আমার ওপর কারো প্রভাব পড়তে না দেওয়া, আমি ভাবি, এটা সত্যিই আমার একটা সপগুণ কিনা। প্রায় পুরোপুরি নিজের বিবেককে অনুসরণ করা, এটা কি সত্যিই ভালো?
খোলাখুলিই বলছি, আমি ভেবে পাই না কেউ কী করে বলে, আমি দুর্বল’ এবং তারপর তেমনিই থেকে যায়।
যখন তুমি জানছই, কেন তার বিরুদ্ধে লড়ো না, কেন তোমার চরিত্রকে গড়েপিটে নেবার চেষ্টা করো না? উত্তর পেয়েছিলাম না করাটা অনেক সহজ বলে। এটা শুনে আমি দমে গিয়েছিলাম।
সহজ? তার মানে, আলসেমি আর ফাঁকি দেওয়ার জীবনটা একটা সহজ জীবন? না,–এটা সত্যি হতে পারে না, সত্যি হওয়া উচিত নয়, মানুষ তাহলে সহজেই প্রলুব্ধ হবে। ঢিলেমিতে… আর টাকায়।
আমি অনেকক্ষণ বসে ভাবলাম পেটারকে আমি কী উত্তর দেব, কিভাবে ওর নিজের ওপর আস্থা আনা যায় এবং, সবচেয়ে বড় কথা নিজের চেষ্টায় কি ভাবে ও নিজেকে শোধরাতে পারে। আমি জানি না আমার এই চিন্তাধারা ঠিক না ভুল।
আগে কত ভেবেছি, একজনের পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করাটা কী সুন্দর একটা ব্যাপার; এখন সেইখানে পেীছে বুঝতে পারছি, অন্যের ভাবনা ভাবতে পারা এবং তার ঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করা কত শক্ত কাজ।
আরও এই কারণে যে, ‘সহজ’ আর টাকা’ এই বিশেষ ধারণাগুলোই আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা আর নতুন। পেটার আমার ওপর খানিকটা ঠেকা দিতে শুরু করেছে এবং এটা কোনো অবস্থাতেই হতে দেওয়া চলবে না।
পেটার জাতীয় ছেলেদের কাছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা শক্ত ঠেকে, কিন্তু তার চেয়েও শক্ত তোমার পক্ষে সচেতন, জ্যান্ত জীবন হয়ে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। কেননা তা যদি তুমি করো, তাহলে আকণ্ঠ সমস্যার মধ্যে সঠিক পথ কেটে এগোনো এবং তৎসত্ত্বেও সবকিছুর মধ্যে ধ্রুবলক্ষ্যে অবিচল থাকা–এ কাজ দ্বিগুণ কঠিন হবে।
আমি কেবল এটা সেটা করছি, দিনের পর দিন সন্ধান করছি, সেই সাংঘাতিক সহজ শব্দটার বিরুদ্ধে এমন একটা মোক্ষম যুক্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি, যাতে বরাবরের মতো ওটা মিটিয়ে ফেলা যায়।
কেমন করে ওকে আমি বোঝাই, যে জিনিস সহজ আর চিত্তাকর্ষক দেখায় ওকে তো এমন রসাতলে টেনে নিয়ে যাবে যেখানে না পাওয়া যাবে প্রাণের সান্ত্বনা, না বন্ধু, না সৌন্দর্য যেখান থেকে নিজেকে তোলা প্রায় অসম্ভব?
আমরা সবাই বেঁচে থাকি, কিন্তু জানি না কিসের জন্যে কি হেতু। আমরা সবাই বাঁচি সুখী হওয়ার জন্যে; আমাদের জীবন যেমন পৃথক পৃথক, তেমনই কুল্লে এক।
আমরা তিনজনে মানুষ হয়েছি ভালো সংসর্গে, আমাদের শিক্ষার সুযোগ আছে, কিছু একটা হতে পারার সম্ভাবনা আছে, আমরা প্রত্যেকেই সঙ্গতভাবে আশা করতে পারি সুখের জীবন, কিন্তু… এটা আমাদেরই অর্জন করতে হবে।
সেটা কখনই সহজ নয়। সুখ যদি অর্জন করতে চাও তো তোমাকে খাটতে হবে এবং ভালো করতে হবে; বসে থেকে বা কপাল ঠুকে তা হওয়ার নয়। কুড়েমি জিনিসটা মন ভোলাতে পারে কিন্তু কাজ করে পাওয়া যায় তৃপ্তি।
যেসব লোক কাজ পছন্দ করে না তাদের আমি বুঝতে পারি না, কিন্তু পেটারের ব্যাপারটা আলাদা; পৌঁছুনোর মতো ওর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সেই সঙ্গে ও মনে করে কিছু করে ওঠার মতো ওর বুদ্ধিও নেই, মোগ্যতাও নেই।
বেচারা!
ও কখনও জানলই না অন্যদের মুখে হাসি ফোঁটালে কি রকমের অনুভূতি হয় এবং সেটা আমি ওকে শেখাতেও পারব না। ওর কোনো ধর্মবিশ্বাস নেই, যীশু খ্রিষ্টকে হেসে উড়িয়ে দেয়, আর ঈশ্বরের নামে দিব্যি গালে। আমিও যে খুব নিষ্ঠাবান, তা নই; কিন্তু যখনই পেটারকে দেখি সে সকলের বার, সব সময় নাক সিটকে আছে এবং সত্যিই রিক্ত তখন। আমি মনে আঘাত পাই।
যেসব লোকের কোনো একটা ধর্ম আছে, তাদের খুশি হওয়া উচিত; কারণ স্বর্গীয় বস্তুতে বিশ্বাসী হওয়ার সুকৃতি সকলের থাকে না।
মৃত্যুর পর দণ্ডভয়ও তোমার না থাকলে চলে; অনেকে আছে যারা শুদ্ধিলোক, নরক আর স্বর্গ, এসব মানতে পারে না, কিন্তু একটি ধর্ম, তা সে যে ধর্মই হোক, মানুষকে সঠিক পথে রাখে। উপরওয়ালার ভয় নয়, সেটা আসলে নিজের ইজ্জত আর নৈতিক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।
যদি রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে লোকে একবার মনে করে দেখে সারাদিন সে কী করেছে এবং ভেবে দেখে তার মধ্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ–তাহলে প্রত্যেকেই কত মহানুভব আর কত ভালো হতে পারে। এবং নিজের অজান্তে, তখন দেখবে রোজ রাত পোহালেই তুমি আত্মোন্নতির জন্যে চেষ্টা করছ, দেখবে কালক্রমে অনেক কিছু আলবাৎ তোমার মুঠোয় এসে গেছে। যে কেউ তা করতে পারে, এর জন্যে পয়সা লাগে না এবং নিশ্চিতভাবেই এতে কাজ সহজ হবে। যারা জানে না অভিজ্ঞতা থেকে তাদের একথা শিখতে হবে যে–’বিবেক শান্ত থাকলে মানুষের শক্তি বাড়ে।‘
তোমার আনা।
.
শনিবার, ৮ জুলাই, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
এ কারবারের প্রধান প্রতিনিধি মিস্টার ব গিয়েছিলেন বেভারহিকে এবং নিলাম (হল্যাণ্ডে প্রত্যেক চাষীকে তার ফসল প্রকাশ্য নিলামে বেচতে হয়) বাজার থেকে সেই রকম জুটিয়ে এনেছেন স্ট্রবেরি।
এখানে এল যখন, একেবারে ধুলোয় ধূসর, বালিতে বালিময়, কিন্তু পরিমাণে প্রচুর। অফিসের লোকজন আর আমাদের জন্যে কম করে চব্বিশ ডালা স্ট্রবেরি। সেইদিনই সন্ধ্যেবেলায় ছয়টা বয়ামে পুরে আমরা আট পাত্র জ্যাম তৈরি করে ফেললাম। পরদিন সকালে মিপ অফিসের লোকদের জন্যে জ্যাম করতে চাইলেন।