অষ্টপ্রহর আমি যা সেইভাবে যারা আমাকে জানে, পাছে তাদের চোখে পড়ে যায় আমার অন্য দিক, যেটা সূক্ষ্মতর এবং অনেক ভালো। তাই আমি বেজায় ভয়ে ভয়ে থাকি। আমার ভয়, ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, মনে করবে আমি উপহাসযোগ্য আর ভাবপ্রবণ। আমাকে ওরা গুরুত্ব দিয়ে নেবে না। গুরুত্ব দিয়ে না নেওয়াতে আমি অভ্যন্ত; কিন্তু তাতে অভ্যন্ত এবং তা সইতে পারে তো শুধু ফুর্তিবাজ আনা; সিকিভাগ সময়ের জন্যে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াতে আমি যদি সত্যিকার বাধ্যও করি, তাহলেও মুখ থেকে কথা বের করতে গিয়ে সে একেবারে কুঁকড়ে যায় এবং শেষে পয়লা নম্বর আনাকে তার জায়গায় দাঁড়াতে দিয়ে, আমি বুঝবার আগেই, সে হাওয়া হয়ে যায়।
সুতরাং লোকজন থাকলে ভালো আনা কখনই সেখানে থাকে না, এ পর্যন্ত একটিবারও সে দেখা দেয়নি, কিন্তু আমরা একা থাকলে প্রায় সব সময়ই সে এসে জাকিয়ে বসে। আমি ঠিক জানি, আমি কি রকম হতে চাই, সেই সঙ্গে আমি কি রকম আছি… ভেতরে। কিন্তু হায়, আমি ঐ রকম শুধু আমারই জন্যে। হয়ত তাই, না, আমি নিশ্চিত যে, এটাই কারণ যে জন্যে আমি বলি আমার হাসিখুশি স্বভাবটা ভেতরে এবং যে জন্যে অন্য লোকে বলে আমার হাসিখুশি স্বভাবটা বাইরে। ভেতরের বিশুদ্ধ আনা আমাকে পথ দেখায়, কিন্তু বাইরে আমি দড়ি ছিঁড়ে নেচেদে বেড়ানো ছাগলছানা বৈ কিছু নই।
যেটা আমি আগেই বলেছি, কোনো বিষয়ে আমি আমার আসল অনুভুতির কথা কখনও মুখ ফুটে বলি না এবং সেই কারণে আমার নাম দেওয়া হয়েছে ছেলে-ধরা, ছেনাল, সবজান্তা, প্রেমের গল্পের পড়ুয়া। ফুর্তিবাজ আনা ওসব হেসে ওড়ায়, ধ্যাষ্টামো করে জবাব দেয়, নির্বিকারভাবে কাঁধ ঝাড় দেয়, কেয়ার না করার ভাব দেখায়, কিন্তু হায় গো হায়, মুখচোরা আনার প্রতিক্রিয়া এর ঠিক উল্টো। যদি সত্যি কথা বলতে হয়, তাহলে স্বীকার করব যে, এতে আমার প্রাণে আঘাত লাগে, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি নিজেকে বদলাতে, কিন্তু আমাকে সর্বক্ষণ লড়তে হচ্ছে ঢের জবরদস্ত এক শত্রুর বিরুদ্ধে।
আমার মধ্যে একটি ফোঁপানো কণ্ঠস্বর গুনি–’ও ঈশ্বর, শেষে তোমার এই হাল হয়েছে; কারো ওপর মায়াদয়া নেই, যা দেখ তাতেই নাক সিটকাও, আর তিরিক্ষে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর উপদেশে কান দিতে চাও না।‘ আমি কান দিতে চাই গো, চাই কিন্তু ওতে কিছু হয় না; যদি আমি চুপচাপ থেকে গুরুতর কোনো বিষয়ে মন দিই, প্রত্যেকে ধরে নেয় ওটা কোনো নতুন রঙ-তামাসা এবং তখন সেটাকে হাসির ব্যাপার করে তুলে তা থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়। আমার নিজের পরিবারের কথাই বা কী বলি–ওঁরা নির্ঘাৎ ভেবে বসবেন আমার ঘাড়ে মাথায় হাত ঠেকিয়ে দেখবেন, আমার গায়ে জ্বর আছে কিনা জিজ্ঞেস করবেন। শরীর খারাপ, মাথাধরা আর স্নায়বিক রোগের ওষুধের বড়ি গোলাবেন, জিজ্ঞেস করবেন আমার কোষ্ঠবদ্ধতা হয়েছে কিনা এবং তারপর আমার মেজাজ ভালো নেই বলে আমাকে চোখে চোখে রাখা হয়, আমি শুরু করি খেকি হতে, তারপর অসুখী এবং সবশেষে আমার অন্তঃকরণে মোচড় দিই, যাতে খারাপটা বাইরে পড়ে আর ভালোটা থাকে ভেতরে এবং সমানে চেষ্টা করতে থাকি রাস্তা খোজার, যাতে হওয়া যায় যা হতে চেয়েছি এবং যা হতে পারি, যদি… পৃথিবীতে আর কোনো জনপ্রাণী বেঁচে না থাকত!
-তোমার আনা।
.
পরিশেষে
আনার ডায়েরি এইখানে শেষ। ৪ঠা আগস্ট, ১৯৪৪–এইদিন সবুজ উর্দি-পরা পুলিস ‘গুপ্ত মহলে’ হানা দেয়। ওখানকার সব বাসিন্দাদের, ক্রালার আর কুপহুইস সমেত, গ্রেপ্তার করে এবং জার্মান আর ডাচ বন্দী নিবাসে পাঠিয়ে দেয়।
গেস্টাপো ‘গুপ্ত মহল’ লুট করে। মেঝের ওপর ফেলে দেওয়া পুরনো বই, ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজের ডাঁই থেকে মিপ আর এলি খুঁজে বের করেন আনার ডায়েরিটা। পাঠকের দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় সামান্য কিছু অংশ বাদে মূল লেখাঁটি এই বইতে ছাপানো হয়েছে।
আনার বাবা ছাড়া ‘গুপ্ত মহলে’র আর কোনো বাসিন্দাই ফিরে আসতে পারেননি। ক্রালার আর কুপহুইস ডাচ বন্দীনিবাসে দারুণ কষ্টভোগ করে স্বগৃহে নিজের নিজের পরিবারে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।
হল্যাণ্ডের মুক্তির দুই মাস আগে ১৯৪৫ এর মার্চ মাসে বেরজেন-বেলসেন বন্দীনিবাসে আনার মৃত্যু হয়।