কথাটা আরেকটু খোলসা করে বলা যাক, কেননা তেরো বছরের একটি মেয়ে দুনিয়ায় নিজেকে একেবারে একা বলে মনে করে, এটা কারো বিশ্বাস হবে না, তাছাড়া তা নয়। আমার আছে খুব আদরের মা-বাবা আর ষোল বছরের এক দিদি। আমার চেনা প্রায় তিরিশজন আছে যাদের বন্ধু বলা যেতে পারে–আমার-একগোছা ছেলে-বন্ধু আছে, যারা আমাকে এক ঝলক দেখবে বলে উদ্গ্রীব এবং না পারলে, ক্লাসের আয়নাগুলোতে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। আমার আত্মীয়স্বজনেরা আছে, মাসি-পিসি কাকা-মামার দল, তারা আমার ইষ্টিকুটুম; আর রয়েছে একটা সুখের সংসার, না–আমার কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। তবে আমার সব বন্ধুরই সেই এক ব্যাপার, কেবল হাসি-তামাসা আর ঠাট্টা ইয়ার্কি, তার বেশি কিছু নয়। মামুলি বিষয়ের বাইরে কোনো কথা বলা যায় না। আমরা কেমন যেন কিছুতেই সেরকম ঘনিষ্ঠ হতে পারি না–আসল মুশকিল সেইখানে। হতে পারে। আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব, কিন্তু সে যাই হোক, ঘটনাটা অস্বীকার করা যায় না এবং এ নিয়ে আমার কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।
সেই কারণেই, এই ডায়রি। যে বন্ধুটির আশায় এতদিন আমি পথ চেয়ে বসেছিলাম তার ছবিটা আমার মানসপটে বড় করে ফোঁটাতেও চাই; আমি তাই অধিকাংশ লোকের মতন। আমার ডায়রিতে একের পর এক নিছক ন্যাড়া ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে দিতে চাই না; তার বদলে আমি চাই এই ডায়রিটা হোক আমার বন্ধু, আমার সেই বন্ধুকে আমি কিটি বলে ডাকব। কিটিকে লেখা আমার চিঠিগুলো যদি হঠাৎ দুম করে শুরু করে দিই তাহলে আমি কী বলছি কেউ বুঝবে না; সেইজন্যে আরম্ভে খানিকটা অনিচ্ছার সঙ্গে মাত্র কয়েকটা আঁচড়ে আমার জীবনের ছবি ফুটিয়ে তুলব।
মাকে যখন বিয়ে করেন তখন আমার বাবার বয়স ছত্রিশ আর মার বয়স পঁচিশ। আমার দিদি মারগট হয় ১৯২৬ সালে ফ্রাঙ্কফোর্ট-অন-মাইন শহরে, তারপর হই আমি–১৯২৯-এর ১২ই জুন। আমরা ইহুদী বলে ১৯৩৩ সালে আমরা হল্যাণ্ডে চলে যাই, সেখানে আমার বাবা। ট্রাভিস্ এন.ভি.-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। যে কোলেন অ্যান্ড কোম্পানীর সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তার অফিস একই বাড়িতে আমার বাবা তার পার্টনার।
আমাদের পরিবারের বাকি সবাইয়ের ওপর অবশ্য হিটলারের ইহুদী বিরোধী বিধি বাঁধনের পুরো চোট এসে পড়েছে, কাজেই জীবন ছিল দুর্ভাবনায় ভরা। যে সময়টা ইহুদীদের দ্যাখ-মার করা হয়, তার ঠিক পরে ১৯৩৮ সালে আমার দুই মামা পালিয়ে আমেরিকায় চলে যান। আমার বুড়ি-দিদিমা আমাদের কাছে চলে আসেন, তাঁর বয়স তখন তিয়াত্তর। ১৯৪০ সালের মে মাসের পর দেখতে দেখতে সুদিন উধাও হতে থাকে। প্রথমে তো যুদ্ধ, তারপর আত্মসমর্পণ, আর তারপরই জার্মানদের পদার্পণ। ওরা পৌঁছুনোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইহুদীদের লাঞ্ছনা দস্তুরমত শুরু হয়ে গেল। দ্রুত পর্যায়ে একের পর এক ইহুদীবিরোধী ফরমান জারি হতে লাগল। ইহুদীদের অবশ্যই হলদে তারা (যাতে আলাদাভাবে তাদের চেনা যায় সেইজন্যে জার্মানরা সমস্ত ইহুদীকে একটি করে ছয় মুখো হলুদ রঙের তারা সকলের চোখে পড়ার মতো করে পরতে বাধ্য করেছিল) পরতে হবে, ইহুদীদের সাইকেলগুলো অবশ্যই জমা দিতে হবে, রেলগাড়িতে ইহুদীদের চড়া নিষিদ্ধ এবং গাড়ি চালানোও তাদের বারণ। কেবল তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে ইহুদীরা সওদা করতে পারবে এবং তাও একমাত্র ইহুদীদের দোকান’ বলে প্ল্যাকার্ড-মারা দোকানে। আটটার মধ্যে ফিরে ইহুদীদের ঘরে আটক থাকতে হবে। ঐ সময়ের পর এমন কি নিজের বাড়ির বাগানেও বসা চলবে না। থিয়েটার, সিনেমা এবং অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের জায়গায় ইহুদীরা যেতে পারবে না। সাধারণের খেলা-ধুলোয় ইহুদীরা যেন যোগ না দেয়। সাঁতারের জায়গা, টেনিস, কোর্ট, হকির মাঠ এবং খেলাধুলোর অন্যান্য জায়গা–সবই তাদের জন্যে নিষিদ্ধ। ইহুদীরা যেন খৃষ্টানদের বাড়িতে না যায়। ইহুদীরা অবশ্যই যাবে ইহুদী স্কুলে। এই রকমের অনেক বিধিনিষেধ জারি হল।
আমরা এটা করতে পারি না, ওটা করা নিষিদ্ধ–এইরকম অবস্থা। কিন্তু তা সত্বেও দিন কেটে যেতে লাগল। গোপি আমাকে বলত, ‘যা কিছু করতে যাও তাতেই ভয়; বলা যায় না, হয়ত বারণ আছে। আমাদের স্বাধীনতায় বেজায় ধরাট। তবু সওয়া যাচ্ছিল।
১৯৪২-এর জানুয়ারিতে দিদু মারা গেলেন; আজও কিভাবে তিনি আমার হৃদয়মন জুড়ে আছেন, আমি তাকে কতটা ভালবাসি–সে কথা কেউ কখনও বুঝবে না।
১৯৩৪ সালে মন্টেসরি কিণ্ডারগার্টেনে আমার হাতেখড়ি, তারপর সেখানেই পাড়শুনো করি। ৬-খ শ্রেণীতে পড়ার সময় ইস্কুলের বৎসরান্তে মিসেস কে.ভে-এর কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হল। দুজনেই কেঁদে ফেললাম, মনও খুব খারাপ হয়ে গেল। ১৯৪১ সালে দিদি মারগটের সঙ্গে আমি গেলাম ইহুদী মাধ্যমিক ইস্কুলে–দিদি ভর্তি হল চতুর্থ শ্রেণীতে আর আমি প্রাথমিক শ্রেণীতে।
এ পর্যন্ত আমরা চারজনে নির্ঝঞ্ঝাটে আছি। এরপর আসব আজকের কথায়।
.
শনিবার, ২০ জুন, ১৯৪২
আদরের কিটি,
বিনা বাক্যব্যয়ে শুরু করে দেব। বাড়িটা এখন নীরব নিস্তব্ধ, মা-মণি আর বাপি বেরিয়েছেন আর মারগট গেছে ওর কিছু বন্ধুর সঙ্গে পিং-পং খেলতে।
ইদানীং আমি নিজেও পিং-পং খেলছি। আমরা যারা পিং-পং খেলি, আইসক্রিমের ওপর আমাদের একটু বেশি টান–বিশেষ করে গরমকালে, খেলতে খেলতে যখন শরীর তেতে যায়। কাজেই সচরাচর খেলার পর আমরা চলে যাই সবচেয়ে কাছাকাছি আইসক্রিমের দোকানে–ডেলফি কিংবা ওয়াসিসে–যেখানে ইহুদীরা যেতে পারে। বাড়তি হাত-খরচার জন্যে হাত পাতা আমরা এখন ছেড়ে দিয়েছি। ওয়াসিসে আজকাল প্রায়ই লোকজনে ভর্তি থাকে; আমাদের চেনাশহর বেশ বড় হওয়ায়, তার মধ্যে আমরা সব সময়ই কোনো না কোনো মহাশয় লোক বা ছেলেবন্ধু জুটিয়ে ফেলি। তারা আমাদের এত আইসক্রিম দেয় যা পুরো সপ্তাহ গোগ্রাসে গিলেও আমরা শেষ করতে পারি না।