দিনের বেলায় যেন বেশি আওয়াজ করার জন্যে আমাকে যথেষ্ট ‘চুপ চুপ’ শুনতে হয় না= আমার শয়নকক্ষের সঙ্গী ভদ্রলোক রাত্তিরেও এখন আমাকে বার বার ডেকে বলেন, চুপ চুপ।’ তার কথা শুনে চললে, আমার তো পাশ ফেরাও বারণ। আমি ওঁকে আদৌ পাত্তা দিতে প্রার্থী নই। এর পরের বার কিছু বলতে এলে উল্টে আমিই ওঁকে ‘চুপ, চুপ’ বলব।
ওঁর ওপর আমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি, বিশেষ করে রবিবারগুলোতে, সাতসকালে উঠে ব্যায়াম করার জন্যে উনি আলো জ্বালিয়ে দেন। মনে হয় স্রেফ ঘণ্টার পর ঘণ্টা উনি চালিয়ে যান, আর ওঁর জ্বালায় আমি বেচারা, আমার শিয়রে জোড়া-দেওয়া চেয়ারগুলো, ঘুম ঘুম চোখে আমার মনে হয়, যেন অনবরত সামনে আর পেছনে সরতে নড়তে থাকে। পেশীগুলো আলগা করার জন্যে বার দুয়েক প্রচণ্ড জোরে হাত ঘুরিয়ে ব্যায়ামের পর্ব শেষ করে শ্রীমৎ মহাপ্রভু শুরু করেন ওঁর প্রাতঃকৃত্য। তার প্যান্টগুলো ঝোলানো থাকে, সুতরাং সেগুলো যোগাড় করে আনতে ওঁকে এখান থেকে সেখানে যেতে আসতে হয়। কিন্তু টেবিলে পড়ে থাকা টাইয়ের কথা ওঁর মনে থাকে না। সুতরাং ফের সেটা আনতে চেয়ারগুলোতে তিনি ধাক্কা মারেন এবং হোঁচট খান।
থাক, আমি আর বুড়ো লোকদের বিষয়ে এর বেশি বলে তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না। এতে অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না এবং আমার শোধ তোলবার সমস্ত মতলব (যেমন ল্যাম্প ডিস্কানেক্ট করা, দরজায় খিল দেওয়া, ভদ্রলোকের জামা-কাপড় গায়েব করা) ত্যাগ করতে হবে শান্তি বজায় রাখার জন্যে। ইস, আমি কিরকম বিচক্ষণ হয়ে উঠছি! এখানে সর্ব বিষয়ে একজনকে তার বিচারশক্তি প্রয়োগ করতে হবে, মান্য করতে শিখতে হবে, মুখ বুজে থাকতে হবে, ভালো হতে হবে গোঁয়ার্তুমি ছাড়তে হবে এবং আমার জানা নেই আরও কত কী। আমার ভয় হচ্ছে, খুব কম সময়ের মধ্যে আমাকে আমার পুরো বুদ্ধি খরচ করে ফেলতে হবে এবং আমার বুদ্ধির পরিমাণ খুব বেশি নয়। যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তখন আর ঘটে কিছু থাকবে না।
তোমার আনা
০৩. আবার এলোমেলো
বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আজ সকালে আবার সবকিছু আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। ফলে, একটা জিনিসও আমি ঠিকমত করে উঠতে পারিনি।
বাইরেটা সাংঘাতিক। দিনরাত ওরা আরও বেশি করে ঐ সব অসহায় দুঃখী মানুষগুলোকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিঠে একটা বোচকা আর পকেটে সামান্য টাকা ছাড়া ওদের নিজের বলতে আর কিছু থাকছে না। পথে সেটুকুও ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সংসারগুলো ছিটিয়ে গিয়ে স্ত্রী-পুরুষ ছেলেমেয়েরা সব পরস্পরের কাছ থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইস্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে দেখছে মা-বাবা নিখোঁজ। মেয়েরা বাজার করে বাড়ি ফিরে দেখছে দরজায় তালা ঝোলানো, পরিবারের লোকজনের হাওয়া হয়ে গেছে। যারা জাতে ওলন্দাজ, তারাও খুব চিন্তাগ্রস্ত। তাদের ছেলেদের ধরে ধরে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সকলেরই মনে ভয়।
প্রত্যেকদিন রাত্রে শ’য়ে শ’য়ে প্লেন। হল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জার্মান শহরগুলোতে। সেখানে বোমায় বোমায় মাটি চষে ফেলা হচ্ছে। রুশদেশে আর আফ্রিকায় প্রতি ঘন্টায় শ’য়ে শ’য়ে হাজারের হাজারে মানুষ খুন হচ্ছে। কেউই এর বাইরে থাকতে পারছে না, লড়াই সারা বিশ্ব জুড়ে। যদিও তুলনায় মিত্রপক্ষ এখন ভালো অবস্থায়, তাহলেও কবে যুদ্ধ শেষ হবে বলা যাচ্ছে না।
আমাদের কথা ধরলে, আমরা ভাগ্যবান। নিশ্চয় লক্ষ লক্ষ লোকের চেয়ে আমাদের ভাগ্য ভালো। এখানে নির্ঝঞ্ঝাটে, নিরাপদে আছি। বলতে গেলে, আমরা রাজধানীতে বাস করছি। এমন কি আমরা এতটা স্বার্থপর যে কথায় কথায় বলি, যুদ্ধের পর, নতুন জামা নতুন কাপড়ের কথা ভেবে আমরা উৎফুল্ল হই–অথচ আমাদের সত্যিকার প্রত্যেকটা পাইপয়সা বাঁচানো উচিত, অন্য মানুষজনদের সাহায্য করা উচিত এবং যুদ্ধের পর ধ্বংস হয়েও যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটুকু রক্ষা করা উচিত।
বাচ্চারা এখানে ছুটোছুটি করে, গায়ে শুধুমাত্র এটা পাতলা পিরান আর শিলি পরে; না আছে কোট, না আছে টুপি, না আছে মোজা। কেউ তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় না। সব সময় তাদের পেটগুলো পড়ে থাকে, কবেকার শুকনো একটা গাজর দাঁতে কাটতে। কাটতে তারা ক্ষিধের ভেঁচকানি ঠেকিয়ে রাখে। কনকনে ঠাণ্ডা ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে তারা যায় কনকনে ঠাণ্ডা রাস্তায়; যখন ইস্কুলে ইস্কুলঘর তার চেয়েও ঠাণ্ডা। দেখ, হল্যাণ্ডের হাল এখন এত খারাপ যে, অসংখ্য ছেলেপুলে রাস্তার লোকদের ধরে এক টুকরো রুটির জন্যে হাত পাতে। যুদ্ধের দরুন মানুষের যাবতীয় দুঃখযন্ত্রণার ওপর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতে পারি। কিন্তু তাতে নিজেকে আমি আরও ম্রিয়মাণ করে তুলব। যতদিন দুঃখের শেষ হয়, ততদিন যথাসম্ভব শান্তচিত্তে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। ইহুদীরা আর খ্রিষ্টানরা অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে সারা জগৎ; সেইসঙ্গে বেশ কিছু লোক মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছে।
তোমার আনা
.
শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
রাগে টগবগ করে ফুটছি, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করব না। ইচ্ছে হচ্ছে পা দাবিয়ে চিৎকার করি, মা-মণিকে আচ্ছা করে ঝাকিয়ে দিই, কান্নায় ফেটে পড়ি, এবং আর কী করব জানি না কারণ, প্রতিদিন আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় যত সব অকথা-কুকথা, বাঁকা বাঁকা চোখের দৃষ্টি এবং যত রাজ্যের নালিশ, এবং টান করে বাঁধা জ্যা-মুক্ত শরের মত সেগুলো যথাস্থানে লাগে এবং শরীরে বেঁধার মতই সেগুলো তুলে ফেলা আমার পক্ষে কঠিন হয়।