সকাল সাড়ে বারোটায় বাড়িতে বাইরের লোক বলতে যখন কেউ নেই, দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দেওয়া হল; ডলাগুলো আনতে বলা হল; পেটার, বাপি, ফান ডান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বকবক করছেন–আনা, যাও গরম পানি আনো; মারগট একটা বালতি নিয়ে এসো; কে কোথায় আছ, দাঁড়িয়ে যাও।
পেটের মধ্যে কুঁই কুঁই করছে, রসুইঘরে গিয়ে দেখি ঠাসা লোক মিপ, এলি, কুপহুইস, হেংক, বাপি, পেটার। অজ্ঞাতবাসে থাকা পরিবারগুলো আর তাদের যোগানদার বাহিনী, সব একাকার এবং ভরদুপুরে এই ব্যাপার।
নেটের পর্দা থাকায় বাইরে থেকে কেউ ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে পায় না, কিন্তু তাহলেও, এই চেঁচামেচি আর দরজা ধাক্কাধাক্কি আমাকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিল। আমরা যে লুকিয়ে আছি, এসব দেখেশুনে কি তা বলা যায়? এটা চকিতে আমার মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল। এ থেকে আমার এই অদ্ভুত অনুভূতি জাগল যে, পৃথিবীতে আবার আমি দেখা দিতে পারব।
প্যান ভর্তি হল আর আমি আবার ছুটে ওপরতলায় গেলাম। পরিবারের আর সবাই রান্নাঘরে আমাদের টেবিলে গোল হয়ে বসে বোঁটাগুলো ছাড়াতে ব্যস্ত–অন্তত সেই কাজই তাদের করার কথা; কিন্তু যত না তারা বালতিতে ফেলছিল, তার চেয়ে বেশি ফেলছিল নিজেদের মুখে। এখুনি আরেকটি বালতি লাগবে।
পেটার ফের চলে গেল নিচতলার রসুইঘরে দুই বার বেল বাজল। সঙ্গে সঙ্গে যেখানকার বালতি সেখানে রেখে পেটার ভোঁ-দৌড়। এক লাফে ওপরে এসে পেটার আলমারি জোড়া দরজায় খিল এটে দিল।
আমরা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি। আধা পরিষ্কার স্ট্রবেরিগুলো যে ধোবো, কিন্তু পানির কল যে খুলতে পারছি না। বাড়িতে কেউ এলে পানি ব্যবহার বন্ধ, কেননা, তাতে আওয়াজ হবে’–এই নিয়ম কড়াভাবে মানা হয়।
একটার সময় হেংক এসে বললেন ডাকপিওন এসেছিল। পেটার আবার একদৌড়ে নিচে। টুং টাং… বেল বাজতেই পেটার পিঠটান দিল।
আমি গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কেউ আসছে কিনা–প্রথমে আলমারিজোড়া দরজায়, তারপর সিঁড়ির মাথায় গুড়ি মেরে উঠে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমি আর পেটার একজোড়া চোরের মত রেলিঙের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে নিচের তলার হৈচৈ শোনার চেষ্টা করলাম।
সকলেরই চেনা গলা, পেটার চুটি চুপি নেমে পড়ে, আধাআধি গিয়ে থেমে পড়ে ডাকল–’এলি!’ কোনো উত্তর নেই, পেটার আবার ডাকল–’এলি!’ রসুইঘরের হৈচৈতে পেটারের কণ্ঠস্বর ডুবে গেল।
পেটার হনহনিয়ে নিচে নেমে সটান রসুইঘরে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। এক্ষুনি ওপরে চলে যাও, পেটার! অ্যাকাউন্টেন্ট এসেছে, পালাও!’ কুপহুইসের গলা।
পেটার হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে এল, আলমারি জোড়া দরজা সপাটে বন্ধ হল। শেষমেষ ক্রালার এসে গেলেন দেড়টায়। ওঃ, প্রাণ গেল, যেদিকে তাকাই শুধু স্ট্রবেরি আর স্ট্রবেরি, সকালের খাবারে স্ট্রবেরি, মিপের করা স্ট্রবেরির দমপূক্ত, আমার গা দিয়ে বেরোচ্ছে স্ট্রবেরির গন্ধ, এ থেকে জিরেন চাই, যাচ্ছি ওপরেকি সব ধোয়াধুয়ি হচ্ছে, এখানে… মরেছে, এখানেও স্ট্রবেরি।
বাকিগুলো বোতলে ভরা হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলায়–দুটো বয়াম খোলা হল। বাপি চটপট তা দিয়ে জ্যাম বানিয়ে ফেললেন। পরদিন সকালে আর দুটো খোলা হল এবং বিকেলে চারটি। ফান ডান ওগুলোতে নির্বীজাণুকরণের উপযোগী তাপ দিতে পারেননি। আজকাল বাপি রোজ সন্ধ্যেবেলায় জ্যাম তৈরি করছেন।
এখন আমরা ডালিয়ার সঙ্গে স্ট্রবেরি খাই, সর-তোলা দুধ খাই স্ট্রবেরি দিয়ে, স্ট্রবেরি মাখিয়ে রুটিমাখন খাই, শেষ পাতে খাই স্ট্রবেরি, চিনিপাতা স্ট্রবেরি, বালি কিচকিচ স্ট্রবেরি। দুদিন ধরে স্ট্রবেরি, শুধুই স্ট্রবেরি; তারপর স্ট্রবেরির যোগান বন্ধ বা বোতলবন্দী হল এবং আলমারিতে তালা পড়ল।
মারগট চেঁচিয়ে বলে, শোন্ আনা, মোড়ের তরিতরকারির দোকানদার আমাদের কিছু মটরশুঁটি দিয়েছে, উনিশ পাউণ্ডের মতো। আমি জবাব দিই, লোকটা খুব ভালো বলতে হবে। ভালো নিশ্চয়ই, কিন্তু দম নিলে যাবে… বাপরে!
টেবিলে সবাই এসে বসলে মা-মনি ডেকে বললেন, শনিবার সকালে মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানোর কাজে তোমাদের সবাইকে হাত লাগাতে হবে।’
যে কথা সেই কাজ। আজ সকালে কানায় কানায় ভর্তি বিরাট এক এনামেলের প্যান যথানিয়মে এসে গেল।
মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানো বিরক্তিকর কাজ, কিন্তু একবার দানাগুলোর খোসা ছাড়িয়ে দেখো। খোসাটা ছাড়িয়ে ফেললে দেখবে দানার ভেতরের শাঁসটা কী নরম আর সুস্বাদু আমার মনে হয় অনেকেই সেটা জানে না। তার চেয়েও বড় সুবিধে হল, শুধু মটরদানা হলে একজন যতটা খাবে, এতে তার তিনগুণ সে খেতে পারবে।
মটরদানার খোসা ছাড়ানোর কাজটা খুব ধীরে ধীরে সাবধানে করতে হয়। দিগগজ দাঁতের ডাক্তার বা মাছিমারা কেরানীর পক্ষে হয়ত ঠিক আছে, কিন্তু আমার মতো ছটফটে নাবালিকার পক্ষে এ কাজ ভয়ঙ্কর।
আমরা বসেছি সাড়ে নটায়, আমি উঠেছি সাড়ে দশটায়, তারপর আবার এসে বসেছি সাড়ে এগারোটায়।
এই ধুয়োটা এখনও আমার কানে গুনগুন করে বাজছে–আগা নোয়াও, খোসা ধরে টানো, শিরা বাছো, উঁটি ছাড়িয়ে ফেল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমার চোখের সামনে সব নাচছে, সবুজ, সবুজ, সবুজ। কৃমিকীট, শির, পচা শুটি, সবুজ, সবুজ, সবুজ।
কিছু একটা তো করতে হবে, তাই সারা সকাল বকর বকর করি, আগডুম বাগডুম যা মনে আসে বলে যাই, প্রত্যেককে হাসাই আর কান ঝালাপালা করে দিই। প্রত্যেকটা শির ধরে টানতে টানতে এ বিষয়ে মন বেঁধে নিই যে, জীবনে কক্ষনো আমি নিছক গৃহকর্মী হতে চাই না।