- বইয়ের নামঃ রক্ত সমীক্ষা
- লেখকের নামঃ আর্থার কোনান ডয়েল
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, গল্পের বই
রক্ত সমীক্ষা
০১. মিঃ শার্লক হোমস
রক্ত সমীক্ষা
অধ্যায় ০১
[সামরিক চিকিৎসা বিভাগ থেকে অবসরপ্রাপ্ত জন এইচ, ওয়াটসন, এম, ডি-র স্মৃতি-চারণা থেকে পুনর্মূদ্রণ]
০১. মিঃ শার্লক হোমস
১৮৭৮ সালে আমি লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রী লাভ করি এবং সেনাবিভাগে সার্জনদের জন্য নির্ধারিত পাঠক্রমে যোগদানের জন্য নেট্লি যাত্রা করি। সেখানকার পাঠ শেষ করে যথারীতি সহকারী সার্জনরূপে পঞ্চম নর্দাম্বারল্যাণ্ড রেজিমেণ্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। সিএ সময়ে ঐ রেজিমেণ্টের কর্মস্থল ছিল ভারতবর্ষ। আমি সেখানে যোগদান করবার আগেই দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ বেধে যায়। বোম্বাইতে জাহাজ থেকে নেমেই জানতে পারলাম আমার রেজিমেণ্ট গিরিবর্ত্মের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের দেশে প্রবেশ করেছে। আমার মত আরও অনেক অফিসারের সঙ্গে যাত্রা করে নিরাপদেই কান্দাহার পৌঁছলাম এবং আমার রেজিমেণ্টকে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্মভার গ্রহণ করলাম।
সেই অভিযান অনেকের জন্যই এনে দিল সম্মান আর পদোন্নতি, কিন্তু দুর্ভাগ্য আর বিপদ ছাড়া আমাকে সে আর কিছুই দিল না। আমার বাহিনী থেকে সরিয়া আমাকে বার্কশায়ার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হলে এবং তাদের সঙ্গেই মাইওয়ান্দের মারাত্মক যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করলাম। সেখানেই একটি ‘যেজাইল’ বুলেট আমার কাঁধে বিদ্ধ হয়ে একখানা হাড় ভেঙে চুরমার করে দিল আর সাবক্লেভিয়ান ধমনীটা ঘেসড়ে গেল। আমার আর্দালি মারের প্রভুভক্তি আর সাহসের জন্যই খুনে গাজীদের হাত থেকে কোনরকমে বেঁচে গেলাম। একটা ভারবাহী ঘোড়ায় চাপিয়ে সে আমাকে নিরাপদে বৃটিশ লাইনে নিয়ে এল।
যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট এবং দীর্ঘস্থায়ী কষ্টভোগের ফলে দুর্বল অসহায় অবস্থায় একদল আহত সৈনিকের সঙ্গে আমাকে পেশোয়ারের বেস-হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানেই ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলাম। ক্রমে ওয়ার্ডের ভিতরে হাঁটাচলা করা আর বারান্দায় রৌদ্রে একটু-আধটু বেড়াবার মত স্বাস্থ্যও ফিরে পেলাম। হঠাৎ ভারতের অভিশাপ আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম। কয়েক মাস আমার জীবনের কোন আশাই ছিল না। অবশেষে আমার যখন সেরে উঠলাম তখন আমি এতই দূর্বল ও শীর্ণকায় হয়ে পড়লাম যে একটা মেডিক্যাল বোর্ড স্থিত করলেন,–আর একটি দিনও নষ্ট না করে আমাকে লণ্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। তদনুসারে আমাকে সৈন্যবাহী জাহাজ ‘ওরোণ্টেস’-এ তুলে দেওয়া হল এবং তার এক মাস পরে পোর্টসমাউথ জেটিতে নামলাম। নষ্টস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের কোন আশাই তখন ছিল না, তবু স্নেহময় সরকার স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য নয় মাস সময় দিলেন।
ইংলণ্ডে আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না। কাজেই আমি তখন বাতাসের মত স্বাধীন, অবশ্য দৈনিক এগারো সিলিং ছয় পেনি আয়ে একজন লোক যতটা স্বাধীন হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই আমি লণ্ডনে হাজির হলাম, কারণ লণ্ডন হচ্ছে এমন একতা বড় ডোবা যেখানে সারা সাম্রাজ্যের যত ভ্রমণবিলাসী আর আলস্যপরায়ণ লোকেরা এক দূর্বার টানে এসে মিলিত হয়। স্ট্রাণ্ড-এর একটা প্রাইভেট হোটেলে আরামহীন অর্থহীন জীবন কাটতে লাগল। পকেটে যা টাকা ছিল তার তুলনায় একটু বেশী স্বাধীনভাবেই চলতে লাগলাম। ফলে ক্রমে আর্থিক অবস্থা এতই ভীতিপ্রদ হয়ে উঠল যে অবিলম্বেই বুঝতে পারলাম হয় মহানগরী ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে হবে, আর না হয় জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ পাল্টাতে হবে। শেষের বিকল্পটাই বেছে নিলাম। স্থির করলাম, হোটেল ছেড়ে কোন স্বল্পব্যয়সাধ্য অঞ্চলে একটা বাসা নেব।
যেদিন এই সিদ্ধান্ত করলাম সেইদিনই ‘ক্রাইটেরিয়ন বার’-এ দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় কে যেন কাঁধে হাত রাখল। ফিরে দাঁড়িয়েই চিনতে পারলাম—স্ট্যামফোর্ড, বার্টস-এ আমার অধীনে ড্রেসার ছিল। লণ্ডনের বিপুল জনারণ্যে পরিচিত মুখের দর্শন পাওয়া একজন সঙ্গীহীন লোকের কাছে খুবই সুখকর। এর আগে স্ট্যামফোর্ড আমার বিশেষ বন্ধুস্থানীয় ছিল না, কিন্তু সেদিন তাকে আমি সাগ্রহে অভ্যর্থনা জানালাম। সেও আমাকে দেখে খুশিই হল। আনন্দের আতিশয্যে তাকে ‘হোলবর্ণ’ এ মধ্যাহ্ন ভোজনের আমন্ত্রণ জানালাম এবং একটা এক্কাগাড়ি নিয়ে দুজনে যাত্রা করলাম।
লণ্ডনের জনবহুল রাজপথ দিয়ে সশব্দে যেতে যেতে সবিস্ময়ে সে প্রশ্ন করল, ‘শরীরটাকে কি করে ফেলেছ ওয়াটসন? বাখারির মত শুকিয়ে গেছ, গায়ের রঙ হয়েছে বাদামের মত।‘
আমার অভিযানের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ তাকে দিলাম। সে বিবরণ শেষ হতেই আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী শুনে সমবেদনার সুরে সে বলল, ‘আহা বেচারি! এখন কি করবে?’
‘একটা বাসা খুঁজছি’, আমি জবাব দিলাম। ‘যুক্তিসঙ্গত ভাড়ায় একটা আরামদায়ক বাসা পাওয়া যায় কিনা সেই সমস্যারই সমাধান করতে চেষ্টা করছি।‘
আমার সঙ্গী মন্তব্য করল, ‘খুব আশ্চর্য তো! তুমিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যে ঐ কথাগুলি আজ আমাকে বললে।‘
‘প্রথম ব্যক্তিটি কে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘লোকটি হাসপাতালের কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাজ করে। আজ সকালেই সে দুঃখ করছিল। একটা ভাল বাসা সে পেয়েছে। কিন্তু ভাড়াটা তার আয়ত্তের বাইরে। অথচ একজন অংশীদারও সে পাচ্ছে না।‘