দিন দুই আগে সন্ধ্যেবেলায় পেটার সিঁড়ির ঘরে উঠেছিল কিছু পুরনো কাগজ আনতে। কলআঁটা দরজাটা শক্ত করে ধরে ধাপে ধাপে ওর নামবার কথা। না তাকিয়ে যেই ও হাত দিয়ে চেপেছে হঠাৎ আচমকা ব্যথা পেয়ে সিঁড়ি থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। নিজের অজান্তে একটা বড় ধেড়ে ইঁদুরের গায়ে হাত পড়ে যাওয়ায় ইঁদুরটা মোক্ষমভাবে তাকে কামড়ে দেয়। ও যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছল, তখন ও কাগজের মত সাদা, হাটু দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে, ওর পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। আসলে তা হওয়ারই কথা; বড় ধেড়ে-ইঁদুরের গায়ে থাবা দেওয়া, কাজটা খুব মনোরম নয়; আর তার দরুন কামড় খাওয়া সত্যিই ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ১২ মার্চ, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
তোমার সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দিই; ইনি হলেন মা-ঠাকুরন ফ্রাঙ্ক, তারুণ্যের রক্ষাকর্তা। তরুণদের জন্যে বাড়তি মাখন; আধুনিক তরুণ-তরুণীদের সমস্যা; সব কিছুতেই মা-মণি তরুণ-তরুণীদের হয়ে লড়েন এবং খানিকটা টানা-হেঁচড়া করে শেষপর্যন্ত সব সময়ই নিজের গো বজায় রাখেন। একটা বোতলে শোলমাছ রাখা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে; মুশ্চি আর বোখার তাতে ভালো ভোজ হবে। বোখাকে এখনও তুমি দেখনি অবশ্য আমরা অজ্ঞাতবাসে আসার আগে থেকেই ও এখানে ছিল। ও হল গুদামের আর অফিসের বেড়াল; গুদামঘরগুলোতে ইঁদুরদের ও ঢিট রাখে। ওর বেয়াড়া ধরনের রাজনৈতিক নামের একটা ব্যাখ্যা দরকার। কিছুকাল কোম্পানির ছিল দুটো বেড়াল; গুদামের জন্যে একটা আর চিলেকোঠার জন্যে একটা। মাঝে মাঝে হত কী, দুই বেড়ালের দেখা হত; আর তার ফলে দুজনের হত ভয়াবহ লড়িই। গুদামের বেড়ালটাই সবসময় আগে ঝাপিয়ে পড়ত; এ সত্ত্বেও চিলেকোঠার বেড়ালটাই কী করে যেন জিতে যেত–দেশজাতের লড়াইতে ঠিক যেমন হয়।
কাজেই গুদামের বেড়ালটার নাম দেওয়া হয়েছিল জার্মান বা ‘বোখা’; আর চিলেকোঠার বেড়ালের নাম দেওয়া হয়েছিল ইংরেজ বা টমি। পরে টমিকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল; আমরা নিচের তলায় গেলে বোখা আমাদের আপ্যায়ন করে।
কিড়নি বিন আর হ্যারিকিট বিন খেয়ে খেয়ে আমাদের এমন অরুচি ধরে গেছে যে এখন ওসব আমার দুই চক্ষের বিষ। এমনকি মনে হলেও আমার গায়ের মধ্যে পাক দেয়। সন্ধ্যেবেলায় এখন আর পাউরুটি দেওয়া হয় না। বাবা এইমাত্র বললেন ওঁর মেজাজ ভালো নেই। ওঁর চোখ দুটো আবার এত বিষন্ন দেখাচ্ছে–বেচারা!
একটা বই পড়ছি। দরজায় কে কড়া নাড়ে’। লেখক ইনা বোড়িয়া বাকার। বইটা একদণ্ড ছাড়তে পারছি না। পরিবারের কাহিনীটা অসাপ্রারণভাবে লেখা হয়েছে। তাছাড়া এতে আছে যুদ্ধ, লেখকদের জীবন, স্ত্রী স্বাধীনতা; এবং সত্যি বলতে, ওসবে আমার অতটা আগ্রহ নেই।
জার্মানির ওপর হয়েছে ভয়াবহ বিমান হামলা। মিস্টার ফান ডানের মেজাজ বিগড়ে আছে; কারণ-সিগারেটের অভাব। টিনের সব্জি আমরা ব্যবহার করব কি করব না, এ নিয়ে আলোচনায় রায় হল আমাদের পক্ষে।
মাত্র একজোড়া জুতোয় আর আমার চলছে না। স্কি-বুট আছে বটে, কিন্তু বাড়ির মধ্যে ওতে তেমন কাজ হয় না। ৬.৫০ ফ্লোরিনে কেনা একজোড়া আটপৌরে চটি আমার পায়ে মাত্র এক হপ্তার বেশি গেল না, এখন ওটা পরার বাইরে। মিপ হয়ত চোরাপথে কিছু একটা জুটিয়ে আনবেন। আমাকে বাপির চুল ছাটতে হবে। পিম্ এখনও বলে যাচ্ছেন যে, আমি নাকি চুল ছাঁটার কাজে এতই পোক্ত যে, যুদ্ধের পর উনি কখনই আর দোস্রা কোনো নাপিতের কাছে যাবেন না। তাও যদি প্রায়ই ওঁর কানে খোঁচা লাগিয়ে না দিতাম।
তোমার আনা।
.
বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
তুরস্ক লড়াইতে যোগ দিয়েছে। দারুণ উত্তেজনা। খবরটার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
এক ঘণ্টা পরে হরিষে বিষাদ ঘটল। তুরস্ক এখনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি। শুধু ওদের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য কথাপ্রসঙ্গে বলেছে যে তাদের শীগগিরই নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিতে হবে। ড্যামে (রাজপ্রাসাদের সামনের একটি চক) একটি কাগজ নিয়ে হকার চেঁচাচ্ছিল, ‘ইংলণ্ডের পক্ষে তুরস্ক’। লোকটার হাত থেকে কাগজগুলো লোকে ছিনিয়ে নেয়। সুসংবাদটা এমনি। ভাবে আমাদের কানে পৌঁছে যায়; ৫০০ আর ১০০০ গিল্ডারের নোট বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কালোবাজারী এবং ঐ ধরনের লোক, তবে তার চেয়েও বেশি যাদের হাতে অন্য রকমের ‘কালো’ টাকা আছে, আর সেই সঙ্গে যারা আত্মগোপন করে আছে তাদের। কাছে এটা একটা ধরা পড়ার ফাদ। তুমি যদি একটা ১০০০ গিল্ডারের নোট নিয়ে যাও, তোমাকে কবুল করতে এবং প্রমাণ করতে সক্ষম হতে হবে যে, ঠিক কিভাবে তুমি নোটটা পেয়েছ। ঐ নোটে এখনও ট্যাক্স জমা দেওয়া যাবে, তবে মাত্র পরের সপ্তাহ অব্দি। ডুসেল একটা সেকেলে পায়ে চালানো ডেন্টিস্টের ঘুরণ-কল পেয়েছেন, আশা করছি উনি শীগগিরই একবার আমাকে আদ্যোপান্ত পরীক্ষা করে দেখবেন। সর্বজার্মানের নেতা, ফুয়ার আলার গেৰ্মানেন, আহতদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কান পেতে তা শোনা কষ্টকর। সওয়াল-জবাব হচ্ছিল এইভাবে
‘আমার নাম হাইনরিশ শেপেল।
‘জখম হয়েছ কোথায়?’
‘স্তালিনগ্রাদের কাছে।’
‘আঘাত কী ধরনের?’
‘দুটো পা ঠাণ্ডায় জমে খসে গেছে এবং বাম বাহুর সন্ধির হাড় ভেঙে গেছে।’