এখানে উৎসাহের ধার এখন একটু কমে এসেছে; তবু আমরা সবাই আশা করছি যে এ বছরের শেষাশেষি যুদ্ধ মিটে যাবে।
ওর কাছাকাছি সময়ই হবে। মিসেস ফান ডানের কুঁই কুঁই শুনে শুনে কান ঝালাপালা; কবে আক্রমণ হবে এই বলে বলে মাথা তো আমাদের এতদিন খারাপ করে দিয়েছেন, এবার শুরু করেছেন কী খারাপ আবহাওয়া বলে সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যান করে আমাদের মাথার পোকা বের করে ফেলা। ওঁকে যদি এক বালতি ঠাণ্ডা পানির মধ্যে বসিয়ে মক্কায় তুলে রেখে দিয়ে আসা যেত তো ভালো হত।
ফান ডান আর পেটার ছাড়া গোটা ‘গুপ্ত মহল’ তিন খণ্ডের হাঙ্গেরীয় পালা’ পড়ে ফেলেছে। এই বইটি হল সুরকার, কলাবিৎ এবং শিশু বয়সেই বিস্ময়কর প্রতিভা ফাস্। লিস্ৎ-এর জীবন ইতিহাস।
বইটা খুবই সুপাঠ্য, কিন্তু আমার মতে এতে স্ত্রীলোকদের কথা একটু বেশি। লিস্ৎ শুধু যে শ্রেষ্ঠ আর প্রসিদ্ধতম পিয়ানোবাদক ছিলেন তাই নয়, সেই সঙ্গে ছিলেন সবচেয়ে রমণীমোহন ব্যক্তি সত্তর বছর বয়স অবধি। তিনি সহবাস করেছেন রাজকুমারী মারি দাওড়, মহারাজকুমারী ক্যারোলিন সাইন-ভিটগেনস্টাইন, নর্তকী লোলা মোনেস, পিয়ানো বাজিয়ে আগৃনেস কিংওয়ার্থ, পিয়ানো-বাজিয়ে সোফি সেন্টার, মহারাজকুমারী ও ইয়ানিনা, লেডি ওল্গা মেয়েনড, অভিনেত্রী লিলা কী যেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি এতজনের সঙ্গে যে বলে শেষ করা যাবে না। বইয়ের যেসব অংশে সঙ্গীত আর শিল্পের আলোচনা আছে, সে জায়গাগুলো অনেক বেশি সুন্দর। বইতে যাদের উল্লেখ আছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন শুমান, ক্লারা ভীক, হেক্টর বেৰ্লিওৎ য়োহানেস ব্রাজু, বীঠোফেন, গোআকিম, রিভার্ড ভাগনার হান্স ফনবুলো, আন্তন রবিশতিন, ফ্লাদারিক শোপা, ভিক্তর উগো, ওনোরা দে বালজাক, হিলার, হুমেল, চেনি, রসিলি, চেরুবিনি, পাগানিনি, মেসেজোন, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
লিৎ মানুষটি ছিলেন খুব ভালো, খুব দিলদরাজ লোক। নিজের সম্পর্কে ছিলেন বিনম্র, যদিও তাঁর ছিল অত্যধিক দেমাগ। তার কাছে যে আসত তাকেই তিনি সাহায্য করতেন। শিল্পকলা ছিল তার প্রাণ, কনিয়াক আর স্ত্রীলোক বলতে তিনি পাগল, কারো চোখের পানি সহ্য করতে পারতেন না, বিলক্ষণ ভদ্রলোক ছিলেন, কাউকে কোনো উপকার করতে উনি অরাজী হতেন না, টাকাপয়সার ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করতেন না, ভালবাসতেন ধর্মীয় স্বাধীনতা আর বিশ্বমুক্তি।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি, আরও একটা জন্মদিন চলে গেল। কাজেই এখন আমি পঞ্চদশী। বেশ অনেক উপহার পেলাম। প্ৰেঙারের চারুকলার ইতিহাসের পুরো পাঁচ খণ্ড, একপ্রস্থ অন্তর্বাস, একটি রুমাল, দুই বোতল দই, গুড়-আদায় তৈরি মশলাদার কেক, আর মা-মণি ও বাপির কাছ থেকে এটি উদ্ভিদতত্ত্বের বই, মারগটের কাছ থেকে জোড়া ব্রেসলেট, ফান ডানদের কাছ থেকে একটা বই, ডুসেলের কাছ থেকে নকুলদানা, মিপ আর এলির কাছ থেকে টফি আর খাতা এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ক্রালারের দেওয়া বই ‘মারিয়া তেরেসা’ এবং তিন টুকরো মালাইদার পনীর। পেটারের কাছ থেকে একগুচ্ছ সুন্দর স্বর্ণালী ঝুমকো ফুল; বেচারা অনেক চেষ্টা করেছিল আর কিছু দিতে, কিন্তু ওর কপাল খারাপ।
অতি জঘন্য আবহাওয়া, থেকে থেকে দমকা বাতাস, ঝমঝম করে বৃষ্টি, ফুলে ফুলে ওঠা সমুদ্র–এ সত্ত্বেও আক্রমণ সংক্রান্ত খবর এখনও খুব ভালো।
কাল চার্চিল, স্মার্টস, আইজুহাওয়ার আর আর্নল্ড ফ্রান্সের অধিকৃত আর মুক্ত গ্রামগুলো দেখতে গিয়েছিলেন। চার্চিল যে টর্পেডো-বোটে ছিলেন তা থেকে উপকূলে গোলা ছোড়া হয়।
ওঁকে মনে হয় আরও অনেকের মতো উনি ভয় কাকে বলে জানেন না–সত্যি, দেখে আমার হিংসে হয়। এই গুপ্ত ঘরে থেকে আমাদের পক্ষে বোঝ শক্ত, বাইরে লোকে এই খবরটাকে কি ভাবে নিয়েছে।
লোকে নিঃসন্দেহে এতে খুশি যে, দীর্ঘসূত্রী(?) ইংরেজরা আস্তিন গুটিয়ে এবার কিছু একটা কাজে নেমে পড়েছে। যেসব ডাচ এখনও ইংরেজদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ইংল্যাণ্ডকে আর তার বৃদ্ধদের সরকারকে উপহাস করে, ইংরেজদের ভীতুর জাত বলে, অথচ জার্মানদের ঘৃণা করে এবার তাদের টনক নড়া উচিত। হয়ত এই ঘটনায় এবার তাদের কানে কিছুটা পানি ঢুকবে।
গত দুই মাসের ওপর আমার ঋতু বন্ধ ছিল; অবশেষে শনিবার থেকে আবার তা শুরু হয়েছে। এত সব ব্যাট আর অশান্তির মধ্যেও আমাকে যে আর হাতশায় ফেলেনি, তাতেই আমার আনন্দ।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ১৪ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
এত ইচ্ছে আর এত রকমের ভাবনা, অভিযোগ আর তিরস্কার আমার মাথায় তাড়া করে ফিরছে। লোকে আমাকে যতটা মনে করে আমি সত্যিই ততটা দাম্ভিক নই। নিজের দোষত্রুটিগুলো আমি অন্যদের চেয়ে ঢের ভালো করে জানি। তবে তফাত এই, আমি এও জানি যে, আমি ভালো হতে চাই, আমি নিজেকে উন্নত করব এবং ইতিমধ্যে আমার দোষত্রুটি অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেন তাহলে প্রত্যেকে এখনও ধরে নেয় যে, আমি সাংঘাতিক ঝানু আর টাটা? আমি সত্যিই কি ঝানু? নাকি আমি সত্যিই তাই, আর ওরা হয়ত তা নয়? ব্যাপারটা যেন কেমন-কেমন, এখন মনে হচ্ছে, কিন্তু শেষ বাক্যটা আমি কাটছি না, কেননা প্রকৃতপক্ষে ওটা ততটা উদ্ভট চিন্তা নয়। প্রত্যেকেই জানে, যিনি আমার বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগকারী, সেই মিসেস ফান ডানের বুঝ-সমঝের একান্ত অভাব। আরও সরল করে বললে, বলতে হয় নির্বোধ’। অন্যেরা যদি বেশি ধারে কাটে, নির্বোধ লোকদের সেটা আবার সহ্য হয় না।