তোমার আনা
.
শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
আমি সাংঘাতিক ব্যস্ত। এইমাত্র আমি ‘লা বেলে নিফেরনাইসে’ থেকে একটি অধ্যায় তর্জমা করেছি এবং নতুন শব্দগুলো খাতায় টুকেছি। এরপর একটা যারপরনেই ভজোঘটে বুদ্ধির অঙ্ক আর তিন পৃষ্ঠা ব্যাকরণ। আমি সোজা বলে দিই রোজ রোজ এই সব বুদ্ধির অঙ্ক আমাকে দিয়ে হবে না। অঙ্কগুলো যে অতি যাচ্ছেতাই, এ বিষয়ে বাপি আমার সঙ্গে একমত। আমি বোধ হয় অঙ্কে বাপির চেয়ে এককাঠি সরেস, যদিও দুজনের কেউই আমরা খুব একটা ভালো নই। প্রায়ই আমাদের মারগটকে ডাকতে হয়। শর্টহ্যাণ্ডে তিনজনের মধ্যে আমিই আছি সব চেয়ে এগিয়ে।
কাল আমি ‘দি অ্যাসণ্ট’ বইটা শেষ করলাম। বইটা বেশ মজার। কিন্তু ‘যুপ টের। হয়েল্’-এর কাছে লাগে না। আদতে আমার মতে সিসি ফান মার্ক্সফেট হলেন প্রথম শ্রেণীর লেখিকা। আমি আমার ছেলেমেয়েদের অবশ্যই ওঁর বই পড়তে দেব। মা-মণি, মারগট আর আমি আবার এখন আমাদের খুব আঠা-আঠা ভাব। এটা সত্যিই অনেক ভালো। কাল সন্ধ্যেবেলায় মারগট আর আমি দুজনে এক বিছানায় শুয়েছিলাম। ঠাসাঠাসি করে শুতে হলেও সেটা ভালোই লেগেছে। মারগট জিজ্ঞেস করল আমার ডায়রিটা ও পড়তে পারে কিনা। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, পারো অন্তত খানিকটা খানিকটা।‘ তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম ওরটা আমি পড়তে পারি কিনা। মারগট বলল, ‘হ্যাঁ।’ এরপর কথায় কথায় ভবিষ্যতের প্রসঙ্গ উঠল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম বড় হয়ে ও কী হতে চায়। কিন্তু ও কিছুতেই ভাঙল না। এবং ব্যাপারটা চেপে গেল। আমি আঁচ করে বুঝলাম ওর ইচ্ছে বোধ হয় মাস্টারি করার। আমার অনুমান সঠিক কিনা জানি না। আমার মনে হয় অবশ্য, আমারই বা জানার জন্যে অত ছোঁকছোঁকানি কেন!
আজ সকালে পেটারকে ভাগিয়ে আমি ওর বিছানা দখল করেছিলাম। ও ভীষণ চটে গিয়েছিল, আমি কেয়ার করিনি। আমার ওপর অতটা রাগ না করলেই ও পারত, কাল যখন ওকে আমি একটা আপেল দিয়েছি।
আমি দেখতে খুব কুৎসিত কিনা মারগটকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল বিলক্ষণ মনে ধরার মতন আমার চেহারা, এবং আমার চোখজোড়া চমৎকার। কথাগুলো, একটু রেখেঢেকে বলা তাই না?
বারান্তরে কথা হবে।
তোমার আনা
.
মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
এখনও আমার হাত কাঁপছে, যদিও আমাদের আচকা ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা ঘটেছিল সেই দু ঘন্টা আগে। খোলাসা করে বলছি। বাড়িটাতে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম আছে পাঁচটা। আমরা জানতাম যে ওগুলো ভর্তি করবার জন্যে কেউ একজন আসছে; কিন্তু আসছে যে ছুতোরমিস্ত্রি, বা তাকে তুমি যাই বলো, এটা আগে থেকে আমাদের জানানো হয়নি।
ফলে, আলমারি-ঢাকা দরজার উল্টোদিকের দালানে হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ আমার কানে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা মুখে চাবি আঁটার কোনো প্রচেষ্টা করেনি। তক্ষুনি ছুতোরমিস্ত্রির কথা আমার মাথায় আসে; এলি আমাদের সঙ্গে খেতে বসেছিল, ওকে আমি সাবধান করে দিয়ে বলি ও যেন নিচের তলায় না যায়। বাবা আর আমি গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়াই যাতে লোকটা চলে গেলে আমরা টের পাই। মিনিট পনেরো ধরে হাতুড়ি পেটানোর পর লোকটা তার হাতুড়ি আর যন্ত্রপাতিগুলো আলমারির মাথায় রেখে দিল (আমরা ধারণা–করেছিলাম) এবং তারপর আমাদের দরজায় টোকা দিতে শুরু করল। শুনে আমরা একেবারে ভয়ে সাদা হয়ে গেলাম! ও বোধ হয় কোনোরকম আওয়াজ পেয়ে থাকবে এবং আমাদের গোপন আভড়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে চাইছিল। দেখে শুনে সেই রকমই মনে হয়েছিল। দরজা ঠোকা, টানাটানি, ঠেলাঠেলি, খোলাখুলি–এইসব সমানে চলছিল। কোথাকার কে না কে আমাদের এমন সুন্দর আত্মগোপনের জায়গাটা জেনে যাবে, এটা ভেবে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলাম। যখন আমি ভাবছি যে মৃত্যু আমার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই আমার কানে গেল মিস্টার কুপহুইস বলছেন, ‘দরজা খোলো, আমি হে আমি।’ সঙ্গে সঙ্গে আমরা দরজা খুলে দিলাম। যে-আংটার সঙ্গে আলমারিটা লাগানো, সেটা খুলতে পারে যারা ভেতরের খবর জানে। কিন্তু আংটাটা সেঁটে গিয়েছিল। তার ফলে ছুতোরমিস্ত্রি আসার ব্যাপারটা আগে থেকে আমাদের কেউ জানিয়ে দিতে পারেনি। ছুতোরমিস্ত্রি নিচে চলে গেছে এবং কুপহুইস চাইছিলেন এলিকে ডেকে নিয়ে যেতে, কিন্তু আলমারিটা আর খোলা যাচ্ছিল না। বাপ রে, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যে লোকটা ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল সে আমার কল্পনায় ফেঁপে ফুলে উঠতে উঠতে দানবের আকারে দুনিয়ার সবচেয়ে ডাকসাইটে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল।
যাক গে, কপাল ভালো, তাই এবারে সব ভালোয় ভালোয় উৎরে গেল। ইতিমধ্যে সোমবারটা তফা কেটেছে। মিথু আর হেংক রাত্তিরে থেকে গিয়েছিলেন। ফান সাপ্টেদের আমাদের ঘর ছেড়ে দিয়ে মারগট আর আমি সে রাতে মা-বাবার ঘরে শুয়েছিলাম। খাবারটা হয়েছিল গরম উপাদেয়। শুধু একটাই যা বিঘ্ন ঘটেছিল। বাবার বাতিটা গোলমাল করায় গোটা বাড়ি ফিউজ হয়ে যায়। হঠাৎ দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা বসে আছি। কী করা যায়? বাড়িতে কিছুটা ফিউজের তার আছে বটে, কিন্তু ফিউজবক্স রয়েছে অন্ধকার গুদাম ঘরের একদম পেছনদিকে–সন্ধ্যের পর খুব খিটকেল কাজ। তবু পুরুষমানুষেরা পিছু হটল না। দশ মিনিট পর মোমবাতিগুলো আবার ফু দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া গেল।