দুঃখের বিষয়, খুব দু-একটি ক্ষেত্রে ছাড়া, আমার কপালে শুধু জুটেছে অসম্ভব ধূলিমলিন। জানালায় ঝোলানো নোংরা নেটের পর্দার ভেতর দিয়ে প্রকৃতিদর্শন। এইভাবে দেখতে আর। ভাল লাগে না, কারণ প্রকৃতি হল এই একটি জিনিস যাকে হতেই হবে নির্ভেজাল।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ১৬ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
নতুন নতুন ঝঞ্ঝাট–মিসেস ফান ডানের এখন প্রায় মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা; ঔর বুলি হল–গুলিতে ওঁর মাথা এফোঁড় হওয়া, জেল খাটা, ফাসি আর আত্মহত্যা। উনি আমাকে হিংসে করেন, কেননা পেটার ওঁকে না বলে আমার কাছে ওর মনের কথা বলে। ডুসেলের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টিতে ওঁর প্রত্যাশা মতো ভুসেল ধরা না দেওয়ায় ওঁর রাগ; ওর ভয় যে ওঁর স্বামী বোধ হয় সিগারেট খেয়ে ফারকোটের জন্যে রাখা সব টাকা ঠুকে দিচ্ছেন।
মিসেস ফান ডান এই করছেন চুলোচুলি, এই করছেন গালিগালাজ, এই ফেলছেন চোখের পানি, এই গাইছেন নিজের কাঁদুনি, আবার তারপরই নতুন করে শুরু করছেন কোদল। অমন এক বোকা, ঘ্যানঘেনে মেয়েমানুষকে নিয়ে কী যে করা যায়! কেউ ওঁর কথার কোনো দাম দেয় না, ওঁর চরিত্র বলে কিছু নেই এবং সকলের কাছেই উনি গজগজ করেন। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল, তাতে পেটার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনায়; মিস্টার ফান ডানের মেজাজ তিরিক্ষে হয়, আর মা-মণি হন বিশ্বনিন্দুক।
সত্যি, এ এক জঘন্য অবস্থা! এ থেকে বাঁচার সেরা নিয়ম একটাই–সব কিছু হেসে ওড়াও এবং আর কারো ব্যাপারে থেকো না। একটু স্বার্থপরের মতো শোনালেও, নিজের মনের জ্বালা জুড়োবার এটাই একমাত্র ওষুধ।
চার সপ্তাহ ধরে মাটি খোড়ার কাজে ক্রালারের আবার তলব পড়েছে। ক্রালার চেষ্টা করছেন ডাক্তারের সার্টিফিকেট আর কোম্পানির চিঠি দেখিয়ে এ থেকে উদ্ধার পেতে, কুপহুইস চাইছেন পাকস্থলীতে অপারেশন করাতে। কাল এগারোটায় সমস্ত ব্যক্তিগত টেলিফোন কেটে দেওয়া হয়েছে।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ২৩ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
এখানে বলবার মতো বিশেষ কিছু হচ্ছে না। ইংরেজরা শেরবুর্গের ওপর বড় দরের হামলা শুরু করেছে। পিম আর ফান ডানের মতে, ১০ই অক্টোবরের মধ্যে আমরা নির্ঘাত মুক্তি পেয়ে যাব। এই অভিযানে রুশরা যোগ দিয়েছে এবং কাল তার ভিতে-এর কাছে আক্রমণ শুরু করেছে, আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে জার্মানরা আক্রমণ করে। আমাদের আলু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে; এখন থেকে মাথা পিছু গুনে নিতে হবে, তাহলে সবাই জানবে কে কটা পেল।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ১৯৪৪
প্রিয়তম কিটি, এখন আর মনের সে ভাব নেই; সব কিছু এখন চমৎকার চলছে। শেরবুর্গ, ভিতেব্স্ক্ আর শ্লোকেন আজ শক্র কবলমুক্ত হয়েছে। বন্দী আর দখল করা জিনিস প্রচুর। এবার ইংরেজরা তাদের চাহিদামতো সৈন্য নামাতে পারবে। ইংরেজরা আক্রমণ শুরু করার তিন সপ্তাহ পরে গোটা কোঁতার্তা উপদ্বীপে তারা একটি পোতাশ্রয় পেয়েছে।
বিরাট সাফল্য বৈকি। সেই দিনটির পর এই তিন সপ্তাহে এমন দিন যায়নি যেদিন ঝড়বৃষ্টি হয়নি, এখানেও যেমন ফ্রান্সেও তেমনই। কিন্তু এই একটু দুর্ভাগ্য ইংরেজ আর মার্কিনদের বিপুল শক্তি প্রদর্শন রোধ করতে পারেনি।
আর সে শক্তিও যেমন-তেমন নয়।
সেই যে ‘আজব অস্ত্র’ সে তো পুরোদমেই চলছে; কিন্তু ইংল্যাণ্ডে খানিকটা ভাঙচুর নিয়ে দু-একটি চুটকি আর বোশ (জার্মান ভাষায় নিরেট মাথা) কাগজে পৃষ্ঠা ভরানো–এছাড়া ওর ফল আর কতটুকু? বলতে কি, বেশ-ভূমি’তে যখন হুঁশ হবে যে, সত্যিই বলশেভিকরা আসছে, তখন ওদের আরও বেশি হাঁটু কাঁপবে।
যেসব জার্মান মেয়ে মিলিটারিতে কাজ করে না, তাদের ছেলেপুলেসুদ্ধ গ্ৰোলিজেনে, ফিজল্যাণ্ডে আর গেন্ডারল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মূসের্ট (ডাচ নাত্সী নেতা) ঘোষণা করেছে যে, ওরা যদি ঠেলতে ঠেলতে এই পর্যন্ত আসে তাহলে মূসের্ট উর্দি পরবে।
মটু বুড়োর কি ইচ্ছে খানিকটা যুদ্ধ করার? এর আগে রুশদেশে সেটা করলেই সে পারত। কিছুদিন আগে শান্তির প্রস্তাব ফিনল্যাণ্ড বাতিল করে দেয়; পরে এর জন্যে হাত কামড়াবে, বোকচন্দরের দল!
২৭শে জুলাই আমরা কত দূরে থাকব বলে তোমার মনে হয়?
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ৩০ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি, খারাপ আবহাওয়া, কিংবা বলা যায়–তিরিশে জুন অব্দি একটানা খারাপ আবহাওয়া (মূল ইংরেজিতে লেখা)। ভালোই বলেছি, তাই না! এর মধ্যেই ইংরেজি আমি দুই কলম শিখে নিয়েছি। আমি যে পারি সেটা দেখাবার জন্যে অভিধানের সাহায্যে আমি ‘আদর্শ স্বামী’ পড়ছি। যুদ্ধ সুন্দর ভাবে চলেছে।
বোর্রইয়্স্ক্, মোগিলেফ আর ওরত্রার পতন হয়েছে, বন্দী প্রচুর।
এখনকার খবর সব ভালো এবং সকলেরই মেজাজের উন্নতি হচ্ছে। যারা উগ্র আশাবাদী। ছিল, তাদের এখন জয়জয়কার। এলির চুলের ধরন পাল্টেছে। এ সপ্তাহটা মিপের ছুটি। নতুন খবর বলতে এই।
তোমার আনা।
.
বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
পেটার যখন বলে এর পরে সে হবে চোর ডাকাত কিংবা যখন সে জুয়োখেলার কথা বলে, আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়; অবশ্যই ঠাট্টা করেই সে বলে, তবু আমার কেমন যেন মনে হয় নিজের দুর্বলতায় ও ভয় পায়।
মারগট আর পেটারের মুখে বার বার শুনি–হ্যাঁ, হতাম যদি তোমার মতো শক্ত আর তেজস্বী, যা চাই তা পাওয়ার জন্যে সবসময় যদি লেগে থাকতে পারতাম, আমার যদি দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার উৎসাহ থাকত, হ্যাঁ, তাহলে দেখতে…!’