তারপর আগুনে সত্যিকার ঘৃতাহুতি পড়ল। ভদ্রমহিলা চেঁচাতে লাগলেন (অমন একটা যন্ত্র মুখে নিয়ে যতটা চেঁচানো যায়), হাত দিয়ে যন্ত্রটা মুখ থেকে টেনে বের করতে চেষ্টা করলেন। তাতে হিতে বিপরীত হল। আরও সেটা ঢুকে বসে গেল। মিস্টার ডুসেল তার হাত দুটো দুই পাশে সেঁটে চুপচাপ থেকে প্রহসনটুকু দেখতে লাগলেন। বাকি দর্শকের দল আর থাকতে না পেরে হাসিতে ফেটে পড়ল। কাজটা খারাপ করেছি, কেননা নিজের কথা বলতে পারি, আমার উচিত ছিল আরও জোরসে হেসে ওঠা। অনেকবার এপাশ ওপাশ করে, পা ছুঁড়ে, চেঁচামেচি করে এবং বাচাও বাঁচাও বলে শেষ অবধি যন্ত্রটা উনি টেনেটুনে বের করলেন এবং যেন কিছুই হয়নি এমনিভাব করে তার কাজ চালিয়ে গেলেন।
জিনিসটা উনি এমন চটপট করে ফেললেন যে মিসেস ফান ডান কোনো নতুন ফিকির করার আর সুযোগ পেলেন না। তবে ডুসেল তাঁর জীবনে কখনও এতটা পরের সাহায্য পাননি। দুজন সাকরেদ তার খুব কাজে লেগেছিল। ফান ডান আর আমি আমাদের কর্তব্যকর্ম ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিলাম। কর্মরত একজন হাতুড়ে’–এই নামের মধ্যযুগের কোনো ছবির মত দৃশ্যটা দেখাচ্ছিল। ইতিমধ্যে অবশ্য রোগিণীটি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন; তার সুপ আর তার খাবারে তাকে নজর রাখতে হবে। একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে আর কখনও ডাক্তারের হাতে নিজেকে সঁপে দেবার মতন এমন তাড়া। তাঁর কদাচ থাকবে না।
তোমার আনা।
.
রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি, সদর দপ্তরে আরামে বসে পর্দার ফাঁকটুকু দিয়ে বাইরেটা দেখছি। পড়ন্ত বেলা, তবু তোমাকে লেখার মত আলো এখনও রয়েছে।
লোকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, এ এক ভারি অদ্ভুত দৃশ্য; সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে যেন পেছনে ষাঁড়ে তাড়া করেছে এবং এখুনি সবাই হোঁচট খেয়ে পড়বে। সাইকেল চালিয়ে এখন যারা যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে তাল রেখে চলা অসম্ভব। আমি এমন কি দেখতেও পাচ্ছি না সাইকেল চড়ে যে যাচ্ছে সে কে।
এ পাড়ার লোকজনদের দিকে খুব একটা তাকাতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে বাচ্চার দল এত নোংরা হয়ে থাকে যে তাদের ছুতে ঘেন্না হয়। নাক দিয়ে পেটা গড়ানো একেবারে বস্তির বাচ্চা। ওদের একটা কথাও আমি শুনলে বুঝব না।
কাল আমি আর মারগট এখানে গোসল করার সময় আমি বলেছিলাম, ‘হেঁটে যাচ্ছে যে বাচ্চারা, ধর, আমরা যদি ওদের এক-একটাকে একটা মাছ ধরার ছিপ দিয়ে টেনে তুলে প্রত্যেককে গোসল করিয়ে দিই, ওদের কাপড়চোপড় কেচে দিই, ফুটোফাটা সেলাই করে দিই, এবং তারপর আবার ওদের ছেড়ে দিই, তাহলে…।’ মারগট আমাকে শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল, কালই আবার দেখবি ওরা আগের মতই যে-কে সেই নোংরা এবং গায়ে শতছিন্ন কাপড়-জামা।
আমি কী আজে-বাজে বকছি। এসব বাদেও দেখার অনেক কিছু আছে–মোটরগাড়ি, নৌকো আর বৃষ্টি। আমার বিশেষ করে পছন্দ চলন্ত ট্রামের ক্যাচর-ক্যাচর আওয়াজ।
আমাদের যেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই, আমাদের ভাবনাচিন্তারও সেই একই দশা। ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত সেই একই জায়গায় আমরা এসে হাজির হই–সেই ইহুদী থেকে খাবার জিনিসে আর খাবার জিনিস থেকে রাজনীতিতে। হ্যাঁ, ভালো কথা, ইহুদী বলতে মনে পড়ল, কাল আমি পর্দার ফাঁক দিয়ে দুজন ইহুদীকে দেখেছি। দেখে আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস। হচ্ছিল না; কী বিশ্রী যে লাগছিল, আমি যেন তাদের বিপদে ফেলে পালিয়ে এখন তাদের দুর্দশা দেখছি। ঠিক উল্টোদিকে আছে একটা বজরা; সেখানে সপরিবারে থাকে একজন। মাঝি। তার একটা ঘেউ-ঘেউ করা ছোট কুকুর আছে। যখন সে পাটাতনের ওপর ছুটোছুটি করে তখন ছোট কুকুরটাকে আমরা চিনতে পারি শুধু ওর ডাক শুনে আর ল্যাজ দেখে। এহ, শুরু হল বৃষ্টি, এখন বেশির ভাগ লোক গা-ঢাকা দিয়েছে ছাতার তলায়। চোখে পড়ছে শুধু বর্ষাতি আর মাঝে মাঝে কারো কারো টুপির পেছনটা। সত্যি এখন আর বেশি দেখার আমার দরকার নেই। ক্রমশ এক নজরেই সব মেয়ে আমার জানা হয়ে যাচ্ছে, আলু খেয়ে খেয়ে মোটা ধুমসী, গায়ে লাল কিংবা সবুজ কোট, জুতার হিল ক্ষয়ে-যাওয়া এবং একটা করে ব্যাগ বগলদাবা করা। তাদের মুখগুলো দেখে হয় করুণ নয় দয়ালু বলে মনে হয় সেটা নির্ভর করে স্বামীদের ভাবসাবের ওপর।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি, ‘গুপ্তমহল’ এই আনন্দ-সংবাদ শুনেছে যে, বড়দিন উপলক্ষে প্রত্যেকে বাড়তি সিকি পাউণ্ড করে মাখন পাবে। খবরের কাগজে বলেছে আধ পাউণ্ড, তবে সে তো সেইসব ভাগ্যবান মর্ত্যের জীবদের জন্যে যারা সরকারী রেশন-খাতার অধিকারী। পালিয়ে-থাকা ইহুদীদের জন্যে নয়–আটের বদলে মাত্র চারটি বেআইনী শেনখাতা কেনা তাদের সাধ্যায়ত্ত।
আমরা সবাই আমাদের মাখন দিয়ে কেকবিস্কুট কিছু বানাব। আজ সকালে আমি কয়েকটা বিস্কুট আর দুটো কেক তৈরি করেছিলাম। ওপরতলায় সবাই খুব ব্যস্ত। মা-মণি বলেছেন গেরস্থালির কাজকর্ম শেষ না করে আমি যেন সেখানে কাজ করতে বা পড়াশুনো করতে না যাই। মিসেস ফান ডান তাঁর চোট-লাগা পাঁজরের দরুন শয্যাশায়ী, দিনভর তাঁর নাকী কান্না, সারাক্ষণ নতুন ড্রেসিং করাতে দিতে তার আপত্তি নেই, এবং কোনো কিছুতেই তাঁর মন ওঠে না। উনি আবার নিজের পায়ে দাঁড়ালে এবং নিজেরটা নিজে গুছিয়ে নিতে পারলে আমি খুশি হব। কেননা তার পক্ষ নিয়ে এটা আমাকে বলতেই হবে–তিনি অসাধারণ পরিশ্রমী এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বরাবর দেহে মনে সুস্থ। সেই সঙ্গে সদা প্রফুল্ল।