তোমার আনা
.
সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি চানুকা আর সেন্ট নিকোলাস এ বছর প্রায় একই সময়ে পড়েছে মাত্র একদিন আগে পরে। চানুকা নিয়ে আমরা কোনো হৈচৈ করিনি। আমরা শুধু পরস্পরকে দিয়েছি টুকিটাকি উপহার এবং সেই সঙ্গে মোমবাতি জ্বালানো। মোমবাতির অভাবের জন্যে আমরা শুধু দশ মিনিটের জন্যে বাতিগুলো জ্বেলে রেখেছিলাম। গান থাকলে ওতে কিছু যায় আসে না। মিস্টার ফান ডান একটা কাঠের বাতিদান বানিয়েছেন, সুতরাং সবদিক থেকে তাতেও সুব্যবস্থা হয়েছে।
শনিবার, সেন্ট নিকোলাস দিবসের সন্ধ্যেটা অনেক বেশি মজাদার হয়েছিল। মিপ্ আর এলিকে সব সময়ে বাপির কানে কানে ফিসফিস করে বলতে দেখে আমাদের খুব কৌতূহলের উদ্রেক হয়েছিল, স্বভাবতই আমরা আন্দাজ করেছিলাম কিছু একটা জিনিস আছে।
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই। রাত আটটার সময় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সার বেঁধে নেমে ঘুটঘুটে অন্ধকারে গলির ভেতর দিয়ে এসে (আমার গা-ছমছম করছিল এবং মনে মনে চাইছিলাম যেন নিরাপদে ওপরতলায় ফিরে যেতে পারি) ছোট্ট ঘুপচি ঘরটাতে জমা হলাম। কোনো জানালা না থাকায় সেখানে আমরা আলো জ্বালাতে পারি। আলো জ্বলে উঠতে বাপি বড় আলমারির ঢাকনাটা খুলে দিলেন। ‘ওঃ, কী সুন্দর’ বলে সবাই চেঁচিয়ে উঠল। এক কোণে সেন্ট নিকালাসের কাগজে সাজানো একটা বড় বেতের ঝুড়ি আর তার ওপর ছিল কৃষ্ণ-পেটারের একটা মুখোশ।
তাড়াতাড়ি ঝুড়িটা নিয়ে আমরা ওপরে চলে গেলাম। তাতে ছিল প্রত্যেকের জন্যে একটা করে সুন্দর ছোট্ট উপহার, তাতে গাঁথা একটা করে লাগসই কবিতা। আমি পেলাম একটা ডল পুতুল, তার স্কার্টটা হল টুকরো-টাকরা জিনিস রাখার থলি। বাবা পেলেন বই রাখার ধরুনি এবং ইত্যাকার সব জিনিস। যাই হোক, মাথা থেকে ভালো জিনিস বেরিয়েছিল। যেহেতু আমরা কেউই সেন্ট নিকোলাসের দিন আগে কখনও পালন করিনি, আমাদের হাতেখড়িটা ভালোই হল।
তোমার আনা
.
বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
মিস্টার ফান ডান আগে ছিলেন মাংস, সসেজ আর মশলার কারবারে। এই পেশা ওঁর জানা ছিল বলে ওঁকে বাবার ব্যবসায় নিয়ে নেওয়া হয়। এখন উনি ওঁর সসেজগত দিকের পরিচয় দিচ্ছেন, যেটা আমাদের পক্ষে মোটেই অপ্রীতিকর নয়।
এ দুর্দিনে পড়তে হতে পারে এই ভেবে আমরা প্রচুর মাংস কিনে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম (অবশ্যই ঘুষ দিয়ে)। দেখতে বেশ মজা লাগে, প্রথমে কিভাবে মাংসের টুকরোগুলো কিমা করার যন্ত্রের ভেতর দিয়ে দুবারে বা তিনবারে যায়, তারপর কিভাবে সঙ্গের মালমশলাগুলো কিমায় মেশানো হয়, এবং তারপর সসেজ তৈরির জন্যে নাড়িভূঁড়ির ভেতর কিভাবে নল দিয়ে তা ভর্তি করা হয়। সসেজের মাংস ভেজে নিয়ে সেদিন রাতে আমরা বাঁধাকপির চাটনির সঙ্গে টাকনা দিয়ে খেলাম, কেননা গোল্ডারল্যাণ্ড সসেজ খেতে হলে আগে খটখটে শুকনো করে নিতে হয়। সেই কারণে মটুকার সঙ্গে সুতো দিয়ে লাঠি বেঁধে তাতে সসেজগুলো আমরা টাঙিয়ে দিলাম। ঘরে ঢুকতে গিয়ে এক ঝলক সার-বাধা সসেজ ঝুলে থাকতে দেখে প্রত্যেকেই হেসে কুটোপাটি হচ্ছিল। সেগুলো সাংঘাতিক মজাদার দেখাচ্ছিল।
ঘরের মধ্যে সে এক দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। মিস্টার ফান ডান তাঁর বপুতে (তাকে দেখাচ্ছিল আরও বেশি মোটা) তার স্ত্রীর একটা অ্যাপ্রন চড়িয়ে মাংস কুটতে ব্যস্ত। রক্তমাখা দুটো হাত, লাল মুখ আর নোংরা আনে তাকে ঠিক কশাইয়ের মত দেখাচ্ছিল। মিসেস ফান ডান একসঙ্গে সব কাজ সারতে চাইছিলেন, একটা বই পড়ে পড়ে ডাচ ভাষা শেখা, সুপের মধ্যে খুন্তি নাড়া, মাংস কিভাবে বানানো হচ্ছে তা দেখা, দীর্ঘশ্বাস ফেলা এবং তার পাজরে চোট লাগা নিয়ে নাকে কাঁদা। যেসব বুড়ি ভদ্রমহিলারা (!) চ্যাটালো পাছা কমাবার জন্যে ঐসব বোকামিপূর্ণ শরীরচর্চা করেন তাঁদের ঐ রকমই দশা হয়।
ডুসেলের একটা চোখ ফুলেছে। আগুনের পাশে বসে ক্যানোনিল ফোঁটানো পানি দিয়ে উনি চোখে সেঁক দিচ্ছেন। জানালা গলে আসা একফালি রোদূরে চেয়ার টেনে নিয়ে বসা পিকে অনবরত এদিক-ওদিক করতে হচ্ছিল। তাছাড়া আমার ধারণা ওর বাতের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। কেননা মুখে একটা কাতর ভাব নিয়ে উনি পুঁটুলি পাকিয়ে বসে মিস্টার ফান ডানের কাজ করা দেখছিলেন। তাকে দেখাচ্ছিল ঠিক বৃদ্ধাশ্রমে থাকা একজন কুঁকড়ে যাওয়া বুড়োর মত। পেটার তার বেড়ালটা নিয়ে ঘরময় খেলার কসরত করে বেড়াচ্ছিল। মা-মণি, মারগট আর আমি আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিলাম। মিস্টার ফান ডানের দিকে নজর পড়ে থাকায় আমরা সকলে অবশ্য অনেক ভুলভাল করে ফেলছিলাম।
ডুসেল তার দাঁতের ডাক্তারি শুরু করেছেন। মজার ব্যাপার বলে আমি তাঁর প্রথম রুগীটির বিষয়ে বলব। মা-মণি ইস্ত্রি করছিলেন এবং মিসেস ফান ডানকেই প্রথম অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। ঘরের মাঝখানে রাখা একটা চেয়ারে গিয়ে উনি তো বসলেন। ডুসেল বেজায় গম্ভীর মুখ করে তার ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র বের করতে লাগলেন। বীজাণুনাশক হিসেবে খানিকটা ওডিকোলন আর মোমের বদলে ভেজলিন চেয়ে নিলেন।
মিসেস ফন ডানের মুখের ভেতর তাকিয়ে উনি দুটো দাঁত পেলেন যা ছোঁয়া মাত্র মিসেস ফান ভান এমন কুঁকড়ে-মুকড়ে গেলেন যেন এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন আর সেই সঙ্গে ব্যথায় আবোলতাবোল আওয়াজ করতে থাকলেন। লম্বা পরীক্ষার পর (মিসেস ফান ডানের ক্ষেত্রে, বাস্তবে কিন্তু দুই মিনিটের বেশি সময় লাগেনি) ডুসেল একটি গর্ত খুঁড়তে শুরু করে দিলেন। কিন্তু করবে কার বাপের বাধ্যি রোগিণী এমন ভাবে ডানে-বামে হাত পা ছুঁড়তে শুরু করে দিলেন যে–একটা পর্যায়ে গিয়ে ডুসেলকে তার হাতের কুরুনি ছেড়ে দিতে হল–সেটা বিধে রইল মিসেস ফান ডানের দাঁতে।