লোকটি মোটেই উম্মাদ নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ, আর দারুণ বুদ্ধিমান। তবে একেবারেই বিবেকহীন। আরো বলি, সে এই খুনগুলো করেছে, স্রেফ টাকার জন্য।
পার্সিভাল ফর্টেস্কুর কথা বলছেন? মনের সায় পাচ্ছিলেন না, তবুও নামটা উচ্চারণ করলেন নীল।
–ওহ, না ইনসপেক্টর, পার্সিভাল নয়। সে হলো ল্যান্সলট ফর্টে।
–এ একেবারেই অসম্ভব।
মিস মারপলের দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন নীল।
মিস মারপল যে রকম মানুষের চরিত্র এঁকেছেন, তাতে নীল অবাক হননি। খুনীর সাদৃশ্য ল্যান্সের সঙ্গে প্রায় হুবহু এক। কিন্তু সুযোগ আর সম্ভাবনার কথা ভেবেই তিনি কথাটা বলেছেন।
মিস মারপল বুঝতে পারলেন, ইনসপেক্টর নীলের মাথায় ব্যাপারটা ঢোকাতে হলে তাকে ধাপে ধাপে পরিষ্কার করে সব বোঝাতে হবে। তিনি তাই ধীর শান্ত স্বরে তার ব্যাখ্যা শুরু করলেন।
-ল্যান্স বরাবরই ছিল নির্দয় প্রকৃতির। অতি বদ তার চরিত্র। অথচ সুপুরুষ চেহারার জন্য সে ছিল আকর্ষণীয়, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে।
ল্যান্সের মানসিক গঠন এমনই ছিল যে সে চিরদিন ঝুঁকি নেবার জন্যই তৈরি ছিল। সে নানা ঝুঁকি নিয়েছে আর বাহ্যিক আকর্ষণের জন্যই লোকে তার কথা বিশ্বাস করেছে।
গত গ্রীষ্মকালে সে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তবে সে যে তার বাবার চিঠি পেয়ে দেখা করতে এসেছিল, অথবা তিনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। এমন কোন প্রমাণও নিশ্চয়ই আপনি পাননি।
-না, মিঃ রেক্স ফর্টেস্কু ল্যান্সকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ পাইনি। বললেন নীল, একটা চিঠি আমি পেয়েছি ল্যান্সের লেখা।
তবে সেটা একটা কারচুপিও হতে পারে। এখানে এসে পৌঁছনোর পর বাবার কাগজপত্রের মধ্যে ওটা গুঁজে রাখা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না।
–চমৎকার। তীক্ষ্ণবুদ্ধির কাজ। বললেন মিস মারপল, যাইহোক, বাবার সঙ্গে একটা মিটমাট কবে নেবার জন্যই সম্ভবত সে এখানে এসেছিল। কিন্তু তার বাবা রাজি হননি।
ল্যান্সের অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করুন। সে বিয়ে করেছিল। আর তার সৎ উপার্জনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বেঁচে ছিল কোন রকমে।
কিন্তু তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। প্যাট মেয়েটি সত্যিই ভাল। তাকে ভালবাসতো ল্যান্স। সেজন্যই সে চাইছিল একটা সম্মানজনক জীবন।
ল্যান্স যখন ইউট্রিলজে আসে তখনই সম্ভবত কালো পাখির ব্যাপারটা শুনেছিল। অ্যাডেল অথবা তার বাবা বলে থাকবে।
তখনই তার মনে পড়ে যায় ব্ল্যাকবার্ড খনির কথা। সে ধরে নেয় ম্যাকেঞ্জিদের মেয়ে নিশ্চয়ই ছদ্মপরিচয়ে ওদের বাড়িতে আছে।
ব্যাপারটাকে মাথায় রেখে সে খুনের পরিকল্পনা নেয় যাতে ম্যাকেঞ্জিদের মেয়ের কাঁধেই দোষটা চাপানো যায়।
ল্যান্স বাবার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিল, কিছু আদায় করা সম্ভব হবে না। তাই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুনের পরিকল্পনা নিতে হয়।
মিঃ রেক্স ফর্টেস্কুর শরীর যে ভাল যাচ্ছে না তা ল্যান্স জানতো। তাই সে দেরি করার পক্ষপাতি ছিল না। কেননা ইতিমধ্যে তিনি মারা গেলে তার ভবিষ্যৎ একেবারেই তলিয়ে যাবে।
-হ্যাঁ, ল্যান্স তার বাবার শরীরের অবস্থার কথা জানতো। বললেন নীল।
–আমার ব্যাখ্যা তো তাহলে মিলেই গেল। বললেন মিস মারপল। যাই হোক, দৈবাৎই বলতে হবে কালোপাখির ছড়ার দিকে ল্যান্সের আগ্রহ জেগেছিল। তার বাবার নাম রেক্স ফর্টেস্কু। রেক্স শব্দটা আর পাই ও ডেস্কের ওপরে কালোপাখির উপস্থিতিই সম্ভবত তার এই আগ্রহ জাগার মূলে কাজ করেছিল।
আসলে তার পরিকল্পনাটাকে যতটা সম্ভব জটিল করে তুলতে চেয়েছিল সে। তার প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল ব্ল্যাকবার্ড মাইনের ঘটনাটাকে অর্থাৎ মিসেস ম্যাকেঞ্জির প্রতিশোধ নেবার হুমকির সঙ্গে ঘটনাটাকে জড়ানো।
ছড়ার সঙ্গে সংগতি রেখেই তাই সে অ্যাডেলকে খুন করে। যাতে ব্যবসা থেকে এক লক্ষ পাউণ্ড বেরিয়ে যায়।
কিন্তু ছড়ার সঙ্গে মেলাবার জন্য আর একটা চরিত্রও দরকার হয়ে পড়েছিল। একজন পরিচারিকা যে বাগানে কাপড় মেলতে ব্যস্ত থাকবে। একটা ধাঁধার মতো করেই ছকটাকে সে তৈরি করেছিল। তার নিরীহ সহযোগীর মুখ বন্ধ করে দেবার মত চমৎকার অ্যালিবাইও সে ছকে রেখেছিল।
বিকেলে চা পর্বের আগেই সে বাড়িতে হাজির হয়। সেই সময়েই গ্ল্যাডিস দ্বিতীয় ট্রে নিয়ে হলঘরে ঢুকেছিল।
বাগানের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে সে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় আর হাতছানি দিয়ে গ্ল্যাডিসকে ডাকে।
গ্ল্যাডিস এগিয়ে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে শ্বাসরোধ করে। তারপর দেহটা বাগানের পেছনে যেখানে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয় সেখানে বয়ে নিয়ে যায়। এই কাজে সে তিন থেকে চার মিনিটের বেশি সময় ব্যয় করেনি।
এরপর আর কোন বাধা থাকে না। সে সদর দরজায় এসে ঘণ্টা বাজায়। বাড়িতে ঢোকার পর সে সকলের সঙ্গে চায়ে যোগ দেয়। চা পানের পর মিস র্যামসবটমের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ওপরে চলে যায়।
ল্যান্স যখন নেমে আসে, অ্যাডেল তখনো ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছিলেন। সে তার পাশে বসে কথা বলতে থাকে এবং সুযোগ মতো চায়ে সায়ানাইড মিশিয়ে দেয়।
আমার ধারণা চিনি নেবার অছিলাতেই সাদা গুঁড়োর সায়ানাইড সে অ্যাডেলের কাপেই ফেলে দেয়। হেসে বলে, যাঃ ভুল করে তোমার কাপে আরো চিনি দিয়ে ফেললাম।