এই বিষয়টা নিয়ে আমি বিলক্ষণ ভেবে থাকি–পিমের ওপর কেন আমি চটি? এতই চটি যে, আমাকে ওঁর জ্ঞান দিতে আসাটা আমি সহ্যই করতে পারি না, ওঁর সস্নেহ ভাব ভঙ্গিগুলো আমার কাছে ভান বলে মনে হয়, আমি চাই একা শান্তিতে থাকতে এবং ওঁর হাত থেকে একটু রেহাই পেলেই বরং খুশী হই, যতক্ষণ ওঁর প্রতি আমার মনোভাব ঠিক কী সেটা নিশ্চিতভাবে না বুঝতে পারছি। কারণ, উত্তেজিত হয়ে যে যাচ্ছেতাই চিঠিটা দম্ভ করে ওঁকে আমি লিখেছিলাম, তার কুরে কুরে খাওয়া অপরাধবোধ এখনও আমার মধ্যে রয়ে গেছে। সবদিক দিয়ে প্রকৃত বলিষ্ঠ আর সাহসী হওয়া, ইস, কত যে শক্ত।
তবু এটাই আমার সবচেয়ে বড় আশাভঙ্গ নয়। না, বাপির চেয়ে আমি ঢের বেশি ভাবি পেটারের কথা। আমি ভালো করেই জানি, আমি ওকে হার মানিয়েছিলাম, ও আমাকে নয়। ওর সম্পর্কে আমি মনের মধ্যে একটা ভাবমূর্তি খাড়া করেছিলাম। শান্ত সংবেদনশীল মিষ্টিমতো একটি ছেলের–যার দরকার স্নেহ-ভালবাসা আর বন্ধুত্ব। আমার প্রয়োজন ছিল জীবন্ত কোনো মানুষের–যাকে আমি প্রাণের সব কথা খুলে বলতে পারি; আমি চেয়েছিলাম এমন একজন বন্ধু, যে আমাকে এনে দেবে ঠিক রাস্তায়। আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি এবং আস্তে আস্তে কিন্তু নিশ্চিতভাবে তাকে আমি নিজের কাছে টানলাম। শেষ পর্যন্ত, যখন তাকে আমি বন্ধুভাব বোধ করাতে পারলাম, তখন আপনা থেকে তা এমন এক মাখামাখিতে গিয়ে গড়াল যে, পুনর্বিবেচনায় বুঝলাম, সেটা অতটা হতে দেওয়া আমার উচিত হয়নি।
আমরা কথা বলেছি যারপরনাই ব্যক্তি বিষয়ে, কিন্তু আজ অবধি আমাদের কথাবার্তায় আমরা সেইসব বিষয়ের ধারকাছ দিয়েও যাইনি যে বিষয়গুলো সেদিন এবং আজও আমার হৃদয়মন ভরে রেখেছে। আমি এখনও পেটারের ব্যাপারটা ভালো জানি না ওর কি সবই ওপরসা? নাকি ও এখনও লজ্জা পায়, এমন কি আমাকেও? কিন্তু সে কথা থাক, সত্যিকার বন্ধুত্ব পাতানোর অধীর আগ্রহে আমি ভুল করে বসেছিলাম। দুম করে সরে গিয়ে ওকে ধরার চেষ্টায় আমি গড়ে তুললাম আরও মাখামাখির সম্পর্ক। সেটা না করে আমার উচিত ছিল অন্যান্য সম্ভাবনাগুলো বাজিয়ে দেখা। পেটার হেদিয়ে মরছে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে এবং আমি দেখতে পাচ্ছি ও ক্রমবর্ধমানভাবে আমার প্রেমে পড়তে শুরু করেছে। আমাদের দেখাসাক্ষাতে ও তৃপ্তি পায়; অথচ আমার ওপর এসবের একমাত্র ক্রিয়া হয় এই যে, আমার মধ্যে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার বাসনা জাগে। এ সত্ত্বেও যেসব জিনিস দিনের আলোয় তুলে ধরার জন্যে আমি আকুলিবিকুলি করছি, কেমন যেন মনে হয় আমি সে বিষয়গুলো টুতেই পারি না। পেটার যতটা বোঝে, তার চেয়েও ঢের বেশি আমি ওকে আমার কাছে টেনে এনেছি। এখন ও আমাকে আঁকড়ে ধরেছে; আপাতত ওকে ঝেড়ে ফেলার এবং ওকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর আমি কোনো রাস্তা দেখছি না। যখন আমি বুঝলাম ও আমার বোধশক্তির উপযোগী বন্ধু হতে পারবে না, তখন ঠিক করলাম আমি অন্তত চেষ্টা করব ওর মনের এঁদো গলি থেকে ওকে তুলে আনতে এবং এমন ব্যবস্থা নিতে যাতে ওর যৌবনটা দিয়ে ও কিছু করতে পারে।
কারণ, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে যৌবন বার্ধক্যের চেয়েও নিঃসঙ্গ। এটা আমি কোনো বইতে পড়েছিলাম এবং বরাবর স্মরণে আছে; দেখেছি কথাটা ঠিক। তাহলে কি এটা ঠিক যে, আমাদের চেয়েও আমাদের গুরুজনদের এখানে থাকা ঢের বেশি কষ্টকর? না। আমি জানি, এটা ঠিক না। বয়সে যারা বড়, সব কিছু সম্পর্কে তাদের মতামত তৈরি হয়ে গেছে। কোনো কিছু করতে গিয়ে তাদের দ্বিধার মধ্যে পড়তে হয় না। আজ যখন সমস্ত আদর্শ ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, যখন লোকে তাদের সবচেয়ে ওঁছা দিকটা চোখের সামনে তুলে ধরছে এবং সত্য, ন্যায় আর ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে কিনা তাও জানে না–তখন নিজের কোট বজায় রেখে নিজের মতামত ঠিক রাখা, আমাদের ছোটদের পক্ষে, তো আরও দ্বিগুণ শক্ত।
কেউ যদি, সে যেই হোক, দাবি করে যে এখানে গুরুজনদের থাকতে বেশি কষ্ট হয়, তাহলে বলব সে মোটেই বোঝে না কী পরিমাণ ভারী ভারী সমস্যা আমাদের ঘাড়ের ওপর; এসব সমস্যা সামলাবার পক্ষে আমরা হয়ত খুবই ছোট, কিন্তু তাহলেও ক্রমাগত তার চাপ। তো আমাদের ওপর পড়ছে; হতে হতে একটা সময় আসে, আমরা তখন ভাবি, যা একটা। সমাধান পাওয়া গেছে–কিন্তু সে সমাধান তো প্রকৃত ঘটনাগুলোকে ঠেকাতে পারে না, ফলে। আবার সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এমন দিনে এই হল মুশকিল–আমাদের ভেতর আদর্শ, স্বপ্ন আর সাধ আহ্লাদ মাথা তোলে, তারপরই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখে পড়ে সেসব খান খান হয়ে। যায়। এটা খুব আশ্চর্য যে, আমি আমার সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিইনি; কেননা সেগুলো অযৌক্তিক এবং কাজে খাটানো অসম্ভব, এ সত্ত্বেও আমি সেগুলো রেখে দিয়েছি, কারণ, মানুষের ভেতরটা যে সত্যিই ভালো, সবকিছু সত্ত্বেও আমি আজও তা বিশ্বাস করি। আমি এমন ভিত্তিতে আমার আশাভরসাকে দাঁড় করাতে পারি না যা বিশৃখল, দুঃখদৈন্য আর মৃত্যু দিয়ে তৈরি। আমি দেখতে পাচ্ছি পৃথিবী ক্রমশ জঙ্গল হয়ে উঠছে, আমি কেবলি শুনতে পাচ্ছি আসন্ন বজ্রনির্ঘোষ, যা আমাদেরও ধ্বংস করবে, আমি অনুভব করতে পারি লক্ষ লক্ষ মানুষের যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা এবং এ সত্ত্বেও, আমি দিবালোকের দিকে মুখ তুলে তাকাই, আমি ভাবি সব ঠিক হয়ে যাবে, এ নিষ্ঠুরতারও অবসান হবে এবং আবার ফিরে আসবে শান্তি আর সুস্থিরতা।