মারগট আর মা-মণি এখন আগের চেয়ে একটু ভালো। সুস্থ বোধ করে মা-মণি কাল প্রথম চুলোতে কিছুটা সুপ চড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিচের তলায় কথা বলতে বলতে সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে, মটরশুঁটির দানাগুলো পুড়ে গিয়ে এমনভাবে তলায় ধরে যায় যে, হাজার চেষ্টা করেও প্যান থেকে তা আর ছাড়ানো যায়নি। মিস্টার কুহুইস আমার জন্যে একটা বই এনেছিলেন–ছোটদের বার্ষিকী। আমরা চারজন কাল সন্ধ্যেবেলায় অফিসের খাসকামরায় চলে গিয়ে রেডিও খুলেছিলাম। পাছে কারো কানে যায়, এই জন্যে আমি এত প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম যে, বাপিকে আমি ধরে টানাটানি করতে লাগলাম আমার সঙ্গে ওপরে যাওয়ার জন্যে। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মা-মণিও চলে এলেন। পাড়া পড়শিরা পাছে আমাদের আওয়াজ পায় এবং কিছু একটা চলছে এটা চোখে পড়ে, সেইজন্যে অন্যান্য দিক থেকেও আমরা রীতিমত ঘাবড়ে রয়েছি। এখানে প্রথমদিন পা দিয়েই আমরা পর্দার ব্যবস্থা করেছি। প্রকৃতপক্ষে ওগুলোকে ঠিক পর্দা বলা যায় না–আকারে, প্রকারে আর কারুকার্যে পৃথক শুধু কয়েকটা পাতলা, ঢিলে কাপড়ের ফালি–যা আমি আর বাপি নেহাত আনাড়ি হাতে সেলাই করে জোড়াতালি দিয়েছিলাম। এই বিচিত্র কাপড়গুলো ড্রইংপিন দিয়ে আমরা গেঁথে দিয়েছিলাম, যাতে আমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া অব্দি টিক থাকে।
আমাদের ডানদিকে বড় বড় সওদাগরী অফিস আর বাদিকে আসবাবপত্র তৈরির একটা কারখানা, দিনান্তে কাজের পর কেউ আর সেখানে থাকে না; কিন্তু তাহলেও দেয়াল ফুড়ে আওয়াজ যেতে পারে। মারগটের বেজায় ঠাণ্ডা লেগেছে; তাকে বলেছি রাতের বেলায় যেন সে না কাশে। তাকে গুচ্ছের কোডিন গেলানো হয়েছে। আমি মঙ্গলবারের জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছি, ঐদিন ফান ড্রানেরা এসে যাবে; তখন অনেক বেশি মজা হবে, এতটা চুপচাপ ভাব আর থাকবে না। সন্ধ্যেবেলায় আর রাতে আমার যে এত গা ছমছম করে, সেটা এই নিঃশব্দতারই জন্যে। আমি মনপ্রাণে চাই যে, আমাদের ত্রাণকর্তাদের কেউ না কেউ রাত্তিরে এসে এখানে ঘুমাক।
কখনও আর ঘরের বাইরে যেতে পারব না, এটা যে কী পীড়াদায়ক, তা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না–সেইসঙ্গে আমার বড় ভয়, আমরা যখন ধরা পড়ে যাব–তখন আমাদের গুলি করে মারা হবে। দিনের বেলায় আমাদের কথা বলতে হয় ফিস ফিস করে আর পা টিপে টিপে চলতে হয় না হলে মালগুদামের লোকগুলো টের পেয়ে যাবে।
চলি। কেউ আমাকে ডাকছে।
তোমার আনা
.
শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ১৯৪২
আদরের কিটি,
পুরো এক মাস আমি তোমাকে ছেড়ে থেকেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, খবর এখানে এত কম যে, প্রত্যেকদিন লেখবার মত মজাদার কিছু আমি খুঁজে পাই না। ফান ডানেরা এসে গেলেন। ১৩ই জুলাই। আমরা জানতাম ওঁরা আসছেন চোদ্দ তারিখে। কিন্তু জুলাইয়ের তেরো থেকে যোল তারিখ পর্যন্ত জার্মানরা একধার থেকে শমন জারি করতে থাকায় লোকে দিন দিন বিচলিত হয়ে উঠতে থাকে। তারা তাই দেখল, যদি বাঁচতে হয় তাহলে একদিন দেরি করে ফাঁদে পড়ার চেয়ে একদিন আগেই ব্যবস্থা করা ভাল। সকাল সাড়ে নটায় (যখন আমরা বসে প্রাতরাশ সারছি) পেটার এসে হাজির। পেটার হল ফান ডানদের ছেলে, তার ষোলো এখনও পূর্ণ হয়নি-নরম প্রকৃতির, লাজুক, খাটো ধরনের ছেলে; ওর সান্নিধ্য থেকে খুব বেশি কিছু পাওয়া যাবে না। পেটারের সঙ্গে এল তার বেড়াল (মুশচি)। মিস্টার আর মিসেস ফান ডান এলেন তার আধঘণ্টা পরে; মিসেস ফান ডানের টুপির বাক্সে একটা বড় পট দেখে। আমাদের খুব মজা লাগল। উনি সবাইকে শুনিয়ে বললেন, সঙ্গে আমার পট না থাকলে কোথাও গিয়ে আমি স্বাচ্ছন্দ্য পাই না। সুতরাং সবার আগে ওটা তিনি স্থায়ীভাবে তার ডিভানের নিচে রাখলেন। মিস্টার ফান ডান অবশ্য তার নিজেরটা সঙ্গে করে আনেননি, তবে বগলদাবা করে এনেছেন একটা ভাঁজ-করা চায়ের টেবিল।
ওঁরা আসার পর থেকে আমরা সবাই একত্রে আরাম করে বসে খাওয়াদাওয়া করছি; তিনদিন কেটে যেতে মনে হল আমরা সবাই যেন একটা বড় পরিবারভুক্ত লোক। বাইরের লোকালয়ে ফান ডানেরা যে অতিরিক্ত সপ্তাহটা কাটিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে ফান ডানেরা স্বভাবতই বিস্তর বলতে পারেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আমাদের খুব কৌতূহল হচ্ছিল আমাদের বাড়িটা আর মিস্টার গুডস্মিট সম্পর্কে জানতে।
মিস্টার ফান ডান আমাদের বললেন–
‘সোমবার সকাল নয়টার সময় মিস্টার গুডস্মিট ফোন করে জানতে চাইলেন আমি একবার আসতে পারি কিনা। আমি তক্ষুনি চলে গেলাম। গিয়ে দেখি গ–বেজায় বিচলিত। ফ্রাংরা একটা চিঠি লিখে রেখে গেছেন, উনি আমাকে সেটা পড়তে দিলেন এবং চিঠিতে যা বলা হয়েছে সেইমত বেড়ালটাকে তিনি আশপাশের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান বললেন। তাতে আমি খুশীই হলাম। মিস্টার গ–ভয় পাচ্ছিলেন বাড়িতে তল্লাসি হবে। সেইজন্যে আমরা সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে দেখলাম; খানিকটা গোছগাছ করে প্রাতরাশের জিনিসগুলো সরিয়ে ফেললাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল মিসেস ফ্রাংকের টেবিলে একটা রাইটিং-প্যাড তার ওপর মাসট্রিটের একটা ঠিকানা লেখা। আমি অবশ্য জানতাম যে, ইচ্ছে করেই এসব করা হয়েছে; তবু আমি খুব অবাক হওয়ার এবং, ইস, একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছে, এই রকমের ভাব দেখিয়ে গ–কে বললাম হতচ্ছাড়া চিরকুটটা অবিলম্বে ছিঁড়ে ফেলতে।