলে শত শত লোক যারা আজও পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা অনেক আগেই তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করত।’
‘সত্যি!’ আমি আস্তে আস্তে বললাম।
‘খুনের মামলাগুলি ক্রমাগত একটি পয়েণ্টের উপরই ঝুলে থাকে। হয় তো খুনের কয়েক মাস পরে একটা লোকের উপর সন্দেহ পড়ল। তার কাপড়-চোপড় পরীক্ষা করে বাদামী দাগ পাওয়া গেল। সেগুলো রক্তের দাগ, কাদার দাগ, মরচের দাগ, ফলের দাগ, না আর কিছু? এই প্রশ্ন অনেক বিশেষজ্ঞকেই বিচলিত করেছে। কিন্তু কেন? কারণ, কোন নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা-ব্যবস্থা ছিল না। এবার “শার্লক হোমস পরীক্ষা”টা পাওয়া গেল, সুতরাং আর কোন অসুবিধা রইল না।’
কথা বলার সময় তার চোখ চকচক করছিল। বুকের উপর হাত রেখে সে এমনভাবে মাথা নীচু করল যেন কল্পনার চোখে দেখা এক সপ্রশংস জনতাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
তার উৎসাহ দেখে বিস্মিত হয় আমি বললাম, ‘আপনাকে অভিবাদন জানানো উচিত।’
‘গত বছর ফ্রাংকফোর্টে ভন বিস্কর্ফের কেসটাই ধরুন। এ পরীক্ষাটা তখন চালু থাকলে নির্ঘাৎ তার ফাঁসি হত। আরও ধরুন, ব্রাডফোর্ডের ম্যাসন, কুখ্যা মুলার; মঁৎপেলিয়ের-এর লেফেভার এবং নিউ অর্লিয়ান্সের স্যামসন। এ রকম আরও এককুড়ি কেসের কথা আমি বলতে পারি যেখানে এই পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে অপরাধের প্রমাণ হতে পারত।’
স্ট্যামফোর্ড হেসে বলল, ‘আপনি দেখছি অপরাধের একটি জীবন্ত পঞ্জিকা। এবিষয়ে আপনি একখানি পত্রিকা বের করতে পারেন। তার নাম দিন “অতীতের পুলিশী সমাচার”।’
আঙুলের মাথায় একটুকরো প্লাস্টার জড়াতে জড়াতে শার্লক হোমস বলল, ‘পত্রিকাটিকে খুব কৌতূহলোদ্দীপক করা যায় কিন্তু।’ তারপর হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমাকে সাবধান হতে হবে। কারণ আমাকে নানারকম বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়।’ সে তার হাতখানা বাড়িয়ে ধরল। দেখলাম, তার সারা হাত কড়া এসিডে বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং তাতে আগাগোড়া টুকরো টুকরো প্লাস্টার জড়ানো।
একটা তিন-পায়া উঁচু টুলে নিজে বসে আর একটা টুল পা দিয়ে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘একটা কাজে আমরা এসেছি। আমার এই বন্ধু একটা আস্তানা খুঁজছেন। আপনি বলেছিলেন একজন অংশীদার খুঁজে পাচ্ছেন না, তাই আপনাদের দুজনকে দেখা করিয়ে দিলাম।’
আমার সঙ্গে এক বাসায় থাকার প্রস্তাবে শার্লক হোমসকে খুশিই মনে হল। বলল, ‘বেকার স্ট্রীটে একটা “সুইট” দেখেছি। আমাদের দুজনের বেশ কুলিয়ে যাবে। আশা করি তামাকের কড়া গন্ধে আপনার আপত্তি হবে না?’
জবাব দিলাম, ‘আমি নিজেও ধূমপান করি।’
‘তাহলে তো ভালই হল। নানারকম রাসায়নিক পদার্থ আমার কাছে থাকে। মাঝে মাঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তাতে আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
‘মোটেই না।’
‘ভেবে দেখি—আমার আর কি দোষ আছে। মাঝে মাঝে আমি চুপচাপ থাকি, পরপর কয়েকদিন হয় তো মুখই খুলি না। তখন যেন মনে করবেন না যে আমি খুব রেগে আছি। স্রেফ আমাকে একা থাকতে দেবেন, ব্যাস সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার আপনার কি বলার আছে বলুন। একসঙ্গে থাকবার আগে দুজনেরই পরস্পরের দোষ-ত্রুটিগুলি জানা থাকা ভাল।’
তার জেরায় আমি হেসে উঠলাম। বললাম, ‘আমার একটা কুকুরের বাচ্চা আছে। আমার স্নায়ুগুলো খুব দূর্বল হয়ে পড়েছে, তাই হট্টগোল পছন্দ করি না। সময়ে অসময়ে ঘুম থেকে উঠি। আলসেমি করি। ভাল অবস্থায় আরও কিছু কিছু দোষ আছে, তবে আপাতত ঐগুলিই প্রধান।’
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সে প্রশ্ন করল, ‘হট্টগোল বলতে কি আপনি বেহালা বাজানোটাকে ধরেছেন?’
‘সেটা বাদকের উপর নির্ভর করে,’ আমি জবাব দিলাম। ‘বেহালার ভাল বাজনা তো দেবতাদের উপভোগ্য। কিন্তু বাজনা যদি বাজে হয়—’
হো-হো করে হেসে সে বলল, ‘বাস, বাস, তাহলে ঠিক আছে। ধরে নিচ্ছি ব্যবস্থাটা পাকা, অবশ্য যদি বাসাটা আপনার পছন্দ হয়।’
‘কখন দেখা যায়?’
‘কাল দুপুরে এখানে আসুন। একসঙ্গে গিয়ে সব পাকা করে ফেলব,’ সে জবাব দিল।
করমর্দন করে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। কাল দুপুরে।’
সে আবার কাজে মন দিল। আমরা হোটেলের দিকে পা বাড়ালামা।
হঠাৎ থেমে স্ট্যামফোর্ডের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম, ‘ভাল কথা, আমি আফগানিস্থান থেকে এসেছি উনি বুঝলেন কি করে?’
একটু রহস্যময় হাসি হেসে সঙ্গী বলল, ‘ঐটেই তাঁর বৈশিষ্ট্য। উনি যে কি করে সবকিছু বোঝেন, সেটা আরও অনেকে জানতে চেয়েছে।’
হাত ঘসতে ঘসতে আমি বললাম, ‘ওঃ! সেটা তাহলে একটা রহস্য? বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। আমাদের দুজনের মিলন ঘটিয়েছ বলে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তুমি তো জান, “মানুষের উপযুক্ত পাঠ্য বিষয়ই হল মানুষ।’
বিদায় নেবার সময় স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘তাহলে ওকে পাঠ কর। যদিও খুব জটিল সমস্যায় পড়বে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, তুমি তাকে যতটা জানতে পারবে তার চাইতে অনেক বেশী সে তোমাকে জানতে পারবে। নমস্কার।‘
‘নমস্কার।’ অপরিচিতের সম্পর্কে প্রচুর আগ্রহন নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম।
০২. অনুমান বিজ্ঞান
তার ব্যবস্থামত পরদিন দেখা করলাম এবং ২২১বি, বেকার স্ট্রীটের ঘরগুলি দেখলাম। দুটো আরামদায়ক শয়ন-কক্ষ, একটি বড় খোলামেলা সুসজ্জিত বসবার ঘর, তাতে দুটো প্রশস্ত জানালা দিয়ে প্রচুর আলো এসে পড়ছে। সব দিক থেকেই বাসাটা ভাল এবং সম-অংশে ভাড়াটাও ন্যায্য বলেই মনে হয়। কাজেই সেখানেই কথাবার্তা পাকা করে সঙ্গে সঙ্গে বাসার দখল নিয়ে নিলাম। আমি সেদিন সন্ধ্যায়ই হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে সেখানে গেলাম। শার্লক হোমস পরদিন সকালে কয়েকটা বাক্স্ ও পোর্টম্যাণ্টো নিয়ে হাজির হল। মালপত্র খুলে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে দু’ একদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে দুজনেই নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম।
হোমসের সঙ্গে একত্রে বাস করা মোটেই কঠিন নয়। লোকটি চলা-ফেরায় শান্ত, স্বভাবে পরিমিত। রাত দশটার পরে কদাচিৎ জেগে থাকে, আর সকালে আমার ঘুম ভাঙবার আগেই প্রাতরাশ সেরে বাইরে বেরিয়ে যায়। কখনও সারাটা দিন কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাটায়। কখনও বা ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে। আবার অনেকদিন শহরের অনুন্নত এলাকাগুলিতে দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়ায়। কাজের নেশা যখন পেয়ে বসে তখন কোন কাজেই সে পিছপা নয়। কখনও বা সম্পূর্ণ উল্টো। দিনের পর দিন বসবার ঘরে সোফায় বসে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মুখে একটা কথা নেই, শরীরের একটু নড়ন-চড়ন নেই। সেসময় তার চোখে এমন একটা ফাঁকা স্বপ্নময় দৃষ্টি দেখেছি যাতে অনায়াসেই সন্দেহ হতে পারত যে নেশাখোর; কিন্তু তার সংযত ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা দেখে সে ধারণা মনেও ঠাঁই পেত না।
যতদিন কাটতে লাগল, তার সম্পর্কে আমার আগ্রহ এবং তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আমার কৌতূহল ততই বাড়তে লাগল। তার শরীর এবং চেহারাই এমন যে যে-কোন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। লম্বায় ছ’ ফুটের উপরে, কিন্তু এতটাই কৃশকায় যে আরও ঢ্যাড়া মনে হয়। যে নেশার ঘোরের কথা এইমাত্র উল্লেখ করেছি সেসময়টা ছাড়া সাধারণভাবে তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং অন্তর্ভেদী। বাজপাখির মত সরু নাক, সারা মুখে সদা-সতর্কতা ও স্থির সিদ্ধান্তের আভাষ ফুটিয়ে তোলে। তার মোটা চৌকো থুতনি দৃঢ় চরিত্র মানুষের লক্ষণ। তার দুই হাতে সব সময়ই কালি আর কেমিক্যালের দাগ লেগে থাকত। তা সত্ত্বেও কোন কিছু ছোঁবার বেলায় সে খুবই খুঁতখুঁতে। কাজের যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করবার সময় তার এই স্বভাব আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি।
এই মানুষটি আমার কৌতূহলকে কতখানি জাগ্রত করেছিল, এবং নিজের সম্পর্কে তার নীরবতাকে ভাঙবার কতটা চেষ্টা আমি বারবার করেছি, সেকথা বললে পাঠক নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চার অপরাধে আমার নিন্দা করবেন; কিন্তু তা করবার আগে মনে রাখতে হবে যে সেসময় আমার জীবন ছিল লক্ষ্যহীন এবং করবার মত কোন কাজও তখন আমার হাতে ছিল না। আমার স্বাস্থ্যের তখন যা অবস্থা তাতে আবহাওয়া অত্যন্ত ভাল না থাকলে আমি বাইরেও বেরোতে পারতাম না। এমন কোন বন্ধুও ছিল না যার সঙ্গে কথা বলে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিকে কাটাতে পারি। সে অবস্থায় এই সঙ্গীটিকে ঘিরে যে ছোটখাট রহস্য ছিল তার সমাধানের চেষ্টায়ই আমি অনে সময় কাটিয়ে দিতাম।
সে ডাক্তারি পড়ত না। এবিষয়ে স্ট্যামফোর্ড যা বলেছিল আমার একটা প্রশ্নের উত্তরে সে নিজেও সেই উক্তিই সমর্থন করেছে। সে নিয়মিতভাবে এমন কোন পড়াশুনা করে না যাতে সে বিজ্ঞানের একটা ডিগ্রি পাবার উপযুক্ততা অর্জন করতে পারে, অথবা জ্ঞান-রাজ্যে প্রবেশের অন্য যে কোন দ্বার-পথ তার সামনে উন্মুক্ত হতে পারে। কিন্তু কোন কোন পাঠ্য বিষয়ে তার উৎসাহ এতই উল্লেখযোগ্য, এবং খামখেয়ালের দ্বারা সীমিত হলেও তার জ্ঞান এত অসাধারণভাবে প্রচুর ও সূক্ষ্ম যে তার অনেক বক্তব্যই আমাকে বিস্মিত করেছে। কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্মুখে না থাকলে কোন মানুষ এত কঠিন পরিশ্রম করতে বা এত নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। যারা আবোলতাবোল পড়াশুনা করে তাগের জ্ঞান কদাচিৎ সঠিক হয়ে থাকে। স্পষ্ট কারণ না থাকলে কোন মানুষ ছোটখাট বিবরণ সংগ্রহ করে মনকে বোঝাই করে রাখতে পারে না।
তার অজ্ঞানতাও তার জ্ঞানের মতই উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সাহিত্য, দর্শন বা রাজনীতির সে প্রায় কিছুই জানে না। টমাস কার্লাইল থেকে উদ্ধৃতি দেওয়াতে সে খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করে বসল, লোকটি কে এবং কি করতেন। কথাপ্রসঙ্গে যেদিন বুঝতে পারলাম যে সে কোপার্নিকাসীয় মতবাদ এবং সৌর জাগতিক গ্রহনক্ষত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সেদিন আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে—এই বিংশ শতাব্দীতে কোন সভ্য মানুষ যে সেটা জানে না সে কথা আমি ভাবতেই পারি নি।
আমার মুখে বিস্ময়ের ভাব লক্ষ্য করে সে বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি এতে বিস্মিত হয়েছ। কিন্তু ও তথ্যটা জানবার পরে মনে হচ্ছে, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব ওটা ভুলে যেতে।‘
‘ভুলে যেতে!’
সে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল, ‘দেখ, আমি মনে করি মানুষের মস্তিষ্ক গোড়ায় একটা ছোট শূন্য চিলেকোঠার মত। সেখানে পছন্দসই আসবাব জমানোই উচিত। একমাত্র বোকা লোকই যা কিছু পায় তাই সেখানে জমা করে। ফলে যে জ্ঞান তার পক্ষে দরকারী সেইটেই হয়ে ভীড়ে হারিয়ে যায়, না হয় অন্য সব জিনিসের সঙ্গে এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে যায় যে দরকারের সময় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মস্তিষ্কের কুঠুরিতে কি রাখবে না রাখবে সেবিষয়ে দক্ষ কারিগর কিন্তু ভারী সতর্ক। কাজের জন্য দরকারী যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু সে সেখানে রাখে না। আর সে যন্ত্রপাতিও সংখ্যায় অনেক বলে সেগুলিকে সে বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। ঐ ছোট কুঠুরিটার বর্ধনশীল দেওয়ালে আছে এবং সেটাকে যতদূর খুশি বাড়ানো যায় এ ধারণা কিন্তু ভুল। ঠিক জানবে, এমন একসময় আসে যখন নতুন কোন জ্ঞান পেতে হলেই পুরনো জ্ঞান কিছুটা ছাড়তে হবেই। কাজেই অদরকারী ঘটনা যাতে দরকারী ঘটনাকে মন থেকে ঠেলে সরিয়ে না দেয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।‘
‘কিন্তু সৌরজগৎ!’ আমি প্রতিবাদ করলাম।
অসহিষ্ণুকণ্ঠে সে বলে উঠল, ‘তা দিয়ে আমার কি দরকার? তুমি বলছ আমরা সূর্যের চারদিকে ঘুরিছি। বেশ তো, আমরা যদি চন্দ্রের চারদিকে ঘুরতাম তাতে আমি বা আমার কাজের তো তিলমাত্র তফাৎ হত না।‘
তার কাজটা কি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার হাবভাবে মনে হল প্রশ্নটাকে সে ভালভাবে নেবে না। যা হোক, আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার কথা ভাবতে ভাবতে তার থেকে কিছু কিছু তথ্য অনুমান করতে চেষ্টা করলাম। সে বলেছে, তার অভীষ্টের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কোন জ্ঞান লাভ করতে সে চায় না। অতএব যা কিছু … (এখানে কিছু অংশ পাঠোদ্ধার করা যায় নি বলে আপাতত মিসিং) …না হেসে থাকতে পারলাম না। তালিকাটি এইরূপ:
শার্লক হোমস—তার জ্ঞানের সীমা
১. সাহিত্যের জ্ঞান—শূন্য
২. দর্শনের জ্ঞান—শূন্য
৩. জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান—শূন্য
৪. রাজনীতির জ্ঞান—দূর্বল
৫. উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞান—পরিবর্তনশীল। ধুতুরা, আফিম এবং সাধারণভাবে বিষাক্ত উদ্ভিদ সম্পর্কে পণ্ডিত। কিন্তু উদ্যানবিদ্যার কিছুই জানে না।
৬. ভূতত্ত্বের জ্ঞান—বাস্তব জ্ঞান আছে, কিন্তু সীমিত। একনজরেই বিভিন্নরকম মাটির পার্থক্য বলে দিতে পারে। বেড়িয়ে দিরে তার ট্রাউজারের দাগ দেখিয়ে সেগুলোর রং এবং ঘনত্বের বিচার করে কোন্ দাগ লণ্ডনের কোন্ অঞ্চল থেকে লেগেছে সেটাও আমাকে বলেছে।
৭. রসায়নের জ্ঞান—প্রগাঢ়।
৮. শারীর সংস্থান বিদ্যার জ্ঞান—সঠিক, কিন্তু শৃঙ্খলাহীন।
৯. উত্তেজক সাহিত্যের জ্ঞান—প্রচুর। এই শতাব্দীর যে কোন লোমহর্ষক ঘটনার প্রতিটি বিবরণ সে জানে বলে মনে হয়।
১০. ভাল বেহালা বাজাতে পারে।
১১. দক্ষ বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়, বক্সার এবং অসিচালক।
১২. বৃটিশ আইনের ভাব বাস্তব জ্ঞান আছে।
তালিকাটি এই পর্যন্ত পড়েই হতাশ হয়ে সেটাকে আগুনে ফেলে দিলাম। নিজের মনেই বললাম, ‘এই সব সৎগুণের সম্মিলন ঘটিয়ে লোকটি কি করতে চাইছে যদি জানতে পারতাম, এবং কি সে কাজ যাতে এগুলি সব দরকার হয় যদি খুঁজে বের করতে পারতাম, তাহলে সেইদণ্ডে এসব চেষ্টা ছেড়ে দিতাম।’
বেহালা বাজাবার ক্ষমতার কথা আগেই বলেছি। সে ক্ষমতাও খুবই উল্লেখযোগ্য, কিন্তু তার অন্য সব গুণের মতই খামখেয়ালি। আমি জানি সে রাগ-রাগিণী বাজাতে পারে,–বেশ শক্ত রাগ-রাগিনীও। আমার অনুরোধে সে ‘মেণ্ডেলসন-এর লিয়েডার’ এবং অন্য প্রিয় রাগ বাজিয়ে আমাকে শুনিয়েছে। কিন্তু একা থাকলে সে কদাচিৎ কোন রাগ-রাগিণী বা পরিচিত সুর বাজায়। সন্ধ্যায় আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে কোলের উপর রাখা বেহালাটায় এলোমেলোভাবে ছড় টানতে থাকে। কখনও তাতে গম্ভীর বিষণ্ণ সুর বাজে, কখনও বা অদ্ভূত এক আনন্দের সুর। স্পষ্টই মনে হয়, তার মনের চিন্তাই যেন সুরের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সে বাজনা তার চিন্তার ধারাকে সাহায্য করে, না কি সেগুলো নেহাতই তার খেয়লাএর ফল, তা আমি আজও বুঝে উঠতে পারি নি। সেই সব একটানা রুদ্ধশ্বাস বাজনার বিরুদ্ধে আমি হয় তো বিদ্রোহ ঘোষণাই করতাম যদি না সে প্রায়শই তার বাজনার শেষে একের পর এক আমার প্রিয় সুরগুলি বাজিয়ে আমার ধৈর্যচ্যুতির ক্ষতিপূরণ করে দিত।
প্রথম সপ্তাহকাল আমাদের কাছে কেউ এলো না। আমার ধারণা হল এই সঙ্গীটিও আমার মত নির্বান্ধব। কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারলাম, তার পরিচিত জনের সংখ্যা অনেক, আর তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। তাদের মধ্যে একজন ছিল হলদেটে, ইঁদুরমুখো কালো চোখওয়ালা মানুষ। তার নাম শুনেছিলাম মিঃ লেস্ট্রেড। সপ্তাহে তিন চার দিন সে আসত। একদিন সকালে একটি সুসজ্জিত তরুণী এল এবং আধ ঘণ্টার উপরে কাটিয়ে গেল। সেইদিন বিকেলেই একটি শুটকো পাকা-চুল লোক এল। দেখতে ইহুদী ফেরিওয়ালার মত। মনে হল লোকটা খুব উত্তেজিত। তার পরেই এল একটি নোংরা বয়স্কা স্ত্রীলোক। একদিন এসেছিল এক পাকা-চুল বৃদ্ধ; আবার কোনদিন বা নকল মখমলের পোশাক-পরা এক রেলের কুলি। এই সব নানা ধরনের লোক যখন হাজির হত তখন শার্লক হোমস আমার কাছ থেকে বসবার ঘরটা ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে নিত, আর আমি আমার শোবার ঘরে চলে যেতাম। আমার এই অসুবিধা ঘটানোর জন্য সে সব সময়ই ক্ষমা চেয়ে নিত। বলত, ‘কাজের জন্য আমাকে ঘরটা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এরা সবাই আমার মক্কেল।‘ তখনই সোজাসুজি প্রশ্ন করবার সুযোগ পেলেও জোর করে একজনের গোপন কথা জানবার কৌতূহল থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতাম। ভাবতাম, সেকথা উল্লেখ না করার কোন সঙ্গত কারণ হয় তো তার আছে। কিন্তু একদিন নিজে থেকেই সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সে আমার এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটাল।
আমার বেশ মনে আছে, সেদিনটা ছিল ৪ঠা মার্চ। অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। দেখলাম, শার্লক হোমসের প্রাতরাশ তখনও সারা হয় নি। গৃহকর্ত্রী আমার দেরীতে ওঠার ব্যাপারে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তখনও আমার প্রাতরাশ টেবিলে দেওয়া হয় নি, বা আমার কফিও তৈরী হয় নি। মানুষ অনেক সময় অকারণে রেগে যায়। আমিও সেইরকম রাগের সঙ্গে ঘণ্টাটা বাজিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমি তৈরী। তারপর টেবিল থেকে একখানা পত্রিকা টেনে নিয়ে তার উপর চোখ বুলিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। আমার সঙ্গী নীরবে টোস্টে কামড় দিচ্ছিল। একটা প্রবন্ধের শিরোনামের নীচে পেন্সিলের দাগ দেখে স্বভাবতই সেটার উপর দ্রুত চোখ বুলোতে লাগলাম।
প্রবন্ধের শিরোনামটি খুব জবরদস্ত—‘জীবনের পুঁথি।’ তাতে দেখানো হয়েছে, একজন অনুসন্ধিৎসু লোক সঠিক ও সুশৃঙ্খল পর্যবেক্ষণের ফলে জীবনের কতকিছু জানতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে চাতুর্য ও অবাস্তবতার একটা খিঁচুড়ি বলে মনে হল। বেশ ধারালো ও তীক্ষ্ণ যুক্তি, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলি কষ্টকল্পিত ও অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। লেখক দাবী করেছেন, একটি আকস্মিক কথা, মাংসপেশীর একটি মোচড় বা চোখের একটু দৃষ্টি থেকেই মানুষের মনের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখা যায়। যে মানুষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে সুশিক্ষিত তাকে ঠকানো অসম্ভব। তার সিদ্ধান্তগুলি ইউক্লিডের প্রতিপাদ্যের মতই অভ্রান্ত। কোন নূতন লোকের কাছে তার সিদ্ধান্তগুলি বিস্ময়কর মনে হবেই এবং যতক্ষণ তার অনুসৃত পদ্ধতিগুলি সে না শিখবে ততক্ষণ তাকে একজন যাদুকর বলেই মনে করবে।
লেখক বলেছেন, একজন যুক্তিবিদ একফোঁটা জল থেকে আতলান্তিক মহাসাগর বা নায়েগ্রা জলপ্রপাতের সম্ভবনাকে অনুমান করতে পারে, যদিও সে ও দুটোর একটাকেও দেখে নি, বা কারও থেকে ওদের সম্পর্কে কিছু শোনেও নি। সব জীবনই একটি প্রকাণ্ড শৃঙ্খল যার একটি গাঁটকে দেখতে পেলেই সমগ্রটাকে জানা যায়। অন্য সব শিল্প-কলার মত ‘অনুমান ও বিশ্লেষণ বিজ্ঞান’কেও সুদীর্ঘ অধ্যবসায় দ্বারাই আয়ত্ব করা যায়, এবং যেহেতু জীবন যথেষ্ট দীর্ঘস্থায়ী নয় সেজন্য কোনও মানুষের পক্ষেই এবিষয়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কোন সমস্যার নৈতিক ও মানসিক দিকগুলি অত্যন্ত বিঘ্নসঙ্কুল; কাজেই ছোটখাট সমস্যাগুলিকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত।
কোন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে একনজরেই জানবার চেষ্টা করতে হবে তার অতীত ইতিহাস, তার বাণিজ্য বা অন্য জীবিকার পরিচয়। এরকম চেষ্টা প্রথমে বোকামির পরিচায়ক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ফলে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ক্ষুরধার হয় এবং কোথায় চোখ ফেলতে হবে বা কি দেখতে হবে সে শিক্ষা লাভ করা যায়। একটা মানুষের হাতের নখ, তার কোটের আস্তিন, জুতো, ট্রাউজারের হাঁটুর কাছটা, তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের উপরকার কড়া, তার কথা, তার শার্টের কফ—এর প্রত্যেকটি থেকেই মানুষের জীবিকার পরিচয় পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়। কোন একটি ক্ষেত্রে এর সবগুলি প্রয়োগ করেও একজন যোগ্য অনুসন্ধানকারী সমস্যার উপর আলোকপাত করতে অসমর্থ হবেন এটা একেবারেই অকল্পনীয়।
‘কী অবর্ণনীয় বাগাড়ম্বর!’ চীৎকার করে বলতে বলতে আমি পত্রিকাটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিলাম। ‘জীবনে এরকম বাজে লেখা কখনও পড়ি নি।’
‘কোনটার কথা বলছ?’ শার্লক হোলস প্রশ্ন করল।
প্রাতরাশ খেতে খেতে ডিমের চামচে দিয়ে দেখিয়ে আমি বললাম, ‘কেন, এই প্রবন্ধটা। মনে হচ্ছে তুমি এটা পড়েছ, কারণ এটার নীচে দাগ দিয়েছ। অস্বীকার করছি না যে লেখাটায় মুন্সিয়ানা আছে; আমি অবশ্য বিরক্ত হয়েছি। এটা নিশ্চয়ই কোন আরামকেদারাশ্রয়ী আলস্যবিলাসীর উদ্ভট মতবাদ। নিজের নির্জন পড়ার ঘরে বসে তিনি এই সব অবাস্তব কথার জাল বোনে। এসব একেবারেই অবাস্তব। আমার ইচ্ছা করে, পাতাল-রেলের কোন তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ঠেলে দিয়ে তাকে বলি, এবার সহযাত্রীদের জীবিকার পরিচয়গুলি দাও তো বাপধন। তার সঙ্গে আমি হাজার পাউণ্ড বাজী লড়তে রাজী।’
হোমস শান্তভাবে বলল, ‘তাতে তোমার টাকাটাই খোয়াবে। আর প্রবন্ধটার কথা যদি বল, ওটা আমি লিখেছি।’
‘তুমি!’
‘হ্যাঁ। পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের কাজে আমার একটা ঝোঁক আছে। সে-সকল মত আমি ওখানে প্রকাশ করেছি, এবং যেগুলিকে তুমি অত্যন্ত অবাস্তব বলে মনে করছ, সেগুলো অত্যন্ত বাস্তবসম্মত—এত বাস্তব যে আমার রুটি-মাখনের জন্য আমি ওগুলোর উপরই নির্ভর করি।‘
‘কিন্তু কেমন করে?’ নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করলাম।
‘দেখ, আমারও একটা জীবিকা আছে। আমার ধারণা এ ব্যাপারে পৃথিবীতে আমি একক। আমি একজন পরামর্শদাতা গোয়েন্দা। অবশ্য সেটা কি জিনিস তুমি বুঝবে কি না জানি না। এই লণ্ডনে অনেক সরকারী ও বে-সরকারী গোয়েন্দা আছে। এরা যখন পেরে ওঠে না, তখন আমার কাছে আসে, আমি তাদের পথ বাতলে দি। তারা সংগৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি আমার কাছে পেশ করে, অপরাধ-ইতিহাসের যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছি তারই সাহায্যে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হই। বিভিন্ন দুষ্কর্মের মধ্যে একটা মূলগত মিল আছে; ফলে হাজারটা দুষ্কর্মের বিবরণ তুমি উদ্ধার করতে পারবে না এটা হতেই পারে না। লেস্ট্রেড একজন নামকরা গোয়েন্দা। সম্প্রতি একটা জালিয়াতির মামলা নিয়ে বড়ই গোলমালে পড়েছিল তাই আমার কাছে এসেছিল।’
‘আর অন্যরা?’
‘বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পাঠায় বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা। কোন ব্যাপার নিয়ে গোলমালে পড়লেই তারা আলোকপাতের জন্য আসে। আমি তাদের কাহিনী মন দিয়ে শুনি, তারা আমার মন্তব্যগুলি মন দিয়ে শোনে, তারপর আমার ফীটা পকেটস্থ করি।‘
আমি বললাম, ‘তুমি কি বলতে চাও, সচক্ষে সব বিবরণ দেখেও যে রহস্যের কিনারা তারা করতে পারে না, তুমি এই ঘরে বসেই তার গিট খুলতে পার?’
‘ঠিক তাই। এবিষয়ে আমার কেমন একটা অন্তর্দৃষ্টি আছে। কখনও সখনও এমন কেস আসে যেটা একটু বেশী জটিল। তখন অবশ্য আমাকেও বাইরে বেরিয়ে নিজের চোখে সবকিছু দেখতে হয়। দেখ, আমার কতকগুলি বিশেষ জ্ঞান আছে যেগুলি প্রয়োগ করে আমি আশ্চর্য ফল পাই। এই প্রবন্ধে অনুমানের যেসব নিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেগুলি তোমার ঘৃণার উদ্রেক করেছে সেগুলি কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমার কাছে খুবই মূল্যবান। পর্যবেক্ষণ আমার দ্বিতীয় প্রকৃতি। প্রথম দিন সাক্ষাতের সময় আমি যখন বললাম যে তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ, তখন তুমি বিস্মিত হয়েছিলে।‘
‘নিশ্চয় কেউ তোমাকে বলেছিল।‘
‘মোটেই তা নয়। আমি স্রেফ জানতে পেরেছিলাম যে তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে চিন্তা-স্রোত এত দ্রুতগতিতে আমার মনে প্রবাহিত হয়ে যে অন্তবর্তী ধাপগুলো চিন্তা না করেই আমি সরাসরি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। অবশ্য সে ধাপগুলো তো থাকেই। চিন্তার ধারাটা এই রকম ছিল; এই ভদ্রলোক ডাক্তার, অথচ চালচলনে সামরিক ভাবভঙ্গি, কাজেই নিশ্চয় সামরিক ডাক্তার। তিনি নিশ্চয় সম্প্রতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে এসেছেন, কারণ তার মুখমণ্ডল বাদামী, অথচ ওটা তাঁর চামড়ার স্বাভাবিক রং নয় যেহেতু তার কব্জী দুটো সাদা। তাঁর বিষন্ন মুখ দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট ও রোগ ভোগ করেছেন। তাঁর বাঁ হাতটায় আঘাত লেগেছে কারণ সে হাতটা তিনি অস্বাভাবিকভাবে আড়ষ্ট করে রাখেন। গ্রীষ্মমণ্ডলের কোন্ স্থানে একজন ইংরেজ সামরিক ডাক্তারের পক্ষে এরকম কষ্ট ভোগ করা সম্ভব? আর কোথায়ই বা তাঁর হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে? নিশ্চয় আফগানিস্থানে। এই পুরো চিন্তাধারাটি কিন্তু এক সেকেণ্ডও সময় নেয় নি। আমি তখনই মন্তব্য করলাম, তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ, আর তুমিও বিস্মিত হলে।‘
হেসে বললাম, ‘তুমি বুঝিয়ে বলার পরে অবশ্য ব্যাপারটা সরলই মনে হচ্ছে। এডগার এলেন পো-র ডিউপিনের কথা মনে পড়ছে। গল্পের বাইরেও এ ধরনের চরিত্র থাকে আমার জানা ছিল না।‘
শার্লক হোমস উঠে পাইপটা ধরাল। তারপর বলতে লাগল, ‘তুমি নিঃসন্দেহে ভাবছ যে ডিউপিনের সঙ্গে তুলনা করে আমার প্রশংসাই করছ। কিন্তু আমার মতে ডিউপিন খুব সাধারণ স্তরের মানুষ। পনের মিনিট চুপ করে থেকে হঠাৎ একটা যুৎসই মন্তব্য করে বন্ধুকে চমকে দেওয়ার যে কৌশল তিনি দেখান সেটা আসলে কিন্তু বড়ই লোক-দেখানো ও কৃত্রিম। অবশ্য বিশ্লেষণী শক্তি তাঁর ছিল, কিন্তু পো তাঁকে যতখানি বড় বলে কল্পনা করেছেন আসলে তিনি তা নন।‘
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি গাবোরিয়-র বই পড়েছ? তোমার মতে লিকক কি একজন ভাল গোয়েন্দা?’
শার্লক হোমস ঠাট্টার ভঙ্গীতে নাকটা টানল। তারপর রাগতঃ স্বরে বলল, ‘লিকক তো একটা মহা আনাড়ি। একটা গুণই তার ছিল,–উৎসাহ। ও বই পড়ে তো আমি কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপার কি না, একটি অজানা কয়েদিকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি ও কাজ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই করতে পারতাম। লিককের লেগেছিল ছ’মাস বা ওই রকম সময়। গোয়েন্দাদের কি বাদ দেওয়া উচিত সেটা শেখবার মত পাঠ্য-পুস্তক অবশ্য ও বইখানা হতে পারে।‘
যে দুটি চরিত্র আমার প্রিয় তাদের সম্পর্কে এই ধরনের উদ্ধত উক্তি করায় আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হলাম।
জানালার কাছে উঠে গিয়ে বাইরের জনবহুল রাস্তার দিকে তাকালাম। মনে মনে বললাম, ‘লোকটি চতুর বটে, তবে বড় দাম্ভিক।‘
যে দুঃখের সঙ্গেই সে বলল, ‘আজকাল আর অপরাধও নেই, অপরাধীও নেই। আমাদের কাজে এখন আর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয় না। আমি জানি, আমার মধ্যে ও বস্তুটি আমাকে বিখ্যা করবার পক্ষে পর্যাপ্তই আছে। অপরাধ উদঘাটনের কাজে যতটা পড়াশুনা এবং মেধা আমি প্রয়োগ করেছি আজ পর্যন্ত অপর কেউ তা করে নি। কিন্তু লাভ কি হল? ধরবার মত কোন অপরাধই ঘটে না। আর যাও বা ঘটে এতই জলের মত পরিষ্কার যে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের যে কোন অফিসারই তার কিনারা করতে পারে।
লোকটির কথাবার্তার এই আত্মম্ভরিতা ক্রমেই আমাকে বিরক্ত করে তুলল কাজেই ভাবলাম এ প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
একটি দীর্ঘদেহ সাদাসিধে পোশাকের মানুষ রাস্তার অপর দিকে ধরে বাড়ির নম্বর দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। তার হাতে একখানা নীল রঙের বড় খাম। নিশ্চয় কোন সংবাদ নিয়ে এসেছে। তাকে দেখিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘লোকটি না জানি কি খুঁজে বেড়াচ্ছে।‘
শার্লক হোমস বলল, ‘নৌবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সার্জণ্টের কথা বলছ?’
‘খালি বড়াই আর দম্ভ!’ মনে মনে ভাবলাম। ‘ভাল করেই জানে যে ওর এই অনুমানকে আমি পরখ করে দেখতে পারব না।‘
এ কথাগুলি ভাবতে না ভাবতেই লোকটি আমাদের দরজাতেই তার প্রার্থিত নম্বরটি দেখতে পেয়ে দ্রুতপায়ে রাস্তাটা পার হল। আমাদের কানে এল দরজায় ধাক্কার শব্দ, নীচে একটি গম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠবে ভারী পদধ্বনি।
ঘরের ভিতরে ঢুকে বন্ধুর হাতে চিঠিখানা দিয়ে সে বলল, ‘মিঃ শার্লক হোমসের জন্য।‘
এতক্ষণে তার মুখোশ খুলে দেবার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। আচমকা একটা কথা বলে ফেলবার সময় এরকমটা যে ঘটতে পারে তা তো আর সে ভাবতে পারে নি। সরাসরি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোথায় কাজ করেন জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’
রূঢ়কণ্ঠে সে জবাব দিল, ‘সেনাবিভাগে, ইউনিফর্মটা মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।‘
ঈর্ষার দৃষ্টিতে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি ছিলেন?’
‘সার্জেণ্ট স্যার। রাজকীয় নৌবাহিনীর পদাতিক বাহিনী স্যার। কোন জবাব দেবেন না? ঠিক আছে স্যার।‘
দুটো গোড়ালি ঠুকে হাত তুলে সে স্যালুট করল। তারপরই চলে গেল।
০৩. লরিস্টন গার্ডেন্স-এর রহস্য
স্বীকার করছি, আমার সঙ্গীর মতবাদের বাস্তবতার এই নতুন প্রমাণ আমাকে বিস্মিত করেছিল। তার বিশেল-ষণী শক্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গেল। একটা । সন্দেহ কিন্তু তখনও উঁকি দিতে লাগল যে, আমাকে চমকে দেবার জন্য সমস্ত ব্যাপারটাই আগে থেকে সাজানো, অবশ্য আমাকে চমকে দিয়ে তার কি লাভ হবে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। তাঁকিয়ে দেখি, সে চিঠিটা পড়ে ফেলেছে। তার চোখে এমন একটা শূন্য অনুজ্জ্বল দৃষ্টি যে দেখলেই মনে হয় সে তার মনের মধ্যে ডুবে গেছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, ওটা তুমি জানলে কেমন করে?’
সে যেন একটু চটেই বলল, ‘কোনটা?’
‘কেন? ওই লোকটা যে নৌবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট, সেটা?’
‘এসব তুচ্ছ কথা বলবার মত সময় নেই, ‘কোনটা?’
‘রূঢ় কণ্ঠেই জবাব সে জবাব দিল। তারপরই হেসে বলল, ‘এই রূঢ়তার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। আমার চিন্তার সুতোটা তুমি ছিঁড়ে ফেলছিলে। কিন্তু তুমি কি সত্য সত্যই বুঝতে পারো নি যে লোকটি নৌবিভাগের সার্জেন্ট ছিল?’
‘মোটেই না।’
‘আমি কি করে জানলাম সেটা বোঝানোর চাইতে ওটা অনেক সহজ। তোমাকে যদি বলা হয় দুই আর দুইয়ে যে চার হয় সেটা প্রমাণ কর, তাহলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই একটু কঠিন মনে হবে, অথচ তুমি নিশ্চিত জান যে এটা সত্য। রাস্তার ওপাশে থাকতেই লোকটির হাতের উল্টো পিঠে একটা বড় নীল নোঙরের উল্কি আমার চোখে পড়ে-ছিল। তাতেই সমুদ্রের গন্ধ পেলাম। তার আচরণের এবং দুদিকে পাকানো গোঁফ ছিল সামরিক গন্ধ। কাজেই পাওয়া গেল নৌবিভাগ। লোকটির মধ্যে কিছুটা ভারিক্কি-য়ানা এবং প্রভুত্বের ভঙ্গীও আমার চোখ এড়ায় নি। যেভাবে সে মাথাটা উঁচু করে ছিল এবং হাতের বেতটা ঘোরাচ্ছিল সেটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ।তার মুখে চোখে একটা স্থির, সম্ভ্রান্ত, মধ্যবয়স্ক মানুষের ছাপ—এই সব দেখেই মনে হল সে সার্জেন্ট ছিল।’
‘চমৎতার।’ আমি সোল্লাসে বলে উঠলাম।
হোমস বলল, ‘অতি সাধারণ।’ যদিও তার কথা শুনে আমার মনে হল, আমার বিস্ময় ও প্রশংসা শুনে সে খুশিই হয়েছে। ‘এইমাত্র বলছিলাম যে আজকাল আর অপরাধী নেই। মনে হচ্ছে-আমি ভুল বলেছি। এটা দেখ! প্রাক্তন সার্জেন্টের দেওয়া চিঠিখানা সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।
‘সে কি।’ চোখ বুলিয়েই আমি চীৎকার করে উঠলাম, ‘এ যে সাংঘাতিক।’
সে শান্তভাবে বলল, ‘একটা অসাধারণ কিছু বলে মনে হচ্ছে। তুমি কি চিঠিটা আমাকে পড়ে শোনাবে?’
নীচের চিঠিটা আমি তাকে পড়ে শোনালামঃ
প্রিয় মিঃ শার্লক হোমস,
৩, লরিস্টন গার্ডেন্সে গত রাতে একটি খারাপ ঘটনা ঘটেছে। লরিস্টন গার্ডেন্স বেরিয়েছে ব্রিক্সটন রোড থেকে। প্রায় দুটো নাগাদ আমাদের বীটের পুলিশ সেখানে একটা আলো দেখতে পায়। যেহেতু বাড়িটা তখন খালি ছিল, তার মনে সন্দেহ দেখা দেয়। গিয়ে দেখে দরজা খোলা আর আসবাব-পত্রহীন সামনের ঘরে জৈনক ভদ্র-লোকের মৃতদেহ পড়ে আছে।লোকটি সুসজ্জিত। তার পকেটে একটা কার্ড পাওয়া গেছে। তাতে লেখা ‘এনক জে, ড্রেবার, ক্লিভল্যান্ড, ওহিও, ইউ, এস, এ,।’ কোন—রকম ডাকাতি হয় নি এবং ভদ্রলোক কেমন করে মারা গেলেন তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ঘরের মধ্যে রক্তের দাগ আছে, কিন্তু লোকটির দেহে আঘাতের কোন চিহ্নই নেই। তিনি কি করে ঐ খালি বাড়িতে এলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। বস্তুতঃ সমস্ত ব্যাপারটাই যেন ধাঁধার মত। বারোটার আগে যে-কোন সময় আপনি যদি ঐ বাড়িতে আসতে পারেন, আমাকে ওখানেই পাবেন। আপনার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সব কিছুই যেমনটি ছিল তেমনটি রেখে দিয়েছে। যদি আসতে না পারেন, আরও বিস্তারিত বিধরণ জানাব। দয়া করে যদি আপনার মতামত পাঠান তাহলে সেটাকে আপনার সসীম অনূগ্রহ বলে বিবেচনা করব।
ভবদীয়
টোবিয়াস প্রেগসন
বন্ধু মন্তব্য করল, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসারদের মধ্যে সবচাইতে চালাক-চতুর। সে এবং লেস্ট্রেডই হচ্ছে মন্দের ভাল। দু’জনই দ্রুতবুদ্ধি এবং উদ্যমশীল, কিন্তু গতানুগতিক-ভয়ানক গতানুগতিক। তাদের মধ্যে ব্রেধরেষিও আছে। দুই পেশাদার সুন্দরীর মতই তারা পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাকার। এই কেসে তাদের দুজনের হাতেই যদি কিছুটা সুতো ধরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ভারি মজা হবে।’
তার শান্তভাবে কথা বলার রকম দেখে আমি বিস্মিত হলাম। চীৎকার করে বললাম, ‘আর এক মহুর্তেও নষ্ট করা উচিত নয়। তোমার জন্য একটা গাড়ি ডেকে দেব কি?’
‘আমি যাব কি না তাই তো বুঝতে পারছি না।আলসেমি যখন আমার উপর ভর করে তখন আমি একে-বারে আলসের গুরুঠাকুর। অবশ্য অন্য সময় আমি খুব চটপটেও হতে পারি।’
‘সে কি? তুমি তো এই রকম একটা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলে।’
‘দেখ ভাই, এতে আমার কি লাভ হবে? ধরা যাক, আমি রহস্যটা উদঘাটন করলাম। ঠিক জানবে তখন ঐ গ্লেগসন, লেস্ট্রেড কোম্পানিই সব বাহাদুরিটা পকেটস্থ করবে। বেসরকারী লোকদের এই তো বরাত।’
‘কিন্তু তিনি তো তোমার সাহায্য চেয়েছেন।’
‘তা চেয়েছে। সে জানে বুদ্ধিতে আমি তার থেকে বড় আর আমার কাছে সেকথা সে স্বীকারও করে। কিন্তু কোন তৃতীয় ব্যক্তির কাছে সে কথা স্বীকার করার আগে সে বরং তার জিভটাই কেটে ফেলে দেবে। যাহোক, তবু যাওয়াই যাক। দেখে আসি ব্যাপারটা। আমার বড়শিতে আমি মাছ ধরব। আম কিছু না পাই, তাদের দেখে একটু হাসতে পারব। চল।’
ওভারকোটটা গায়ে চড়িয়ে এমন তাড়াহুড়ো করতে শুরু করল যে মনে হল, উদাসীনতার ভাব কাটিয়ে উদ্যম-শীলতা তার উপর ভর করেছে।
‘তোমার টুপিটা নিও,’ সে বলল।
‘তুমি বলছ আমাকে যেতে?’
‘হ্যাঁ। অবশ্য যদি এর চেয়ে বড় কাজ কিছু না থাকে।’
এক মিনিট পরেই একটা ভাড়াটে গাড়ি নিয়ে আমরা দ্রুত ছুটে চললাম ব্রিকসটন রোডের দিকে।
কুয়াসাঢাকা মেঘাচ্ছন্ন সকাল। বাড়িগুলোর মাথার একটা বাদামী আবরণ ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে, যেন নীচে মেটে রঙের রাস্তায় ছায়া পড়েছে। আমার সঙ্গী খুব খোশ মেজাজে চলেছে। আমি চলেছি নীরবে। একে এই বিষণ আবহাওয়া, তার উপর চলেছি একটি বেদনাদায়ক কাজে। আমার মন একেবারেই নেতিয়ে পড়েছে।
হোমস তখন একমনে সঙ্গীতপ্রসঙ্গে কথা বলে চলেছে। তাকে বাধা দিয়েই বললাম, ‘হাতের কাজে খুব মন দিচ্ছ বলে তো মনে হয় না।’
সে জবাব দিল, ‘এখনও কোন তথ্যই পাই নি। সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগৃতীত হবার আগেই মত গঠন করা মস্ত ভূল। তাতে বিচারশক্তি প্রভাবিত হয়।’
আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘শীঘ্রই তথ্য পেয়ে যাবে। এইটেই ব্রিকসটন রোড, আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে ঐটেই সেই বাড়ি।’
‘ঠিক। কোচম্যান, গাড়ি থামাও।’ তখনও আমরা শ’খানেক গজ দুরে। কিন্তু তার নির্দেশে সেখানেই নামতে হল। বাকিটা হেঁটে গেলাম।
৩ নম্বর লরিস্টন গার্ডেন্স একটা অশুভ ভয়ংকর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে চারটে বাড়ি রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এটা তাদেরই একটা। চারটে বাড়ির দুটোয় লোক আছে, দুটো খালি। শেষের দুটো বাড়িতে দেখা যাচ্ছে তিন সারি খোলা জানালা, আর এখানে-ওখানো ছিটানো-ছড়ানো কিছু কিছু ছোট গাছের একটা বাগান বাড়িগুলোকে রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। কাদা ও পাথরের একটা হলদেটে সংকীর্ণ পথ বাগানের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। রাতের বৃষ্টিতে সমস্ত জায়গাটাই সত্যিসেতে। বাগানের চারধারে তিন-ফুট উঁচু ইটের পাঁচিল। তার উপরে একটুকরো কাঠের রেল বসানো দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন হৃষ্টপুষ্ট পুলিশ কনেস্টবল দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভীড় করে আছে পথচারীদের একটা ছোট দঙ্গল। বকের মত গলা বাড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তারা ভিতরে কি ঘটেছে সেটা দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
আমি ভেবেছিলাম, শার্লক হোমস সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে ঢুকে রহস্য সমাধানের লেগে যাবে। সে কিন্তু সেদিক দিয়েই গেল না। সম্পূর্ণ অনামনস্কভাবে সে ফুটপাতে পায়চারি করতে লাগল। কখনও মাটির দিকে, কখনও আকাশের দিকে, উল্টো দিকের বাড়িগুলোর দিকে, আবার কখনও বা রেলিংএর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সবকিছু দেখে ধীরে ধীরে পথটা ধরে—বরং বলা উঁচিত পথের দু’ধারের ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। চোখ দুটো সারাক্ষণই মাটির দিকে নিবন্ধ। দু’বার থামল। একবার তার মুখে হাসি দেখলাম। একটা খুশির উল্লাসও
যেন কানে এল। ভিজে আঠালো মাটিতে অনেক পায়ের ছাপ পড়েছে। কিন্তু এপথে তো অনেক পুলিশ যাতায়ত করছে, সুতরাং থেকে আমার সঙ্গী যে কি জিনিসের আশা করছে আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তার দ্রুত দর্শন ক্ষমতার এমন সব অসাধারণ প্রমাণ আমি পেয়েছি যাতে আমি নিঃসন্দেহ যে সে এমন অনেক কিছু দেখতে পায় যা আমাদের কাছে থাকে লুকনো।
বাড়ির দরজায়ই একটি লম্বা, সাদা-মুখ, শনের মত চুলওয়ালা লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হল। তার হাতে একটা নোট বুক। ছুটে এসে সে মহা উৎসাহে আমার সঙ্গীর করমর্দন করে বলল. ‘আপনি এসে পড়ায় অনুগৃহত হলাম। দেখুন, কোন কিছুই আমি স্পর্শ করতে দেই নি।’
‘ঐটে ছাড়া!’ পথটা দেখিয়ে আমার বন্ধু বলল। ‘একপাল মোষ ওখান দিয়ে হেঁটে গেলেও এর চাইতে জগাখিচুড়ি হোত না। গ্রেগসন, এটা হতে দেবার আগেই তোমার নিজস্ব সিন্ধান্তে নিশ্চয়ই উপনীত হয়েছিলে?
গোয়েন্দাপ্রবর তার কথাটা এড়িয়ে বলল, ‘বাড়ির ভিতরে আমার অনেক কাজ ছিল। আমার সহকর্মী ভিতরে আমার অনেক কাজ ছিল। এটা দেখবার ভার তার উপরেই ছিল।’
হোমস আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের ভঙ্গীতে ভুরু দুটো তুলে বলল, ‘তুমি এবং লেস্ট্রেড যখন আসরে নেমেছ তখন আর তৃতীয় ব্যক্তির করবার কিছু থাকতে পারে না।
আত্মসন্তুষ্টিতে দুই হাত ঘসতে ঘসতে গ্রেগসন বলল, ‘যাকিছু করণীয় সবই তো করেছি বলে মনে হয়। যদিও কেসটা অদ্ভুত আর এ ধরনের কেস আপনি যে ভাল বাসেন তাও জানি।’
শার্লক হোমস প্রশ্ন করল, ‘তুমি তো ভাড়াটে গাড়িতে এখানে আসনি?’
না।’
‘লেস্ট্রেডও নয়?’
‘না স্যার।’
‘তাহলে চল ঘরটা একবার দেখি। ‘ এই অবান্তর মন্তব্য করে সে বাড়ির ভিতর ঢুকল। পিছনে গ্রেগসন। তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
কাঠের পাটাতন-করা ধুলোভরা একটা প্যাসেজ রান্না-ঘর ও অফিসের দিকে চলে গেছে। বাঁয়ে ও ডাইনে দুটো দরজা। দেখেই বোঝা যায় একটা দরজা বেশ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ বন্ধই আছে। অপর দরজাটি খাবার ঘরের। রহস্যময় ঘটনাটি ঘটেছে সেই ঘরেই। হোমস ভিতরে পা বাড়াল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। মৃত্যুর উপ-স্থিতির অনুভূতিতে আমার মন আচ্ছন্ন।
একটা বড় চৌকোণা ঘর। আসবাবপত্র কিছুই নেই বলে আরও বড় দেখাচ্ছে। দেওয়ালে ঝকমকে সস্তা কাগজ মোড়। ছ্যাতলা পড়ে জায়গায় জায়গায় দাগ ধরেছে। কোথাও বা অনেকটা কাগজ খুলে গিয়ে ঝুলে পড়েছে।ফলে নীচেকার হলদে প্লাসটার বেরিয়ে পড়েছে। দরজাটার উল্টো দিকে একটা সৌখিন অগ্নিকুন্ড, তার উপরে নকল শ্বেত পাথরের ম্যান্টেলপিস। তার এককোণে একটা লাল মোমবাতির শেষটুকু বসানো। ঘরের একমাত্র জানালায় এত ধুলো-ময়লা জমেছে যে ঘরের আবছা আলোয় সব কিছুতেই একটা হলদে আভা পড়েছে। সারা ঘরে ধুলোর আস্তরণ পড়ায় সেই হলুদ আভায় আরও বেশী করে চোখে লাগছে।
এ সবই আমি পরে লক্ষ্য করেছি। তখনকার মত আমার সব মনোযোগ পড়ল একটিমাত্র ভয়াবহ নিশ্চল মনু্ষ্যদেহের প্রতি। দেহটি মেঝের পড়ে রয়েছে। দৃষ্টি-হীন শূন্য চোখ যেন তাকিয়ে আছে বিবর্ণ শিলিংএর দিকে। লোকটির বয়স হবে বছর তেতাল্লিশ, মাঝারি গড়ন, চওড়া কাধ, কালো কোঁকড়ানো চুল, ছোট ঘন দাঁড়ি। পরনে মোটা কাপড়ের কোটও ওয়েস্টকোট। হালকা রঙের ট্রাউজার, চকচকে কলার ও কফ। ব্রাশ-করা তকতকে একটা টপ হ্যাট তার পাশেই মেঝের উপর পড়ে আছে। দুই হাত মুষ্টিবন্ধ। দুই বাহু, ছড়ানো, দেহের নিষ্মাংশ একসঙ্গে জড়ানো। দেখে মনে হয় মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার শক্ত মুখে বিভীষিকার ছায়া। আমার মনে হল সে মুখে এত তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠেছে যা আমি কখনও মানুষের মুখে দেখি নি। দেহের এই উৎকট ভয়ংকর বিকৃতির সঙ্গে নীচু কপাল, থ্যাবড়া নাক ও পুরু-ঠোঁট যুক্ত হয়ে একটি বানর-সুলভ আকৃতি গড়ে উঠেছে। তার দেহের দুমড়ানো অস্বাভিক ভঙ্গীর জন্য সেটা যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা ধরনের মৃত্যু আমি দেখেছি,কিন্তু লন্ডনের উপ-কণ্ঠবর্তী একটি প্রধান রাজপথের এই অন্ধকার ভয়ংকর ঘরে তার যে ভয়াবহ রূপ দেখলাম তার আর কখনো দেখি নি।
ক্ষীণকায় ভোঁদড়-সূলভ আকৃতির লেস্ট্রেড দরজায়ই দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দুজনকেই সে অভ্যর্থনা করল।
বলল ‘এই কেস নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যাবে স্যার। এমনটি আমি আর দেখি নি। আর আমি কিন্তু ছেলে-মানুষ নই।’
গ্রেগসন বলল, ‘কোন সূত্র পাওয়া গেল?’
লেস্ট্রেড জবাব দিল, ‘কিচ্ছু না।’
শালক হোমস মৃতদেহের কাছে এগিয়ে হাঁট গেড়ে বসে ভাল করে পরীক্ষা করল। চারদিকের চাপ চাপ রক্তের দাগ দেখিয়ে বলল, তোমরা ঠিক জান কোন ক্ষত নেই?’
উভয় গোয়েন্দাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘নিশ্চয়!’
‘তাহলে এ রক্ত নিশ্চয় কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির—সম্ভবত হত্যারারীর, অবশ্য যদি হত্যাকান্ড সত্যিই ঘটে থাকে। এ প্রসঙ্গে ’০৪ সালে ইউট্রেকট-এ ভ্যান জ্যানসেনের মৃত্যুর পারিপাশ্বিক ঘটনার কথা আমার মনে পড়েছে। গ্রেগসন, সে কেসটার কথা তোমার মনে আছে?’
‘না স্যার।’
‘পড়ো-পড়া উচিত। সূর্যের নীচে নতুন কিছু ঘটে না। যা ঘটেছে তা আগেও ঘটেছে।’
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার হালকা আঙুলগুলিও মৃতদেহের সর্বাঙ্গে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে—হাত বুলোচ্ছে, চাপ দিচ্ছে, বোতাম খুলছে, পরীক্ষা করছে। কিন্তু চোখে কোন সুদুরের আভাষ। পরীক্ষার কাজ অত্যন্ত দ্রুত সমাপ্ত হল। এত তাড়াতাড়ি যে এরুপ পুংখানুপুংথভাবে কাজ করা যায় তা ভাবাই যায় না। সব শেষে সে মৃতের ঠোঁট দুটি শুকল, আর দেখল তার পেটেন্ট লেদারের জুতোর তলা।
প্রশ্ন করল, ‘একে একেবারেই সরানো হয়নি তো?’
‘পরীক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন হয়েছে তার বেশী নয়।’
‘এবার একে মর্গে পাঠাতে পার’, সে বলল। ‘আর কিছু জানবার নেই।’
একটা স্ট্রেচার ও চারজন লোক মোতায়েনই ছিল। গ্রেগসনের নির্দেশে তারা ঘরে ঢুকে আগন্তুককে তুলে নিয়ে গেল। তাকে তুলতেই একটা আংটি মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ল। লেস্ট্রেড সেটাকে মুঠো করে তুলে হী করে দেখতে লাগল।
‘নিশ্চয় এখানে কোন স্ত্রীলোক ছিল’ সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘এটা কোন স্ত্রীলোকের বিয়ের আংটি।’
হাতের তালুতে রেখে আংটিটা সকলেই দেখল। তাকে ঘিরে ধরে আমরাও সেটা দেখলাম। কোন সন্দেহ নেই যে এই খাঁটি সোনার বস্তুটি একসময় কোন বিয়ের কনের আঙুলে শোভা পেয়েছে।
গ্রেগসন বলল, ‘ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠল। ঈশ্বর জানেন, আগেই যথেষ্ট ঘোরালো ছিল।’
হোমস বলল, ‘তুমি কি ঠিক জান, এর ফলে ব্যাপারটা সরলতর হল না? ওটাকে হী করে দেখে কিছু জানা যাবে না। তার পকেটে কি কি পাওয়া গেছে?’
সিঁড়ির একটা নিচু ধাপের উপর বোঝাই করা এক-গাদা জিনিসপত্র দেখিয়ে গ্রেগসন বলল, ‘ওখানে সব আছে। লন্ডনের বার্ড কোম্পানির একটা সোনার ঘড়ি, নং ৯৭১৬৩। বেশ ভারী নিরেট সোনার অ্যালবার্ট চেন। কারুকার্ষ-করা সোনার আংটি। সোনার পিন-কুকুরের মস্তকাকৃতি, চোখ দৃষ্টিতে চুনী বসানো। রাশিয়ান লেদারের কার্ড-কেস, তাতে ক্লিভল্যান্ডের এনক জে, ড্রেবারের কার্ড ভরা। তারই অদ্য অক্ষর ই, জে, ডি, লেখা জমাকাপড়ে। কোন টাকার থলি নেই, কিন্তু সাত পাউন্ড তের শিলিং খুচরো ছিল। বোকাশিওর “ডেকা-মেরন” এর একখানা পকেট-সংস্করণ, তার প্রথম পাতায় জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনের নাম। দু’খানি চিঠি—ই, জে, ড্রেবার ও জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনকে লেখা।’
‘কোন ঠিকানায়?’
‘আমেরিকান এক্সচেঞ্জ, স্ট্যান্ড না চাওয়া পর্যন্ত থাকবে। দু’খানিই এসেছে “গুইওন স্টীমশিপ কোম্পানি” থেকে। তাদের জাহাজ যে লিভারপুল থেকে ছাড়া হয়েছে তারও উল্লেখ আছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই ভাগ্য-হীন লোকটির শীঘ্রই নউ ইয়র্কে ফিরবার কথা।’
‘এই স্ট্যাঙ্গারসন সম্পর্কে কোন খোঁজ-খবর করেছ?’
গ্রেগসন বলল, ‘সঙ্গে সঙ্গেই করেছি স্যার। সবগুলো খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। একজন লোককে পাঠিয়েছি আমেরিকান এক্সচেঞ্জ-এ। সে এখনও ফেরে নি।’
‘ক্লিভল্যান্ডে কাউকে পাঠিয়েছ?’
‘সকালেই টেলিগ্রাম করে দিয়েছি।’
‘তাতে কি লিখছে?’
‘অবস্থার বিররণ দিয়ে বলেছি, আমাদের পক্ষে সহায়ক কোন সংবাদ জানালে খুশি হব।’
‘তোমারা চুড়ান্ত মনে কর এরকম কোন খবর জানতে চেয়েছ কি?’
‘স্টারঙ্গারসনের খবর জানতে চাওয়া হয়েছে।’
‘আর কিছু নয়? এমন কোন ঘটনা কি নেই যার উপর কেসটা ঝুলে আছে? আর একবার টেলিগ্রাম করতে পার না?’
আহত গলায় গ্রেগসন বলল, ‘আমার যা বলবার সবই বলেছি।’
শার্লক হোমস মুখ টিপে হাসল। তারপর কি যেন বলতে যাবে এমন সময় সামনের ঘর থেকে খুব খুশি-খুশি ভাবে হাত দুটো ঘসতে ঘসতে লেস্ট্রেড হল-ঘরে ঢুকল।
‘মিঃ গ্রেগসন,’ সে বলল, ‘এই মাত্র একটা খুব বড় রকমের আবিষ্কার করে ফেলেছি। দেওয়ালটাককে ভাল করে পরীক্ষা না করলে সেটা ধরাই পড়ত না।’
কথা বলবার সময় এই ছোটখাটো লোকটির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। সমকর্মীর উপর একহাত নেবার আনন্দ যেন তার চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে।
‘আমার সঙ্গে এস’ বলে সে দ্রুত সেই ঘর থেকে ফিরে গেল। ভয়ংকর লোকটির সরিয়ে নেওয়ায় সে ঘরের আবহাওয়া তখন অনেকটা হাল্কা হয়েছে। ‘এবার, ওইখানে দাঁড়াও!’
‘জুতার তলায় একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে সে দেওয়ালের দিকে তুরে ধরল।
‘ঐটে দেখ!’ বিজয়গর্বে বলল।
আগেই বলেছি, দেওয়ালের অনেক জায়গায়ই কাগজ খুলে খুলে পড়েছি। ঘরের ঐ বিশেষ কোণটায় অনেক বড় একখন্ড কাগজ খুলে পড়ায় হলদে প্ল্যাস্টার বেরিয়ে পড়েছে। সেই চৌ-কোণা প্লাস্টারের উপর রক্ত-লাল অক্ষরে একটিমাত্র শব্দ লেখা আছে—
RA CHE (রাসে)
একজন প্রদর্শক যেভাবে তার খেলা দেখায় সেইরকম ভঙ্গীতে গোয়েন্দাপ্রবর চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এটার বিষয়ে তুমি কি বলছ? ঘরের একেবারে অন্ধকার কোণে রয়েছে বলে এটা কারও চোখে পড়ে নি, এদিকটা দেখার কথাও কেউ ভাবি নি। খুনি নিজের রক্ত দিয়ে এটা লিখেছে। দেখ, দেওয়াল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা-যে আত্মহত্যা নয় সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। লেখবার জন্য ঐ কোণটা বেছে নেওয়া হল কেন? সেটাও বলছি। ম্যান্টেলপিসের বেছে নেওয়া হল কেন? সেটাও বলছি। ম্যান্টেলপিসের উপর ঐ মোমবাতিটা দেখ। ঘটনার সময় ওটা জ্বালান ছিল, আর ওটা জ্বললে ঘরের ঐ কোণটা সবচাইতে অন্ধকার না হয়ে সবচাইতে উজ্জ্বল হয়।’
অসন্তোষের ভাব নিয়ে গ্রেগসন প্রশ্ন করল, ‘বেশ তো, তুমি ওটা দেখেছ, কিন্তু তাতে কি বোঝা গেল?’
‘কি বোঝা গেল? বোঝা গেল যে লেখক একটি মেয়ের নাম “রাসেল” লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু লেখাটা শেষ করবার আগেই কোন বিঘ্ন ঘটে। আমার কথাটা বোঝ, এই কেসের কিনারা যখন হবে তখন দেখতে পারে রাসেল নামের একটি মেয়ে এর সঙ্গে জড়িত আছে। মিঃ শার্লক হোমস, আপনি হাসতে পারেন। আপনি খুব তুখোড় ও চতুর হতে পারেন, কিন্তু সব কথার সেরা কথা হল—পুরেনো চাল ভাতে বাড়ে।’
হো-হো করে হেসে উঠে আমার সঙ্গী এই ছোটখাট লোকটির মেজাজ সত্যি খি’চড়ে দিয়েছিল। তাই সে বলল, ‘সত্যি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি প্রথম এটা দেখেছ, এ কৃতিত্ব অবশ্যই তোমার প্রাপ্য। গত রাত্রের রহস্যের অপর অংশীদারই যে এটা লিখেছে সে বিষয়েও তোমার সঙ্গে আমি একমত। এ ঘরটা পরীক্ষা করে দেখবার সময় আমি এখনও পাই নি। তোমার অনুমতি নিয়ে সে কাজটা এবার করতে চাই।’
বলতে বলতেই সে পকেট থেকে একটা মাপের ফিতে ও একটা বড় ম্যাগ্মিফায়িং গ্লাস বের করে ফেলল। তারপর এই দুটি হাতিয়ার নিয়ে নিঃশব্দে ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিল। কখনও থামছে, কখনও হাঁটুগেড়ে বসছে, একবার তো টানটান হয়ে উপুড় হয়ে শুয়েই পড়ল। নিজের কাজে তখন সে এতই মগ্ন যে আমাদের উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলে গেল। সারাক্ষণ নিজের সঙ্গেই কথা বলে চলেছে—কখনও উল্লাস, কখনও আর্তনাদ; এই হয় তো শিস দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই উৎসাহে ও আশায় চীৎকার করে উঠছে। তাকে দেখে তখন আমার এক সুশিক্ষিত ভাল জাতের শিকারী কুকুরের কথা মনে হচ্ছিল; শিকারের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত সেও তো এমনই তীব্র কৌতূহলে ঝোপ-ঝাড়ের ভিতরে এমনিভাবে কখনও এগোয়, কখনও পেছোয়। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে সে তার কাজ চালিয়ে গেল। আমার চোখে সম্পূর্ণ অদৃশ্য দাগগুলির দুরত্ব বেশ যত্ন নিয়ে সঠিকভাবে মাপল। কখনও আবার কেন যে ফিতেটাকে দেওয়ালের গায়েও ব্যবহার করল সেটা তো আমার কাছে দুর্বোধ্য। এক জায়গায় মেঝে থেকে এক –মুঠো ধুলো খুব যত্ন করে তুলে নিয়ে কামে ভরে রাখল। শেষকালে দেওয়ালের লেখার উপর কাঁচটা ধরে প্রতিটি অক্ষরকে সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখল। কাজ শেষ করে খুশি মনে ফিতে আর কাঁচটা পকেটে রেখে দিল।
হেসে বলল, ‘লোকে বলে, বেদনা সহ্য করবার অসীম ক্ষমতাই হল প্রতিভা। এটা খুব বাজে সংজ্ঞা কিন্তু গোয়েন্দাদের কাজে এটা সত্যি খাটে।’
গ্রেগসন এবং লেস্ট্রেড তাদের সৌখিন সহকর্মীর এই সব পায়তাড়া বেশ কৌতুহল ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছিল। শার্লক হোমসের তুচ্ছতম কাজও যে একটা সুনির্দিষ্ট বাস্তব লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত এ সত্য আমি বুঝতে আরম্ভ করলেও তারা কিন্তু এখনও বুঝতে অপারগ।
দুজনে একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?’
আমার বন্ধু, জবাব দিল, ‘আমি তোমাদের সাহায্য করছি একথা মনে হলেই যে এ কেসের কৃতিত্ব থেকে তোমাদের বঞ্চিত করা হবে। তোমরা এত ভাল কাজ করছ যে জন্যর হস্তক্ষেপ খুবই দুঃখের কারণ হতে পারে।’ মজার স্বরে প্রচুর ঠাট্রা মিশিয়ে সে বলতে লাগল, ভেতরে তদন্তের কাজ কিভাবে চালাচ্ছ যদি আমাকে বল, তোমাদের কোনরকম সাহায্য করতে পারলে আমি খুমি হব। ইতিমধ্যে যে কনেস্টবল মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছিল, তার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। তার নাম, ঠিকানাটা আমাকে দিতে পার?’
লেস্ট্রেড নোটবুক দেখে বলল, ‘জন রাঞ্চ। এখ তার ছুটি, কেনিংটন পার্ক গেটের ৪৬, অডলি কোটে তাকে পাবেন।’
হোমস ঠিকানা লিখে নিল।
তারপর বলল, ‘চল ডাক্তার। তাকে খুঁজে বের করতে হবে।’ গোয়েন্দা-যুগলের দিকে ফিরে বলল, ‘খুন হয়েছে। খুনি একজন পুরুষ মানুষ। উচ্চতায় ছ’ফুটের বেশী, বয়সে যুবক, উচ্চতার তুলনায় পা দুটো ছোট, পায়ে চৌকো-মাথা বুট, ঠোঁটে ত্রিচিনোপলি সিগার। একটা চার চস্কার গাড়িতে করে শিকারকে নিয়ে সে এখানে এসেছিল। গাড়িটা ছিল এক-ঘোড়ায় টানা, আর ঘোড়াটার তিন পায়ে ছিল পুরনো নাল এবং সামনের এক পায়ে ছিল নতুন নাল লাগানো। খুব সম্ভব খুনীর মুখের রং লাল, আর ডান হাতের আঙুলের নখগুলো বেশ লম্বা। অল্প গোটাকয় লক্ষণ উল্লেখ করলাম। তবে এগুলো তোমাদের কাজে লাগতে পারে।’
লেস্ট্রেড এবং গ্রেগসন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসল।
লেস্ট্রেড বলল, ‘লোকটি যদি খুনি হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে খুব করা হয়েছে?’
‘বিষ।’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে শালক হোমস যাবার জন্য পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আর একটা কথা লেস্ট্রেড। ‘RACHE’ হচ্ছে “প্রতিহিংসা’র জামার্ন প্রতিশব্দ; কাজেই মিস রাসেলকে খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করো না।’
শব্দের তীরটি ছুঁড়ে দিয়েই সে চলে গেল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হী করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
০৪. জন রাঞ্জের জবানবন্দী
৩নং লরিস্টন গর্ডেন্স থেকে যকন বেরলাম তখন বেলা একটা। শালক হোমস নিকটবর্তী টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে একটা লম্বা তার পাঠাল। তারপর একটা গাড়ি ডেকে গাড়োয়ানকে লেস্ট্রেডের দেওয়া ঠিকানায় যাবার নিদেশ দিল।
যেতে যেতে সে বলল, ‘চোখে-দেখা প্রমাণের মত কিছু হয় না। আসলে এ কেস সম্পর্কে আমার মন সব ঠিক করে ফেলেছে। তথাপি যা কিছু জানবার আছে সেসব জানাই ভাল।ৎ
আমি বললাম, ‘তুমি আমাকে বিস্মিত করেছ হোমস। যেরকম নিশ্চয়তার সঙ্গে খুটিনাটি কথা তুমি জানালে, নিশ্চয় আসলে ততটা নিশ্চিত তুমি নও।’
উত্তরে সে বলল, ‘ভুলের কোনরকম সুযোগই নেই। ওখানে পৌঁছে প্রথমেই আমি লক্ষ্য করলাম, পথের উপর একটা গাড়ির চাকার দুটো দাগ পড়েছে। এখন, গত রাতের আগে গত এক সপ্তাহ এখানে কোন বৃষ্টি হয় নি। কাজেই যে চাকাগুলির দাগ এত গভীরভাবে মাটিতে বসে গেছে সেগুলি নিশ্চয় গত রাত্রেই সেখানে এসেছিল। ঘোড়ার ক্ষুরের যে দাগ সেখানে রয়েছে তার একটা অন্য তিনটের তুলনায় বেশী গভীর। তা থেকেই বোঝা যায় ক্ষুরের একটা নাল নতুন। যেহেতু বৃষ্টি আরম্ভ হবার পরেও গাড়িটা সেখানে ছিল এবং কাল সকালে কোন সময়ই সেটাকে দেখা যায় নি—একথা গ্রেগসনই বলেছে—সুতরাং অনুমান করা চলে যে রাত্রে ওটা সেখানেই ছিল এবং ওই গাড়িতে করেই দুই ব্যক্তি ও বাড়িতে এসেছিল!’
আমি বললাম, ‘এটা তো বেশ সোজা। কিন্তু অপর লোকটির উচ্চতা?’
‘কেন? প্রতি দশজনের ন’জনের ক্ষেত্রেই পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য দেখেই তার উচ্চতা বলে দেওয়া যায়। ‘হিসাবটা খুবই সোজা। তার বিবরণ দিয়ে তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। বাইরের মাটিতে এবং ঘরের ধুলোর মধ্যে এই লোকটির পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য আমি দেখেছি। তারপর একটা বিশেষ উপায়ে হিসাবটা আমি পরীক্ষা করেও নিয়েছি। কোন লোক যখন দেওয়ালে কিছু লেখে, সাধারণত সে তার চোখের সমান উচ্চতায়ই লেখে। ঐ লেখাটা আছে মেঝে থেকে ছ’ফুটের সামান্য উঁচুতে। বাকিটা তো ছেলেখেলা।’
‘আর তার বয়স?’ আমি প্রশ্ন করলাম। একটাোক যদি অনায়াসে প্রতি পদক্ষেপে সাড়ে চার ফুট পার হতে পারে তাহলে সে নিশ্চয়ই অথর্ব বৃদ্ধ নয়। বাগানের পথে একটা খানা পথ আছে। সেটাও সে পার হয়েছে নিশ্চয়। পেটেন্ট লেদার জুতোর ছাপ রয়েছে চার দিকে। তার চৌকোণা ডগার চিহ্ন ও স্পষ্ট। এর মধ্যে তো রহস্যের কিছু নেই। আমার সেই প্রবন্ধটাতে পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের যেসব নীতির উল্লেখ আমি করেছি, তারিই কিছু কিছু বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেছি মাত্র, আর কিছু কি বুঝবার আছে?’
‘আঙুলের নখ আর ত্রিচিনোপোলি,’ আমি মনে করিয়ে দিলাম।
‘একটা মানুষের তর্জনীকে রক্তে ডুবিয়ে দেওয়ালের উপর শব্দটা লেখা হয়েছে। আমার কাঁচের সাহায্যে দেখেছি। লেখার দরুন দেওয়ালের প্লাসারে কিছুটা আচঁড় লেগেছে। ছাইটা দেখতে কালো এবং পাতলা আঁশযুক্ত। এরকম ছাই একমাত্র ত্রিচিনোপোলি সিগারে হয়। সিগারের ছাই নিয়ে আমি অনেক পড়াশুনা করেছি, ও বিষয়ে একখানা ছোট বইও লিখেছি। আমি গর্ব করে বলছি, যেকোন পরিচিত ব্যান্ডের সিগার বা তামাকের ছাইয়ের পার্থক্য আমি একবার দেখলেই বলে দিতে পারি। এই সব ছোটখাট ব্যাপার নিয়েই একজন দক্ষ গোয়েন্দা আর লেস্ট্রেড-গ্রেগসনের মধ্যে এত তফাৎ।’
‘আর লাল মুখ?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘ওঃ, ওটা তো খুব মোক্ষম চাল। বর্তমান অবস্থায় নির্ভূল সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমান অবস্থায় ও বিষয়ে তুমি আমাকে কোন প্রশ্ন করো না।’
কপালে হাত বুলিয়ে আমি বললাম, ‘আমার মাথাটা ঘুরছে। যত ভাবছি ততই যেন রহস্য বাড়ছে। খালি বাড়িটাতে দুজন এল কি করে? অবশ্য যদি দু’জনের কথা ঠিক হয়। যে গাড়োয়ান গাড়িটা চালিয়েছিল তার কি হল? একজন অপরজনকে বিষ খেতে বাধ্য করল কেমন করে? কোন কিছু ডাকাতি যখন হয় নি, তখন খুনির উদ্দেশ্য কি ছিল? একটি স্ত্রীলোকের আংটিই বা এল কোথা হতে? সর্বোপরি, পালাবার আগে দ্বিতীয় লোকটি জার্মান ভাষায় “রাসে” (RACHE) শব্দটি লিখল কেন? আমি স্বীকার করছি, এই সব ঘটনাকে মিলিয়ে দেবার কোন পথ আমি দেখতে পাচ্ছি না।’
আমার সঙ্গী সমর্থনসূচক হাসি হাসতে লাগল।
বলল, ‘পরিস্থিতির অসুবিধাগুলি তুমি পরিষ্কার ভাষায় বেশ ভালভাবেই বলেছ। মুল ঘটনাবলী সম্পর্কে আমার মনস্থির করা হলও এখনও অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়েছে। বেচারি লেস্ট্রেডের আবিষ্কার সম্পর্কে বলতে পারি, ওটা পুরোপুরি ধাপ্পা। সমাজতন্ত্রের ও গুপ্ত সমিতির ধারণা সৃষ্টি করে পুলিশকে ভুল পথে চালাবার মতলব। ওটা কোন জার্মানের লেখা নয়। লক্ষ্য করলে দেখতে পেতে A অক্ষরটা জার্মান কায়দাই লেখা হয়েছে। কিন্তু একজন সত্যিকারের জার্মান সব সময়ই ল্যাটিন কায়দায় লেখে। কাজেই অসংকোচে বলা যায়, ওটা কোন জার্মানের লেখা নয়, কোন অক্ষম নকলনবীশ বাড়াবাড়ি করে বসেছে। সমস্ত তদন্তটাকে ভুল পথে ঘুরিয়ে দেবার একটা ফন্দী মাত্র।কিন্তু ডাক্তার, আর কোন কথা নয়। তুমি তো জান, যাদুকর যদি তার খেলা সবাইকে বুঝিয়ে দেয়, তাহলে আর কেউ তাকে বাহবা দেয় না। আমার কাজের পদ্ধতি যদি সবটা তোমাকে বুঝিয়ে দেই, তাহলে তুমিও আমাকে একজন অতি সাধারণ মানুষ বলে মন করবে।’
‘আমি কখনও তা বরব না’, আমি উত্তরে বললাম,‘অপরাধতত্ত্বকে‘তুমি নির্ভূল বিজ্ঞানের এত কাছাকাছি এনে ফেলেছ যে পৃথিবীতে আর কেউ এর চাইতে বেশী কিছু করেত পারবে না।’
এমন আন্তরিকতার সঙ্গে আমি কথাগুলি বললাম যে আমার সঙ্গীর মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা জিনিস আমি এর মধ্যেই রক্ষ্য করেছি যে, একটি মেয়ে তার রূপের প্রশংসা শুনলে হোমসও তেমনি খুশিতে জরমর করে।
সে বলল,‘তোমাকে আর একটি কথা বলছি।পেটেপ্ট লেদার এবং চৌকো-ডগা একই গাড়িতে এসেছিলে, এক্ সঙ্গে বন্ধুর মত-সম্ভবত হাত-ধরাধরি করেই পতটা হে‘টেছিল।ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক পায়চারি করেছিল,-বরং বলা যায় পেটেপ্ট-লেদার দাড়িয়ে ছিল, আর চৌকো-ডগা পায়চারি করছিল। ধূলোর উপরে এসব দাগই স্পষ্ট।তাই বুঝতে পেরেছি, হাঁটতে হাঁটতে সে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। পা ফেলবার ফাঁকটা ক্রমাগতই দীর্ঘ্ হয়েছে দেখেই সেটা্ বোঝা যায়। সারাক্ষণ কথাবলছিল এবং ক্রোধে জ্বলছিল।তারপরই দূর্ঘ্টনাটি ঘটল।আমি যতটা জেনেছি সবই তোমাকে বললাম।বাকিটা এখনও অনুমান মাএ। অবশ্য এর ভিত্তিতেই কাজ শুরু করা যেতে পারে।এখন তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে,কারণ সন্ধ্যায় হ্রালে-র কনসার্টে নর্মান নেরুদার বাজনা শুনতে চাই।’
যতক্ষণ সে এই সব বরছির ততক্ষণে আমাদের গাড়িটা পরপর অনেকগুলো সরু রাস্তা ও ময়লা গলি পার হয়ে চলেছে। এতক্ষণে সবচাইতে সরু ও সবচাইতে ময়লা একটা পতে পৌছে গাড়োয়ান হটাৎ গাড়িটা থামিয়ে দিল। একটা চিলতে মত জায়গায় একসারি রং-মরা ই‘টের বাড়ি দেখিয়ে সে বলল, ‘ওই যে অডলি কোর্ট্। আপনারা ফিরে এসে আমাকে এখানেই পা্বেন।’
অডলি কোর্ট্ মোটেই আকর্ষণীয় জায়গা নয়। চিনতে পথটা পেরিয়ে একটা চৌকো মত জায়গা আর সারি সারি জঘন্য বাড়ি। একদল নোংরা ছেলে-মেয়ে আর রংওঠা নানারকম নিশানের ভিতর দিয়ে পথ করে ৪৬নম্বরে পৌছিলাম। দরজায় ভিতরের একটা জাহাজ আটা। তার উপরে রাঞ্চের নাম খোদাই করা। খোজঁ নিয়ে জানলাম, কনেস্টবল তখনও বিছানায়। একটা ছোট বসবার ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায একটু বিরক্ত হয়েই সে ঘরে ঢুকল;বলল, ‘আমি তো আপিসে রিপোর্ট্ দিয়ে দিয়েছি।’
পকেট থেকে একটা আধ-গিনি বের করে নাচাতে নাচাতে হোমস বলল, ‘আমরা ভেবেছিলাম তোমার মুখ থেকেই সব শুনব।’
সোনার চাকতিটার ঊপরে চোখ রেখে কনেস্টবর বলল,‘আমি যা জানি সব বলব।’
‘যেমন যেমনটি ঘটেছিল ঠিক তেমনটি করে সব বল।’রাচ্ঞ সোফায় বসে ভূর দুটো কোঁচকালো। যেন মনে মনে সংকল্প করে নিল, কোন কিছুই যাতে বাদ না পড়ে। তারপর বলতে শুরু করল,‘গোড়া থেকেই বলছি। রাত দশটা থেকে ভোর ছটা পর্য্ন্ত আমার সময়। এগারটার সময়‘‘হোয়াইট হার্ট্’’’-এ একটা লড়াই হয়েছিল । তাছাড়া আর সব শান্ত্ ।একটার সময় বৃষ্টি শুরু হল। সেইসময় হল্যান্ড গ্রোভ বীটের হ্যারি র্মাচারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। দুজনে হেনডরয়েটা স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িযে গল্প করছিলাম। একটু পরে- হয় তো দুটো নাগাদ বা তার একটু পরে-ভাবলাম বিকসটন রোডের দিকটা একটু দেকে আসি। ওদিকটা যেমন নোংরা, তেমনি র্নিজন।সারা পথে জন-মনিষ্যির দেখা নেই শুধু একটা গাড়ি চলছে।হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঐ বাড়িটার জানালা দিয়ে একটা আলো চোখে পড়ল। আমি জানতাম লরিস্টন গার্ডেস্নের ঐ দুটো বাড়ি খালি আছে। তার মধ্যে একটার শেষ ভাড়াটে টাইফয়েডে মারা গেছে। তাই জানালার আলো দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বলে সন্দেহ হল। দরজার কাছে পৌঁছে—’
সঙ্গী বাধা দিল, ‘তুমি থেমে গেলে এবং আবার বাগানের গেটের কাছে ফিরে গেলে। এরকমটা কেন করলে?’
রাঞ্চ একটা প্রকান্ড লাফ দিয়ে অবাক বিস্ময়ে শালর্ক হোমসের দিকে হী করে তাকিয়ে বলল, ‘আর, ঠিক তাই স্যার। ভগবান জানেন সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে? বুঝতেই তোর পারছেন, যখন আমি দরজার কাছে পৌঁছলাম তখন চারিদিকটা এমন নির্জন আর থমথমে যে মনে হল এ অবস্থায় একজন সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না। যদিও কবরের এপারে কোন কিছুকেই আমি ভয় পাই না, তবু কেন জানি মনে হল, ড্রেন পরীক্ষা করতে গিয়ে টাইফয়েড হয়ে যে মারা গেছে এটা হয় তো তারই কাজ। এই ভাবনাই আমাকে ঘুরিয়ে দিল। মার্চারের লণ্ঠনাটা চোখে পড়ে কি না দেখবার জন্য আমি গেটের কাছে ফিরে গেলাম। কিন্তু তাকে বা অন্য কাউকেই দেখতে পেলাম না।
‘পথে কেউ ছিল না?’
‘কোন জীবন্ত প্রাণী নয় স্যার। একটা কুকুর পর্যন্ত না। তখন সাহস করে ফিরে গেলাম এবং ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম। ভিতরে চুপচাপ। ঘরের মধ্যে যেখানে আলোটা জ্বলছিল সেখানে গেলাম। ম্যান্টেল-পিসের উপর মোমবাতিটা—একটা লাল মোমবাতি জ্বলছিল আর তারই আলোয় দেখলাম—’
জন রাঞ্চ লাফিয়ে উঠল। তার মুখে ভয়, তার চোখে সন্দেহ। চেঁচিয়ে বলল, ‘এসব দেখবার জন্য আপনি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন? আমি তো দেখেছি, আপনি এমন অনেক কিছুই জানেন যা আপনার জানবার কথা নয়।’
হোমস হেসে উঠল। তার কাডখানা কনেস্টবলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খুনের দায়ে আমাকেই যেন গ্রেপ্তার করে বসো না। আমিও একটি শিকারী, নেকড়ে নই। মিঃ গ্রেগসন বা মিঃ লেস্ট্রেডের কাছেই সব জানতে পারবে। এখন বলে যাও। তারপর কি করলে?’
রাঞ্চ আবার আসনে বসল। তার চোখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর। ‘গেটের কাছে গিয়ে আমার বাঁশিটা বাজালাম। তাই শুনে মার্চার এবং আরও দুজন ঘটনাস্থলে হাজির হল।’
‘তখন কি রাস্তা খালি ছিল?’
‘তা—ছিল। কাজেই লোক বলতে কেউ ছিল না।’
‘তুমি কি বলতে চাও?’
কনেস্টবলের মুখে মুচকি হাসি খেলে গেল। বলল, ‘জীবনে অনেক মাতাল আমি দেখেছি, কিন্তু ও ব্যাটার মত পাড় মাতাল কখনও দেখি নি; আমি যখন বেরিয়ে আসি, সে তখন রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর কলম্বাইনের “খোলা নিশান” বা ঐ জাতীয় কোন গান গলা ফাটিয়ে গাইছিল। ব্যাটা পায়ের উপর দাঁড়াতেই পারছিল না, তার সাহায্য করবে কি।’
‘লোকটা কেমন?’ শার্লক হোমস প্রশ্ন করল।
একথায় জন রাঞ্চ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কেমন আবার? বেহদ্দ মাতাল হলে যেমন হয়। তখন যদি আমরা ওরকম ব্যস্ত না থাকতাম তাহলে তো শ্রীমানকে থানায় নিয়ে যেতাম।’
হোমস অধীরভাবে বলে উঠল, ‘তার মুখ—তার পোশাক—সেসব কি লক্ষ্য কর নি?’
‘তা মনে হয় করেছিলাম। আমি আর মার্চারই তো অতি কষ্টে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়েছিলাম। লোকটা বেশ লম্বা, লাল মুখ, নীচের দিকটা জড়ানো—’
হোমস চেঁচিয়ে বলল, ‘ওতেই হবে। তারপর কি হল?’
পুলিশটি ক্ষুদ্ধ গলায় বলল, ‘তার দিকে নজর দেওয়ার চাইতে অনেক বড় কাজ আমাদের ছিল। আমি বাজী ধরে বলতে পারি, সে ঠিক বাড়ি পৌঁছেছিল।’
‘তার পরনে কি ছিল?’
‘একটা বাদামী ওভারকোট।’
‘হাতে একটা চাবুক ছিল?’
‘চাবুক—না।’
‘নিশ্চয়ই রেখে এসেছিল।’ আমার সঙ্গী নিজের মনেই বলল।
‘তারপরই কোন গাড়ি দেখ নি? বা গাড়ির শব্দ শোন নি?’
‘না।’
‘এই নাও তোমার আধ-গিনি।’ আমার সঙ্গী উঠে দাঁড়িয়ে টুপিটা হাতে নিল। ‘আমার ভয় হচ্ছে রাঞ্চ, পুলিশ-লাইনে তুমি কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না। দেখ, তোমার মাথাটা শুধু শোভাই নয়, ওটাকে কাজে লাগাতেও হয়। কাল রাতেই তুমি সার্জেন্টের পদ অর্জন করতে পারতে। কাল যে লোকটিকে তুমি হাত ধরে তুলে-ছিলে সেই এই রহস্যের গুরু আর তাকেই আমরা খুঁজছি। এখন এ নিয়ে তর্ক করে কোন লাভ নেই। আমি বলছি, এটাই ঠিক। চলহে ডাক্তার।’
আমার গাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কনেস্ট-বলটির মনে তখনও অবিশ্বাস থাকলেও সে বেশ অস্বস্থিত বোধ করতে লাগল।
বাসার দিকে যেতে যেতে হোমস তিক্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘একেবারে বেহদ্দ বোকা! ভেবে দেখ, এমন একটা অতুলনীয় সৌভাগ্য ওর হাতের কাছে এসেছিল, অথচ ও সেটাকে কাজে লাগাতে পারল না।’
‘আমি কিন্তু এখন সেই অন্ধকারেই আছি। এ কথা ঠিক যে, এই রহস্যের দ্বিতীয় পক্ষ সম্পর্কে তোমার ধারণার সঙ্গে এই লোকটির বিবরণ মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ বাড়ি থেকে চলে গিয়েও সে আবার ফিরে আসবে কেন? অপরাধীরাও তো এরকম করে না।’
‘ঐ আংটি, বাবা ঐ আংটি। ঐ আংটির জন্যই সে ফিরে এসেছিল। তাকে ধরবার আর কোন পথ যদি না পাই, ওই আংটিটাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। ডাক্তার, আমি তাকে পাবই, বলতে পার পেয়ে গেছি। আর এসবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি না থাকলে আমি হয় তো সেখানেই যেতামই না। আমর এমন একটা অদ্ভুত-পূর্ব সূক্ষ্ম সমীক্ষা আমার হাতছাড়া হয়ে যেতঃ রক্ত-না কেন? জীবনের বর্ণহীন বস্ত্রের ভিতর দিয়ে বোনা হয়েছে হত্যার একগাছি রক্তববর্ণ সুতো। আমাদের কাজ তাকে আবিষ্কার করা, পৃথক করা, তার প্রতিটি ইঞ্চিকে প্রকাশিত করা। কিন্তু এবার লাঞ্চে যেতে হবে আর সেখান থেকে নর্মান নেরুদার উদ্দেশ্যে। তার প্রতিটি কাজ অনবদ্য। কিরকম আশ্চর্জনকভাবে সে “চপিন”-এর সুর বাজায়ঃ ট্রা—লা—লা—লিরা—লিরা—লে—’
গাড়ির মধ্যে হেলান দিয়ে এই সৌখিন শিকারী কুকুর চাতক পাখির মত গান গেয়ে উঠল। আর আমি মানব মনের বিপুল বৈচিত্র্যের চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলাম।
০৫. বিজ্ঞাপন ও আগন্তুক
আমার দুর্বল স্বাস্থ্যের পক্ষে সকালবেলাটা তাই খুবই শ্রমটা একটু বেশীই হয়েছিল। বিকেলবেলাটা তাই খুবই ক্লান্ত লাগছিল। হোমস কনসার্টে চলে গেল, আমি সোফায় শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সকালবেলাকার ঘটনাবলীতে আমার মন খুবই সেখানে ঢুঁ মেরে চলেছে। যতবার চোখ বুজি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিহত লোকটির বিকৃত বেবুনের মত মুখ। ঐ মুখটা আমার মনের উপর এমন একটা অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল যার ফলে ঐ মুখের মালিককে যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু অনুভব করা আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। মানুষের মুখে যদি জঘন্যতম কোন পাপের প্রকাশ হয়ে থাকে তবে সে মুখ ক্লিভল্যান্ডের এনক জে, ড্রেবারের। তথাপি আমি স্বীকার করি, ন্যায় বিচার অবশ্য হওয়া উচিত; মৃতের দুশ্চরিত্রতার জন্য আইনের চোখে অপরাধীর কোন ক্ষমা থাকতে পারে না।
যতই ভেবেছি ততই মানে হয়েছে, লোকটিকে বিষ-প্রয়োগ করা হয়েছে বলে আমার সঙ্গী যে মত প্রকাশ করেছে সেটা অসাধারণ। মনে পড়ছে, সে মৃতের ঠোঁট দুটো শুঁকেছিল: নিশ্চয় এমন কিছু সে পেয়েছে যার ফলে তার মনে এই ধারণা জন্মেছে। তাছাড়া, বিষপ্রয়োগ না হলে আর কিভাবে লোকটির মৃত্যু হতে পারে? মৃত-দেহে আঘাতের বা শ্বারোধের কোন চিহ্ন নেই। আবার ভেবে দেখতে হবে, তাহলে কার রক্ত মেঝের উপর পুরু হয়ে ছড়িয়ে ছিল? ধৃস্তাধৃস্তির কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি, বা নিহতের কাছে এমন কোন অস্ত্র ছিল না যা দিয়ে সে প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে পারে। এসব প্রশ্নের মীমাংসা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ হোমস বা আমি কারও পক্ষেই ঘুমানো সহজ নয়। তার শান্ত আত্মবিশ্বাসের ভাব দেখে মনে হচ্ছে এমন একটা সিদ্ধান্ত যে কি এক পলকের জন্যও আমি তা ভাবতে পারছি না। তার ফিরতে বেশ দেরী হয়েছিল—এত দেরী যে আমি জানতাম ঐ কনসার্ট তাকে এতক্ষণ আটকে রাখতে পারে না। তার আসার আগেই টেবিলে রাতের খাবার দেওয়া হয়েছিল।
আসন গ্রহণ করতে করতে সে বলল, অপূর্ব! সঙ্গীত সম্পর্কে ডারুইন কি বলেছেন তোমার মনে পড়ে? তিনি বলেছেন, কথা বলতে শেখার আগেই মানুষ গান গাইতে ও গান ভালবাসতে শিখেছিল। সেইজন্যই বোধ হয় গানের দ্বারা আমরা এতটা প্রভাবিত হই। যে কুয়াসাচ্ছন্ন শতাব্দীতে পৃথিবী তার শৈশব অবস্থায় ছিল তার অস্পষ্ট স্মৃতি এখনও আমাদের বাসা বেঁধে আছে।’
‘ওটা তো খুব বড় কথা,’ আমি মন্তব্য করলাম।
সে বলল, ‘প্রকৃতিকে জানতে হলে আমাদের ধারণাকেও প্রকৃতির মত বড় হতে হবে। ব্যাপার কি বল তো? তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে। ব্রিক্সটন রোডের ব্যাপারটা দেখছি তোমাকে খুবই বিচলিত করেছে।’
আমি বললামি, ‘সত্যি তাই: আফগানিস্থানের অভিজ্ঞতার পরে আমার মনটা আরও শক্ত হওয়া উচিত ছিল। মাইওয়ান্দে নিজের চোখে আমার সঙ্গীদের কুচকাটা হতে দেখেছি। তাতে তো এমন বিচলিত হই নি।’
‘বুঝতে পারছি। এখানে এমন একটা রহস্য রয়েছে যা কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে। যেখানে কল্পনা নেই, সেখানে ভয়ও নেই। সন্ধ্যার কাগজটা পড়েছ কি?’
‘না।’
‘তাতে এ বিষয়ে একটা মোটামুটি ভাল বিবরণ দিয়েছে। তবে লোকটিকে তুলবার সময় একটি বিয়ের আংটি যে মেঝেতে পড়েছিল, সেকথা লেখে নি। না লিখে ভালই হয়েছে।’
‘কেন?’
‘এই বিজ্ঞাপনটা দেখ। ঘটনার ঠিক পরে সকালেই এটি সব কাগজে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলাম।’
কাগজটা সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। তার নির্দেশ মত জায়গাটা পড়লাম। ‘প্রাপ্তি’ স্তম্ভে সেটি প্রথম ঘোষণা। তাতে লেখা, ‘ব্রিকসটন রোডে আজ সকালে হোয়াইট হার্ট ট্যাভার্ন ও হল্যান্ড গ্রোভের মধ্যবর্তী রাস্তায় একটি নিরেট সোনার বিয়ের আংটি পাওয়া গিয়াছে। আজ সন্ধ্যা আটটা থেকে ন’টার মধ্যে ২২১ বি, বেকার স্ট্রীটে ডঃ ওয়াটসনের নিকট আবেদন করুন।’
‘তোমরা নামটা ব্যবহার করেছি বলে ক্ষমা করো। আমার নাম ব্যবহার করলে ওই সব আহাম্মকদের কেউ কেউ হয় তো চিনে ফেলত আর অকারণে নাক গলাত।’
‘ঠিক আছে।’ আমি বললাম, ‘কিন্তু ধরো যদি কেউ আসে, আমার কাছে তো আংটি নেই।’
আমার হাতে একটি আংটি দিয়ে সে বলল, ‘আলবৎ আছে। এতেই কাজ চলবে। এটা অবিকল একই রকম।’
‘এই বিজ্ঞাপনের ফলে কে আসবে তুমি আশা কর?’
‘কেন? বাদামী কোট পরা লোকটি—চৌকো ডগা-ওয়ালা জুতোপরা আমাদের সেই লালমুখ বন্ধু। স্বয়ং না এলে কোন স্যাঙাৎকে পাঠাবে।’
‘একজটাকে সে কি খুব বিপজ্জনক বলে মনে করবে না?’
‘মোটেই না। এই কেস সম্পর্কে আমার অভিমত যদি সত্য হয়,–অবশ্য এবিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই—কোন ঝুঁকি নেবেই। আমার মতে ড্রেবারের মৃতদেহের উপর ঝুঁকে পড়বার সময় সে আংটি হারানোর পরিবর্তে যে কোন ঝুঁকে পড়বার সময় সে আংটিটি ফেলে দেয়, কিন্তু তখন বুঝতে পারে না। বাড়ি থেকে চলে যাবার পর সেটা বুঝতে পেরেই আবার ফিরে আসে। কিন্তু নিজের নিবুদ্ধিতায় মোমবাতিটা জ্বেলে রেখে যাওয়ায় ততক্ষণে সেটা পুলিশের হাতে চলে গেছে। গেটের কাছে তার উপস্থিতিতে পাছে কোনরকম সন্দেহ হয়, তাই সে মাতা-লের ভান করে। এইবার ওই লোকটার জায়গায় নিজেকে, বসাও। দ্বিতীয় চিন্তায় নিশ্চয় তার মনে হয়েছিল যে, হয় তো ঐ বাড়িটা থেকে চলে যাবার পরে পথেই কোথাও আংটিটা হারিয়ে গেছে। সে তখন কি করবে? হারানো জিনিস প্রাপ্তির কলমে ওটার খবর দেখবার আশায় সে নিশ্চয় সান্ধ্য সংবাদপত্রগুলি আগ্রহসহকারে পড়বে। ফলে এই বিজ্ঞাপনের উপর তার চোখ পড়বেই। আনন্দে সে উল্লসিত হয়ে উঠবে। ফাঁদের কথা তার মনে পড়বে কেন? আংটি হারানোর সঙ্গে খুনের কোন সর্ম্পক থাকতে পারে না। আসতেই সে চাইবে। সে নিশ্চয়ই আসবে। এক ঘন্টার মধ্যে তাকে আমরা দেখতে পাব।’
‘তারপর?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘তাকে মোকাবিলা করার ব্যাপারটা আমার উপরই ছেড়ে দাও। তোমার সঙ্গে কোন অস্ত্র আছে কি?’
‘পুরনো একটা সামরিক রিভলবার ও কয়েকটি কার্তুজ সঙ্গে আছে।’
‘সেটাকে পরিষ্কার করে গুলি ভরে রাখ। লোকটা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। যদিও তাকে আমি অতর্কিতে আক্রমণ করব, তবু যে-কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা ভাল।’
শোবার ঘরে গিয়ে তার কথামত কাজ করলাম। পিস্তল নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি টেবিল পরিষ্কার করা হয়ে গেছে এবং হোমস যথারীতি বেহালায় ছড় টেনে চলেছে।
আমি ঘরে ঢুকতেই সে বলল, ‘ষড়যন্ত্র ক্রমেই ঘণী-ভূত হচ্ছে। আমেরিকায় যে টেলিগ্রাম করেছিলাম এইমাত্র তার জবাব এল। এ কেসের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত নির্ভুল।’
‘সেটা কি?’ আমি সাগ্রহে প্রুশ্ন করলাম।
সে শুধু বলল, ‘নতুন তার লাগালেই বেহালাটা ভাল বাজবে। পিস্তলটা পকেটে রাখ। লোকটা এলে খুব সহজভাবে কথা বলো। বাকিটা আমি বুঝব। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন ভয় পাইয়ে দিও না।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখন আটটা বাজে।’
‘হ্যাঁ। সম্ভবত কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে হাজির হবে। আস্তে দরজাটা খুলে দাও। ঠিক আছে। চাবিটা ভিতরে লাগিয়ে রাখ। ধন্যবাদ। এটা একটা অদ্ভুত পুরনো বই—“ডি জুরে ইন্টার জেস্টেস।” কাল একটা স্টলে খুঁজে পেয়েছি। ১৬৪২ সালে লোল্যা-ডসের অন্তর্গত লীজ থেকে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত। চার্লসের মাথা তখনও তাঁর ঘাড়ের উপরে খাড়া ছিল। সেই সময়েই এই বাদামী মলাটের ছোট বইটাকে বাতিল করা হয়েছিল।’
‘‘মুদ্রাকর কে?’
‘কে এক ফিলিস্পি ডি ক্রয়। প্রথম পাতায় খুব অস্পষ্ট কালিতে লেখা“Ex Libris Guliemi Whyte” জানি না কে এই উ্ইলিয়াম হোয়াইট। হয়তো সপ্তদশ শতাব্দীর কোন ধুরন্ধর আইনজীবী। তার লেখায় একটা আইনগত প্যাঁচ আছে। মনে হচ্ছে, লোকটি আসছে।’
কথার সঙ্গে সঙ্গেই ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠল আস্তে উঠে হোমস চেয়ারটাকে দরজার দিকে ঠেলে দিল। শুনতে পেলাম, পরিচাব্রিকা হলের ভিতর হলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হুট করে তালা খুলে দরজা খুলে দিল।
‘ডঃ ওয়াটসন কি এখানে থাকেন?’ একটি স্পষ্ট কর্কশ কণ্ঠের প্রশ্ন কানে এল। পরিচারিকার জবাব শুনতে পেলাম না। কিন্তু দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং একজন কেউ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। পায়ের শব্দ অনিশ্চিত এবং এলোমেলো। কান পেতে শুনে আমার সঙ্গীর চোখেমুখে একটা বিস্ময়ের আভা খেলে গেল। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে প্যাসেজ পার হয়ে এল। আস্তে দরজায় একটা টোকা পড়ল।
‘ভিতরে আসুন,’ আমি জোরে বললাম।
আমার ডাকে প্রত্যাশিত একটি দুর্ধর্ষ লোকের বদলে একটি কুঞ্চিতমুখ বৃদ্ধা ঘরে ঢুকল। ঘরের আকস্মিক কড়া আলোয় তার চোখ যেন ঝলসে গেল।
অভিবাদন জানিয়ে সে আমাদের দিকে মিটমিট করে তাকাতে লাগল। হাতের আঙুলগুলো বুঝি বা পকেটের মধ্যেই কাঁপছে। সঙ্গীর দিকে তাকালাম। তার মুখে নিরাশার ছায়া।
সান্ধ্য দৈনিকখানা বের করে বুড়ি আমাদের বিজ্ঞাপনটা দেখাল। তারপর আর একবার মাথা নুইয়ে বলল, ‘মশায়রা, এইটে দেখেই এখানে এসেছি। ব্রিকসটন রোডে একটা সোনার বিয়ের আংটি। এই বারো মাস হল তার বিয়ে হয়েছে। সোয়ামি রাজকীয় নৌবহরের সরকার। ফিরে এসে সে যখন দেখবে বৌ-এর হাতে আংটি নেই, তখন কি যে হবে আমি ভাবতেই পারছি না। ভাল সময়েই তার টানাটানি চলে, যখন মদে চুর হয় তখন তো কথাই নেই। কাল রাতে সে সার্কাস দেখতে—’
‘এটা তার আংটি কি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল, ‘যীশুকে ধন্যবাদ! আজ রাতে শাবী স্বস্তি পাবে। ঐ আংটিটাই।’
একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে বললাম, ‘তোমার ঠিকানা কি?’
’১৩-ডানকান স্ট্রীট, হাউন্ডসডিচ। এখান থেকে অনেকটা পথ।’
সঙ্গে সঙ্গে শালক হোমস বলে উঠল, ‘কেন সার্কাস অন্য হাউন্ডসডিচের মধ্যে তো ব্রিকসটন রোড পড়ে না।’
বাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে লাল চোখ মেলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। বলল, ‘ভদ্রলোক আমার ঠিকানা জানতে চেয়েছেন। স্যালী থাকে ০,. মেফিল্ড প্লেস, শেষহাম-এ।’
‘আর তোমার নাম?’
‘আমার নাম সয়ার—মেয়ের নাম ডেনিস, কারণ টম ডেনিস তাকে বিয়ে করেছে। যতদিন সমুদ্রে থাকে ছোকরা খুব চালাক-চতুর। কোম্পানির আর কোন সরকারের ওর মত সুনাম নেই। কিন্তু মাটিতে পা দিলেই মেয়েমানুষ আর মদের দোকানে মিলে—’
সঙ্গীর ইঙ্গিতে আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘মিসেস সয়ার, এই তোমার আংটি। নিশ্চয় এটা তোমার মেয়ের। প্রকৃত মালিককে এটা ফিরিয়ে দিতে পারায় আমি খুশি।’
অনেক আশীর্বাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বুড়ি আংটিটা পকেটে ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শালক হোমস লাফ দিয়ে উঠে তার ঘরে ছুটে চলে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অলেস্টার আর গলাবন্ধ পরে ফিরে এসে খুব তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি ওর পিছু নেব। ও নিশ্চয়ই দলের লোক। ওর সঙ্গে গেলেই তার হদিস মিলবে। আমার জন্য জেগে থেক।’ নীচে হলঘরের দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গেই নীচে নেমে গেল। জানালা দিয়ে আমি দেখতে পেলাম, রাস্তার ওপার দিয়ে বুড়ি দুর্বল পায়ে এগিয়ে চলেছে, আর তার অনুসরণকারী কিছুটা দুরে থেকে তার পিছু নিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, হয় তার সমস্ত সিদ্ধান্তটাই ভুল আর না হয় তো এবার সে রহস্যের একেবারে মাঝখানে গিয়ে পড়বে। আমাকে জেগে থাকতে বলার কোন দরকারই ছিল না, কারণ তার এই অভিযানের ফলাফল না জানা পর্যন্ত ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
প্রায় ন’টা নাগাদ সে বেরিয়ে গেল। কখন ফিরবে জানি না। তাই বোকার মত বসে পাইপ টানতে টানতে হেনরি মার্জারের “ভাই ডি বোহেম” এর পাতা ওল্টাতে লাগলাম। দশটা বাজল। পরিচারিকার পায়ের শব্দ তার শোবার ঘরের দিকে মিলিয়ে গেল। এগারোটা, এবার গৃহকত্রীর পায়ের শব্দও ঐ একই লক্ষ্যপথে আমার দরজার পাশ দিয়ে চলে গেল। প্রায় বারোটা নাগাদ তার সিটকিনির চাবির শব্দ শুনতে পেলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই তার মুখ দেখে বুঝলাম, কোন কাজ হয় নি। ফূর্তি ও বিরক্তি পাঞ্জা লড়তে লড়তে একসময়ে ফূর্তিরই জয় হল,–সে হো হো করে হেসে উঠল।
চেয়ারে বসে পড়ে সে চেঁচিয়ে বলে উঠল ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকদের এ খবর কিছুতেই জানতে দেব না। তাদের আমি এত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছি, যে তারা কিছুতেই এর শেষটা আমাকে শুনতে দেবে না। আমি এখন হাসছি, কারণ আমি জানি অচিরেই আমি তাদের দলেই ভিড়ে যাব।’
‘ব্যাপার কি?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘ওঃ, ইচ্ছার বিরুদ্ধেও গল্পটা বলতে বাধা নেই। কিছুদুর গিয়েই ওই জীবটি খোঁড়াতে আরম্ভ করল, আর পায়ে ঘা হবার সব লক্ষণ দেখাতে শুরু করল। একটু পরেই সে থামল এবং একটা চার চাকার গাড়িকে ডাকল। পরেই সে থামল এবং একটা চার চাকার গাড়িকে ডাকল। ঠিকানাটা শুনবার জন্য আমি এগিয়ে কাছে গেলাম। কিন্তু তার কোন দরকার ছিল না, কারণ সে এত জোরে ঠিকানাটা ঘোষণা করল যে রাস্তার ওপাশ থেকে শোনা যেত। চীৎকার করে বলল, “১৩, ডানকান স্ট্রীট,হাউন্ডসডিচ-এ চালাও।” ভাবলাম তাহলে তো সবই ঠিক। যাহোক, তাকে গাড়ির ভেতরে উঠতে দেখেই আমি পিছন উঠে বসলাম। গোয়েন্দামাত্রকেই একাজে খুব দক্ষ হতে হয়। গাড়ি ছুটে চলল। পূর্বকথিত রাস্তায় পৌঁছে তবে রাস টানল। বাড়ির দরজায় পৌঁছেই আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম এবং হাওয়া খাবার ভঙ্গিতে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাশ টানতে গাড়িটা থামল। গাড়োয়ান লাফ দিয়ে নীচে নেমে দরজা খুলে দাঁড়াল। কিন্তু কেউ গাড়ি থেকে নামল না। এগিয়ে গিয়ে দেখি, সে পাগলের মত গাড়ির ভিতরটা খুঁজছে আর নানা রকম অশ্রাব্য গালিগালাজ উচ্চারণ করেছে।গাড়ির আরোহীর কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না।বেচারি তার ভাড়াটাও পাবে কিনা সন্দেহ। ১৩ নম্বরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঐ বাড়ির মালিক কেসুইক নামে এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক এবং ও অঞ্চলে কেউ সয়ার বা ডেনিসের নামও কখনও শোনে নি।’
আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, ‘তুমি কি বলতে চাও যে ওই দুর্বল থুথুড়ে বুড়ি তোমায় বা গাড়োয়ানের অজ্ঞাতেই চলন্ত গাড়ি থেকে পালিয়েছে?’
শালক হোমস তীক্ষ্মকণ্ঠে বলে উঠল, ‘বুড়ি জাহান্নামে যাক। আমরাই যে বুড়ি বনে গিয়েছি। সে একটি কর্মঠ যুবক। অতুলনীয় অভিনেতা তো বটেই। তার রুপ-সজ্জা অননুকরণীয়। আমি যে তার পিছু নিয়েছি সেটা বুঝতে পেরেই সে কেটে পড়বার এই পথ বেছে নিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে, লোকটা একা নয়, তার এমন সব সাকরেদ আছে যারা তার জন্য যেকোন ঝুঁকি নিতে রাজী। আরে ডাক্তার, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমার কথা শোন, শুয়ে পড়গে।’
সত্যি আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তার কথাই শুনলাম। জ্বলন্ত অগ্নি-কুন্ডের পাশে হোমসকে বসিয়ে রেখে আমি চলে গেলাম। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর বেহলার নীচু করুণ আর্তনাদ আমার কানে এলো। বুঝতে পারলাম, যে বিস্ময়কর রহস্যের সমাধানে সে আত্মনিয়োগ করেছে তখনও সে তার কথাই ভেবে চলেছে।
০৬. টোবিয়াস গ্রেগসনের কেরামতি
পরদিন খবরের কাগজগুলি ছিল ‘ব্রিকসটন রহস্যে’ ভরা। সমস্ত কাগজে র্দীঘ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে অকেনগুলিতে তার উপরে আবার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তাতে এমন কিছু তথ্য ছিল যা আমার কাছে নতুন। এই কেস সম্পর্কে খবরের কাগজের অনেক কাটিং ও উদ্ধৃতি এখন আমার ‘স্ক্র্যাপ-বুকে’ রক্ষিত আছে। এখানে তার কিছু কিছু সংক্ষিপ্ত-সার তুলে দেওয়া হলঃ
‘ডেইলি টেলিগ্রাম’-এ মন্তব্য করা হয়েছে যে, অপ-রাধের ইতিহাসে এরুপ বিস্ময়কর বৈশিষ্টাপূর্ণ দুঃখজনক ঘটনা কাদচিৎ দেখা যায়। মৃত ব্যক্তির জার্মান নাম, উদ্দেশ্যের অভাব, দেওয়ালে অশুভ লিখন এই সব দেখে মনে হয় রাজনৈতিক শরণার্থী এবং বিপ্লবীরাই এ ঘটনার নায়ক। আমেরিকায় সমাজতন্ত্রীদের অনেক শাখা আছে। মৃত ব্যক্তি নিশ্চয় তাদের কোন অলিখিত আইন লংঘন করেছিল। এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাকে খুঁজে বের করেছে। প্রসঙ্গত ভেমগেরিকট, একোয়া টোকনা, কার্বোনারি, মার্কিওনেস ডি ব্রিনভিলিয়ার্স, ডারুইনের মতবাদ, ম্যালথাস-নীত ও র্যাটক্লিফ রাজপথে খুনের উল্লেখ করে প্রবন্ধের শেষে সরকারকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে এবং ইংলন্ডে বিদেশীদের উপর কড়া নজর রাখবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
‘স্ট্যান্ডার্ড-এ মন্তব্য করা হয়েছে এ ধরনের বেআইনী অত্যাচার সাধারণতঃ উদারনৈতিক সরকারের আমলেই ঘটে থাকে। জনতার মানসিক অস্থিরতা এবং দুর্বলতা থেকেই এদের উদ্ভব। নিহত ব্যক্তি একজন আমেরিকান ভদ্রলোক। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ তিনি মহানগরীতে বাস করছিলেন।তিনি কাম্বারওয়েলের অন্তর্গত টকোয়ে টেরেসের ম্যাডাম চাপেন্টিয়ারের বোডিং-হাউসে থাকতেন। এই দেশভ্রমণের সময় তার সঙ্গে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন। এ মাসের ৪ তারিখ মঙ্গলবার গৃহকর্ত্রীকে বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে তারা লিভারপুল এক্সপ্রেস ধরবার উদ্দেশ্যে ইউস্টন স্টেশনে যাত্রা করেন। তারপরেও দুজনকে প্ল্যাটফর্মে দেখা গিয়েছে। সংবাদ অনুসারে, ইউস্টন থেকে অনেক মাইল দুরবর্তী, ব্রিক্সটন রোডের একটি খালি বাড়িতে মিঃ ড্রেবারের মৃতদেহ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত রহস্যে আবৃত; স্ট্যাঙ্গারসনের গতিবিধি সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায় না। কেমন করে তিনি সেখানে এলেন, বা কেমন করে তার মৃত্যু হল, এসব প্রশ্নই এখনও পর্যন্ত রহস্য আবৃত! স্ট্যাঙ্গারসনের গতিবিধি সম্পর্কেও কিছুই জানা যায় নি। আমরা শুনে সুখী হলাম যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিঃ লেস্ট্রেড ও মিঃ গ্রেগসন এই কেসটি গ্রহণ করেছেন। আশা করা যায় যে এই দুই সুপরিচিতি অফিসার অতি শীঘ্রই এ ব্যাপারে আলোকপাত করবেন।
‘ডেইলি-নিউজ’-এ বলা হয়েছে, অপরাধটি যে রাজ-নৈতিক সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্বৈরাচর ও সমাজতন্ত্রবোধিতা ইউরোপীয় শাসক শক্তিগুলিকে অনুপ্রাণিত করার ফলে এমন বহুলোক আমাদের দেশে চলে এসেছেন যাঁরা অতীত জীবনের তিক্ত স্মৃতির দ্বাড়া তাড়িত না হলে উচ্চশ্রেণীর নাগরিক হতে পারতেন। ঐসব লোকের মধ্যে এমন একটা কঠোর নিয়ম-নিষ্ঠা প্রচলিত ছিল যেকোনরকমভাবে সেটা লঙ্ঘিত হলেই তার শাস্তি ছিল মৃত্যু। সচিব স্ট্যাঙ্গারসনকে খুঁজে বের করতে এবং মৃতের অতীত জীবনের বিবরণ জানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। যে বাড়িতে তিনি বাস করেছিলেন তার ঠিকানাটা হস্তগত হওয়ায় একটা বড় কাজ হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিঃ গ্রেগসনের তীক্ষ্মবৃদ্ধি ও উদ্যমের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
প্রাতরাশে বসে শার্লক হোমস ও আমি সবগুলিই একত্রে পড়লাম। মনে হল, এগুলি যেন তাকে প্রচুর মজার খোরাক জোগাল।
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম, যা কিছুই ঘটুক লেস্ট্রেড আর গ্রেগসনই দইটুকু মারবে।’
‘দেখা যাক কি হয়। তার উপরেই তো সব নির্ভর করছে।’
‘হা ভগবান! মোটেই তা নয়। লোকটি ধরা পড়লে ওদের জন্যই ধরা পড়বে, আর সে যদি পালিয়ে যায় সেও ওদের চেষ্টা সত্বেও যাবে। এ হচ্ছে, আমরা জিতলেও ভেড়ের ভেড়ে, হারলেও ভেড়ের ভেড়ে। ওরা যা করবে তাতেই লোক বাহবা দবে। `Un not trouve tlouj-ours un plus sot quil I’ admire’.
‘ব্যাপার কি?’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে হলেও সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল। গৃহকর্ত্রীর নানারকম বিরক্তিসূচক বাণীও কানে এল।
আমার সঙ্গী গম্ভীরভাবে বলল, ‘এটা হচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনী বেকার স্ট্রীট ডিভিশন।’ তার কথার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত নোংরা একদল বাউন্ডুলে ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
‘সোজা হয়ে দাঁড়াও!’ কর্কশ কণ্ঠে হোমস চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দুটি বাচ্চা বদমাইস কুখ্যাত স্ট্যাচুর মত এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘ভবিষ্যতে শুধু উইগিন্সকে ভিতরে পাঠাবে খবর দিতে, বাকিরা সব রাস্তায় অপেক্ষা করবে। কোন খবর পেয়েছ উইগিন্স?’
একটা ছেলে জবাব দিল, ‘না স্যার, পাই নি।’
‘পাবে সে আশা আমিও করি নি। কাজ চালিয়ে যাও। এই নাও, তোমাদের পাওনা।’ প্রত্যেককে সে এক শিলিং করে দিল। ‘এখন চলে যাও। এরপর ভাল খবর নিয়ে আসবে।’
সে হাত নাড়তেই তারা সব ইঁদুরের মত লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। পরক্ষণেই রাস্তায়, তাদের কর্কশ গলা শোনা গেল।
হোমস বলল, ‘একজন পুলিশের চাইতে ওদের একটা বাচ্চা ভিখারির কাছ থেকে অনেক বেশী কাজ পাওয়া যায়। সরকারী লোক দেখলেই লোকের ঠোঁট বন্ধ হয়ে যায়। এই বাচ্চাগুলো সব জায়গায় যায়, সব কথা শোনে। ওদের বুদ্ধিও সূঁচের মত তীক্ষ্ম। শুধু প্রয়োজন ওদের গড়ে তোলা।’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি ব্রিক্সটন কেসে ওদের লাগিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। একটা জিনিস আমি সঠিক জানতে চাই। অবশ্য সেটা সময় সাপেক্ষমাত্র। আরে! এখনই কিছু নতুন সংবাদ শুনতে পাব। রাস্তা দিয়ে গ্রেগসন আসছে।তার চোখে-মুখে খুশি উপছে পড়ছে।জানি, এখানেই আসবে। হ্যাঁ, ওই তো দাঁড়িয়েছে। এসে গেছে!’
ঘণ্টটা জোরে বেজে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোয়েন্দা-প্রবর এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি পার হয়ে বসবার ঘরে ঢুকল।
হোমসের অনিচ্ছুক হাতটাকে মুচড়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল, ‘বন্ধু. আমাকে অভিন্দন জানান। সবকিছু একেবারে দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে ফেলেছি।’
সঙ্গীর মুখের উপর একটা দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল। ‘তুমি কি ঠিক পথে চলেছ বলে মনে কর?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘ঠিক পথ! লোকটাকে হাতকড়া পরিয়ে ফেলেছি।’
‘তার নাম কি?’
মাননীয়া মহারাণীর নৌ-বিভাগের সহকারী লেফ্টেন্যাপ্ট আর্থার চার্পেন্টিয়ার’, মোটা হাত দুটো ঘসতে ঘসতে বুক ফুলিয়ে গ্রেগসন সদম্ভে কথা গুলি বলল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শালক হোমস একটুখানি হাসল।
বলল, ‘বস। সিগারেট খাও। কি করে এত কান্ড করলে জানতে কৌতুহল হচ্ছে। হুইস্কি আর জল চাই কি?
গোয়েন্দা জবাব দিল, ‘পেলে মন্দ হত না।’ গত দু’একদিন যা পরিশ্রম গেছে, শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। শারীরিক পরিশ্রম যত নয়, তার চাইতে বেশী চাপ পড়েছে মনের উপর। মিঃ শালক হোমস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কারণ আমরা দুজনেই তো মস্কিষ্কের কারবারী।’
হোমস গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমাকে বড় বেশী সম্মান দেওয়া হচ্ছে, যাহোক এরকম একটা সন্তোষজনক ফল কিভাবে লাভ করলে খুলে বল তো শুনি।’
গোয়েন্দাটি চেয়ারে বসে মনের সুখে সিগার টানছিল। হঠাৎ অতি-আনন্দের উচ্ছ্বাসে উরুতে একটা থাপ্পড়ে মেরে বলে উঠল, ‘মজার ব্যাপার কি জানেন, নিজেকে, খুব চালাক ভাবলে কি হবে ঐ বোকা লেস্ট্রেড একেবারেই ভুলপথ ধরেছে। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সচিব স্ট্যাঙ্গারসনকে, অথচ অপারাধের সঙ্গে সে কতটুকু জড়িত? যে শিশু এখনও মায়ের পেটে তার চাইতে বেশী নয়’ এতদিনে সে যে তাকে পাকড়াও করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’
কথাটা ভাবতেই গ্রেগসনের মনে এমন সুড়সুড়ি লাগল যে হাসতে হাসতে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম।
‘তোমার সূত্রটি কেমন করে পেলে?’
‘বলছি, বলছি, সবই বলছি। ডঃ ওয়াটসন, আমরা ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে। এই মার্কিন অতীত ভদ্রলোকের বৃত্তান্ত জানাটাই হল প্রথম সমস্যা। অন্যরা এ অবস্থায় কি করত, না বিজ্ঞাপনের উত্তর আসা বা কেউ এসে স্বেচ্ছায় কোন খবর দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত। কিন্তু টোবিয়াস গ্রেগসনের কাজের পদ্ধতি সেরকম নয়। আচ্ছা, মৃত লোকটির পাশের টুপিটার কথা মনে আছে?’
হোমস জবাব দিল, হ্যাঁ। ১২৯, কাম্বারওয়েল রোডের জন আন্ডারউড অ্যান্ড সন্স দ্বারা প্রস্তুত।’
গ্রেগসন যেন খুবই মুষড়ে পড়ল। বলল, ‘আপনিও যে সেটা লক্ষ্য করেছেন তা ভাবি নি। আপনি কি সেখানে গিয়েছিলেন?’
‘না।’
‘হ্যাঁ।’ স্বস্তি ভরা গলায় গ্রেগসন বলল, ‘আপাত দৃষ্টিতে যত তু্চ্ছ নয়।’
‘যাহোক, আমি আন্ডারউডের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম ঐ মাপের ও বিবরণের টুপি সে বিক্রি করেছে কি না। খাতাপত্র ওল্টাতেই পেয়ে গেল। টুপিটা সে পাঠিয়েছিল টর্কোয়ে টেরেসের চার্পেন্টিয়ার্স বোডিং এস্টাব্লিমেন্টের মিঃ ড্রেবারকে। সেখানেই তার ঠিকানাটা পেলাম।’
শালক হোমস আপন মনেই বলে উঠল, ‘চতুর—খুব চতুর!’
গোয়েন্দা বলতে লাগল, ‘তারপরই ম্যাডাম চাপেন্টিয়ারের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে খুবই বিমর্ষ ও বিষণ্ন দেখলাম। তার মেয়েও সেই ঘরেই ছিল—অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে। তার চোখে দুটো লাল। তার সঙ্গে কথা বলবার সময় তার ঠোঁট কাঁপছিল। সেটা আমার নজর এড়ায় নি। তখনই আমার সন্দেহ হল। মিঃ শালক হোমস, আপনি তো জানেন, ঠিক সূত্রটি খুঁজে পেলে মনের কিরকম ভাব হয় স্নায়ুতে কিরকম একটা উত্তেজনা দেখা দেয়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার প্রাক্তন বোর্ডার ক্লিভল্যান্ডের মিঃ এনক জে, ড্রেবারের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর আপনি শুনেছেন কি?’
‘মা ঘাড় নাড়ল। একটা কথাও বলতে পারল না। মেয়েটি কেঁদে উঠল। বুঝলাম, এরা অনেককিছুই জানে।’
‘জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ট্রেন ধরবার জন্য মিঃ ড্রেবার ক’টার সময় আপনাদের এখান থেকে চলে যান?’
‘উত্তেজনাকে চাপা দেবার জন্য ঢোঁক গিলে সে বলল, ‘আটটার সময়। তাঁর সচিব মিঃ স্ট্যাঙ্গারসন বলেছিলেন, দুটো ট্রেন আছে—একটা ৯টা ১৫-তে আর একটা ১১টায়। তিনি প্রথমটাই ধরবেন?’
‘সেই কি তাকে আপনি শেষ দেখেছেন?’
‘প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটির মুখের ভয়ংকর পরিবর্তন ঘটল। মুখখানা কালিবর্ণ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে অনেক কষ্টে একটিমাত্র শব্দই সে উচ্চারণ করতে পারল ‘হ্যাঁ,-তখনও তার গলায় স্বর ফ্যাঁসফেঁসে অস্বাভাবিক।’
‘কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পরে মেয়েটি শান্ত স্পষ্ট গলায় বলল, ‘মা, মিথ্যার ফল কখনও ভাল হয় না।এই ভদ্রলোকের কাছে সব কথা খুলে বলাই ভাল। মিঃ ড্রেবারকে আমরা আবার দেখেছিলাম।’
‘ঈশ্বর তোকে ক্ষমা করুন।’ দুই হাত শূন্যে তুলে চেয়ারে বসে পরে ম্যাডাম চার্পেন্টিয়ার বলে উঠলো, ‘তোর ভাইকে তুই খুন করেছিস।’
মেয়েটি দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আর্থারও চাইত যে আমরা সত্য কথাই বলি।’
‘আমি বললাম, ‘সব কথাই আমাকে খুলে বল। অর্ধেক বলা না বলার চাইতে খারাপ। তাছাড়া , এ ব্যাপারে আমরা কতটা জানি তাও তো তোমরা জান না।’
‘মা কেঁদে বলল, ‘এলিস, তোর মাথার দিব্যি,তাই হোক।’ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘স্যার, আপনাকে আমি সব কথাই বলব। আমার ছেলে এই ভয়ংকর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বে এই আশংকাতেই আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছি তা মনে করবেন না। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার শুধু ভয়, আপনার চোখে না অন্যদের চোখে তাকে এ ব্যাপারে জড়িত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব। তার উন্নত চরিত্র, তার জীবিকা, তার অতীত-সবাই এধরনের কাজের পরিপন্থী।’
‘সে বলল, ‘এলিস, আমাদের একটু একা থাকতে দাও।’ মেয়েটি চলে গেল। সে বলতে লাগল, ‘দেখুন স্যার, সব কথা আপনাকে বলবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু মেয়েটা যখন সব ফাঁস করে দিয়েছে, তখন আর গন্ত্যন্তর নেই। বলাই যখন স্থির করেছি, তখন কিছুই বাদ না দিয়ে সবই আপনাকে বলব।’
‘আমি বলক. সেটাই বুদ্ধিমতীর কাজ।’
‘মিঃ ড্রেবার প্রায় তিন সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি আর তাঁর সচিব মিঃ স্যাঙ্গারসন ইউরোপ পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকটি ট্যাংকের উপর ‘কোপেনহেগেন’ লেবেল আঁটা দেখেছি। তাতে মনে হয় তারা সর্বশেষ সেখানেই ছিলেন। স্ট্যাঙ্গারসন শান্ত, চাপা প্রকৃতির লোক। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলছি, তাঁর মালিক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ। তাঁর স্বভাব অমার্জিত, চাল-চলন জানোয়ারের মত। যেদিন ও’রা আসেন সেদিন রাতেই ওরা মদে চুর হয়ে পড়েন। পরদিন বেলা বারোটার আগে তাঁর হুঁস হয় না।পরিচারিকাদের সঙ্গে তাঁর চাল-চলনও দৃষ্টিকটু ও বে-আব্রু। সবচাইতে দুঃখের কথা, আমার মেয়ে এলিসকেও তিনি সেই চোখেই দেখতে শুরু করলেন এবং একাধিকবার তাঁকে এমন সব কথা বললেন, সৌভাগ্যবশত যেগুলো বোঝবার মত বয়স তার এখনও হয় নি। একসময় তিনি হাত ধরে টেনে তাকে আলিঙ্গন পর্যন্ত করেন। তার নিজের সচিব এই অভদ্র আচরণের জন্য তাকে তিরস্কার করতে বাধ্য হন।’
‘আমি প্রশ্ন করলাম, ‘এসব আপনি সহ্য করলেন কেন? যখন খুশি বোর্ডারদের তো আপনি ছাড়িয়ে দিতে পারেন বলে আমি জানি।’
‘আমার প্রশ্নে ম্যাডাম চার্পেম্টিয়ারের মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ঈশ্বরের কৃপায় তার আসার দিনই তাকে নোটিশ দিলেই ভাল করতাম। কিন্তু লোভ বড় দারুণ জিনিস। দিন প্রতি প্রত্যেকে তারা এক পাউন্ড করে দিচ্ছিলেন—সপ্তাহে চৌদ্দ পাউন্ড। তার উপর এখন খদ্দের-পত্তর কম। আমি বিধবা। ছেলেকে নৌ-বিভাগে পাঠাবার খরচও অনেক। তাই টাকাটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না। সবই মেনে নিয়েছিলাম।কিন্তু শেষটায় অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমি তাকে বাড়ি ছাড়বার নোটিশ দিলাম। তাই তিনি চলে গেলেন।’
‘তারপর?’
‘তাকে চলে যেতে দেখে মনটা হাল্কা হল। ছেলে তখন ছুটিতে এসেছে। এসব কথা কিছুই তাকে জানালাম না। কারণ সে খুব বদরাগী, আর বোনকে খুব ভালবাসে। তারা চলে যেতে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে মনে হল মনের উপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। কিন্তু হায়! এক ঘণ্টার মধ্যই দরজায় আবার বেল বেজে উঠল। শুনলাম, মিঃ ড্রেবার ফিরে এসেছেন। তিনি খুব উত্তেজিত। মদ খাওয়ার জন্য তাঁর অবস্থা আরও শোচনীয়। যে ঘরে আমি মেয়েকে নিয়ে বসেছিলাম তিনি জোর কর সেই ঘরে ঢুকে ট্রেন পান নি বলে কিছু অবান্তর কথা বললেন। তারপর এলিসের দিকে ফিরে আমার মুখের উপর তাকে বললেন তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে। বললেন, ‘তোমার বয়স হয়েছে, কোন আইন তোমাকে আটকাতে পারে না, আমার অনেক বাড়তি টাকা আছে। ওই বুড়ি মেয়েটার কথা ভেব না। আমার সঙ্গে এখনই সোজা চলে এস। আমি তোমাকে রাণীর মতো রাখব।’ বেচারি এলিস আতংকে ছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই তিনি তার হাত ধরে দরজার দিকে টানতে লাগলেন। আমি চীৎকার করে উঠলাম, আর সেই মুহূর্তে আমার ছেলে আর্থার ঘরে ঢুকল। তারপর কি ঘটল আমি জানি না। আমি নানারকম কটুক্তি ও ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনেছিলাম। কিন্তু ভয়ে মুখ তুলতে পারি নি।যখন মুখ তুললাম তখন দেখি একটা লাঠি হাতে নিয়ে আর্থার দাঁড়িয়ে হাসছে। আমাকে সে বলল, ‘ভদ্রলোক আর কখনও আমাদের বিরক্ত করবে না। একবার গিয়ে দেখতে হবে তিনি কি করেন।’ বলতে বলতে টুপিটা নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। পরদিন মিঃ ড্রেবারের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর শুনলাম।’
‘অনেকবার ঢোঁক গিলে থেমে থেমে ম্যাডাম চার্পেস্টিয়ার যা বলছিলেন হল সেই বিবরণ। সময় সময় সে এত নীচু স্বরে কথা বলছিল যে সব শোনও যায়নি। আমি অবশ্য তার সব কথারই শর্ট-হ্যান্ড নোট নিয়েছি, যাতে কোনরকম ভুলের সম্ভাবনা না থাকে।’
শার্লক হোমস হাই তুলে বলল, ‘খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। তারপর কি হল?’
গোয়েন্দা বলতে লাগলেন, ‘ম্যাডাম চার্পেস্টিয়ার থামল। আমি বুঝতে পারলাম সমস্ত ব্যাপারটা একটা পয়েন্টের উপর নির্ভর করছে। একদৃষ্টিতে স্ত্রীলোকটির চোখের দিকে তাকালাম। মেয়েদের ব্যাপারে এটা অনেক সময় খুব কার্যকারী হয়। জানতে চাইলাম, তার ছেলে কখন ফিরেছিল।’
‘আমি জানি না,’ সে জবাব দিল।
‘জানেন না?’
‘না। তার কাছে একটা চাবি থাকে। সেটা দিয়ে দরজা খুলে সে নিজেই বাড়িতে ঢোকে।’
‘আপনি শুতে যাবার পরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কখন শুতে গিয়েছিলেন?’
‘এগারোটায়।’
‘অর্থাৎ আপনার ছেলে দুঘণ্টা বাইরে ছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘চার বা পাঁচ ঘণ্টাও হতে পারে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এত সময় সে কি করছিল?’
‘আমি জানি না।’ সে জবাব দিল। তার ঠোঁট তখন সাদা হয়ে গেছে।
‘অবশ্য এর পরে আর সেখানে কিছু করবার ছিল না। লেফটেন্যান্ট চার্পেন্টিয়ার কোথায় আছে খোঁজ করে দুজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলাম এবং তাকে গ্রেপ্তার করলাম। তার কাঁধে হাত রেখে যখন তাকে নিঃশব্দে আমাদের সঙ্গে আসতে বললাম, সে উদ্ধৃত সাহসের সঙ্গে বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে ঐ পাজী ড্রেবারের মৃত্যুর জন্য আমাকে গ্রেপ্তার করছেন।’ তখনও আমরা তাকে কিছুই বলি নি। তাই তার পক্ষে ওকথা উল্লেখ করায় আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল।’
‘খুবই স্বাভাবিক’ হোমস বলল।
‘সে যখন ড্রেবারের পিছু নেয় তখন তার হাতে যে ভারী লাঠিটা ছিল বলে তার মা উল্লেখ করেছে, সেটা তখনও তার হাতেই ছিল। ওক কাঠের একটা মুগুরবিশেষ।’
‘তাহলে তোমার বক্তব্যটা কি?’
‘দেখুন, আমার বক্তব্য সে ব্রিক্সটন রোড পর্যন্ত ড্রেবারকে অনূসরণ করে। সেখানে পৌঁছে দুজনের মধ্যে আবার ঝগড়া বাঁধে। সেইসময় ড্রেবারের পেটে লাঠির আঘাত লাগে এবং সে মারা যায়, কিন্তু আঘাতের কোন চিহ্ন মৃতদেহে পড়ে না। বৃষ্টির রাত। কেউ কোথাও ছিল না। চার্পেন্টিয়ার মৃতদেহটাকে টানতে টানতে খালি বাড়িতে নিয়ে যায়। আর মোমবাতি, রক্ত, দেওয়ালের লেখা, এবং আংটি—এসবই পুলিশকে ভুল পথে চালাবার ধোঁকা হতে পারে।’
উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গীতে হোমস বলল, ‘চমৎকার! সত্যি গ্রেগসন, বেশ ভালই চালাচ্ছ। তোমাকে আরও বড় কিছু না বানিয়ে ছাড়ছি না।’
গোয়েন্দা গর্বভরে বলল, ‘সমস্ত ব্যাপারটা বেশ ভালভাবে গুছিয়ে এনেছি বলে আমার খুব গর্ব হচ্ছে। যুবকটি স্বেচ্ছায় একটা বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, কিছুদুর পযন্ত ড্রেবারকে অনুসরণ করবার পর ড্রেবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য একটা গাড়িতে উঠে পড়ে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরবার পথে একটা পুরনো জাহাজী বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয় এবং তার সঙ্গে সে অনেকটা পথ হাঁটে। সেই পুরনো জাহাজী বন্ধু কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে না। আমার তো মনে হয় সব ব্যাপারটাই গাঁটে গাঁটে মিলে যাচ্ছে। লেস্ট্রেড যে ভুল পথে ঘুরে মরছে সেটা ভেবেই আমার আরও বেশী মজা লাগছে। আমার ধারণা, সে বেশী দূর এগোতেও পারবে না। আরে! সে যে সশরীরে হাজির।’
সত্যি লেস্ট্রেড। আমার যখন কথা বলছিলাম তখন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে। এবার ঘরে ঢুকল। তার হাবভাব এবং পোশাকে সাধারণতঃ যে আড়ম্বর থাকে সেটার যেন অভাব দেখা গেল। তার মুখে বিরক্তি ও গোলযোগের আভাষ। তার পোশাক এলোমেলো ও ময়লা। স্পষ্টই বোঝা গেল, সে শালর্ক হোমসের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিল। সহকর্মীকে দেখেই কেমন যেন বিব্রত ও মুহ্যমান হয়ে পড়ল। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে টুপিটা হাতাতে লাগল। অবশেষে বলল, ‘একটা অসাধারণ কেস—একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার।’
গ্রেগসন বিজয়গর্বে বলে উঠল, ‘তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি! আমি জানতাম তুমি ঐ সিন্ধান্তেই পৌঁছাবে। সচিব মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গাসনের খোঁজ পেয়েছ কি?’
লেস্ট্রেড গম্ভীরভাবে বলল, ‘আজ সকাল ছ’টা হ্যালিডেস প্রাইভেট হোটেলে মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন খুন হয়েছেন।’
০৭. আঁধারে আলো
যে সংবাদ লেস্ট্রেড জানাল সেটা এতই গুরুতর এবং অপ্রত্যাশিত যে আমরা তিনজনই প্রায় হতবাক হয়ে গেলাম। গ্রেগসন চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে অবশিষ্ট হুইস্কি ও জল ঢেলে ফেলল। তার ঠোঁট ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে। দুই ভুরু চোখের উপর নেমে এসেছে।
‘স্ট্যাঙ্গারসনও!’ সে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ষড়যন্ত্র ঘণীভুত হচ্ছে।’
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে লেস্ট্রেড বলল, ‘আগেই যথেষ্ট ঘণ ছিল। আমার তো মনে হচ্ছে কোন সমর-পরিষদে ঢুকে পড়েছি।’
গ্রেগসন তো-তো করে বলে উঠল, ‘তুমি-তুমি নিশ্চিত জান খবরটা ঠিক?’
লেস্ট্রেড জবাব দিল, ‘এইমাত্র তার ঘর থেকে আমি আসছি। ঘটনাটা আমিই প্রথম আবিষ্কার করি।’
হোমস বলল, ‘এবিষয়ে গ্রেগসনের মত আমরা এতক্ষণ শুনছিলাম। তুমি কি দেখেছ বা করেছ, সেটা আমাদের জানাতে কোন আপত্তি আছে কি?’
চেয়ারে বসে লেস্ট্রেড জবাব দিল, ‘কোনই আপত্তি নেই। খোলাখুলিই স্বীকার করছি, আমি ভেবেছিলাম ড্রেবারের মৃত্যুর সঙ্গে স্ট্যাঙ্গারসন জড়িত। বর্তমান পরিণতি অবশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে আমার সম্পূর্ণ ভুল হয়ে—ছিল। ঐ ধারণঅ নিয়েই আমি সচিবের খোঁজে বেরিয়ে ছিলাম। ওরা সন্ধ্যা সাড়ে আটটা নাগাদ তাদের দুজনকে ইউস্টন স্টেশনে দেখা গিয়েছিল। রাত দুটোয় ড্রেবারকে পাওয়া গেল ব্রিক্সটন রোডে। কাজেই আমার কাছে প্রশ্ন হল, ৮টা ৩০মিঃ থেকে ঘটনার সময় পর্যন্ত স্ট্যাঙ্গারসন কি করছিল এবং তারপরেই বা সে কোথায় গেল—সেটা বের করা। লোকটির বিবরণ দিয়ে লিভারপুলে তার করে দিলাম।তাদের বলে দিলাম, মার্কিন নৌকাগুলোর উপর নজর রাখতে । তারপর ইউস্টনের কাছাকাছি সবগুলি হোটেলও লজিংহাউসে খোঁজ করলাম। দেখুন, আমি চিন্তা করলাম যে ড্রেবার এবং তার সঙ্গী যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তার সঙ্গী কাছাকাছি কোথাও রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আবার স্টেশনে হাজির হবে—এটাই স্বাভাবিক।’
হোমস মন্তব্য করল, ‘আগে থেকেই একটা কোন সাক্ষাতের জায়গা হয়তো তারা স্থির করেছিল।’
‘তাই। গতকাল সারাটা সন্ধ্যা এই খোঁজেই কাটালাম। কিন্তু কোন ফল হল না। আজ খুব ভোরেই আবার আরম্ভ করলাম। আটটার সময় লিটল জর্জ স্ট্রীটের হ্যালিডেস প্রাইভেট হোটেলে পৌঁছলাম। মিঃ স্ট্যাঙ্গারসন সেখানে আছেন কিনা জানতে চাইলে তারা সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতিসূচক জবাব দিল।
তারা আরও বলল, নিশ্চয়ই আপনারই আসবার কথা ছিল। দুদিন যাবৎ তিনি একজন ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।’
‘তিনি কোথায় আছেন?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘তিনি উপরতলায় শুয়ে আছেন। ন’টায় ডেকে দিতে বলেছেন।’
‘উপরে গিয়ে আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা করব,’ আমি বললাম।
‘ভেবেছিলাম, আমি হঠাৎ উপস্থিত হলে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলতেও পারেন। ঘর দেখিয়ে দেবার জন্য পরিচারক আমার সঙ্গে গেল। ঘরটা তিনতলায়, একটা ছোট করিডোর ধরে যেতে হয়। ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে পরিচারক নীচে নেমে যাচ্ছিল, ঠিক সেইসময়ে আমি কিছু দেখতে পেলাম যাতে বিশ বছরের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমার কেমন মাথা ঘুরে গেল। দরজার নীচ দিয়ে রক্তের একটা লাল ফিতা এঁকে বেঁকে এসে প্যাসেজটা পার হয়ে অপরদিকে দেওয়ালের নীচে বেশ খানিকটা জমে আছে। আমি চিৎকার করে উঠতে পরিচারকটি ফিরে এল। সব দেখে তারও মূর্চ্ছা যাবার উপক্রম। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। কিন্তু আমরাও কাঁধ লাগিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম। ঘরের জানালা খোলা, আর তারই নীচে নৈশ-পোশাক পরা একটি লোকের দেহ দলা পাকিয়ে পড়ে আছে। লোকটি মৃত। বেশ কিছুক্ষণ হল মারা গেছে, কারণ হাত-পাগুলো শক্ত এবং ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাকে উল্টে দিতেই পরিচারক চিনতে পারল, এই লোকটিই জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন নামে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। বাদিকে একটা গভীর ক্ষত হৃৎপিন্ড বিদীর্ণ করে ফেলেছে। তার ফলেই লোকটির মৃত্যু ঘটেছে। তারপরই আসছে এব্যাপারের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ। নিহত লোকটির উপর কি ছিল আন্দাজ করুন তো।’
শার্লক হোমস উত্তর দেবার আগে আসন্ন বিভীষিকার কল্পনায় আমার শরীর শিরশির করে উঠল।
সে বলল, ‘রক্তের অক্ষরে লেখা ‘RACHE (রাসে) শব্দটি।’
আতংকগ্রস্ত গলায় লেস্ট্রেড বলল, ‘ঠিক তাই।’ কিছুক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলাম।
এই অজ্ঞাত আততায়ীর ক্রিয়া-কলাপের মধ্যে এমন একটা শৃঙ্খলা অথচ দুর্বোধ্যতা আছে যাল ফলে তার অপরাধ আরও ভয়াবহ রুপ পরিগ্রহ করেছে। আমার যে স্নায়ু রণক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্ত ছিল, তাও যেন এই অপরাধের চিন্তায় শিরশির করতে লাগল।
লেস্ট্রেড বলতে লাগল ‘লোকটি চোখেও পড়েছিল। হোটেলের পিছনের আস্তাবল থেকে যে গলিটা চলে গেছে সেই পথ ধরে গোশালার দিকে যাচ্ছিল একটি গোয়ালা ছেলে। সে দেখতে পায়, ওখানে সাধারণত যে মইটা পড়ে থাকে সেটা তিনতলার একটা জানালার সঙ্গে লাগানো। জানালাটা খোলা। একটু এগিয়ে ফিরে তাকাতেই সে দেখতে পায় একটা মই বেয়ে নামছে। সে এত শান্তভাবে ও প্রকাশ্যে নেমে এল যে ছেলেটি ভাবল, লোকটি হয় তো ছুতোর বা হোটেলের কোন যোগানদার। সে আরও ভাবল, লোকটা এত সকালে কাজে এসেছে কেন। এ ছাড়া তার সম্পর্কে আর কিছুই তার মনে আসে নি। তার মোটামুটি মনে আছে যে লোকটি লম্বা, তার মুখ লালচে পরনে লম্বা বাদামী কোট। খুনের পরেও কিছুক্ষণ সে ওই ঘরে ছিল, কারণ বেসিনে রক্ত মেশানো জলের দাগ আমরা দেখতে পেয়েছি, সেখানে সে নিশ্চয় হাত ধুয়েছে, আর চাদরে রক্তের দাগ, যাতে সে ইচ্ছা করে ছুরিটা মুছেছে।
খুনির বিবরণ শুনে আমি আড়-চোখে হোমসের দিকে তাকালাম, কারণ তার নিজের বিবরণের সঙ্গে এটা হুবুহু মিলে গেছে। তার মুখে কিন্তু উল্লাস বা সন্তুষ্টির চিহ্নমাত্র নেই।
সে প্রশ্ন করল ‘খুনিকে ধরবার সূত্র পাওয়া যায় এরুপ কোন কিছুই কি ঘরের মধ্যে দেখনি?’
‘কিচ্ছু না। ড্রেবারের টাকার থলিটা স্ট্যাঙ্গারসনের পকেটে ছিল। এটা তো খুবই স্বাভাবিক। কারণ দেনা-পাওনা সব সেই করত। তার মধ্যে আশি পাউন্ড ছিল, কিছুই খোয়া যায়নি। এইসব অসাধারণ অপরাধের উদ্দেশ্য আর যাই হোক ডাকাতি নয়। নিহত লোকটির পকেটে কোন কাগজপত্র বা স্মৃতি-লেখা ছিল না। শুধু ছিল একটা টেলিগ্রাম। ক্লিভল্যান্ডে এক মাস আগের তারিখ দেওয়া। তাতে লেখা, ‘জে, এইচ, ইওরোপে আছে।’নীচে কোন নাম লেখা নেই।’
‘আর কিছুই ছিল না?’ হোমস প্রশ্ন করল।
গুরুত্বপূর্ণ কিছুই না। লোকটি যে উপন্যাসখানা পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছিল সেখানা বিছানার উপর পড়েছিল । আর তার পাইপটা ছিল পাশেই চেয়ারের উপর। টেবিলের উপর এক গ্লাস জল ছিল, আর জানালার গোবরাটের উপর ছিল একটা টুকরো মলমের বাকস তাতে গোটা দু্ই বড়ি।’
আনন্দে চীৎকার করে শালক হোমস চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল।
‘শেষ সূত্র’,উল্লাসে চীৎকার করে সে বলল, এবার ‘আমার কেস সম্পূর্ণ হল।’
দুই গোয়েন্দা সবিস্ময়ে তারঁ দিকে তাকিয়ে রইল। আমার সঙ্গী আত্ন-বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে লাগল,‘যে-সব সুতো মিলে এমন একটা জট পাকিয়েছিল, তার সবগুলোকে এখন হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছি।যদিও কিছু কিছু টুকরো ঘটনা এখনও তার মধ্যে ঢোকাতে হবে, তথাপি স্টেশনে ড্রাইবার এবংস্ট্যাঙ্গারসন পরস্পর থেকে বিচ্চিন্ন হবার পর থেকে স্ট্যাঙ্গারসনের মৃতদেহ আবিষ্কার পযর্ন্ত সবগুলি প্রধার ঘটনা সম্পর্কে আমি এতই নিশ্চিত যেন সেগুলোকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার জ্ঞানের একটা প্রমাণ তোমাকে দিচ্ছি। সেই বড়িগুলো তোমার কাছে আছে কি?’
একটা ছোট সাদা বাক্স বের করে লেস্ট্রেড বলল,‘থানায় গিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখবার জন্য মলমের বাক্স,টাকার থলি আর টেলিগ্রামখানা আমি নিয়ে এসেছি। কিছু না ভেবেই বড়িগুলো আমি নিয়ে এসেছি,কারণ সত্যি বলছি ওগুলোর উপর কোন গুরুত্বই আরোপ করছি না।
হোমস বলল, ‘ওগুলো আমাকে দাও দেখি।’তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ডাক্তার ,এগুলো কি সাধারণ বড়ি?’
সাধারণ মোটেই নয়। মুক্তোর মত রং, ছোট গোল, স্বচ্ছ। আমি বললাম,‘এগুলো এত হাল্কা এবং স্বচ্ছ যে জলে ফেললে গলে যাবে বলে মনে হয়।’
হোমস বলল, ঠিক তাই। দয়া করে নীচে গিয়ে টেরিয়ারটাকে নিয়ে আসবে কি?ওটা তো অনেকদিন থেকেই ভুগছে, আর গৃহকর্মীও তোমাকে কালই বলেছে ওটাকে সব যন্তণার হাত থেকে রেহাই দিতে।’
আমি নীচে গিয়ে কুকুরটাকে কোলে করে নিয়ে এলাম। তার শ্বাসকষ্ট আর ঝকঝকে চোখ দেখেই মনে হল, ওর শেষের দিন আর বেশী দেরী নেই। ওর বরফের মত সাদা নাকই ঘোষণা করছে যে কুকুর –জীবনের আয়ুষ্কাল ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। কম্বলের উপর একটা কুশনে ওটাকে রাখলাম।
‘এইবার একটা বড়িকে দুটুকরো করে কাটছি,’বলে হোমস একখানা কলমকাটা ছুরি বের করে কথামতকাজ করল। ‘ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য অর্ধেকটা বাক্রসেই রেকে দিলাম। বাকি অর্ধেকটা এক চামচ জল-ভরা এই মদের গ্লাসে ফেললাম। দেখ, আমার ডাক্তার বন্ধুটি ঠিকই বলেছ্। সঙ্গে সঙ্গে বড়িটা গলে গেল। ‘
কাউকে উপহাস করলে সে যেরকম আহত হয় সেই-রকম ক্ষূধ্ব গলায় লেস্ট্রেড বলল, ‘ব্যাপারটা দেখতে ভালই, কিন্তু জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনের মৃত্যুর সঙ্গে এর কি সর্ম্পক আমি তো বুঝতে পারছি না।’
‘র্ধৈয, বন্ধু, র্ধৈয! যথাসময়েই দেখতে পাবে সর্ম্পক খুবই ঘনিষ্ঠ। মিশ্রণটাকে স্বাদু করবার জন্য একটু দুধ মিশিয়ে কুকুরটার সামনে ধরলেই ও সবটা চেটে খেয়ে ফেলবে।’
বলতে বলতে সে মদের গ্লাসের মিশ্রণটা একটা পাত্রে ঢেলে টেরিয়ারটার সামনে ধরতেই সে চটপট সেটাকে খেয়ে ফেলল। র্শালক হোমসের এতাগ্রতা আমাদের উপর এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে আমরা নিঃশব্দে বসে জন্তুটাকে দেখছিলাম আর বিস্ময়কর কোন ফলের প্রত্যাশা করছিলাম্। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না।কুকুরটা কুশনের উপর টান-টান হয়ে শ্বাস টানতে লাগল। কিন্তু ঐপানীয় পান করার ফলে তার মধ্যে ভাল বা মন্দ কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
হোমস ঘড়ি বের করে দেখছে। মিনিটের পর মিনিট বিফলে কেটে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশার ছায়া পড়ছে। সে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিচ্ছে, একে একে তীব্র অধৈর্যের সব লক্ষণই তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। সে এতই মুষড়ে পড়ছে। যে তার জন্য সত্যই আমার দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু সে যে শেষ পর্যন্ত একটা ধাক্কা খেয়েছে তাতে গোয়েন্দা-যুগল অখুশি তো নয়ই বরং মিটি-মিটি হাসছে।
অবশেষে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ঘরময় দ্রুতবেগে পায়চারি করতে করতে সে বলে উঠল, ‘এটা আকস্মিক যোগাযোগ হতে পারে না। আকস্মিক যোগাযোগ হওয়া অসম্ভব। ড্রেবারের ক্ষেত্রে যে বাড়ির সন্দেহ আমি করে—ছিলাম, স্ট্যাঙ্গারসনের মৃত্যু পরে সেই একই বাড়ি পাওয়া গেছে। অথচ ওগুলো তো জড় পদার্থ। এর কি অর্থ হতে পারে। আমার যুক্তি-শৃঙ্খলটা আগাগোড়াই ভ্রান্ত হতে পারে না। অসম্ভব! অথচ এই হতভাগ্য কুকুরটার কিছুই ছিল হল না। ও হো, পেয়েছি! পেয়েছি! আনন্দে চীৎকার করে উঠে সে বাক্সটার কাছে ছুটে গেল, অন্য একটি বাড়ি কেটে জলে গুলে দুধে মেশাল। টেরিয়ারটার সামনে ধরতেই হতভাগ্য জন্তুটা সেই পানীয়ে ঠোঁট ভেজাতে না ভেজাতেই তার সারা দেহটা থরু থর করে কেঁপে উঠেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত নির্জ্জীব হয়ে গেল।
শার্লক হোমস একটা লম্বা নিঃস্বাস ফেলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘নিজের উপরে আরও বিশ্বাস রাখা উচিত ছিল। একটা বিশেষ ঘটনা যদি একটা র্দীঘ অনুমান-শৃংখলের বিরোধী হয়, তাহলে সে ঘটনাটির অন্য কোন ব্যাখ্যা যে অবশ্যই পাওয়া যাবে—এতদিনেও সেটা অন্তত আমার জানা উচিত। ঐ বাক্সের দুটো বড়ির একটা ছিল মারাত্মক বিষ, অন্যটা ছিল সম্পূর্ণ অক্ষতিকর। বাক্সটা দেখবার আগেই এটা আমার বোঝা উচিত ছিল।’
এই সর্বশেষ বক্তব্যটি এতই চাঞ্চল্যকর যে তার বুদ্ধি-শুদ্ধি ঠিক আছে কিনা সেবিষয়ে সন্দেহ হতে লাগল। অবশ্য মৃত কুকুরটা প্রমাণ করছে যে তার অনুমানই যথার্থ, আমার মনের কুয়াসাও যেন ক্রমেই কেটে যাচ্ছে। আমি যেন সত্যের একটা অস্পষ্ট অনুভূতি লাভ করেছি।
হোমস বলতে লাগল, ‘এইসব তোমাদের কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে, কারণ তদন্তের একেবারে শুরুতেই যে একমাত্র প্রকৃত সূত্রটি তোমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল তার গুরুত্ব তোমরা বুঝতে পারনি। সৌভাগ্যবশত সেটাকে আমি ধরতে পেরেছিলাম, এবং তারপর থেকে যা কিছু ঘটেছে সবই আমার মূল ধারণাকে সমর্থন তো সে করেছেই, বরং সে সবই তার ন্যায়সঙ্গত পরিণতি। কাজেই যেসব ব্যাপার তোমাদের বিচলিত করেছে এবং কেসটাকে আরও জটিল করে তুলেছে, সেগুলিই আমাকে দেখিয়েছে আলো, আমার সিদ্ধান্তকে করেছে দৃঢ়তর। বিস্ময়করতাকে রহস্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা একটা মস্ত বড় ভুল। সবচাইতে সাধারণ অপরাধই প্রায়শঃ সবচাইতে রহস্যময় হয়ে থাকে, কারণ তাতে এমন কোন নতুন বা বিশেষ লক্ষণ থাকে না যার থেকে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এক্ষেত্রেও মৃতের দেহটা যদি রাস্তায় পাওয়া যেত, যে সমস্ত ভয়ংকর ও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা-সমাবেশ সমস্ত ব্যাপারটাকে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে সেসব কিছুই যদি না থাকত, তাহলে এই খুনের রহস্যভেদ করা আরও অনেক বেশী কষ্টসাধ্য হত। এই সব বিস্ময়কর ঘটনার সমাবেশ কেসটাকে কষ্টসাধ্য করার বদলে বরং সহজসাধ্য করে তুলেছে।’
মিঃ গ্রেগসন যথেষ্ট ধৈর্যসহকারে এই ভাষণ শুনছিল। কিন্তু আর সে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। বলে উঠল, ‘দেখুন মিঃ র্শালক হোমস, আমরা সকলেই স্বীকার করছি যে আপনি খুব চতুর লোক, আপনার কাজের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। কিন্তু এখন আমরা শুধু থিওরি আর ভাষণের চাইতেও বেশী কিছু চাই। কথা হচ্ছে, আসল লোকটি কে। আমার কথা বলেছি। দেখছি, আমার ভুল হয়েছিল। যুবক চার্পেণ্টিয়ার দ্বিতীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। লেস্ট্রেড ছুটেছিল স্ট্যাঙ্গারসনের পিছনে। দেখা যাচ্ছে, তারও ভুল হয়েছিল। আপনি এখানে কিছু ইঙ্গিত করেছেন, ওখানে কিছু ইঙ্গিত করেছেন, মনে হচ্ছে, আমাদের চাইতে বেশিই আপনি জানেন। কিন্তু এখন আমরা সরাসরি জানতে চাই, এ বিষয়ে আপনি কতটা জানেন। এ কাজ কে করেছে তার নাম কি আপনি বলতে পারেন?’
লেস্ট্রেড বলল, ‘আমারও অভিমত যে গ্রেগসন ঠিকেই বলেছে স্যার।’ আমরা দুজনই চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। আমি ঘরে ঢুকবার পরে আপনি একাধিকবার বলেছেন যে আপনি সেগুলি আর চেপে রাখবেন না’
আমি বললাম, ‘আততায়ীর গ্রেপ্তার বিলম্বিত হলে সে নতুন কোন দুষ্কর্মের সুযোগ পেতে পারে।’
এইভাবে সকলে চেপে ধরায় হোমস অস্থিরভাবে ঘরের এদিক-ওদিক হাঁটটে লাগল। মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছে, ভুরু দুটো নেমে এসেছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেই তার এরকম হয়।
হঠাৎ থেমে আমাদের সামনে এসে সে বলে উঠল, ‘আর খুন হবে না। সে সম্ভাবনা একেবারেই বাতিল করে দিতে পার। তোমরা জানতে চেয়ছ, হত্যাকারীর নাম আমি জানি কি না। জানি। শুধু নাম জানাটা কিছু নয়, আসল কথা হচ্ছে তাকে পাকড়াও করা। আশা করছি অতি শীঘ্রেই সেটা পারব। যথেষ্ট আশা আছে যে আমার নিজের ব্যবস্থাপনায়ই সেটা সম্পন্ন হবে। কিন্তু খুব সর্তকতার সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে, কারণ একটি খুব সুচতুর ও বেপরোয়া লোকের সঙ্গে আমাদের যুঝতে হবে, এবং আমি প্রমাণ পেয়েছি যে তার এমন একজন সঙ্গী আছে যে তার মতই চতুর। কেউ তার খোঁজ পেয়েছে এটা যতক্ষণ সে না জানতে পারবে ততক্ষণই তাকে পাকড়াও করবার কিছুটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তিলমাত্র সন্দেহ বোধ করলেই সে নাম পাল্টে এই মহানগরীর চল্লিশ লক্ষ লোকের মধ্যে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আপনাদের মনে কোনরকম আঘাত দেবার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু একথা বলতে আমি বাধ্য যে দুটি লোকের মহড়া নেবার সামর্ত্য সরকারী পুলিশ বাহিনীর নেই, আর সেইজন্যই আপনাদের সহায়তা আমি চাই নি। আমি বিফলকাম হলে অবশ্য আপনাদের বাদ দেওয়ার দায়ভাগ আমাকে বহন করতে হবে। আর সেজন্য আমি প্রস্তুতও আছি। বর্তমানে আমি এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমার ব্যবস্থাকে বিপন্ন না করে যখনই আপনাদের সব কথা জানান সম্ভব হবে সেই মূহুর্তেই তা জানিয়ে দেব।’
এই প্রতিশ্রুতিতে বা গোয়েন্দা পুলিশ সম্পর্কে নিন্দাসূচক উল্লেখে গ্রেগসন বা লেস্ট্রেড কাউকেই সন্তুষ্ট মনে হল না। গ্রেগসনের মুখ, তার হলদে চুলের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল, আর লেস্ট্রেডের ক্ষুদে চোখ দুটি কৌতুহলে ও ক্ষোভে চকচক করতে লাগল। কেউ কোন কথা বলবার আগেই দরজায় একটা টোকা পড়ল এবং বাউন্ডুলে ছেলেদের দলপতি উইগিন্স ঘরে ঢুকল।
মাথার সামনেকার চুলে হাত রেখে সে বলল, ‘স্যার, নীচে গাড়িখানা রেখেছি।’
হোমস বলল, ‘লক্ষ্মী ছেলে।’ টেবিলের টানা থেকে একজোড়া স্টীলের হাত-কড়া বের করে সে আর বলল, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে এই ব্যবস্থাটা চালু কর না কেন? দেখ না, এর স্প্রিংটা কী সুন্দর কাজ করবে। মুহূর্তের মধ্যে আটকে ধরবে।’
লেস্ট্রেড মন্তব্য করল, ‘হাত-কড়া’ পরাবার লোকটিকে খুঁজে বের করতে পারলে পুরনো ব্যবস্থাও মন্দ কাজ করবে না।”
হোমস হেসে বলল, ‘খুব ভাল, খুব ভাল। গাড়োয়ান আমার বাক্সগুলো নামাতে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। উইগিন্স, তাকে উপরে আসতে বল।’
আমার সঙ্গী এমনভাবে কথা বলল যেন সে কোথাও ভ্রমণে বের হবে। এতে আমি বিস্মিত হলাম, কারণ এ সম্পর্কে সে তো আমাকে কিছুই বলে নি। ঘরের মধ্যে একটা ছোট পোর্টম্যান্টো ছিল। সেটাকে টেনে বের করে সে তাতে পটি আটকাতে লাগল। সেই সময় গাড়োয়ান ঘরে ঢুকল
সে তখন হাঁটু ভেঙে বসে পটি আঁটছিল। মুখ না ঘুরিয়ে বলল, ‘গাড়োয়ান, এই বকলসটা আটতে একটু সাহায্য কর তো।’
রুষ্ট, উদ্ধত ভঙ্গীতে এগিয়ে গিয়ে লোকটি কাজে হাত লাগাল। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লিক করে একটা শব্দ হল, ধাতুর কর্কশ আওয়াজ শোনা গেল এবং শার্লক হোমস লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘ভদ্রমহোদয়গণ’ ঝকঝকে চোখ মেলে সে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘মিঃ জেফারসন হোপের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দি,–ইনিই এনক ড্রেবার এবং জোসেফ স্যাঙ্গারসনের হত্যাকারী।’
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে গেল। এতদ্রুত ঘটল যে কোন কিছু বুঝবার সময়ই পেলাম না। সেই মুহূতের স্মৃতি এখনও আমার মনে স্পষ্ট হয়ে আছে। হোমসের সগৌরব ঘোষণা, তার কন্ঠস্বর, গাড়োয়ানের বিহ্বল বিকৃত মুখ, ইন্দ্রজালের মত তার কণ্ঠস্বর, গাড়োয়ারনের বিহ্বল বিকৃত মুখ, ইন্দ্রজালের মত তার কজ্বিতে আটকে থাকা চকচকে হাত-কড়ার প্রতি তার চোখের দৃষ্টি-সব। দু’এক সেকেন্ডের মত আমরা সবাই যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছিলাম। তারপরই একটা ক্রুদ্ধ দুর্বোধ্য গর্জন করে বন্দী হোমসের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জানালার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তার ধাক্কায় কাঠের ফ্রেম ও কাঁচ ভেঙে গেল। কিন্তু সে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাবার আগেই গ্রেগসন, লেস্ট্রেড এবং হোমস শিকারী কুকুরের মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে টেনে আনা হল ঘরের মধ্যে। তারপর শুরু হল এক প্রচন্ড সংঘর্ষ। লোকটি এতই শক্তিশালী ও হিংস্র যে আমাদের চারজনকে সে বারবার ছিটকে ফেলে দিতে লাগল। মনে হচ্ছিল সে যেন মুগীরোগক্রান্ত রুগীর মত অমিত বলশালী । কাঁচের ভিতর দিয়ে বের হবার চেষ্টার তার মুখ এবং হাত ভয়ংকর ভাবে কেটে গেছে। কিন্তু সে রক্তক্ষয়ের ফলে তার প্রতিরোধশক্তি হ্রাস পায় নি। একসময়ে লেস্ট্রেড যখন তার গলা-বন্ধনীর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তার গলায় ফাঁস আটকাবার উদ্যেগ করে ফেলল, তখন সে বুঝতে পারল আর লড়াই করে কোন লাভ নেই। তৎসত্ত্বেও যতক্ষণ তার হাত আর পা কসে একসঙ্গে বাঁধা না হল ততক্ষণ আমরা নিরাপদ বোধ করছিলাম না। সেটা হয়ে গেলে আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালাম।
শার্লক হোমস বলল, ‘ওর গাড়িটা আছে। তাতে চড়িয়েই ওকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া যাবে।’ তারপর স্মিত হেসে সে বলল, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের এই ছোট্ট রহস্যের সমাপ্তি ঘটল। এইবার আপনাদের যদি কোন প্রশ্ন থাকে আমাকে জানান। এখন আর এমন কোন বিপদ নেই যার জন্য আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অস্বীকার করব।