আমি আজ ভোরে উঠেছি। সাড়ে আটটায় হেংককে চলে যেতে হল। জমিয়ে বসে সকালের খাওয়া সেরে মি নিচে চলে গেলেন। বৃষ্টি হচ্ছিল মুষলধারে। তার মধ্যে সাইকেল চালিয়ে যে অফিসে আসতে হয়নি, মিপ্ তাতে খুশি। পরের সপ্তাহে এলি আসছে; এখানে এক রাত কাটাতে।
তোমার আনা
.
বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
আমি খুবই চিন্তায় আছি, বাপি অসুস্থ। খুব জুর আর গায়ে লাল লাল কি সব বেরিয়েছে, হাম বলে মনে হয়। আমরা ডাক্তারও ডাকতে পারছি না, ভাবো! মা-মণি চেষ্টা করছেন বাপির যাতে ঘাম বের হয়। হয়ত তাতে গায়ের তাপ কমবে।
আজ সকালে মি আমাদের বললেন যে, ফান ডানদের বাড়ি থেকে সমস্ত আসবাবপত্র নিয়ে গেছে। মিসেস ফান ডানকে আমরা এখনও বলিনি। এমনিতেই উনি যে রকম তেতে পুড়ে রয়েছেন, তাতে বাড়িতে ওঁর ফেলে-আসা মনোরম সব চিনেমাটির বাসন, আর সুন্দর সুন্দর সব চেয়ার নিয়ে আরেকবার উনি ফোপাতে শুরু করলে সেটা শুনতে আমাদের ভালো। লাগবে না। আমরা বাধ্য হয়ে, আমাদের প্রায় সমস্ত ভালো জিনিস ফেলে রেখে চলে এসেছি; সুতরাং ও নিয়ে এখন গাইগুই করে লাভ কী?।
ইদানীং তুলনায় বড়দের বইপত্র আমি পড়তে পারছি। এখন আমি পড়ছি নিকো ফান জুখটেলেনের ‘ইভার যৌবন’। এর সঙ্গে স্কুলের মেয়েদের প্রেমের গল্পের খুব বেশি তফাত দেখতে পাচ্ছি না। এটা ঠিক যে এদো গলিতে অচেনা পরপুরুষের কাছে মেয়েরা নিজেদের বিক্রি করছে, এ সব কিছু কিছু জিনিস এতে আছে। এর জন্যে তারা একমুঠো টাকা চাইছে। আমার জীবনে এ রকম ঘটলে আমি মরে যেতাম। এতে আরও বলা আছে যে ইভার মাসিক। হয়। ইস, আমার কবে যে হবে; মনে হয় জীবনে এটা একটা দামী জিনিস।
বড় আলমারিটা থেকে বাবা এনেছেন গোটে আর শিলারের নাটক। প্রত্যেক দিন। সন্ধ্যেবেলায় বাবা আমাকে পড়ে শোনাবেন। ‘ডন্ কার্রস্’ দিয়ে আমাদের এই পড়ার ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেছে।
বাপির দেখাদেখি জোর করে মা-মণি তার প্রার্থনাপুস্তক আমার হাতে ঠেসে দিয়েছেন। মুখরক্ষার জন্যে জার্মান ভাষার কিছু কিছু স্ত্রোত্র আমি পড়েছি; পড়তে বেশ সুন্দর, কিন্তু আমার কাছে খুব একটা অর্থবহ বলে মনে হয় না। আমাকে অমন উনি জোর করে ধার্মিক করতে চান কেন, কেবল ওঁকে খুশি করার জন্যে?
কাল আমরা এই প্রথম ঘরে আগুন জ্বালাব। শেষটায় ধোয়ার চোটে আমরা দমবন্ধ হয়ে। মারা না যাই। কত যুগ ধরে যে চিমনি সাফ করা হয়নি তার ঠিক নেই। আশা করা যাক, চিমনিটা ধোয়া টানবে।
তোমার আনা
.
শনিবার, ৭ নভেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
মার মেজাজ সাংঘাতিক তিরিক্ষে, এবং মনে হয় আমার জীবনে সেটা সব সময় অশান্তি ডেকে আনে। না বাবা, না মা–ওঁরা কেউই কখনও মারগটকে বকেন না এবং ওঁরা সব সময় সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপান–এটা কি নেহাতই একটা আকস্মিক ব্যাপার? কাল সন্ধ্যের কথাই ধরা যাক; মারগট একটা বই পড়ছিল, তাতে সুন্দর সুন্দর সব আঁকা ছবি; বইটা উপুড় করে রেখে ও উঠে ওপরে চলে গেল যাতে ফিরে এসে আবার পড়া শুরু করতে পারে। আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না বলে বইটা তুলে নিয়ে ছবিগুলো দেখতে শুরু করে দিলাম। মারগট ফিরে এসে ‘ওর’ বই আমার হাতে দেখে ভুরু কুঁচকে বইটা ফেরত চাইল। আমি শুধু চেয়েছিলাম আরও কয়েকটা পাতা উল্টে বইটা দেখতে, তার জন্যেই মারগট ক্রমশ রাগে ফুলে উঠতে লাগল। মা-মণি তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বললেন, ‘মারগটকে বইটা দিয়ে দে; ও পড়ছিল।’ বাবা এই সময় ঘরে এলেন। কী ব্যাপার কিছুই না জেনে, শুধু মারগটের মুখে ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভাব দেখেই উনি আমাকে নিয়ে পড়লেন—‘তোমার কোনো বইতে যদি মারগট হাত দিত, তাহলে তুমি কী বলতে আমি দেখতাম।‘ আমি কোনো আপত্তি করে তক্ষুনি বইটা নামিয়ে রেখে ঘর ছেড়ে চলে গেলাম–ওঁরা ভাবলেন, আমি অভিমান করেছি। যেটা হল, সেটা রাগও নয়, অভিমানও নয়–শুধু আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল। কী নিয়ে গোলমাল সেটা না জেনে রায় দিয়ে দেওয়া বাবার এটা উচিত হয়নি। আমি বইটা নিজেই মারগটকে দিয়ে দিতাম, এবং ঢের তাড়াতাড়ি, মা-বাবা যদি এ ব্যাপারে নাক না গলাতেন। ওঁরা এসেই এমনভাবে মারগটের পক্ষ নিলেন যেন তার প্রতি এক মহা অপরাধ করা হয়েছে।
মা-মণি মারগটের পক্ষ নেবেন এটা বোঝাই যায়; উনি আর মারগট, ওঁরা দুজনে সব সময়ই পরস্পরকে সমর্থন করে চলেন। এটা আমার কাছে এমন ডালভাত হয়ে গেছে যে মার বকবকানি আর মারগটের মেজাজ এসব আমি একেবারেই গায়ে মাখি না।
আমি ওদের ভালবাসি, তার একমাত্র কারণ ওরা মা আর মারগট বলে। বাবার ব্যাপারটা একটু আলাদা। বাবা মারগটকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখালে, ওর কার্যকলাপ মঞ্জুর করলে, বাবা ওকে প্রশংসা আর আদর করলে আমার বুক ফেটে যায়, কেননা বাবাকে আমি মনে মনে পূজো করি। আমার ভরসা আমার বাবা। দুনিয়ায় বাবাকে ছাড়া আর কাউকে আমি ভালবাসি না। এটা বাবার নজরে পড়ে না যে, মারগটের সঙ্গে বাবা যে ব্যবহার করেন আমার সঙ্গে তা করেন না। মারগটের মত সুন্দর, মিষ্টি, রূপসী মেয়ে দুনিয়ায় দুটি নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি নিশ্চয় এটা দাবি করতে পারি যে, আমার দিকেও তাকানো হোক। বাড়িতে আমি হলাম সব সময়ই উজবুক, হাতে পায়ে জড়ানো; কিছু করলে সব সময়ই আমার হয়। দুনো খোয়ার, প্রথমে জোটে গালমন্দ এবং তারপর আবার আমার মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার ধরনের জান্যে। এই স্পষ্ট পক্ষপাত আর আমি বরদাস্ত করতে রাজী নই। আমি বাপির কাছ থেকে এমন কিছু চাই যা উনি আমাকে দিতে পারছেন না।