বস্তুত এই বিভীষিকা যখন আমাদের মনের মধ্যে ফিকে হয়ে আসবে, আবার আমরা ঠাট্টামস্করা করব, আবার আমরা এ ওর পেচনে লাগব। এখন আমরা যে রকম মন-খারাপ করে রয়েছি সেইভাবে থাকলে আমাদেরও তাতে ফল ভালো হবে না, বাইরে যারা আছে তাদেরও কোনো উপকারে আমরা আসব না। আমাদের গুপ্ত মহলকে ‘হতাশার গুপ্ত মহল’ করে তুলে কোন্ উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে? আমি যাই করি না কেন, আমাকে কি অষ্টপ্রহর শুধু ঐ ওদের কথাই ভেবে যেতে হবে? কোনো ব্যাপারে আমার হাসতে ইচ্ছে করলে কি তাড়াতাড়ি আমাকে হাসি চাপতে হবে এবং উফুল্ল হওয়ার জন্যে আমাকে লজ্জা পেতে হবে? তবে কি আমায় দিনভর কেঁদে যেতে হবে? না, আমি তা পারব না। তাছাড়া সময়ে এই বিবাদ ঘুচে যাবে।
এই দুঃখকষ্টের সঙ্গে এসে জুটেছে আরও একটা যা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত; যেমন মরা অবস্থার কথা এখুনি তোমাকে বললাম তার পাশে আমার দুঃখটা কিছুই নয়। তবু তোমাকে না বলে পারছি না যে, ইদানীং আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সবাই আমাকে ত্যাগ করেছে। আমার চারপাশে যেন এক দুস্তর শূন্যতা। আগে কখনও আমার এরকম অনুভূতি হত না। আমার হাসি-খেলা, আমার মজা আনন্দ আর আমার মেয়ে বন্ধুরা–এই সবই আমার ভাবনা সম্পূর্ণ ভাবে জুড়ে রাখত। এখন আমি হয় দুঃখের জিনিসগুলো নিয়ে কিংবা নিজের কথা ভাবি। বাবা আমার খুব প্রিয় হলেও, শেষ অব্দি এখন আমি আবিষ্কার করেছি যে, আমার বাপি এখনও আমার ফেলে আসা দিনগুলোর যে ছোট্ট জগৎ তার পুরোটা জুড়ে বসতে পারেন না। কিন্তু এইসব আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে তোমাকে জ্বালানোর কোনো মানে হয়? কিটি, আমি খুবই অকৃতজ্ঞ; আমি তা জানি। কিন্তু আমার ওপর যদি বেশি লাফাই-ঝাপাই হয় তাহলে অনেক সময় আমার মাথার মধ্যে ভো ভো করতে থাকে এবং তার ওপর আবার যদি অতসব দুঃখকষ্টের কথা ভাবতে হয় তাহলেই তো গিয়েছি।
তোমার আনা
.
শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
আমরা আমাদের বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি বিজলি খরচ করে ফেলেছি। ফলত, যতদূর সম্ভব খরচ বাঁচানো এবং ইলেকট্রিক কেটে দেওয়ার আশঙ্কা। পনেরো দিন বিন আলোয়; অবস্থাটা ভাবতে পারো? তবে কে জানে, শেষ পর্যন্ত হয়ত সেটা ঘটবে না! আমরা যত রকমের খামখেয়ালি করে সময় কাটাচ্ছি। বাধা জিজ্ঞেস করা, অন্ধকারে ব্যায়াম-চর্চা, ইংরেজিতে ফরাসীতে কথা বলা, বইয়ের সমালোচনা করা। কিন্তু শেষমেশ এ সবই কেমন যেন ভোতা হয়ে যায়। কাল সন্ধ্যেবেলায় আমি একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছি; একজোড়া জোরালো দূরবীনের কাঁচের ভেতর দিয়ে পেছনের বাড়িগুলোর আলো-জ্বালা ঘরগুলোতে উকি দিয়ে দেখা! দিনের বেলায় আমাদের পর্দায় একচুল ফাঁক হতে আমরা দিই না, কিন্তু রাতের বেলায় সেটা হলে কোনো ভয় নেই। পাড়াপড়শিরা যে এত মজার মানুষ। হয় এর আগে আমি জানতাম না। সে যাই হোক, আমাদের প্রতিবেশীরা তাই। আমি দেখতে পেলাম এক ঘরে স্বামী-স্ত্রী খেতে বসেছে; একটি বাড়ির লোকজনেরা ঘরে সিনেমা দেখার সরঞ্জাম সাজাচ্ছে। উল্টো দিকের বাড়িতে একজন দাতের ডাক্তার এক বুড়ি মহিলাকে দেখছেন, তিনি তো ভয়ে কাঠ।
সব সময়ে বলা হত যে, মিস্টার ডুসেল নাকি ছেলেপুলেদের সঙ্গে খুব মিশতে পারেন এবং তাদের সবাইকে তিনি ভালবাসেন। এখন তার আসল রূপ ধরা পড়ে গেছে, উনি এক রসকষহীন, সেকেলে নিয়মনিষ্ঠ লোক এবং আদবকায়দার ব্যাপারে লম্বা-চওড়া বুকনি ঝাড়তে ওস্তাদ।
আমি যেহেতু আমার শোবার ঘর–হায় রে, ছোট্ট একটু–শ্রীমৎ মহাপ্রভুর সঙ্গে ভাগযোগ করে থাকার অমূল্য সৌভাগ্যের (!) অধিকারী এবং তিনজন কমবয়সীর মধ্যে সবাই যেহেতু আমাকেই সবচেয়ে বে-আদব বলে গণ্য করে, সেইহেতু আমাকে প্রচুর ভুগতে হয় এবং একঘেয়ে বস্তাপচা বাক্যযন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্যে আমাকে কালা সাজতে হয়। এ সবও সয়ে যেত, ভদ্রলোক যদি ভীষণ কুচুটে প্রকৃতির না হতেন এবং অন্য সবাই থাকতে সব সময় মা-মণির কানে গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর না করতেন। একচোট ওঁর কাছ থেকে হুড়ো খাওয়ার পর নতুন পালা শুরু হয় মা-মণির কাছ থেকে, সুতরাং আগুপিছু দুদিক থেকেই আমাকে ঝাড় খেতে হয়। তারপর আমার কপাল যদি ভালো হয়, তাহলে মিসেস ফান ডানের কাছে আমার ডাক পড়ে জবাবদিহি করার জন্যে এবং তখন একেবারে তুফান। বয়ে যায়।
সত্যি বলছি, পালিয়ে-থাকা অতিরিক্ত খুঁত-কাড়া একটি পরিবারের মানুষ-না-হয়ে ওঠা চোখের-কাটা হওয়াটা ভেবো না সহজ ব্যাপার। রাত্তিরে যখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার ওপর আরোপ-করা রাজ্যের অপরাধ আর দোষত্রুটির কথা মনে মনে ভাবি, আমার কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যায়, হয় আমি হাসি নয় কাদি; কখন কি রকম মেজাজ তার ওপর সেটা নির্ভর করে।
আমি যেমন তা থেকে অথবা আমি যা হতে চাই তা থেকে ভিন্ন কিছু হওয়ার একটা ভোতা চাপা বাসনা নিয়ে তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি; আমি যেভাবে চলতে চাই কিংবা আমি যে ভাবে আচরণ করি হয়ত তার থেকে ভিন্ন কোনো আচরণ। হা ভগবান, এবার তোমাকেও আমি গুলিয়ে দিচ্ছি। মাপ করো, লিখে ফেলে সেটাকে আমি কাটতে চাই না এবং কাগজের এই অভাবের দিনে আমি কাগজ ফেলে দিতে পারব না। সুতরাং তোমাকে আমি শুধু এই পরামর্শই দিতে পারি যে, শেষের বাক্যটা তুমি যেন ফিরে পড়ো না, এবং কোনোক্রমেই ওর অর্থোদ্ধারের চেষ্টা করো না, কেন না চেষ্টা করেও তুমি তা পারবে না।