আমাদের গোপন ডেরার প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমাদের খাবার জিনিসের যোগান সম্বন্ধে তোমাকে কিছুটা বলা দরকার। তুমি জানো, আমাদের ওপরতলায় কিছু আছে একেবারে সত্যিকার লুভিস্টি শুয়োর।
আমরা রুটি পাই কুপহুইসের বন্ধু এক চমৎকার রুটিওয়ালার কাছ থেকে। বাড়িতে থাকতে যতটা পেতাম, স্বভাবতই সেই পরিমাণ মেলে না। তবে ওতে আমাদের কুলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে বেআইনীভাবে চারটে রেশন কার্ড কেনা হয়েছে। এই সব রেশন কার্ডের দাম দিন দিনই বাড়ছে। সাতাশ ফ্লোরিন থেকে বেড়ে এখন তার দাম হয়েছে তেত্রিশ ফ্লোরিন। তাও কী, না ছাপানো এক টুকরো কাগজের জন্যে।
কিছু খাবার বাড়িতে রেখে দেওয়ার জন্যে, ১৫০ টিন তরিতরকারি ছাড়াও, আমরা ২৭০ পাউন্ড শুকনো কড়াইশুটি আর বি কিনেছি। সবটাই আমাদের জন্যে নয়, তার কিছুটা অফিসের লোকদের জন্যে। আমাদের যাতায়াতের ছোট রাস্তায় (লুকানো দরজার ভেতরদিকে) বস্তায় করে জিনিসগুলো হুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরের জিনিস খুব ভারী হওয়ায় তার চাপে বস্তার কিছু কিছু সেলাই ছিঁড়ে গিয়েছে।
কাজেই আমরা ঠিক করেছিলাম যে, শীতের জন্য রাখা মালগুলো চিলেকোঠায় রেখে দিলেই ভালো হয়। পেটারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ও যেন মালগুলো টেনে টেনে ওপরে তোলে।
ছটার মধ্যে পাঁচটা বস্তা অক্ষত অবস্থায় সে ওপরে তুলেছিল। ছয় নম্বর বস্তাটা যখন সে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, তখন বস্তাটার তলা ফেলে যায়। ফলে, বেগুনে বিনগুলো ঝুর ঝুর করে না, একবারে যথার্থ মুষলধারে বেরিয়ে এসে সিঁড়িতে ঝম ঝম করে পড়তে লাগল। বস্তায় পঞ্চাশ পাউণ্ডের মত জিনিস ছিল এবং তার এত আওয়াজ যে, তাতে মরা মানুষও জেগে ওঠে।
নিচেরতলার লোকেরা ভাবল ঝরঝরে পুরনো বাড়িটা বুঝি তাদের মাথায় ভেঙে পড়ছে। (ভগবানের দয়ায় বাড়িতে তখন কোনো বাইরের লোক ছিল না) পেটার এক মুহূর্তের জন্য। ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই হাসতে হাসতে ওর পেট ফাটার যোগাড়, বিশেষ করে ও যখন দেখল সিঁড়ির নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি বিনের সমুদুরের মাঝখানে যেন ছোট্ট একটা দ্বীপ হয়ে। আমার গোড়ালি অব্দি বিনের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ডোবা।
তাড়াতাড়ি আমরা কুড়োতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু বিনের দানা এত পিছল আর ছোট যে গড়িয়ে গড়িয়ে যেন সম্ভব অসম্ভব যত আনাচকানাচ আর গর্তে গিয়ে পড়ছিল। এখন হয়েছে কী, যখনই কেউ নিচে যায় এক দুবার হাঁটু মুড়ে নিচু হয়ে যাতে সে মিসেস ফান ডানকে একমুঠো করে বিন ভেট দিতে পারে।
আরেকটু হলে বলতে ভুলে যেতাম যে বাপি আবার বেশ ভালো হয়েছেন।
তোমার আনা
পুনশ্চ : এইমাত্র রেডিওতে খবর বলল যে, আলজিয়ার্সের পতন হয়েছে। মরোক্কো, কাসাব্লাঙ্কা আর ওরান বেশ কয়েকদিন ধরে ব্রিটিশের কব্জায়। এইবার তুনিসের পালা, আমরা তার অপেক্ষায় আছি।
.
মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
দারুণ খবর–আমরা আরেকজনকে আশ্রয় দিতে চলেছি, উনি এলে আমরা হব আটজন। হ্যাঁ, সত্যি। আমরা বরাবর ভেবেছি যে, আরও একজনের থাকার মতন আমাদের যথেষ্ট জায়গা আর খাবারদাবার আছে। আমাদের ভয় ছিল তাতে কুপহুইস আর ক্রালারের আরও কষ্ট বাড়বে। কিন্তু ইহুদীদের মর্মান্তিক দুর্দশার খবর এখন যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে যে দুজনের কথামত কাজ হবে বাপি তাদের ধরে বসেন এবং তারাও মনে করেন প্রস্তাবটা খুব ভালো। ওঁরা বলেছেন, সাতজনকে নিয়ে যে ভয়, আটজন হলেও সেই এই ভয়, খুব ঠিক কথা। কথা পাকা হওয়ার পর আমরা আমাদের বন্ধুবর্গের মধ্যে বাছাই করে কোন্ একজনকে নিলে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ভালভাবে খাপ খাবে, এই নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা করতে লেগে গেলাম। একজনের সম্বন্ধে মনস্থির করতে কোনো মুশকিল ছিল না। ফলে ডান পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের বাপি যখন নাকচ করে দিলেন, তখন আমরা অ্যালবার্ট ডুসেল বলে এজন দাতের ডাক্তারকে মনোনীত করলাম। যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ভাগ্যক্রমে তার স্ত্রী ছিলেন দেশের বাইরে। খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ বলে লোকে তাকে জানে। আমরা এবং মিস্টার ফান ডান তাকে যতটা জানি, তাতে দুই পরিবারেরই ধারণা–ভদ্রলোক নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। মিপ ওকে চেনেন। কাজেই ওঁকে এখানে আনার ব্যাপারে মি্প সব ব্যবস্থা করতে পারবেন। উনি এলে মারগটের জায়গায় আমার ঘরে এঁকে শুতে হবে, মারগট ঘুমোবে ক্যাম্পখাটে।
তোমার আনা
.
বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
মিপ্ যখন ডুসেলকে জানান যে তার জন্যে একটা গা ঢাকা দেওয়ার জায়গার ব্যবস্থা হয়েছে, ডুসেল বেজায় খুশি হন। মিপ্ ওঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসার জন্যে তাগাদা দেন। ভাগো হয় শনিবারে এলে। ডুসেল বলেন শনিবারেই চলে আসা বোধহয় সম্ভব হবে না, প্রথমত ওঁর কার্ডের সূচিপত্র হাল অবধি টেনে আনতে হবে, জনা দুয়েক রোগীকে দেখতে হবে এবং দেনাপাওনাগুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে। মিপ্ আজ সকালে এসেছিলেন এই খবরটা দিতে। আমরা বলি যে, ওঁর দেরি করা উচিত হবে না। ওঁকে এভাবে গোছগাছ করে আসতে গেলে একগাদা লোকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে, তারা জেনে যাক এটা আমরা চাই না। মিপ্ ওঁকে জিজ্ঞেস করবেন শনিবারে কোনোমতে উনি চলে আসতে পারেন কিনা।