তারপর থেকে ক্লাসে আমি অবাধে কথা বলতে পারি, আমার ঘাড়ে বাড়তি কাজ চাপানো হয় না; বস্তুত কেপ্টর সমস্ত সময়ই ব্যাপারটা নিয়ে তামাসা করেন।
তোমার আনা
.
বুধবার, ২৪ জুন, ১৯৪২
আদরের কিটি,
এখন সব আগুনে সেদ্ধ হচ্ছে, প্রচণ্ড গরমে আমরা সব রীতিমত গলে যাচ্ছি। আর ঠিক সেই সময় আমাকে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে পায়ে হেঁটে। ট্রাম যে কত ভালো জিনিস এখন আমি তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছি; কিন্তু ট্রামে চড়ার বিলাস ইহুদীদের পক্ষে নিষিদ্ধ আমাদের পক্ষে পা-গাড়িই প্রশস্ত। কাল দুপুরে টিফিনের সময়টাতে আমাকে যেতে হয়েছিল
য়ান লুইকেন স্ট্রাটে দাঁতের ডাক্তারের কাছে। দুপুরের পর ফিরে ইস্কুলে আরেকটু হলেই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাগ্য ভালো, দাঁতের ডাক্তারের সহকারিণী ছিলেন খুব দয়ালু, তিনি আমাকে খানিকটা পানীয় দিয়েছিলেন–মানুষটি বড় ভালো।
ফেরী নৌকোয় আমরা পার হতে পারি–ব্যস, ঐ পর্যন্ত। যোসেফ ইস্রাইলস্কাডে থেকে একটা ছোট বোট ছাড়ে, সেখানে বোটের লোকটিকে বলতেই সে আমাদের তৎক্ষণাৎ তুলে নিল। আজ আমাদের যে কষ্টের একশেষ তার জন্যে কিন্তু ওলন্দাজরা দায়ী নয়।
ইস্কুলে যেতে না হলে বাঁচতাম–কেননা ঈস্টারের ছুটিতে আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে আর মা-মণিরটা বাপি দিয়েছেন এক খৃস্টান পরিবারকে নিরাপদে রাখার জন্যে। তবু রক্ষে, সামনে ছুটি–আর এক হপ্তা কাটাতে পারলেই আমাদের শান্তি। কাল একটা মজার ব্যাপার হল; সাইকেল রাখার আড়তটা পেরোচ্ছি, এমন সময় একজন আমার নাম ধরে ডাকল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সেই সুন্দর দেখতে ছেলেটা, পরশু সন্ধ্যেবেলায় আমার মেয়ে-বন্ধু ইভাদের বাড়িতে যার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। লাজুক-লাজুক ভাব করে এগিয়ে এসে হ্যারি গোল্ডবার্গ বলে সে তার পরিচয় দিল। আমি একটু থতমত খেয়ে ঠিক ধরতে পারছি না ছেলেটা কী চাইছে। কিন্তু আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ইস্কুল অব্দি আমার সঙ্গে সে গেলে আমার আপত্তি হবে কিনা এটা সে জানতে চাইল। আমি বললাম, তুমি তো ঐ রাস্তাতেই যাচ্ছ, চলো আমিও যাচ্ছি’–এই বলে দুজনে হাঁটতে লাগলাম। হ্যারির বয়েস ষোল; ওর ঝুলিতে আছে মজাদার সব গল্প। আজ সকালেও রাস্তায় ও আমার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার মনে হয় এবার থেকে রোজই থাকবে।
তোমার আনা
.
মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ১৯৪২
আদরের কিটি,
এর আগে একদণ্ড সময় পাইনি তোমাকে লেখার। বৃহস্পতি বার সারাটা দিন বন্ধুদের সঙ্গে কেটেছে। শুক্রবার বাড়িতে অতিথিরা এসেছিল, আজ অবধি এইভাবে একটার পর একটা। এই একটা সপ্তাহে হ্যারি আর আমি পরস্পর সম্পর্কে বেশ খানিকটা জেনেছি; হ্যারি ওর জীবনের অনেক বৃত্তান্ত আমাকে বলেছে। হল্যাণ্ডে ও একা এসেছে। ও এখন ওর দাদু দিদিমার কাছে থাকে। হ্যারির বাবা-মা থাকেন বেলজিয়ামে। ফ্যানি বলে হ্রারির এক মেয়ে বন্ধু ছিল। ফ্যানিকেও আমি চিনি। খুব নরম প্রকৃতির খাটো ধরনের মেয়ে। আমাকে দেখার পর হ্যারির মনে হচ্ছে সে এতদিন ফ্যানির সান্নিধ্যে দিবাস্বপ্ন দেখত। আমার উপস্থিতিতে এমন কিছু সে পায় যা তাকে জাগিয়ে রাখে। দেখছ তো, আমরা সকলেই কোনো না কোনো কাজে লাগি এবং কখনও কখনও সেসব অদ্ভুত ধরনের কাজ! গোপি শনিবার রাত্তিরে এখানে ছিল, তবে রবিবার লিসূদের ওখানে চলে যায়; সময় যেন কাটতেই চাইছিল না। কথা ছিল হ্যারি সন্ধ্যেবেলায় আসবে। ছ-টা নাগাদ সে ফোন করলে আমি গিয়ে ধরলাম। হ্যরির গলা, ‘আমি হ্যারি গোল্ডবার্গ, দয়া করে আমাকে একটু ডেকে দেবেন?
‘হ্যাঁ, হ্যারি, আমি আনা বলছি’
‘হ্যালো, আনা, কেমন আছ?’
‘খুব ভালো, ধন্যবাদ।‘
‘আজ সন্ধ্যেবেলা আসতে পারছি না বলে আমার খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু তবু শুধু একটু কথা বলে আসতে চাই। দশ মিনিটের মধ্যে আসছি–অসুবিধে হবে না তো?
‘মোটেই না। এসো কিন্তু।‘
‘আচ্ছা, ছাড়ছি। এখুনি এসে যাব।’
রিসিভারটা রাখলাম।
চটপট ফ্রক বদলে ফেলে মাথার চুল একটু আঁচড়ে নিলাম। তারপর হ্যারির পথ চেয়ে দুরুদুরু বক্ষে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। অবশেষে দেখতে পেলাম ও আসছে। দেখামাত্র দৌড়ে নিচে ছুটে গেলাম না যে, সেটাই আশ্চর্য। তার বদলে ও বেলু না বাজানো পর্যন্ত আমি ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। তারপর নিচে গেলাম। আমি দরজা খুলবামাত্র হ্যারি ছিটুকে ভেতরে এল। ‘আনা, আমার দিদিমা মনে করেন তোমার মতো ছোট্ট মেয়ের আমার সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ির বাইরে যাওয়া ঠিক নয়, উনি মনে করেন আমার উচিত লোর্স এ যাওয়া। তবে এটা তুমি আশাকরি জানো যে, আমি আর এখন ফ্যানিকে নিয়ে বেড়াতে বের হই না?’
‘জানি না তো; কেন, তোমরা কি আড়ি করেছ?’
‘না, না, তা নয়। আমি ফ্যানিকে বলেছি যে, আমাদের দুজনের ঠিক পটে না; সুতরাং দুজনে মিলে বাইরে বের না হওয়াই আমাদের পক্ষে ভালো। অবশ্য আমাদের বাড়িতে সবাই সব সময়ই তাকে স্বাগত জানাবে; তেমনি আশাকরি ওর বাড়িতেও আমার জন্যে দ্বার অবারিত থাকবে। দেখ, আমি ভেবেছিলাম ফ্যানি অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বেরোয়; ওর সঙ্গে আমার ব্যবহারটাও হয়েছিল সেইরকম। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ সত্যি ছিল না। এখন আমার মামা বলেন আমার উচিত ফ্যানির কাছে ক্ষমা চাওয়া। আমার বয়ে গেছে। সুতরাং গোটা ব্যাপারটাই আমি কাটাকাটি করে দিয়েছি। এটা তো ছিল আরও অনেক কারণের মধ্যে মাত্র একটি।