‘আমি এতক্ষণ এমন একটা ভাব করছিলাম যেন তোমাদের উধাও হওয়ার ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গ আমি জানি না। কিন্তু চিরকুটটা দেখতে পেয়ে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি বললাম, মিস্টার গুডস্মিট, ঠিকানাটার উদ্দিষ্ট পুরুষটি যে কে সেটা এতক্ষণে আমার খেয়াল হচ্ছে। হু এইবার মনে পড়েছে, ইনি একজন উচ্চপদস্থ অফিসার; মাসছয়েক আগে অফিসে এসেছিলেন, দেখে মনে হয়েছিল, মিস্টার ফ্রাংকের সঙ্গে তাঁর বেশ দহরম মহরম। তেমন দরকার পড়লে মিস্টার ফ্রাংককে উনি সাহায্য করবেন বলেছিলেন। ভদ্রলোকের কর্মস্থল ছিল মাসট্রিশটু। আমার মনে হয় দ্রলোক তাঁর কথা রেখেছেন; তিনি কোনো না কোনো ভাবে ওঁদের গোড়ায় বেলজিয়ামে এবং তারপর সেখান থেকে সুইটজারল্যাণ্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বন্ধুরা কেউ খোঁজ করলে এই খবরটা আমি তাদের দেব। অবশ্য কারো কাছে মাসট্রিশটের নাম যেন করবেন না।
কথাগুলো বলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। ইতিমধ্যে তোমাদের অধিকাংশ বন্ধুই জেনে গেছে, কেননা আলাদা আলাদাভাবে অনেকেই বেশ কয়েকবার খোদ আমাকেই সে কথা বলেছে। এ গল্পটা শুনে আমরা দারুণ মজা পেয়েছিলাম এবং এরপর মিস্টার ফান ডান যখন আমাদের আরও সবিস্তারে সব বললেন, মানুষ কিভাবে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দেয় সেটা দেখে তখন আরও বেশি হেসেছিলাম। একটি পরিবার নাকি দেখেছে খুব ভোরবেলায় আমরা দুটিতে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি; আবার এক ভদ্রমহিলা নাকি একেবারে নিশ্চিতভাবে জেনেছেন যে, মাঝরাত্তিরে একটা মিলিটারি গাড়ি এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেছে।
তোমার আনা
.
শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ১৯৪২
আদরের কিটি,
এ আমাদের লুকোবার জায়গায় প্রবেশপথটি এবার যথাযথভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মিস্টার ক্রালার মনে করছিলেন আমাদের দরজার সামনে একটা কাবার্ড রেখে দিলে ভালো হয় (কেননা লুকোনো সাইকেলের খোঁজে বিস্তর বাড়িতে খানাতল্লাসি হচ্ছে), তবে কাবার্ডটা হবে অস্থাবর–যাতে দরজার মতো খোলা যায়।
গোটা জিনিসটা করলেন মিস্টার ফোসেন। আমরা তাঁকে আগেই সব খুলে বলেছি; কিন্তু তিনি কী করবেন, তার হাত-পা বাঁধা। নিচের তলায় যেতে চাইলে প্রথমে আমাদের হাঁটু মুড়ে নিচু হতে হবে, তারপর ঝাঁপ দিতে হবে, কেননা ধাপগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গোড়ার তিনদিন আমাদের কপালে ঢিবি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হল, কারণ নিচু দরজায় সবাইকেই ঠোক্কর খেতে হয়েছিল। এখন আমরা একটা কাপড়ে, পশম জড়িয়ে ওপরের ঝনকাঠে এঁটে দিয়েছি। দেখা যাক ওতে কোনো উপকার হয় কিনা!
এখন আমি খুব বেশি গা ঘামাচ্ছি না; সেপ্টেম্বর অবধি নিজেকে ছুটি দিয়ে রেখেছি। এরপর বাবা আমাকে পড়ালেখা করাবেন। ইস্, এরই মধ্যে এত কিছু ভুলেছি যে বলার নয়। আমাদের এখানকার জীবন বলতে সেই থোড়বড়িখাড়া আর খাড়াবড়িথোড়। মিস্টার ফান ডান আর আমি যেভাবেই হোক সচরাচর পরস্পরকে নস্যাৎ করি। মারগটের বেলায় তা হয় না, ওকে উনি বিলক্ষণ ভালবাসেন। মা-মণি থেকে থেকে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন যেন আমি কচি খুকী–এটা আমার অসহ্য লাগে। না হলে, অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। পেটারকে এখনও আমার আদৌ ভালো লাগে না, ছেলেটা কী যে বিরক্তিকর কী বলব। অর্ধেক সময় বিছানায় পিপুফিশু হয়ে কাটায়, খানিকটা কাঠের কাজ করে, এবং তারপরই। ফিরে গিয়ে আরেক দফা ঘোত ঘোত করে ঘুমোয়। একেবারে গাড়োল।
আবহাওয়াটা এখন ভারি সুন্দর। সবকিছু সত্ত্বেও আমরা যতটা পারি উপভোগ করার চেষ্টা করি; চিলেকোঠায় চলে গিয়ে ক্যাম্প-খাটে লম্বা হই–খোলা জানলা দিয়ে ভেতরে এসে ঝলমল করে রোদ্দুর।
তোমার আনা
০২. মিস্টার আর মিসেস ফান ডান
বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২
আদরের কিটি,
মিস্টার আর মিসেস ফান ডানের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল। এই জিনিস বাপের জন্মে আমি কখনও দেখিনি। মা-মণি আর বাপি তো এভাবে চেঁচিয়ে পরস্পরকে মুখনাড়া দেওয়ার কথা কল্পনাই করতে পারবেন না। কারণটা ছিল এত তুচ্ছ যে, মোটা ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়াল শুধু কথার ফুলঝুরি। অবশ্য এও ঠিক, যার যেমন অভিরুচি।
পেটারকে যে ঘুর ঘুর করে বেড়াতে হয়, এটা স্বভাবতই তার ভালো লাগার কথা নয়। ও এমন ভয়ঙ্কর রকমের ছিচকাঁদুনে আর আসে যে, কেউ তাকে গুরুত্ব দেয় না। কালকেও দেখি ওর জিভ লাল হওয়ার বদলে নীল হয়ে রয়েছে–ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এই অসাধারণ প্রকৃতিক ঘটনাটি হুট করে দেখা দিয়ে হুট করে উবে গিয়েছিল। আজ ও গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে ঘুরছে, ওর ঘাড়ে নাকি ফিক-ব্যথা; এর ওপর কর্তাবাবা’রও নাকি কোমরে বাতের ব্যথা। তাছাড়া হৃৎপিণ্ড মূত্রাশয় এবং ফুসফুস–এসবের আশপাশেও ওর যখন-তখন ব্যথা হয়। ও হচ্ছে সত্যিকার রোগাতঙ্ক ব্যাধিগ্রস্ত (এইসব লোকদেরই তো হাইপোকনড্রিয়াক বলে, তাই না?)। মার সঙ্গে মিসেস ফান ডানের পুরোটাই যে একটা মধুর সম্পর্ক তা নয়; তিক্ততার কারণ আছে।
একটা ছোট দৃষ্টান্ত দিই, সকলের জন্যে কাপড়ের যে আলমারি–সেখান থেকে মিসেস ফান ডান তিনটি চাদরের সব কয়টিই হস্তগত করেছেন। উনি এটা ধরেই নিয়েছেন যে মা মণির চাদরে আমাদের সবারই কাজ চলে যাবে। ওর পিত্তি জ্বলে যাবে যখন উনি দেখবেন মা-মণি ওঁরই মহৎ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছেন।