ডুসেল না বলেছেন, উনি জানিয়েছেন, সোমবারে আসবেন। এরকম একটা প্রস্তাবে তা সে যেরকমই হোক–কোথায় তিনি লাফিয়ে চলে আসবেন, তা নয়। আমার কাছে একটা এক রকমের পাগলামি বলে মনে হয়। বাইরে থাকা অবস্থায় ওঁকে যদি তুলে নিয়ে চলে যায়, তখন কি উনি আর ওঁর কার্ড সাজানো, দেনাপাওনা মেটানো, রোগী দেখা–এসব করতে পারবেন? তাহলে আর দেরি করা কেন আমার মনে হয় বাবা তাতে রাজী হয়ে বোকামি করেছেন। আর কোনো খবর নেই।
তোমার আনা
.
মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
ডুসেল এসে পৌঁচেছেন। সব ভালোভাবে চুকেছে। মিপ ওঁকে বলেছিলেন ডাকঘরের সামনে একটা বিশেষ জায়গায় ঠিক এগারোটার সময় এসে দাঁড়াতে, সেখানে একটি লোক ওঁর সঙ্গে দেখা করবে। ডুসেল একেবারে কাটায় কাটায় যথাসময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। মিস্টার কুপহুইস–ডুসেল তারও পরিচিত–ওঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেন, যে ভদ্রলোকের আসার কথা ছিল তিনি আসতে পারেননি। ডুসেল যেন সটান অফিসে চলে গিয়ে মিপের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর কুপহুইস ট্রামে উঠে অফিসে ফিরে আসেন, আর সেই একই দিকে ডুসেল হাঁটতে থাকেন। এগারোটা কুড়িতে অফিসে এসে ডুসেল দরজায় টোকা দিলেন। মিপ তাঁকে কোট খুলতে সাহায্য করলেন যাতে হলদে তারার চিহ্নটা না দেখা যায়। তারপর তাকে খাসকামরায় নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে ঘর পরিষ্কার করার মেয়েলোকটি থাকা অব্দি কুপহুইস এটা সেটা বলে তাকে ব্যস্ত রাখলেন। তারপর মিপ এসে, একটা কাজের জন্যে ঘরটা ছাড়তে হবে, এই রকমের ভাব দেখিয়ে ডুসেলকে ওপরে নিয়ে গেলেন। ওপরে গিয়ে মিপ ঝোলানো আলমারিটা ঠেলে চোখের সামনে ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখে। ডুসেল একেবারে হতভম্ব।
আমরা সবাই ওপরতলায় টেবিলে গোল হয়ে বসে কফি আর কনিয়াক নিয়ে অপেক্ষা করছি, নবাগতকে অথ্যর্থনা জানাব। মিপ ওঁকে প্রথমে আমাদের বৈঠকখানাটা দেখালেন। উনি আমাদের আসবাবপত্র দেখেই চিনতে পারলেন এবং উনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে আমরা এখানে রয়েছি, ওঁর ঠিক মাথার ওপর। মিপ যখন ওঁকে খবরটা দিলেন তখন উনি প্রায় মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম হলেন। ভাগ্যিস্ মিপ ওঁকে বেশি সময় না দিয়ে সটান ওপরতলায় নিয়ে তুললেন।
ডুসেল ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে নির্বাক হয়ে বেশ খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন গোড়ায় উনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। খানিকক্ষন পরে তোলাতে ভোলাতে বললেন, কিন্তু…আবার, সিন্দ…তোমরা তাহলে বেলজিয়ামে নয়? ইশট ডের মিলিটার নিশট কাম, ডাস আউটো….তোমরা তাহলে পালাতে গিয়ে পালাতে পারোনি?
আমরা ওঁকে সব পরিষ্কার করে বললাম সৈন্যদের আর গাড়ির গল্পটা ইচ্ছে করেই রটানো হয়েছিল যাতে লোকে, বিশেষ করে জার্মানরা আমাদের খোঁজে এলে ভুল ধারণা করে।
এতটা বুদ্ধি খাটানো হয়েছে দেখে ডুসেল আবার হাঁ হয়ে গেলেন। এরপর যখন আমাদের দারুণ বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক অতি সুন্দর এই ছোট্ট ‘গুপ্ত মহল’টা ঘুরে ঘুরে দেখলেন, তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া তার আর কিছু করার রইল না।
দুপুরের খাওয়া আমরা সবাই একসঙ্গে বসে খেলাম। তারপর উনি খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চা খেয়ে নিলেন। তারপর ওঁর জিনিসপত্রগুলো (মিপ আগেই এনে রেখেছিলেন) খানিকটা গোছগাছ করলেন। ততক্ষণে উনি এটাকে অনেকটা নিজের বাড়ি বলে মনে করতে আরম্ভ করেছেন। বিশেষ করে নিচের টাইপ করা একখানা গুপ্তমহলের নিয়মকানুন’ (ফান ডানের করা) উনি হাতে পেলেন।
‘গুপ্ত মহলের ছক ও সহায়িকা’
ইহুদী ও ঐ জাতীয় লোকদের সাময়িক বসবাসের জন্যে বিশেষ সংস্থা।
বছরের বারোমাসই খোলা থাকে। সুন্দর, শান্ত, জঙ্গলমুক্ত পরিবেশ, আমস্টার্ডামের একেবারে কেন্দ্রস্থলে। ১৩ আর ১৭ নম্বর ট্রামের রাস্তায়, গাড়িতে অথবা সাইকেলেও আসা। যায়। বিশেষ ক্ষেত্রে পায়ে হেঁটেও আসা যায়, যদি জার্মানরা যানবাহনে চড়া নিষিদ্ধ করে।
থাকা খাওয়া ও বিনামূল্যে।
বিশেষ রকমের চর্বিমুক্ত খাবার।
সব সময় পানি পাওয়া যাবে বাথরুমে (হায়, গোসলের ব্যবস্থা নেই) এবং বিভিন্ন ভেতর বাইরের দেয়ালের গায়ে।
প্রচুর গুদামঘর আছে সব রকমের মাল রাখার জন্যে।
নিজস্ব বেতার কেন্দ্র, লন্ডন, নিউইয়র্ক, তেল আবিব এবং আরও বিস্তর বেতারঘাটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। সন্ধ্যে ছ’টার পর কেবল এখানকার বাসিন্দারা ব্যবহার করতে পারবেন। কোনো রেডিও স্টেশনই নিষিদ্ধ নয়, এটা ধরে নিয়ে যে কেবল বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রেই জার্মান স্টেশন শোনা যাবে, যেমন চিরায়ত সঙ্গীত ইত্যাদির জন্যে।
বিশ্রামের সময় : রাত ১০টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। রবিবারে সওয়া ১০টা। পরিচালকদের নির্দেশ অনুসারে, অবস্থা অনুকূল হলে, বাসিন্দারা দিনের বেলায় বিশ্রাম নিতে পারবেন। সাধারণের নিরাপত্তার জন্যে বিশ্রামের সময়কাল অক্ষরে অক্ষরে অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
ছুটিছাটা (ঘরের বাইরে) : অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত রইল। বাক-ব্যবহার ও সমস্ত সময় নিচু গলায় কথা বলবেন, এটা আদেশ। সমস্ত সভ্য ভাষা ব্যবহার করা যাবে, সুতরাং জার্মন ভাষা চলবে না।
অনুশীলন ও প্রতি সপ্তাহে একটি করে শর্টহ্যাণ্ড লেখার ক্লাস। অন্য সমস্ত সময়ে ইংরেজি, ফরাসী, গণিত এবং ইতিহাস।