মারগটকে আমি হিংসে করি না, কখনই করিনি। ওর চোখমুখ ভালো, ও সুন্দর দেখতে–তার জন্যে আমার গা জ্বলে না। আমি শুধু উন্মুখ হয়ে থাকি বাপির সত্যিকার ভালবাসার জন্যে; শুধু তার সন্তান বলে নয়, আমি আনা হিসেবে।
আমি বাপিকে আঁকড়ে ধরি, কারণ শুধু তার ভেতর দিয়েই বাড়ির প্রতি আমার অবশিষ্ট টানটুকু আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারি। বাপি বোঝেন না যে, মাঝে মাঝে মা-মণির ব্যাপারে আমার চাপা অভিমান প্রকাশ করার দরকার হয়। বাপি এ নিয়ে কথা বলতে নারাজ; শেষে মা-মণির ভুলত্রুটি নিয়ে কোনো মন্তব্য হয় এমন যে কোনো জিনিস বাপি স্রেফ এড়িয়ে চলেন। ঠিক তেমনি, আমি আর সব পারি কিন্তু মা-মণি এবং তার ভুলত্রুটিগুলো সহ্য করা আমার পক্ষে শক্ত হয়। এর সবটাই কিভাবে নিজের মনে চেপে রাখতে হয় আমি জানি না। মার জবরজং কাজ, বাঁকা বাঁকা কথা এবং তাঁর মিষ্টত্বের অভাব–সব সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়; অন্য দিকে এটাও মানতে পারি না যে আমি যা করি তাতেই দোষ।
সব কিছুতেই আমরা একে অন্যের ঠিক বিপরীত; কাজেই আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যাব, এটা স্বাভাবিক। মা-মণির স্বভাবের ব্যাপারে আমি কোনো রায় দিচ্ছি না, সে বিচারে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তাকে দেখছি শুধু মা হিসেবে এবং আমার কাছে সেদিক থেকে তিনি মোটেই সার্থক নন; আমাকে আমার নিজেরই মা হতে হবে। আমি ওদের সকলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আমি আমার নিজের কর্ণধার এবং পরে দেখা যাবে কোথায় তরী ভেড়াব। এ সব কথা ওঠে বিশেষ করে এই জন্যেই যে, নিখুত মা। আর সহধর্মিণী কি রকম হওয়া উচিত তার একটা ছবি আমার মানসপটে আঁকা আছে; যাকে আমি ‘মা’ বলতে বাধ্য, তার ভেতর ঘুণাক্ষরেও সে ছবির কোনো আদল দেখতে পাই না।
আমি সবসময় এই বলে মনকে বেঁধে নিই যে, মা-মণির কু-দৃষ্টান্তগুলোর দিকে আমি নজর দেব না। আমি মার শুধু ভালো দিকটাই দেখতে চাই এবং তার ভেতর যেটা না পাব সেটা আমি নিজের ভেতর খুঁজব। কিন্তু তাতে কাজ হয় না এবং এর ভেতর সবচেয়ে খারাপ জিনিস হল–বাপি না, মা-মণি না-ওঁরা কেউই আমার জীবনের এই ফঁাকটা দেখতে পান না এর জন্যে আমি ওঁদেরই দায়ী করি। কেউ কখনও তাদের সন্তানদের একেবারে পুরোপুরিভাবে খুশি করতে পারে বলে মনে হয় না।
মাঝে মাঝে আমি বিশ্বাস করি, ভগবান আমাকে বাজিয়ে দেখতে চান, যেমন এখন তেমনি এর পরেও আমাকে ভালো হতে হবে নিজের চেষ্টায়, কাউকে দেখে নয়, কারো সদুপদেশ শুনে নয়। তাহলে এরপর আমি আরও বেশি জোর পাব। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আর এই চিঠি পড়বে? নিজের কাছ থেকে ছাড়া দ্বিতীয় আর কার কাছ থেকেই বা আমার সান্ত্বনা মিলবে? প্রায়ই আমার সান্ত্বনার দরকার হয় বলে, অনেক সময়ই নিজেকে মনে হয় দুর্বল এবং নিজের ওপর অসন্তুষ্ট; আমার দোষত্রুটি বিস্তর। এটা আমি জানি এবং প্রত্যহ আমি আত্মন্নতির চেষ্টা করি, বার বার করি।
আমার রোগ তাড়ানোর প্রথাটা খুবই বিচিত্র। একদিন আনা হয় ভারি বুঝদার মেয়ে এবং তাকে সবজান্তা বলে মেনে নেওয়া হয় এবং পরের দিনই শুনি আনা একটা বোকা পাঠা, একেবারে গণ্ডমূর্খ এবং সে মনে করে বই পড়ে পড়ে ভারি দিগগজ হয়ে উঠেছে। আমি কচি খুকী নই, অথবা এখন আর আদরে-মাথা খাওয়াও নই যে, যাই কিছু করুক সে হবে হাসির পাত্র। কথায় প্রকাশ করে উঠতে না পারলেও আমার নিজস্ব মতামত, ছক এবং ভাবনাচিন্তা আছে। যখন আমি বিছানায় শুই আমার ভেতর কত কিছু যে টগবগ করে ফোটে যাদের সম্পর্কে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, যারা সব সময় আমার মনোগত অভিপ্রায় ধরতে না পেরে তার কদৰ্থ করে, তাদেরই সঙ্গে আমাকে ওঠাবসা করতে হচ্ছে। সেইজন্যেই আমার শেষ আশ্রয়স্থল হয় আমার ডায়রি। আমার সূচনা আর পরিণতি সেখানেই, কেননা কিটি, সব সময় সহনশীল। আমি তাকে কথা দেব, আমি সব সত্বেও সমানে লেগে থাকব এবং এই সব কিছুর ভেতর দিয়ে আমার নিজস্ব পথ খুঁজে নেব এবং আমার চোখের পানি নীরবে গিলব। এরই মধ্যে যেন দেখতে পাই তাতে ফল হয়েছে অথবা যে আমাকে ভালোবাসে তেমন কারো কাছ থেকে যেন উৎসাহ পাই, এটাই আমার মনোগত বাসনা।
আমাকে দোষী সাব্যস্ত করো না; বরং মনে রেখো, কখনও কখনও আমিও ফেটে পড়ার পর্যায়ে পৌঁছুতে পারি।
তোমার আনা
.
সোমবার, ৯ নভেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
কাল ছিল পেটারের জন্মদিন, ওর বয়স হল ষোল বছর। ও বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু উপহার পেয়েছে। নানা জিনিসের মধ্যে রয়েছে একটা মনোপলি খেলা, একটা দাড়ি কামানোর ক্ষুর আর একটা লাইটার। ও যে খুব একটা সিগারেট খায় তা নয়; আসলে নিছক দেখানোর জন্যে।
সবচেয়ে তাক লাগানোর ব্যাপার এল মিস্টার ফান ডানের কাছ থেকে। বেলা একটার সময় তিনি ঘোষণা করলেন যে ব্রিটিশরা তুনিস, আলজিয়ার্স, কাসাব্লাঙ্কা আর ওরানে অবতরণ করেছে। প্রত্যেকে বলছিল, ‘এইবার শেষের শুরু’, কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বোধ হয় ইংল্যাণ্ডে একই জিনিস শুনেছিলেন, তিনি বললেন, ‘এটা শেষ নয়। এমন কি এটা শেষেরও শুরু নয়। আসলে এটা বোধ হয় আরম্ভে শেষ।’ তফাতটা কি ধরতে পারছ? আশাবাদী হওয়ার রীতিমত কারণ আছে। রুশরা তিন মাস ধরে যে স্তালিনগ্রাদ শহরে সমানে। প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, এখনও তা জার্মানদের হাতে চলে যায়নি।