তোমার আনা
.
শনিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩
আদরের কিটি, পিম আশা করেছেন যে কোনদিন আক্রমণাভিযান শুরু হবে। চার্চিলের নিউমোনিয়া হয়েছে, আস্তে আস্তে সেরে উঠছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রেমিক গান্ধী এইবার নিয়ে কতবার যে অনশন করলেন। মিসেস ফান ডান দাবি করেন তিনি অদৃষ্টে বিশ্বাসী। কামান থেকে যখন গোলা ছোড়া হয়, তখন কে সবচেয়ে বেশি ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়? পেট্রোনেলা।
গির্জায়-যাওয়া লোকদের কাছে লেখা বিশপের চিঠির একটা কপি হেংক এনেছিলেন। আমাদের পড়াবার জন্যে। চিঠিটা বড় সুন্দর এবং পড়ে প্রেরণা জাগে। নেদারল্যাণ্ডসের মানুষ, গা এলিয়ে বসে থেকো না। প্রত্যেকে তার দেশ, দেশের মানুষ আর তাদের ধর্মের স্বাধীনতার জন্যে নিজস্ব অস্ত্রে লড়ছে।’ গীর্জার বেদী থেকে তারা সোজাসুজি বলছে, সাহায্য দাও, দরাজ হও এবং আশা হারিও না।’ কিন্তু ওতে কি ফল হবে? আমাদের ধর্মের লোকদের বেলায় ওতে কাজ হবে না।
আমাদের এখন কী দশা হয়েছে তুমি ধারণায় আনতে পারবে না। এ বাড়ির মালিক ক্রালার আর কুপহুইসকে না জানিয়ে বাড়িটা বেচে দিয়ে বসে আছে। নতুন মালিক একদিন সকালে সঙ্গে একজন স্থপতিকে নিয়ে বাড়িটা দেখাবার জন্যে দুম করে এসে হাজির। ভাগ্যিস, মিস্টার কুপহুইস তখন উপস্থিত ছিলেন এবং ‘গুপ্তমহল’টা বাদ দিয় বাকি সবটাই তিনি ভদ্রলোককে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। কুপহুইস এমন ভাব দেখান যেন ওপাশে যাওয়ার যে দরজা তার চাবিটা আনতে তিনি ভুলে গেছেন। নতুন মালিক ও নিয়ে আর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। ভদ্রলোক যতদিন না আবার ফিরে এসে ‘গুপ্তমহল’টা দেখতে চাইছেন ততদিন সব ঠিক আছে–কেননা দেখতে চাইলেই তো চিত্তির।
বাপি আমার আর মারগটের জন্যে একটা কার্ড-ইনডেক্স বক্স খালি করে তাতে কার্ড ভরে দিয়েছেন। এটা হবে বই বিষয়ক কার্ড প্রণালী; এরপর আমরা দুজনেই লিখে রাখব কোন কোন বই পড়লাম বইগুলো কার কার লেখা ইত্যাদি। বিদেশী ভাষার শব্দ টুকে রাখার জন্যে আমি আরেকটা খাতা যোগাড় করেছি।
ইদানীং মা-মণি আর আমি আগের চেয়ে নিয়ে চলতে পারছি, কিন্তু এখনও আমরা পরস্পরের কাছে মনের কথা বলি না। মারগট এখন আগের চেয়েও বেশি হিংসুটে এবং বাপি কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন, তবে বাপি আগের মতই মিষ্টি মানুষ।
খাবার টেবিলে মাখন আর মারগারিনের নতুন বরাদ্দ হয়েছে। প্রত্যেকের পাতে ছোট্ট এক টুকরো চর্বি রাখা থাকে। আমার মতে, ফান ডানেরা মোটেই ঠিক ন্যায্যভাবে ভাগগুলো করেন না। আমার মা-বাবা এ নিয়ে কিছু বলতে ভয় পান, কেননা বললেই একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। খুব দুঃখের কথা। আমি মনে করি ওসব লোকদের বেলায় যেমন কর্ম তেমনি ফল হওয়াই উচিত।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ১০ মার্চ, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
কাল সন্ধ্যেবেলায় ইলেকট্রিকের তার জ্বলে গিয়েছিল। তার ওপর সারাক্ষণ দমাদ্দম কামান ফাটার আওয়াজ। গোলাগুলি আর প্লেন-ওড়া সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপারে আমার ভয় এখনও আমি কাটিয়ে উঠিতে পারিনি; ফলে প্রায় রোজ রাতেই আমি ভরসার জন্যে বাপির বিছানায় গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ি। এটা যে ছেলেমানুষি আমি তা জানি, কিন্তু সে যে কী জিনিস তুমি জানো না। বিমানে গোলা-ছেড়া কামানের প্রচণ্ড গর্জনে নিজের কথাই নিজে শোনা যায় না। মিসেস ফান ডান এদিকে অদৃষ্টবাদী, কিন্তু তিনি প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। বেজায় কাঁপা কাচা ক্ষীণ গলায় বললে, ‘ওঃ, এত বিতকিচ্ছিরি! আঃ, এত দমাদ্দমভাবে গোলাগুলি ছুঁড়ছে, এই বলে আসলে উনি বোঝাতে চান ‘আমার কী যে ভয় করছে, কী বলব।’
মোমবাতির আলোয় যত, অন্ধকারে তার চেয়ে ঢের বেশি খারাপ লাগে। আমি থর থর করে কাপছিলাম, ঠিক যেন আমার জ্বর হয়েছে। করুণ গলায় বাপিকে বললাম মোমবাতিটা আবার জ্বেলে দিতে। বাবাকে নড়ানো গেল না; আলো নেভানোই রইল। হঠাৎ একদফা মেশিনগান কড় কড় করে উঠল, তার আওয়াজ গোলাগুলির চেয়েও দশগুণ বেশি কান-ফাটানো। সেই শুনে মা-মণি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে মোমবাতি জ্বেলে দিলেন। বাপি খুব বিরক্ত হলেন। তার আপত্তি উত্তরে মা-মণি বললেন, ‘যত যাই হোক, আনা তো আর ঠিক পাকাঁপোক্ত সৈনিক নয়।’ ব্যস, ঐ পর্যন্ত।
মিসেস ফান ডানের অন্য ভয়গুলোর কথা তোমাকে আমি বলেছি কি? বুলিনি বোধ হয়। ‘গুপ্তমহলে’র সব ঘটনা সম্পর্কে তোমাকে যদি আমার ওয়াকিবহাল রাখতে হয়, তাহলে এ ব্যাপারটাও তোমার জেনে রাখা দরকার। এক রাতে মিসেস ফান ডানের মনে হল তিনি চিলেকোঠায় সিঁদেল-চোরের আওয়াজ পেয়েছেন; তাদের পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে উনি ওর স্বামীকে জাগিয়ে দিলেন। ঠিক তক্ষুনি সিঁদেল-চোরেরা হাওয়া এবং মিস্টার ফান ডান সেই ভয়তরাসে অদৃষ্টবাদী মহিলার বুক ধড়ফড় করার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলেন না। ‘ও পুট্টি (মিস্টার ফান ডানের ডাক নাম), ওরা নিশ্চয় আমাদের সসেজ আর সমস্ত কড়াইশুঁটি আর বিন নিয়ে চলে গেল। আর পেটার নিরাপদে বিছানায় শুয়ে আছে কিনা তাই বা কে জানে?’ ‘পেটারকে ওরা নিশ্চয় ঝোলার মধ্যে পুরে নিয়ে যাবে না। বলছি, কথা শোনো–ওসব নিয়ে ভেবো না। আমাকে বুঝতে দাও।’ কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। ভয়েময়ে মিসেস ফান ডান সে রাত্তিরে আর দুই চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। তার কয় রাত পরে ভূতুড়ে শব্দ শুনে ফান ডানদের পরিবারের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। হাতে টর্চ নিয়ে পেটার চিলেকোঠায় যেতেই–খুসুরমুসুর আর খসুরমুসুর! ছুটে ছুটে কী পালাচ্ছিল বলো তো? ইয়া ইয়া একপাল ধেড়ে ইঁদুর। যখন আমরা জেনে ফেললাম চোরের দল কারা, তখন মুশ্চিকে আমরা চিকেকোঠায় শুতে দিলাম ব্যস, তারপর আর অনাহুত অতিথিরা ফিরে ওমুখো হয়নি। অন্তত রাতের বেলা।