শেষ অব্দি আমরা প্রতিঃরাশ করলাম বারোটায়।
সাড়ে বারোটা থেকে সোয়া একটা আবার মটরশুঁটি ছাড়ানো। যখন হাত দুটো থামে, মাথাটা টলমল করে অন্যদেরও খানিকটা তাই। উঠে পড়ে চারটে অবধি ঘুম লাগাই। কিন্তু তাও ঐ অখাদ্য মটরটিগুলো এখনও আমাকে বড়ই বিপর্যস্ত করে রেখেছে।
তোমার আনা।
.
শনিবার, ১৫ জুলাই, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
লাইব্রেরি থেকে আমরা একটা বই পেয়েছিলাম, বইয়ের নামটাতে একটা যুদ্ধংদেহি ভাব; কমবয়সী আধুনিক তরুণীদের সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?’ আজ এই বিষয়টা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই।
বইটির লেখিকা ‘আজকের তরুণ সমাজ’-কে আগাপাছতলা ধুনেছেন–অবশ্য তাই বলে একথা বলেননি যে, তরুণদের সবাই ‘ভালো কিছু করতে অপারগ।’ বরং বলেছেন এর ঠিক উল্টো।
তার মতে, তরুণ-তরুণীরা যদি ইচ্ছে করে তাহলে তারা এর চেয়ে বড়, এর চেয়ে সুন্দর এবং এর চেয়ে ভালো দুনিয়া গড়তে পারে–সে ক্ষমতা তাদের মুঠোর মধ্যেই আছে; কিন্তু তারা সত্যিকার সৌন্দর্যের বিষয়ে না ভেবে ওপরকার জিনিসগুলো নিয়েই ব্যস্ত।
রচনার কোনো কোনো অংশে মনে হয়েছে লেখিকার সমালোচনার লক্ষ্য যেন আমি; তাই আমি তোমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে একবার খুলে ধরতে চাই এবং এই আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাই।
যে আমাকে কিছুকালও দেখেছে, তারই চোখে না পড়ে পারে না–আমার চরিত্রের এক অসামান্য গুণ হল আমার আত্মজ্ঞান। ঠিক একজন বাইরের লোকের মতোই আমি নিজেকে আর আমার ক্রিয়াকলাপগুলোকে নিরীক্ষণ করতে পারি।
কোনোরকম পক্ষপাত ছাড়াই, তার হয়ে কোনোরকম সাফাই না গেয়েও, প্রতিদিনের আনার মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারি; এবং তার মধ্যে কী ভালো আর কী মন্দ তা লক্ষ্য করতে পারি।
এই ‘আত্মচেতনা’ সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং যখনই আমি মুখ খুলি, কথা বলমাত্র আমি জানি ওটা না বলে অন্য কিছু বলা উচিত ছিল’ কিংবা ‘ওটা ঠিকই বলা হয়েছে। আমার মধ্যে এত কিছু আছে যা আমার চোখে খারাপ ঠেকে; সে সব বলে ফুরোবে না। আমি যত বড় হচ্ছি তত বুঝছি বাপির সেই কথাগুলো কত ঠিক–সব শিশুকেই তার মানুষ হওয়ার দিকে নজর দিতে হবে।’
বাপ-মা-রা শুধু সদুপদেশ দিতে পারেন অথবা তাদের সঠিক পথে এনে দিতে পারেন কিন্তু কারো চরিত্র চূড়ান্তভাবে কী রূপ নেবে সেটা নির্ভর করে তাদের নিজেদের ওপর।
এর ওপর আমার আর যা আছে তা হল মনের জোর; সবসময় নিজেকে আমার খুব শক্তসমর্থ বলে মনে হয় এবং মনে হয় আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। নিজেকে ঝাড়া হাত-পা আর নবীন বলে মনে হয়।
প্রথম সেটা জানতে পেরে আমি কী খুশি হয়েছিলাম; কেননা যখন প্রত্যেকের ওপর অনিবার্যভাবে ঘা এসে পড়বে, আমার মনে হয় না, আমি সহজে সে আঘাতে ভেঙে পড়ব।
কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আগেও আমি অনেকবার বলেছি। এবার আমি ‘বাপি আর মা-মণি আমাকে বোঝে না’ অধ্যায়টিতে আসব।
বাপি আর মা-মণি বরাবর পুরোপুরিভাবেই আমার মাথাটি খেয়েছেন; ওঁরা সবসময় আমার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করেছেন, আমার পক্ষ নিয়েছেন, এবং মা-বাবার পক্ষে সম্ভবপর। সবকিছুই আমার জন্য করেছেন।
তবু আমি দীর্ঘ সময় ধরে কী ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ বোধ করেছি এবং নিজেকে পরিত্যক্ত, উপেক্ষিত আর লোকে আমাকে ভুল বুঝেছে বলে মনে হয়েছে। বাপি সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন আমার বিদ্রোহী ভাব ঠেকাতে, কিন্তু ফল হয়নি; আমার নিজের আচরণে কী ভুল তা দেখে এবং সেটা নিজের চোখের সামনে তুলে ধরে আমি নিজেকে সারিয়ে তুলেছি।
এই বা কেমন যে, আমার লড়াইতে আমি বাপির কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাইনি? তখন তিনি আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছেন, কেন তিনি তখনও সম্পূর্ণভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন?
বাপি এগিয়েছিলেন ভুল পথ ধরে, উনি সবসময় আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হবে আমি যেন এমন এক শিশু যে কষ্টকর অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা অদ্ভুত ঠেকবে, কারণ বাপিই হলেন একমাত্র লোক যিনি আমাকে বিশ্বাস করে সবকিছু বলতেন; এবং আমি যে সুবোধ মেয়ে, একটা বাপি ছাড়া আর কেউই আমাকে মনে মনে বুঝতে দেয়নি। কিন্তু একটা জিনিস বাদ পড়েছিল; তিনি এটা উপলব্ধি করতে পারেননি যে, আমার পক্ষে অন্য সবকিছুর চেয়ে ঢের বেশি জরুরী হল চরম উৎকর্ষে পৌঁছুবার লড়াই। তোমার বয়সে এটা হয়; বা অন্য মেয়েরাবা ‘এটা আপনা থেকে আস্তে আস্তে কেটে যাবে’–এ ধরনের কথা আমি শুনতে চাইতাম না; আমি চাইনি আমার সঙ্গে ব্যবহার করা হোক আর পাঁচটা মেয়ের মতো ব্যবহারটা হওয়া উচিত আনা যা তার সেই নিজের গুণে। পিম সেটা বোঝেননি। সেদিক থেকে কাউকেই আমি মনের কথা বলতে পারি না, যদি না তারা নিজেদের সম্বন্ধে বিস্তর কথা আমাকে বলে। যেহেতু পিম সম্পর্কে আমি খুব সামান্যই। জানি। আমি মনে করি না তাকে সঙ্গে নিয়ে আমি খুব ঘনিষ্ঠ জায়গায় পা ফেলতে পারি। পিম সবসময় বয়োবৃদ্ধের, পিতৃসুলভ মনোভাব নেন; বলেন এক সময়ে তারও এই ধরনের ঝোক হয়েছিল। তবে ওসব বেশিদিন থাকে না। হাজার চেষ্টা করেও আমার সঙ্গে আজও বাপির মনের তার ঠিক বন্ধুর মতো এক সুরে বাজে না।
এই সবের দরুন, জীবন সম্বন্ধে আমার মতামত অথবা আমার সুচিন্তিত তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর কথা আমি আমার ডায়েরির পাতায় এবং মাঝে মাঝে মারগটকে ছাড়া কখনও কারো কাছে গুণাক্ষরেও বলি না। যেসব জিনিস আমাকে বিচলিত করছিল, তার পুরোটাই আমি বাপির কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম; আমি কখনই বাপিকে আমার আদর্শের অংশীদার করিনি। এটা আমি মনে মনে বুঝছিলাম যে, আমি তাকে আস্তে আস্তে আমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। অন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি সবকিছুই পুরোপুরি আমার অনুভূতি অনুযায়ী করেছি, কিন্তু করেছি এমনভাবে যা আমার মনের শান্তি রক্ষার সবচেয়ে অনুকূল। কারণ, এ অবস্থায়, আমি যদি আমার অর্ধসমাপ্ত কাজের সমালোচনা মেনে নিই, তাহলে নড়বড় করতে করতে যে স্থিরতা আর আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছি–আমাকে তা সম্পূর্ণভাবে খোয়াতে হয়। পিমের কাছ থেকে এলেও আমি তা মানতে পারি না, যদিও কথাটা কঠিন শোনাবে, কেননা পিমকে আমি আমার গূঢ় ভাবনার অংশীদার তো করিইনি, উপরন্তু আমার রগচটা মেজাজের সাহায্যে অনেক সময় নিজেকে তার কাছ থেকে আরও বেশি দুরে ঠেলে দিয়েছি।