সোমবার মিসেস ফান ডান বলে চলেছেন, আমার পায়ে ব্যথা, গায়ে দেবার পাতলা জামা নেই। এই গরমে আর বাসন মাজতে পারি না। এমন বিশ্রী দিন কী বলব।
এখনও গরম আমার ধাতে সয় না; তবু ভালো যে, জোরে হাওয়া বইছে। বলে কী হবে, রোদ এখনও চনচনে।
তোমার আনা।
১০. পরিশেষে
মঙ্গলবার, ৫ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
‘গুপ্ত মহলে’ নতুন ঝঞ্ঝাট, খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ডুসেলের সঙ্গে ফ্রাঙ্ক দম্পতির লেগেছে মাখনের ভাগ নিয়ে। ডুসেল ঘাট মেনেছেন। মিসেস ফ্রাঙ্কের সঙ্গে এখন ওঁর খুব ভাব, ফষ্টিনষ্টি, চুমো খাওয়া এবং অমায়িক হাসিঠাট্টা।
ডুসেল স্ত্রীলোকের অভাব অনুভব করতে শুরু করেছেন। পঞ্চম বাহিনী রোম দখল করেছে। দুই পক্ষেরই স্থল ও বিমান বাহিনী শহরটিতে ভাঙচুর করা থেকে নিবৃত্ত হয়েছে এবং তার ফলে শহর অক্ষত আছে। সব্জি আর আল শেষ হয়ে এসেছে। আবহাওয়া বিশ্রী। ফরাসী উপকূলে আর পা দে কালেতে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ হচ্ছে।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ৬ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
ইংরেজি খবরে বলা হল, ‘আজ ডি-ডে’ ঠিকই, ‘আজ সেই দিনটিই বটে। আক্রমণ শুরু।
আজ সকাল আটটায় ইংরেজরা খবর দিল–কালে বুলোন, লে হাভরে, আর শেরবুর্গ, সেই সঙ্গে পা দে কালেতে (যেমন চলছিল) প্রচণ্ড বোমা ফেলা হয়েছে।
তাছাড়া নিরাপত্তার খাতিরে সব অধিকৃত রাজ্যে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে উপকূলবর্তী সমস্ত অধিবাসীকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের ব্যাপারে তারা যেন তৈরি থাকেন। হলে, ইংজেররা এক ঘন্টা আগে ওপর থেকে বিজ্ঞপ্তি ফেলবেন।
জার্মানদের খবর অনুযায়ী, ইংরেজ ছত্রীবাহিনী ফরাসী উপকূলে অবতরণ করেছে, ইংরেজদের অবতরণকারী জাহাজের সঙ্গে জার্মান নৌবহরের লড়াই চলছে–বি.বি.সি. থেকে বলা হয়েছে।
সকাল নয়টায় ঘরোয়া প্রাতঃরাশে এই বিষয়ে আমাদের কথা হল–এটা কি দুই বছর আগে দিয়েপের মত নিছক একটা পরীক্ষামূলক অবতরণ?
দশটায় ইংল্যাণ্ড থেকে জার্মান, ডাচ, ফরাসী এবং অন্যান্য ভাষায় বলা হল–’আক্রমন। শুরু করা হল!’–তার মানে, এটা আসল আক্রমণ। এগারোটায় ইংল্যাণ্ড থেকে জার্মান ভাষায় প্রচার করা হল, প্রধান সেনাপতি জেনারেল ডোয়াইট আইজনহাওয়ার ভাষণ দিলেন।
ইংল্যাণ্ড থেকে বারোটায় ইংরেজি খবরে বলা হল–’আজই সেই দিন।’ জেনারেল আইজুহাওয়ার ফরাসী জনগণের উদ্দেশে বললেন, এবার তুমুল লড়াই হবে, কিন্তু তারপর। আসবে জয়। ১৯৪৪ সাল পুরোপুরি বিজয়ের বছর; শুভমতু।
ইংল্যাণ্ড থেকে একটায় ইংরেজিতে খবর (অনুবাদ)–১১,০০০ বিমান প্রস্তুত, এবং না থেমে যাচ্ছে আর আসছে, উপকূলে অবতরণকারী সৈন্য এবং ব্যুহের পেছন থেকে আক্রমণ চলছে; ৪০০০ অবতরণকারী জাহাজ, তার সঙ্গে ছোট ছোট জলযান–তাতে করে শেরবুর্গ আর লে হারের মধ্যে অবিরত অবতরণকারী সৈন্য আর মালপত্র নামাচ্ছে। ইংরেজ আর মার্কিন সৈন্যরা ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
জেরব্রাণ্ডি, বেলজিয়ামের প্রধান মন্ত্রী, নরওয়ের রাজা হাকন, ফ্রান্সের দে-গোল, ইংল্যাণ্ডের রাজা এবং শেষে, কিন্তু সর্বোপরি, চার্চিল।
‘গুপ্ত মহলে খুব চাঞ্চল্য। এতদিন ধরে যা নিয়ে এত কথা হয়েছে, সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি, যা এখনও কিন্তু অবিশ্বাস্য, বড় বেশি কল্পিত বলে মনে হয়–সেই মুক্তি সত্যিই কি আসবে? ১৯৪৪ সালেই কি আমাদের জয়ের আশা পূর্ণ হবে?
এখনও জানি না, তবে আমাদের মনে আবার আশা জেগেছে। মনে নতুন বল পেয়ে আমরা শরীরে আবার শক্তি পাচ্ছি।
সব ভয়, সব কষ্ট আর লাঞ্ছনার সামনে আমাদের সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়াতে হবে; তার জন্যে এখন আমাদের ধীর-স্থির আর অবিচলিত থাকতে হবে। এখন আমাদের আরও বেশি দাঁতে দাঁত দিয়ে থেকে কান্না চেপে রাখতে হবে। ফ্রান্স, রাশিয়া, ইত্যাদি আর জার্মানিও হাউমাউ করে সকলে তাদের আর্তির কথা জানাতে পারে শুধু আমরাই এখনও সে অধিকার। থেকে বঞ্চিত।
জানো কিটি, এই আক্রমণের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল এই যে, আমি মনে-প্রাণে বুঝছি বন্ধুরা আসছে। ঐ ভয়ঙ্কর জার্মানরা এতদিন এমন ভাবে আমাদের ওপর অত্যাচার করেছে, আমাদের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে রেখেছে যে, আজ বন্ধুদের কথা আর মুক্তির কথা ভাবতে পেরে মনের মধ্যে ভরসা জাগছে।
এটা আর এখন ইহুদিদের ব্যাপার থাকছে না; হল্যাণ্ড আর সারা ইউরোপের ভাগ্য আজ এর সঙ্গে জড়িত। মারগট বলছে, আমি হয়ত এই সেপ্টেম্বরে বা অক্টোবরেই আবার ইস্কুলে ফিরে যেতে পারব।
তোমার আনা।
পুনশ্চঃ আমি তোমাকে যখনই যা নতুন খবর হবে জানাব।
.
শুক্রবার, ৯ জুন, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
আক্রমণের ব্যাপারে জবর খবর। মিত্রপক্ষ ফরাসী উপকূলের একটি ছোট গ্রাম বাইয়ু দখল করেছে; এখন তারা কায়েন দখল করার জন্যে লড়ছে।
এটা পরিষ্কার যে, যেখানে শেরবুর্গ অবস্থিত সেই উপদ্বীপটি তারা বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় আছে। রোজ সন্ধ্যেবেলায় সামরিক সংবাদদাতারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খবর দেন; সৈনবাহিনীর লোকদের কী কী অসুবিধে, তাদের সাহসিকতা আর উৎসাহ উদ্দীপনা সম্পর্কে তারা বলেন।
শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না এমন সব খবর তারা যোগাড় করেন। জখম হয়ে যারা ইংল্যাণ্ডে ফিরেছে তাদেরও কেউ কেউ রেডিওতে বলেছে। আবহাওয়া খারাপ হওয়া সত্বেও বিমানবাহিনীরা সারাক্ষণ আকাশে টহল দিচ্ছে। বি.সি.সি-র খবরে শুনলাম আক্রমণ শুরু হওয়ার দিন সৈন্যদের সঙ্গে চার্চিল অবতরণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আইজহাওয়ার আর অন্য জেনারেলরা ওঁকে নিবৃত্ত করেন। বয়স সত্তর তো হবেই–বলিহারি সাহস এখনও লোকটার।