মিপ আর ক্রালারের মাথায় লুকিয়ে থাকা আটটি প্রাণীর গুরুভার চাপানো। মিপ্ যাই করুন তার স্বপনে জাগরণে আমরা। ক্রালারের কাধে এত বিরাট দায়িত্ব যে, মাঝে মাঝে অতিরিক্ত চাপে মুখ দিয়ে তার কথা বেরোয় না। কুপহুইস আর এলিও আমাদের ভালোভাবে দেখাশুনো করেন। তবে মাঝে মধ্যে তাঁরা কয়েক ঘণ্টা বা একদিন কিংবা এমন কি দুদিনের জন্যেও মাথা থেকে বোঝাটা তবু নামিয়ে রাখতে পারেন। ওঁদের সকলেরই নিজের নিজের। সমস্যা আছে; কুপহুইসের স্বাস্থ্য ভালো নয়। এলির বাদানের ব্যাপার, সেটা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও ওঁরা একটু-আধটু কোথাও বেড়িয়ে আসতে পারেন, বন্ধুদের বাড়িতে ঢু মারতে পারেন এবং তাছাড়া ওঁদের আছে সাধারণ মানুষের মোলআনা জীবন। কিছু সময়ের জন্যে হলেও ওঁদের চোখের সামনে থেকে কখনও-কখনও অনিশ্চয়তার পর্দা সরে যায়। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার হাত থেকে আমাদের এক মুহূর্তও রেহাই নেই। এখানে আমরা আছি আজ দুই বছর হল; এই অসহ্যপ্রায়, ক্রমবর্ধমান চাপের ভেতর আরও কতকাল আমাদের থেকে যেতে হবে?
মলনালী বুজে গেছে, কাজেই পানি ঢালা চলবে না, ঢাললেও যৎসামান্য; শৌচাগারে। গেলে পায়খানার বুরুশ আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় এবং নোংরা পানি আমরা। ওডিকোলনের একটা বড় পাত্রে জমা করে রাখি। আজকের দিনটা না হয় যে-সো করে কাটানো গেল, কিন্তু কাল যদি কলের মিস্ত্রি একা পেরে না ওঠে, তখন কী দশা হবে? পুরসভার সাফাই কর্মী তো মঙ্গলবারের আগে আসবে না।
মিপ একটা পুতুলের আকারের কিসমিস দেওয়া কেক পাঠিয়েছেন; তার গায়ে কাগজে লেখা ‘শুভ হুইটসান’। এটা যেন আমাদের প্রায় ঠাট্টা করার মতো শোনাচ্ছে; আমাদের এখনকার মনের অবস্থা এবং আমাদের অস্বস্তির সঙ্গে ‘শুভ’ কথাটা একেবারেই বেমানান। সব্জিলার ব্যাপারটা আমাদের আরও বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছে, চারপাশে সবাই এখন আবার ‘শ্ শ্, শ্ শ্’ করছে এবং সব ব্যাপারেই আমরা এখন আগের চেয়ে চুপচাপ হয়ে গিয়েছি।
পুলিস ওখানে দরজা ভেঙে ঢুকেছে, আমাদের এখানেও তা করতে পারে। যদি একদিন আমাদেরও… না, আমি সেটা লিখব না, কিন্তু আজ আমি মন থেকে সেটা উড়িয়ে দিতে পারছি না। উল্টে, এতদিন যে বিভীষিকার মধ্যে ছিলাম, আজ তা সমস্ত ভয়ঙ্করতা নিয়ে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আজ সন্ধ্যে আটটায় নিচের তলায় আমাকে একেবারে একা পায়খানায় যেতে হল; নিচে তখন কেউ ছিল না, কেননা সবাই তখন রেডিও শুনতে ব্যস্ত।
আমি মনে সাহস আনার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু খুব কঠিন। ওপরতলায় সব সময়ই নিজেকে আমার নিরাপদ লাগে; নিচের তলার প্রকাণ্ড, নিঃশব্দ বাড়িটাতে একা একা আমার গা ছমছম করে; ওপরতলা থেকে ভুতুড়ে সব আওয়াজ, আমি একা; রাস্তা থেকে মোটরগাড়ির প্যাক প্যাক। আমাকে তাড়াতাড়ি সারতে হবে, কেননা ঐ অবস্থাটার কথা মনে হলেই আমার কাপুনি ধরে।
বার বার আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি–আমরা যদি অজ্ঞাতবাসে না যেতাম, এত দৈন্যদশার মধ্যে গিয়ে যদি আমরা এতদিনে মরে যেতাম, সেটাই কি আমাদের পক্ষে এর চেয়ে ভালো হত না? বিশেষ করে, আমাদের রক্ষাকর্তাদের তো আর এই বিপদের মধ্যে পড়তে হত না?
কিন্তু এইসব ভাবনা থেকে আবার আমরা নিজেদের গুটিয়ে নিই। কেননা এখনও আমরা জীবনের প্রতি আসক্ত; এখনও আমরা প্রকৃতির কণ্ঠস্বর ভুলে যাইনি, এখনও সবকিছু নিয়েই আমার আশা, এখনও আশা। শীগগিরই কিছু একটা ঘটবে বলে আমি আশা করি দরকার হলে গুলি-গোলা; শুধু এই অস্থিরতাই আমাদের পিষে মারছে। কঠিন হলেও, যবনিকা পড়ুক; তাহলে আমরা অন্তত জানতে পারব শেষ পর্যন্ত আমরা জিতছি না হারছি।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ৩১ মে, ১৯৪৪
আদরের কিটি, শনি, রবি, সোম, মঙ্গল–এতদিন এত প্রচণ্ড গরম গেছে যে, কলম স্রেফ হাতে করতেই পারিনি। সেইজন্যে তোমাকে লিখে উঠতেই পারিনি। নর্দমাগুলো শুক্রবার আবার বিগৃড়ে যায়, ফের শনিবার ঠিক করে ফেলা হয়। বিকেলে কুপহুইস এসেছিলেন আমাদের দেখতে; কোরিকে নিয়ে অনেক সাতপাঁচ বললেন এবং জানালেন ইয়োপির সঙ্গে একই হকি ক্লাবে ও আছে।
রবিবারে এসে এলি দেখে গেলেন কেউ সিঁদ কেটে ঢুকেছিল কিনা; প্রাতঃরাশ পর্যন্ত এলি ছিলেন।
সুইট মাডেতে মিস্টার ফান সান্টেন গোপন আস্তানার পাহারাদারের কাজ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবারে যাহোক জানলাগুলো খোলা গেল।
এমন সুন্দর, কবোষ্ণ, এমন কি গরমও বলা চলে, হুইটসান আগে কখনও দেখা যায়নি। এখানে এই ‘গুপ্ত মহলে’ গরম প্রচণ্ড; সংক্ষেপে তোমাকে আমি এই কলোঞ্চ দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলব এখানে কী ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
শনিবার সকালে আমরা সবাই একবাক্যে বললাম, ‘বাহ্, কী চমৎকার আবহাওয়া।‘ বিকেলে যখন জানালাগুলো বন্ধ করতে হল, তখন বললাম, ‘ইসু, এতটা গুমোট না হলেই ভালো হত।’
রবিবার–আর সহ্য করা যায় না, এই গরম। মাখন গলে যাচ্ছে, বাড়িতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে শরীর স্নিগ্ধ হয়, রুটিগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, দুধ একটু বাদেই টকে যাবে, জানলাগুলো খোলা যাচ্ছে না; আমরা যত আঁস্তাকুড়ের ছাই এখানে দমবন্ধ হয়ে পচে মরছি আর অন্য লোকেরা হুইটসানের ছুটিতে দিব্যি মজা করছে।