তোমার আনা
.
মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
অজ্ঞাতবাসে গেলে মানুষের জীবনে অভাবিত সব ঘটনা ঘটে। ভাবো একবার, বাথটাব না থাকায় আমাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে হাত ধোয়ার পানির জায়গা। গরম পানি মেলে অফিসঘরে (অফিস বলতে সবসময়ই বুঝবে গোটা নিচের তলা); ফলে, আমরা সাতজন সবাই পালা করে এত বড় বিলাসিতাটা কাজে লাগাই। আমরা একেকজন একেক রকম; কারো কারো শ্লীলতাবোধ অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। সেই কারণে সংসারের প্রত্যেকে তার নিত্যকর্মের জন্যে নিজস্ব জায়গা বেছে নিয়েছে। কাঁচের দরজা থাকা সত্ত্বেও পেটার ব্যবহার করে রান্নাঘর। গোসলের ঠিক আগে একে একে আমাদের সকলের কাছে সে যাবে এবং গিয়ে বলবে যে আধঘণ্টা সময় আমরা কেউ যেন রান্নাঘরের পাশ দিয়ে না যাই। ওর ধারণা এটাই যথেষ্ট। মিস্টার ফান ডান সোজা উপরতলায় চলে যান; অতটা পথ গরম পানি টেনে নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা কম নয়। কিন্তু ওঁর চাই নিজস্ব ঘরটুকুর আড়াল। মিসেস ফান ডান আজকাল স্রেফ গোসলের পাটই তুলে দিয়েছেন; উনি সেরা জায়গা বের করার অপেক্ষায় আছেন। বাবা গোসল সারেন অফিসের খাসকামরায়; রান্নাঘরে অগ্নিবারক দেয়ালের পেছনের জায়গায় মা-মণি। মারগট আর আমি গা মাজাঘষার জন্যে বেছে নিয়েছি সামনের। অফিসঘর। শনিবার বিকেলগুলোতে ঘরের পর্দাগুলো ফেলে দেওয়া হয়, সুতরাং আধো অন্ধকারে আমরা গা ধুই। অবশ্য, এই জায়গাটা আর আমার ভালো লাগছে না; গত সপ্তাহের পর থেকে যেখানে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য থাকবে এমন একটা জায়গার খোঁজে আছি। পেটার একটা ভালো মতলব দিয়েছে–বড় অফিসঘরের শৌচাগারটা আমার পছন্দ হতে পারে। সেখানে বসা যায়, আলো জ্বালানো যায়, দরজা বন্ধ করা যায়, নিজস্ব গোসলের পানি ঢাললে বাইরে বেরিয়ে যাবে। তাছাড়া চোরাচাহনির হাত থেকে বাঁচব।
রবিবার দিন এই প্রথম আমার মনোরম গোসল-ঘরটা আমি পরখ করে দেখলাম বাপরে, কী শব্দ! তবুও আমার মতে এটাই হল সবার সেরা জায়গা। অফিসের শৌচাগার থেকে ড্রেন আর পানির পাইপ সরিয়ে দালানে লাগানোর জন্যে গত সপ্তাহে কলের মিস্ত্রি নিচের তলায় কাজ করেছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়লে পাইপ যাতে জমে না যায় তারই জন্যে আগে থেকে সারানোর এই ব্যবস্থা। কলের মিস্ত্রির আসাতে সারা দিন আমরা পানি তো নিতে পারিইনি, উপরন্তু শৌচাগারেও যেতে পারিনি। এই মুশকিল আসানের জন্যে আমরা কী করেছিলাম সেটা বললে অবশ্য তোমার কাছে মোটেই প্রীতিকর ঠেকবে না।
এখানে যেদিন আমরা চলে আসি, আমি আর বাবা আমাদের জন্যে যাহোক করে একটা টুকরি বানিয়ে নিয়েছিলাম। আর কিছু না পেয়ে কাজে লাগানোর জন্যে আমরা একটা কাঁচের বয়াম নষ্ট করেছি। যেদিন কলের মিস্ত্রি আসে সেইদিন এইসব পাত্রে দিনের বেলায় বসার ঘরে প্রকৃতিদত্ত জিনিসগুলো জমা করা হয়েছিল। তার চেয়েও খারাপ ছিল মুখে কুলুপ দিয়ে সারাটা দিন বসে থাকা। কুমারী ‘প্যাক-প্যাক’-এর পক্ষে সেটা যে কী যন্ত্রণাকর ব্যাপার তুমি তা ধারণাই করতে পারবে না। এমনিতেই সাধারণত দিনের বেলায় আমাদের কথা বলতে হয় ফিস্ ফিস্ করে কিন্তু তার চেয়ে দশ গুণ খারাপ মুখ বুজে ঠায় বসে থাকা। তিন দিন সমানে বসে থেকে থেকে আমার নিচটা অসাড় হয়ে টনটন করছিল। রাত্তিরে শোয়ার সময়। খানিকটা শরীর চালনা করাতে ব্যথা খানিকটা কমল।
তোমার আনা
.
বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
কাল আমার অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড় হয়েছিল। আটটার সময় হঠাৎ খুব জোরে বেল বেজে উঠল। আমি ভাবলাম ঐ এল; কার কথা বলছি বুঝতেই পারছ। কিন্তু সবাই যখন বলতে লাগল যে, কোনো চ্যাংড়া ছেলে কিংবা হয়ত ডাক-পিওন, তখন আমি খানিকটা আশ্বস্ত হলাম।
দিনগুলো এখানে ক্রমেই ভারি চুপচাপ হয়ে পড়ছে। মিস্টার ক্রালারের কাছে রসুইখানায়। কাজ করেন ছোট্টখাট্টো ইহুদী কম্পাউণ্ডার লিউইন। সারা বাড়িটাই তাঁর নখদর্পণে; তাই আমাদের সর্বদাই ভয় এই বুঝি তিনি খেয়ালবশে পুরনো ল্যাবরেটরিতে একবার উকি দিয়ে বসেন। আমরা নেংটি ইঁদুরের মতন ঘাপটি মেরে আছি। তিন মাস আগে ঘুণাক্ষরেও কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে ছটফটে আনাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে বসে থাকতে হবে এবং তার চেয়েও বড় কথা, সেটা সে পারবে।
ঊনত্রিশে ছিল মিসেস ফান ডানের জন্মদিন। অবশ্য দিনটি বড় করে পালন করা যায়নি; তাহলেও তাঁর সম্মানে আমরা একটু প্রীতি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম, সঙ্গে কিছুটা উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল; কিছু ছোটখাটো উপহার আর ফুলও তিনি পেলেন। পতিদেবতার কাছ থেকে পেলেন লাল কারনেশান ফুল, ওটা ওঁদের কুলপ্ৰথী।
মিসেস ফান ডানের বিষয়ে একটু কচলে নেওয়া যাক; তোমাকে আমার বলা দরকার যে বাপির সঙ্গে উনি প্রায় চেষ্টা করেন ফষ্টিনষ্টি করতে; সেটা হয়ে পড়েছে আমার সারাক্ষণ বিরক্তির কারণ। উনি বাপির মুখে আর চুলে ঠোনা মারেন, স্কার্ট টেনে তোলেন এবং বন্ রসিকতা করেন। এইভাবে তিনি চান বাপির নজর কাড়তে। বরাত ভালো, বাপি পান না ওঁর ভেতর কোনো আকর্ষণ বা কোনো রসকস–কাজেই বাপির কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলে না। মিস্টার ফান ডানের সঙ্গে মা-মণি অমন ব্যবহার করেন না–একথা আমি মিসেস ফান। ডানের মুখের ওপর বলেছি।