যতদিন তা না হয়, আমি আমার আদর্শগুলোকে উঁচুতে তুলে ধরব, কেননা হয়ত এমন দিন আসবে যখন আমি সেই আদর্শগুলোকে কাজে খাটাতে পারব।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ২১ জুলাই, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
এখন আমার সত্যিই আশা জাগছে, এখন সব কিছুই সুভালাভালি চলছে। হ্যাঁ, সব ভালো চলছে। সবার বড় খবর। হিটলারকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল এবং এবার যে করেছিল সে এমন কি না ইহুদী কমিউনিস্ট, না ইংরেজ পুঁজিবাদী বরং যে করেছিল সে একজন জার্মান সেনাপতি, এবং তদুপরি একজন কাউন্ট, এবং বয়সেও যথেষ্ট তরুণ। ফুরার প্রাণে বেঁচেছে দৈবক্রমে, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে, দু-চারটে আঁচড় আর পোড়ার ওপর দিয়ে ফুরারের ফাড়া কেটে গেছে। সঙ্গে যে কয়জন অফিসার আর জেনারেল ছিল, তারা কেউ খুন, কেউ জখম হয়েছে। যে প্রধান অপরাধী, তাকে গুলি করে মারা হয়।
যাই হোক, এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, প্রচুর অফিসার আর জেনারেল যুদ্ধের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ এবং তারা হিটলারকে জাহান্নামে পাঠাতে পায়। হিটলাকে সরিয়ে দিয়ে, তাদের লক্ষ্য সে জায়গায় এমন একজন সামরিক একনায়ককে বসানো, যে মিত্রপক্ষের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করবে; এরপর তারা চাইবে পুনরাস্ট্রীকরণ করে বিশ বছরের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ ডেকে আনতে। দৈবশক্তি বোধহয় ইচ্ছে করেই হিটলারকে সরিয়ে ওদের পথ পরিসর করার ব্যাপারটা একটু দেরি করিয়ে দিয়েছেন, কেননা নিচ্ছিদ্র জার্মানরা তাহলে নিজেরা নিজেদের মেরে মিত্রপক্ষের কাজ অনেক সহজ এবং ঢের সুবিধাজনক করে দেবে। এতে রুশ আর ইংরেজদের কাজ কমে যাবে এবং ঢের তাড়াতাড়ি তারা নিজেদের শহরগুলো পুনঃনির্মাণের কাজে হাত দিতে পারবে।
কিন্তু তবু, আমরা অতদূর এখনও এসে পৌঁছাইনি, এবং সময় হওয়ার এত আগে সেই গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোর কথা আমি বিবেচনা করতে চাই না। তবু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, এ সমস্তই ঠাণ্ডা মাথার বাস্তব এবং আজ আমি রয়েছি, আটপৌরে গদ্যের মেজাজে; এই একটিবার উচ্চ আদর্শ নিয়ে আমি বকবক করছি না। আরও কথা হল, হিটলার এমন কি বারি কৃপা পরবশ হয়ে তার বিশ্বস্ত ভক্তজনদের জানিয়ে দিয়েছে যে, সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেকে অতঃপর গেস্টাপোকে মানতে বাধ্য থাকবে; এবং হিটলারকে হাজার নীচ, কাপুরুষোচিত প্রচেষ্টায় জড়িত ছিল জানলে যে কোনো সৈনিক তার সেই উপরওয়ালাকে যেখানে পারে সেখানেই, কোট-মার্শাল ছাড়াই গুলি করে মারতে পারবে।
এবার যা একখানা নিখুত খুনের খেল শুরু হবে। লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে সেপাই জনির পা ব্যথা করেছে, উপরওয়ালা অফিসার দাঁত খিচিয়েছে। আর যায় কোথায়–জনি অমনি তার রাইফেল বাগিয়ে ধরে হুঙ্কার দেবে—‘ফ্যুরারকে বড় যে মারতে গিয়েছিলি, এই নে ইনাম।’ গুড়ুম! ব্যস, সেপাই জনিকে ধমকানোর স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে নাক-তোলা ওপরওয়ালা চলে গেল চিরন্তন জীবনে (নাকি সেটা চিরন্তন মৃত্যু?)। শেষকালে, কোনো অফিসার যখনই কোনো সেপাইয়ের মুখোমুখি হবে, কিংবা তাকে সবার আগে পিঠে রেখে দাঁড়াতে হবে, দুর্ভাবনায় সে তার প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। কেননা সেপাইরা যা বলতে সাহস পায় না সে সবই তারা বলবে। আমি যা বলতে চাইছি, তার খানিকটা কি তুমি ধরে নিতে পারছ? নাকি আমি প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে লাফ দিয়ে দিয়ে যাচ্ছি? লাফ না দিয়ে উপায় নেই; আসছে অক্টোবর ইস্কুলের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে পারি, এই সম্ভাবনায় মন খুশিতে এত ভরে উঠেছে যে, যুক্তিতর্ক সব চুলোয় গেছে। এই মরেছে দেখ, এক্ষুনি তোমাকে আমি বলেছিলাম না যে, আমি খুব বেশি আশাবাদী হতে চাই না? আমার ঘাট হয়েছে, সাধে কি ওরা আমার নাম দিয়েছে ‘টুকটুকে বিরোধের পুটুলি’।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
‘টুকটুকে বিরোধের পুঁটুলি’–এই বলে ইতি করেছিলাম আমার শেষ চিঠি এবং সেই একই কথা দিয়ে শুরু করছি এটা। ‘টুকটুকে বিরোধের পুটুলি’! আচ্ছা বলতে পারো এটা ঠিক কী? বিরোধ বলতে কী বোঝায়। অন্য অনেক কথার মতো এতে দুটো জিনিস বোঝাতে পারে বাইরে থেকে বিরোধ আর ভেতর থেকে বিরোধ।
প্রথমটা হল মামুলি সহজে হার না মানা, সব সময় সেরা বিশেষজ্ঞ বলা, মোক্ষম কথাটা বলে দেওয়া’, সংক্ষেপে, যে সব অপ্রিয় বপণের জন্যে আমি সুবিদিত। দ্বিতীয়টা কী কেউ জানে না, ওটা আমার নিজের গোপন কথা।
এর আগেই তোমাকে আমি বলেছি যে, আমার রয়েছে যেন এক দ্বৈত ব্যক্তিত্ব। তার একার্থ ধারণ করে আছে। আমার আল্লাদে আটখানা ভাবি, সবকিছু নিয়ে মজা করা, আমার তেজস্বিতা এবং সবচেয়ে বড় কথা, যেভাবে সমস্ত কিছু আমি হালকাভাবে নিই। প্রেমের ভান দেখে নারাজ না হওয়া, চুমো, জড়িয়ে ধরা, অশ্লীল রসিকতা–সব এর মধ্যে পড়ে। এই দিকটা সাধারণত ওৎ পেতে থাকে এবং অন্য যে দিকটা ঢের ভালো, ঢের গভীর, ঢের বেশি খাঁটি–সেই দিকটাকে দুম করে ঠেলে সরিয়ে দেয়। তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে, তুলনায় আনার সেটা ভালো দিক সেটার কথা কেউ জানে না এবং সেইজন্য অধিকাংশ লোকের কাছে আমি অসহ্য।
এক বিকেলে আমি হই অবশ্যই এক মাথাঘোরানো ভাড়; ব্যস, আর একটা মাস ওতেই ওদের চলে যাবে। গভীর চিন্তাশীল লোকদের পক্ষে যেমন প্রেমমূলক ফিল্ম–নিছক চিত্তবিনোদন, মজাদার শুধু একবারের মতো। এমন জিনিস যা অল্পক্ষণ পরেই ভুলে যাওয়া যায়, মন্দ নয়, তবে নিশ্চয়ই ভালো বলা যায় না। সত্যি বলতে, এও ঠিক তাই। তোমাকে এসব বলতে খুবই খারাপ লাগছে; কিন্তু যাই হোক এ জিনিস যখন সত্যি বলে জানি, তখন বলব নাই বা কেন? আমার যে দিকটা হালকা ওপর, সেটা আমার গভীরতর দিকের তুলায় সব সময়ই বড় বেশি প্রাণবন্ত মনে হবে এবং তাই সব সময়ই কিস্তি মাত করবে। তুমি ধারণা করতে পারবে না ইতিমধ্যেই আমি যে কত চেষ্টা করেছি। এই আনাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে, তাকে পঙ্গু করে দিতে, কেননা, সব সত্ত্বেও, যাকে আনা বলা হয়, সে হল তার অর্ধেক মাত্র; কিন্তু তাতে কাজ হয় না এবং আমি এও জানি, কেন তাতে কাজ হয় না।