- বইয়ের নামঃ রেসের ঘোড়া
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
রেসের ঘোড়া
০১.
এসে গেছি, জীপের পেছনের সিট থেকে বলল কিশোর পাশা। রুক্ষ পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছে গাড়ি। মাথা থেকে খুলে স্টেটসন হ্যাটটা কোলের ওপর রাখল সে। তাকিয়ে রয়েছে তীর চিহ্ন দেয়া নির্দেশকের দিকে। তাতে লেখাঃ ডাবল সি র্যাঞ্চ।
এলাম তাহলে, গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিশোরের পাশে সীট খামচে ধরে রেখেছে। যা রাস্তা। হাড্ডিমাংস সব এক হয়ে গেছে।
সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে বসেছে রবিন। ড্রাইভ করছে ব্ৰড় জেসন। হেসে বলল, আমরা কিন্তু সব সময়ই চলি এই রাস্তায়। আমাদের কিছু হয় না।
আপনাদের তো অভ্যাস হয়ে গেছে, মুসা বলল। মনে হচ্ছে সেই কোন যুগে রকি বীচ থেকে বেরিয়েছি। এতদিনে এসে পৌঁছলাম।
মিস্টি ক্যানিয়নে স্বাগতম, ব্রড বলল। ডাবল সি র্যাঞ্চের কর্মচারী সে, র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। শুকনো খড় রঙা চুল। বয়েস পঁচিশ-টচিশ হবে, আন্দাজ করল কিশোর।
মিস্টি ক্যানিয়ন, বিড়বিড় করল সে। তাকিয়ে রয়েছে পাহাড়ের দিকে। রবিন আর মুসারও চোখ সেদিকে। মনটানার একটা র্যাঞ্চে ঢুকছে ওরা। ঘিরে থাকা পাহাড়ের কোল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে র্যাঞ্চের জমি। রোদ খুব গরম। বাতাস শুকনো, পরিষ্কার।
এই পাহাড়ের কোলে অনেক র্যাঞ্চ আছে, ব্রঙ জানাল। ডাবল সি তারই একটা। মিস্টি ক্যানিয়ন কেন নাম হয়েছে জান? একটা ঝর্নার জন্যে। পাহাড়ের গোড়ায় বইছে গরম পানির ওই ঝর্নাটা, বাষ্প ওঠে ওটা থেকে। দূরের একটা শৈলশিরার দিকে হাত তুলে দেখাল সে।
নৌকার মত দুলে উঠল জীপ। তিক্ত কণ্ঠে মুসা বলল, রাস্তারই এই অবস্থা। গরম পানির ঝর্না কেমন হবে কি জানি। পা দিলেই হয়তো ফোঁসকা পড়ে যাবে, হট বাথ আর হবে না।
বাতাসে লম্বা সোনালি চুল এসে পড়ছে রবিনের চোখে মুখে। সরিয়ে দিতে দিতে বলল, এই ঝাঁকুনিতেই এই? আসল ব্রোঙ্কোতে তো এখনও চড়ইনি।
চড়েছি। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল মুসা, যে কোন ঘোড়ায় চড়লেই হলো।
না, হলো না। ঘোড়ার নানা রকম জাত আছে, একেকটায় চড়তে একেক রকম লাগে। টাট্ট ঘোড়ায় চড়া আর মনটানার মাসট্যাঙে চড়া এক কথা নয়, ওই যেমন তোমার ঝরঝরে ভেগা আর চকচকে মার্সিডিজ কিংবা জাগুয়ার,
হয়েছে হয়েছে, রেগে উঠল মুসা, আর খোঁচা মারতে হবে না!
ওদের ঝগড়া থামানোর জন্যে হাসল কিশোর। রবিন, তুমিও ভুল করছ। র্যাঞ্চের সব ঘোড়াই বুনো কিংবা খেপা নয়।
ঠিক বলেছ, কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল ব্রড। হেসে অভয় দিল মুসাকে, সব রকমের আরোহীর জন্যেই ঘোড়া রাখি আমরা। একেবারে আনাড়ির জন্যেও আছে।
ভাল! নাক কুঁচকাল মুসা। আনাড়ি শুনতে ভাল লাগেনি। তবে আমার জন্যে ভাল ঘোড়াই দরকার। চড়তে জানি। বহুবার চড়েছি। নবিস নই।
বুনো মাসট্যাংও নিশ্চয় আছে আপনাদের? ব্রডকে জিজ্ঞেস করল রবিন।
সরু হয়ে এল লোকটার চোখের পাতা। বুনো?
ঝড়ো বাতাসের মত জোরাল বাতাস এসে ঢুকছে জানালা দিয়ে। বইয়ের পাতা মেলা মুশকিল। অনেক কায়দা করে ডাবল সি র্যাঞ্চের ঝলমলে কভার ওয়ালা ব্ৰশিয়ারটা খুলে দেখাল রবিন, একটা কালো ঘোড়ার ছবিতে আঙুল রাখল। সামনের পা তুলে দিয়ে পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা, যেন পক্ষিরাজের মত আকাশে উড়াল দেয়ার মতলব।- এই যে এটার মত? ইউনিকর্ন?
ইউনিকর্ন? চোখ গোল গোল হয়ে গেল মুসার। গ্রীক মিথলজির দানব এল কোত্থেকে এখানে? এটারও শিং আছে নাকি?
বাস্তব ঘোড়ার শিং থাকে না, বলে আবার ব্রডের দিকে তাকাল রবিন, চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে।
ওতে চড়ে না কেউ, কাটা কাটা শোনাল ব্রডের কণ্ঠ।
ব্রশিয়ারেও অবশ্য তাই লেখা রয়েছে। কেউ নাকি চড়তে পারে না।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, দেখতে পাব তো ওকে?
রিয়ারভিউ মিররে কিশোরের চোখে চোখে তাকাল ব্রড। একটা পরামর্শ দিচ্ছি, কিশোর, ইউনিকের কাছ থেকে দূরে থাকবে। মরতে না চাইলে। গ্যাস প্যাডালে চাপ বাড়াল সে। খেপা ঘোড়ার মতই যেন লাফ দিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি। এবড়োখেবড়ো পথে ঝাঁকি খাওয়া বাড়ল, পেছনে বাড়ল ধুলোর ঝড়।
বিষণ্ণ হাসি ফুটল মুসার মুখে। গাড়ি তো নয়, মনে হচ্ছে নাগরদোলায় চড়ছি।
কিশোর চুপ। ইউনিকর্নের কথা ভাবছে। ব্রডের হুঁশিয়ারি ঘোড়াটার প্রতি কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে ওর। কয়েকটা কোরাল পেরিয়ে এল গাড়ি। অনেক ঘোড়া দেখা গেল। তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে কিশোর। ইউনিকর্নকে দেখার জন্যে। মায়ের পাশে ছোটাছুটি করতে দেখল অস্বাভাবিক লম্বা পা-ওয়ালা বাচ্চা ঘোড়াকে। ধুলোয় ঢেকে রয়েছে ঘোড়াগুলোর শরীর। তৃণভূমিতে ঘোড়ার পাশাপাশি চড়ছে সাদা চৌকোণা মুখওয়ালা লাল গরু। ওগুলোর গায়েও ধুলো।
কালো ঘোড়াটাকে দেখা গেল না।
র্যাঞ্চের মূল বাড়িটার সামনে এনে গাড়ি রাখল ব্রড়। এক সময় সাদা রঙ করা। হয়েছিল দোতলা বাড়িটাকে। রঙ চটে গেছে এখন, জানালার কাছগুলোতে ফাটা ফাটা হয়ে আছে। লাল রঙ করা শার্সির অনেকগুলো কজা ছুটে গিয়ে কাত হয়ে। রয়েছে বিচিত্র ভঙ্গিতে। টালির ছাত মেরামত করা হয়েছে বহু জায়গায়। সামনের বারান্দা বাড়িটার সমান লম্বা, এককোণ থেকে মোড় ঘুরে পাশ দিয়েও এগিয়ে। গেছে। রেলিঙের খুটি জায়গায় জায়গায় খুলে পড়ে গেছে, রেলিঙের ওপরটা দেবে। রয়েছে ওসব জায়গায়।
ধুলো ঢাকা মাটিতে লাফিয়ে, নামল গোয়েন্দারা। চত্বরে থেকেই আস্তাবল, গোলাঘর আর বাঙ্কহাউস দেখতে পাচ্ছে কিশোর। সবগুলো ঘরই সাদা রঙ করা হয়েছিল। মলিন ফেকাসে হয়ে গেছে এখন, ধূসর হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। কাত হয়ে রয়েছে বেড়া। পুরো জায়গাটারই কেমন বিবর্ণ দরিদ্র চেহারা।
সাংঘাতিক মোটা, ধূসর রঙের চুলওয়ালা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন সামনের দরজার কাছে। তিনিই কেরোলিন হোফারসন, এই র্যাঞ্চের হাউসকীপার, রবিনের মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী, স্কুলে একসাথে পড়েছেন। তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করেছেন, র্যাঞ্চে এসে ছুটি কাটানোর জন্যে।
ফিসফিস করে মুসা বলল, কিশোর, এ-কি! ব্রশিয়ারে কি দেখলাম, আর এসে কি দেখছি? এই অবস্থা তো কল্পনা করিনি।
রবিন! বারান্দায় দাঁড়ানো মহিলা এগিয়ে এলেন। বিশাল মুখে হাসি।
ব্যাগ হাতে দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন। আন্টি, কেমন আছেন? আমি…
আর বলতে হবে না, তুমিই রবিন। দেখেই চিনেছি।…আর তুমি কিশোর পাশা। তুমি মুসা।
গর্জন তুলে চত্বরে ঢুকল একটা ভ্যান। বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। জীপটার মতই এটার গায়েও সবুজ রঙে লেখা রয়েছে র্যাঞ্চের নামঃ ডাবল সি র্যাঞ্চ। পাশে পা তুলে দেয়া একটা কালো ঘোড়ার ছবি, র্যাঞ্চের মনোগ্রাম।
কয়েকজন নামল ভ্যান থেকে, তাদের মধ্যে রয়েছে এক তরুণী। বয়েস বিশ মত হবে, লাল চুল, মুখে হাসি। এগিয়ে এসে হাত বাড়াল প্রথমেই কিশোরের দিকে, হাই, আমি লিলি মরগান। তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা?
মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দুজনের পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর।
খুব খুশি হলাম তোমাদেরকে দেখে, হাসি এবং আন্তরিকতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে লিলির চোখ। তবে ঠোঁটের কোণে ক্লান্তির হালকা ছাপও স্পষ্ট। যাও, ভেতরে যাও। আমাদের আরও মেহমান আছে, তাদেরকে খাতির যত্ন করতে হবে আমাকে। আন্টির সঙ্গে তো পরিচয় হয়েই গেছে তোমাদের। রাঁধুনী, নার্স, অ্যাকাউনটেন্ট, হাউসকীপার, সব এক হাতেই করেন। আন্টি না থাকলে যে আমার কি দুর্গতি হত! আরেক বার হেসে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল লিলি ভ্যানের কাছে দাঁড়ান অন্য মেহমানদের দিকে।
সবই করেন তাহলে আপনি, কেরোলিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।
হাত দিয়ে ডলে অ্যাপ্রনের ভাজ সমান করতে লাগলেন তিনি। এভাবে সামনাসামনি প্রশংসায় লজ্জা পেয়েছেন। লিলির কথা আর বল না। এসো, তোমাদের ঘর দেখিয়ে দিই। হাতমুখ ধুয়ে এসো। লেমনেড খেতে দেব।
আউফ, দারুণ কথাটা বলেছেন আন্টি, মুসা বলল। এটাই চাইছিলাম এখন।
মাটিতে নামিয়ে রাখা ওর ডাফেল ব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল কিশোর। বাধা দিয়ে কেরোলিন বললেন, থাক, তোমাদের নিতে হবে না। ব্রড আর টিম আছে, দিয়ে আসবে।
হাউসকীপারের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। প্রবেশপথের মুখ থেকেই চার দিকে চলে গেছে চারটে শাখাপথ। সিঁড়ি উঠে গেছে ওগুলোর মাথা থেকে। একটা সিঁড়ির গোড়া থেকে বড় একটা হলঘর চলে গেছে বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘর পর্যন্ত। বায়ে রয়েছে ডাইনিং রুম, লম্বা লম্বা টেবিল পাতা। ওই ঘর আর রান্নাঘরের মাঝে দরজা রয়েছে, সুইংডোর লাগান। ডানে লিভিং রুম। পাইন। কাঠের প্যানেলিং করা। আসবাবপত্র সব পুরানো, মলিন, কাঠের মেঝেতে পাতা কার্পেটটাও বিবর্ণ। ছাত ধরে রেখেছে বড় বড় কড়িকাঠ। দেয়ালে আঁকা রয়েছে। ওয়াগনের ছবি। এক কোণে একটা রিভার-রক ফায়ারপ্লেস, ওটার ম্যানটেল বোঝাই হয়ে আছে নানারকম ট্রফিতে।
এসব পুরস্কার কি সব লিলি জিতে এনেছে? দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল মুসা।
সঅব। এখানে ওর মত ঘোড়ায় চড়তে পারে না আর কেউ, গর্বের সঙ্গে বললেন কেরোলিন। হাঁটতে শেখার আগেই ঘোড়ায় চড়তে শিখেছে মেয়েটা, তা ও জিন ছাড়া, ইনডিয়ানদের মত ঘোড়ার খালি পিঠে। বারো বছর বয়েসে স্থানীয় সমস্ত রোডিও প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। এর কয়েক বছর পরেই ঘোড়ার পিঠে চেপে বেরিয়ে পড়েছিল দেশভ্রমণে। তাতেও পুরস্কার জিতে নিয়ে শেষে এসে এই– র্যাঞ্চের কাজে লেগেছে।
কাজে লেগেছে মানে? জানতে চাইল কিশোর।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন কেরোলিন। ওর সাহায্য দরকার হয়েছিল ওর বাবার, অ্যাক্সিডেন্টের পর। প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, এসো। ঘরে চলো। চওড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে ওদেরকে দোতলায় নিয়ে চললেন তিনি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পাশের দেয়ালে টানানো ছবিগুলো দেখল কিশোর। ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে থামল, ফ্রেমে বাঁধাই একটা সাদা কালো ছবি দেখে। কার ছবি? লিলির বাবার? কাউবয়ের পোশাক পরা একজন মানুষের ছবি, সেদিকে হাত তুলল সে।
হাসি মলিন হয়ে এল কেরোলিনের। হ্যাঁ, লিলির বাবা। মেয়েটাকে একাই মানুষ করেছেন। লিলির মা মারা গেছে ওর পাঁচ বছর বয়েসে।
মা বলে, রবিন বলল, লিলি নাকি আপনার মেয়ের মত।
বিষণ্ণতা ফুটল কিশোরের চেহারায়। তারও মা নেই। ছোটবেলায় এক মোটর দুর্ঘটনায় বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। তারপর থেকে বড় হয়েছে মেরিচাচীর কাছে। লিলির বাবার দুর্ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছিল, জানতে ইচ্ছে করছে তার। জিজ্ঞেস করল, বাপ-মেয়ের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, না?
ছিল, সিঁড়ির মাথা থেকে জবাব দিলেন কেরোলিন।
লম্বা করিডরে মলিন কার্পেট পাতা। দোতলায়ও হলঘর আছে। এক প্রান্ত থেকে নেমে গেছে আরেকটা সিঁড়ি।
কিশোরকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেরোলিন জানালেন, ওটা দিয়ে রান্নাঘরে যাওয়া যায়। আর এই যে দরজাগুলো দেখছ, এগুলো বেডরুম। মেহমানদের থাকার। সিঁড়ির ডানের একটা দরজা খুলে বললেন, এটা তোমাদের ঘর।
একটা জানালা খুললেন কেরোলিন। হুড়মুড়িয়ে যেন ঘরে ঢুকল গরম বাতাস, তাজা খড়ের গন্ধে ভারি হয়ে আছে। মুসা বলল, বাহু, গন্ধটা তো চমৎকার।
হ্যাঁ, কেরোলিন বললেন। ভালই ছিল সব কিছু। নষ্ট করে দিল ওই শয়তান ঘোড়াটা।
শয়তান ঘোড়া? ইউনিকর্নের কথা বলছেন? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
ওটাকে যে এখনও কেন রেখেছে লিলি বুঝি না। ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। কেরোলিন। কাঁধ দিয়ে ঠেলে আরেকটা দরজা খুললেন। এখানে আরেকটা ঘর আছে। দুটো ঘরে থাকতে পারবে তো তিনজনে?,
নিশ্চয়ই, রবিন বলল। একটা হলেও পারতাম।
প্রথম ঘরটা ছোট, একটা সিঙ্গল বেড, পুরানো কার্পেট, একটা রকিং চেয়ার, আর একটা আলমারি আছে। পরের ঘরটা বড়, সবই একটা করে আছে, কেবল বিছানা দুটো। যে কোন একজনকে থাকতে হবে ছোট ঘরটায়। ওয়েস্টার্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি ঝোলানো রয়েছে দেয়ালে। জানালায় লাগানো হয়েছে ভারি কাপড়ের পর্দা।
ঘর দেখিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন কেরোলিন।
এখন কে কোনটাতে থাকবে ঠিক করতে বসল তিনজনে। মুসা প্রস্তাব দিল, টস করা হোক। কিশোর টসে জিতল। সে থাকবে ছোট ঘরটায়, একা। বড়টায় অন্য দুজন।
রবিন বলল, আমি থাকব জানালার কাছে। বলতে বলতে গিয়ে যেন নিজের জায়গা দখলের জন্যেই উঠে পড়ল দেবে যাওয়া ম্যাট্রেসে। রাতে ঝিঁঝি আর কয়োটের ডাক শুনতে পাব এখান থেকে। আমার খুব ভাল লাগে।
থাকো, আমার আপত্তি নেই, মুসা বলল।
জানালা দিয়ে মুখ বের করল রবিন। তোমরা যাই বলো, আমার কাছে। এটাকে লাগছে গোস্ট টাউনের মত। ওই যে, ওয়েস্টার্ন শহরে ভূতুড়ে শহরের কথা শোনা যায় না, সে রকম।
ঠিকই বলেছ, একমত হলো কিশোর, ও রকমই। কেমন যেন পোড়ো পোড়ো লাগে। বিছানায় উঠে এসে রবিনের পাশে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। কাজ করছে কয়েকজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড, র্যাঞ্চের শ্রমিক ওরা। ঘোড়াকে ব্যায়াম করাচ্ছে কেউ, কেউ জিন আর লাগাম পরিষ্কার করছে, কেউ বা বেড়া পরিষ্কারে ব্যস্ত। তবে এতবড় একটা র্যাঞ্চে যত লোক থাকার কথা, যতটা সরগরম থাকার কথা, সে রকম নেই। হলোটা কি এখানে, বলো তো?
পুরোপুরি সব জানি না, রবিন বলল। মার কাছে যতটা শুনেছি। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন লিলির বাবা। অকর্মণ্য হয়ে যান। র্যাঞ্চের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় তদারকির অভাবে। শেষে মারাই গেলেন। বাধ্য হয়ে রোডিও খেলা বাদ দিয়ে সাহায্য করতে আসতে হয় লিলিকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভ্রূকুটি করল রবিন। তবে তখন দেরি হয়ে গেছে। আরেকটা র্যাঞ্চে চলে যেতে শুরু করেছে তখন মেহমানরা, টুরিস্ট, যারা এখানে বেড়াতে এলে থাকে।
বিড়বিড় করে কি বলল কিশোর বোঝা গেল না।
আমাদের পরে যে ভ্যানটা এল, দেখেছ? মুসা বলল, অনেক বড়, অনেক লোক ধরবে। অথচ নামল পাঁচজন, তা-ও একজন ড্রাইভার। ব্রশিয়ারে পড়লাম এই র্যাঞ্চে মেহমানই থাকতে পারে ষাটজন…আছে কজন এখন? আমাদেরকে নিয়ে বড় জোর দশ-এগারো?
কাছাকাছি হয়ে এল কিশোরের ভুরু। ভাঁজ পড়ল কপালে। এই কথাটা সে-ও ভেবেছে। বলল, হয়তো আসবে, পরে। ডিনারের এখনও দুই ঘণ্টা বাকি।
হয়তো, মাথা ঝাঁকাল রবিন। তবে বিশ্বাস করতে পারছে না কথাটা।
ওদের মালপত্র নিয়ে দরজায় দেখা দিল ব্রড।
দেখি, দিন ওটা আমার হাতে, নিজের ব্যাগটা নিয়ে লোকটাকে সাহায্য করার জন্যে নেমে গেল কিশোর।
রবিন আর মুসাও এগোল।
বাপরে বাপ, কি ভারি, অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে ব্রড। সারা গরমটাই কাটাতে চলে এসেছ মনে হয়।
না, কিছু কাপড়চোপড় তো লাগেই, মুসা বলল, লাগে না?
রবিন বলল, তাছাড়া আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস দরকার হয়। অল্প অল্প নিতে গেলেও ভারি হয়ে যায়।
বেরিয়ে গেল ব্রড।
ব্যাগ খুলে তোয়ালে বের করল মুসা। তোমরা কি করবে জানি না, আমি গোসল করতে চললাম।
করগে, কিশোর বলল। আমি যাচ্ছি জায়গাটা ঘুরে দেখতে।
রবিন বলল, আমিও যাব।
ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিজের ঘরে এনে রাখল কিশোর। তারপর রবিনকে নিয়ে রওনা হলো নিচতলায়।
রান্নাঘরে ঢুকতেই ওদেরকে লেমোনেড দিলেন কেরোলিন।
খেতে খেতে র্যাঞ্চটার ব্যাপারে নানা খবর নিতে লাগল কিশোর। কেরোলিনও সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। জানালেন, কোথায় কোথায় রয়েছে। আস্তাবল, বাঙ্কহাউস, ট্যাকরুম আর ঘোড়ার বাচ্চা রাখার ছাউনি। বিশ্রাম নিয়েছে, লেমোনেড খেয়েছে। অনেকটা তাজা হয়ে বাইরে বেরোল দুই গোয়েন্দা, র্যাঞ্চ দেখার জন্যে।
ঘুরেটুরে দেখে এসে দাঁড়াল কাত হয়ে থাকা একটা বেড়ার কাছে। খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল একজন শ্রমিক কি করে ধূসর রঙের একটা ঘোড়ার বাচ্চাকে ট্রেনিং দিচ্ছে।
অনেক অবাধ্যতা করল বাচ্চাটা। লাফালাফি করল, ঘাড় বেঁকিয়ে এদিক ওদিক সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিঠে জিন বাধতে দিতেই হলো।
কি দেখছ? ওদেরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল লোকটা। এটাকে এখন পোষ মানান হচ্ছে। পিঠে চড়ব। চেষ্টা করে দেখতে চাও? ও, আমি শেপ
আপত্তি নেই, এগিয়ে গেল কিশোর। হেসে বলল, দেখিই না পারি কিনা।
দেখো। খুব শয়তান, বলে দিলাম। হ্যাটটা ঠেলে পেছনে সরিয়ে হাত দিয়ে। কপালের ঘাম মুছল শেপ।
ইউনিকর্নের বংশধর নাকি?
শক্ত হয়ে গেল শেপের চোয়াল। না।
ইউনিকর্ন তো এখানে বিখ্যাত, তাই না?
কুখ্যাত। হ্যাটটা আবার আগের জায়গায় নিয়ে এসে ঘোড়ার গলার রশি ধরে টান দিল। গোলাঘরের দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোরকে অবাক করে দিয়ে। কয়েক পা এগিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, পোষ মানান আরেক দিন শেখ। আজ আর এটাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। কাহিল হয়ে পড়েছে। খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে।
তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সে-ও কম অবাক হয়নি। লোকটা দূরে চলে গেলে বলল, ইউনিকর্নের কথা কেউই আলোচনা করতে চায় না এখানে।
ভাবছি, কেন? আস্তাবলের দিকে তাকিয়ে গাল চুলকাল কিশোর। বিনা অনুমতিতে মেহমানদের ওখানে ঢাকার নিয়ম নেই। গেট বন্ধ। হুট করে যাতে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়তে না পারে সেই ব্যবস্থা করা আছে। ঘোড়াটাকে দেখার বড় লোভ হচ্ছে।
রবিনকে নিয়ে আবার র্যাঞ্চ হাউসে ফিরে চলল সে। পোশাক বদলে ডিনারের জন্যে তৈরি হতে হবে।
রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ মনে হয়? হাঁটতে হাঁটতে বলল রবিন।
জবাব দিল না কিশোর। ভাবছে। ইউনিকনের ব্যাপারে ব্রড, কেরোলিন, এমনকি শেপের আচরণ কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে তার।
.
দ্রুত গোসল সেরে নিয়ে ধোয়া টি-শার্ট আর জিনস পরে নিচে রওনা হলো কিশোর। কয়েক ধাপ নেমেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
নিচ থেকে শোনা যাচ্ছে একজন লোকের ভারি কণ্ঠ, রেগে গিয়ে বলছে, সময় শেষ হয়ে আসছে, লিলি, বোঝার চেষ্টা করো!
সিঁড়ির রেলিঙের কাছে এসে নিচে উঁকি দিল কিশোর। সামনের দরজায়। দাঁড়িয়ে আছে লিলি। কোমরে হাত, এদিকে পেছন করে আছে। যে লোকটা কথা বলছে সে রয়েছে বাইরে বারান্দায়, দেখা যাচ্ছে অবশ্য। বেঁটে, গোলগাল শরীর, লাল মুখ, পাতলা হয়ে এসেছে কালো চুল।
আপনার কাছ থেকে ওকথা শোনার কোন প্রয়োজন নেই আমার। লিলিও রেগে গেছে। গলা কাঁপছে ওর।
সেটা তোমার ইচ্ছে। তবে আর কোন উপায়ও নেই তোমার, লোকটার চোখজোড়ায় শীতল, কঠিন দৃষ্টি। কুকুর যেভাবে মাড়ির ওপর থেকে ঠোঁট সরিয়ে ভেঙচি কাটে, অনেকটা তেমনি করেই ভেঙচি কাটল লোকটা। বলল, দেখো, ডবসি কুপার আর হারনি পাইকের কাছে তুমি একটা মশা। টিপ দিলেই মরে যাবে। কি আছে তোমার? ছিলে রোডিও রাইডার, এখানে এসে হয়েছ একটা ধসে পড়া র্যাঞ্চের মালিক। সেটাও আবার বন্ধক দেয়া। তোমার ওই শয়তান ঘোড়াটারও কানা কড়ি দাম নেই। কেউ চড়তেই পারে না ওটার পিঠে, কে দাম দিতে যাবে? ভেবে দেখ আমার কথা। লিলিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জুতোর গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরল সে। গটমট করে নেমে চলে গেল বারান্দা থেকে।
এতক্ষণ সোজা করে রাখলেও লোকটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁকা হয়ে গেল লিলির কাঁধ, যেন ভার বইতে পারছে না আর। ঘুরল। ঘুরতেই কিশোরের চোখে চোখ পড়ল।
সরি, আড়ি পেতে শুনতে চাইনি, কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তাড়াতাড়ি নেমে গেল নিচতলায়। কানে এল ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ। যেন বিশেষ কারও ওপর ঝাল দেখার জন্যেই টায়ারের শব্দ তুলে, গর্জন করে ছুটতে শুরু করল। জানালা দিয়ে লম্বা একটা সাদা গাড়ি দেখতে পেল সে।
কিছুই হয়নি এরকম একটা ভঙ্গি করল লিলি। কিন্তু চেহারার ফেকাসে ভাব দূর করতে পারল না। ওর নাম ফিলিপ নিরেক। গলা কাঁপছে মেয়েটার। ঢোক গিলল। আমার সর্বনাশ করতে চায়।
কেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এই র্যাঞ্চটা চায় ও। কয়েক বছর আগে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিল আব্বা। ঘোড়ার খেলা দেখিয়ে আমিও কিছু কামিয়েছিলাম। দুজনের টাকা দিয়ে কিছু গরুঘোড়া কিনলাম, ব্যবসার জন্যে। এই র্যাঞ্চটা কিনলাম। অনেক বেশি খরচ করে ফেললাম আমরা। ভাবলাম, কি আর হবে, আস্তে আস্তে তুলে নেব টাকাটা। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট করে বসল আব্বা। কাজ করার ক্ষমতা রইল না। রোডিও খেলা বাদ দিয়ে চলে আসতে হলো আমাকে। তবু সামাল আর দিতে পারলাম না। একের পর এক গোলমাল হতেই থাকল।
এই ফিলিপ নিরেক লোকটা কে?
ব্যাংকের লোন অফিসার। ঋণ শোধ করার সময় শেষ হতে আরও কিছুদিন। বাকি, অথচ এখনই এসে হুমকিধামকি শুরু করেছে। বলছে কোনদিনই পারব না। র্যাঞ্চ বন্ধ করে দিতে।
লিলির উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। লিভিং রুমের দিকে চলল মেয়েটা। ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল কিশোর, আরও দুজন। লোকের নাম বলল শুনলাম?
হ্যাঁ। ডবসি কুপার আর হারনি পাইক। দুজনেই র্যাঞ্চার, ডাবল সির সব চেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।
ডবসি কুপার? নামটা পরিচিত লাগল কিশোরের। বেনি কুপারের কিছু হয় না তো? রোডিও স্টার?
বেনির বাবা। কাচের বাক্সে রাখা ট্রফিগুলোর দিকে তাকাল লিলি। আমি সরে আসতেই ও ওপরে উঠে গেল। নাম করে ফেলল। আমি থাকতে ট্রিক রাইডার আর বেয়ারব্যাক রেসার হিসেবে আমার পর পরই ছিল ও।
রোডিও খেলা দেখেছে কিশোর। রিঙের ভেতরে জিন ছাড়াই ঘোড়ার খালি। পিঠে বসে বেদম গতিতে ছুটতে থাকে খেলোয়াড়েরা। আরও নানারকম বিপজ্জনক খেলা দেখায়, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
এগিয়ে গিয়ে একটা ট্রফিতে হাত বোলাল লিলি। ফিলিপের বক্তব্য, ওই দুজন র্যাঞ্চারের সঙ্গে কোনমতেই এঁটে উঠতে পারবে না ডাবল সি। বিক্রি করে। দিতে বলছে হারনি পাইকের কাছে। অনেক জায়গাজমি কিনছে পাইক, মিস্টি ক্যানিয়নে হোটেল পাইকের কাছে। অনেতে পারবে না ডাবল সি বক্তব্য, ওই
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। এ রকম একটা জায়গাকে কিছু বানিয়ে নষ্ট করা উচিত না।
প্রাণ থাকতে দেবও না আমি! ফুঁসে উঠল লিলি।
কি করে বাধা দেবেন?
ঝিক করে উঠল লিলির সবুজ চোখ। আবার কাজ শুরু করব।
কাজ তো করছেন… থেমে গেল কিশোর। ও, আবার রোডিও?
কেন নয়? জুলাইয়ের চার তারিখে ইডাহোর বয়েসে একটা বিরাট রোডিওর আয়োজন করা হয়েছে। এতবড় আয়োজন এই এলাকায় আর হয়নি। পুরস্কারের টাকাও অনেক বেশি। জিততে পারলে ব্যাংকের ঋণ সহজেই শোধ করে দিতে পারব। শুধু তাই নয়, যে জিতবে তাকে বিজ্ঞাপনে এমনকি সিনেমায়ও অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হবে। টাকার আর অসুবিধে হবে না তখন। র্যাঞ্চের খরচ সহজে জোগাতে পারব। এভাবে দুচারটা টুরিস্ট মৌসুম টিকিয়ে রাখতে পারলেই বেঁচে যাবে র্যাঞ্চটা। নিজের আয়েই চলতে পারবে তখন।
হ্যাঁ, ভালই হবে, কিশোর বলল। আইডিয়াটা মন্দ না।
ঘণ্টা শোনা গেল বাড়ির ভেতর থেকে।
ঘড়ি দেখল লিলি। খাবার সময় হয়েছে। লিলিকে দেরি করিয়ে লাভ নেই। ওকে কথা দিয়েছি, আজকে খাবার টেবিলে সাহায্য করব। কিশোরের দিকে তাকাল, তোমাকে এত কিছু বলে ফেললাম, কিছু মনে করনি তো?
লিলির সঙ্গে ডাইনিংরুমে এসে ঢুকল কিশোর। ঢোকার মুখেই দেখা হয়েছে ফোরম্যান লুক বোলানের সঙ্গে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লিলি। কিশোরের হাসির জবাব দিয়েছে লোকটা সামান্য একটু মাথা নুইয়ে।
লম্বা একটা টেবিলে বসে পড়েছে রবিন।
আরি, তুমি আগে? কিশোর জিজ্ঞেস করল, মুসা কোথায়?
বলতে পারব না। আমি বাথরুমে থাকতেই ও ডেকে বলল, বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে।
দেখি, খুঁজে নিয়ে আসিগে। দেরি করলে তো ডিনার মিস করবে।
দরজার দিকে ঘুরল কিশোর, বেরোনর জন্যে। আচমকা, বিকেলের শান্ত বাতাসকে চিরে দিল যেন তীব্র একটা আতঙ্কিত চিৎকার। রেসের ঘোড়া।
.
০২.
চত্ত্বর ধরে ছুটতে ছুটতে আরেকটা চিৎকার শুনতে পেল কিশোর। আস্তাবলের দিক থেকে আসছে।
বিপদে পড়েছে মুসা, ভীষণ বিপদ। কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে তাকে। কোরালের বেড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বাঁকা হয়ে আছে। আক্রমণের ভঙ্গিতে ওর দিকে এগিয়ে চলেছে বিরাট কালো একটা ঘোড়া। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কালো চোখের তারা, ঘামে ভেজা চামড়া চকচক করছে সিকিউরিটি ল্যাম্পের আলোয়, নীলচে দেখাচ্ছে।
ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের হৃৎপিণ্ড। ইউনিকর্ন।
পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। সামনের দুই পা গেঁথে ফেলতে চায় মুসার বুকে। কিছুই করার নেই তার। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে মাথার ওপর দুহাত তুলে তাকিয়ে রয়েছে আতঙ্কিত অসহায় দৃষ্টিতে।
কোন রকম দ্বিধা না করে লাফিয়ে কোরালের বেড়া ডিঙাল কিশোর।
সাবধান! পেছন থেকে চেঁচিয়ে হুশিয়ার করল লিলি।
মাথা ঝাড়া দিল ঘোড়াটা। পা চালাল। সামনের দুটো খুর অল্পের জন্যে লাগল না মুসার মুখে।
চিৎকার করে হাত নাড়তে নাড়তে ছুটল কিশোর। ঘোড়াটার নজর এদিকে ফেরাতে চাইছে, যাতে মুসাকে আর আক্রমণ না করে।
ফিরেও তাকাল না ঘোড়াটা। আরেকবার লাফিয়ে উঠল পেছনের পায়ে ভর দিয়ে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে কিশোর। মুসার এক হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সরো, সরে যাও!
পেছনে এসে চিৎকার শুরু করল লিলি। ঘোড়াটার নাম ধরে ডাকতে লাগল। এই সুযোগে মুসাকে নিয়ে সরে এল কিশোর। গেটের দিকে দৌড় দিল দুজনে। ঘোড়াটা আবার এদিকে নজর দেয়ার আগেই দৌড়ে গেট পেরিয়ে এল।
লিলি লাগিয়ে দিল গেট।
থ্যা-থ্যাঙ্কস! গলা কাঁপছে মুসার।
কিছু হয়নি তো তোমার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ন-না! ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকাল আবার মুসা, এখনও ফোঁস ফোঁস করছে ওটা। আরি পরে, কি জানোয়ার…
কি হয়েছে? খোয়া বিছান পথে বুটের শব্দ তুলে দৌড়ে আসছে লুক, বোলান। মুসার কাছে এসে ঝাঁজাল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি করছিলে?
কয়েকজন মেহমানও এসে ঘিরে দাঁড়াল ওদেরকে।
গেট খোলা দেখে ঢুকে পড়েছিলাম, মুসা বলল। ভাবলাম বাড়িতে যাওয়ার এটা শর্টকাট…
গেট খোলা ছিল? তুমি শিওর?
হ্যাঁ।
মুসার হয়ে কিশোর বলল, হয়তো হুড়কো লাগাতে ভুলে গিয়েছিল…
অসম্ভব! মানতে পারল না লুক। গেট ঠিকমত বন্ধ রাখার ব্যাপারে কড়া নির্দেশ রয়েছে এখানে। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে ফোরম্যান। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক আছ তো?
আছি।
গুড। মেহমানরা সব কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে জোর করে হাসল লুক। আপনারা যান। ডিনারের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য মেহমানদের নিয়ে সরে গেল ব্রড জেসন, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল লুক, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন?
ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে লিলি। সেদিকে তাকিয়ে কিশোর জবাব দিল, দেখি, ঘোড়াটাকে।
আর কিছু না বলে লুকও কোরালে ঢুকল, লিলিকে সাহায্য করার জন্যে।
লিলির সঙ্গে কথা আছে, ফিসফিস করে দুই বন্ধুকে বলল কিশোর।
কি? রবিনের প্রশ্ন।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গেটটা ইচ্ছে করেই খোলা রাখা হয়েছিল, কোন কারণে। ভাবছে কিশোর। ঘোড়াটার সম্পর্কে সবারই খুব খারাপ ধারণা। সেটাই যেন প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে জানোয়ারটাকে দিয়ে মুসাকে আক্রমণ করিয়ে।
কে গেট খোলা রাখতে যাবে?
সেটাই জানার চেষ্টা করব। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে মুসা, ওকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, সত্যিই তোমার কোথাও লাগেনি তো?।
নাহ্, মাথা নাড়ল মুসা। তবে তোমরা আসতে আরেকটু দেরি করলেই হগেছিলাম। বাপরে বাপ, এরকম সাংঘাতিক জানোয়ার আর দেখিনি! এমন ভাবে আটকে ফেলল আমাকে কিছু করতে পারলাম না। হাসল মুসা। বড্ড খিদে পেয়েছে। কি দিয়েছে টেবিলে, দেখেছ? ডাবল চিজ আর পেপারোনি পিজা হলে খুব ভাল হত।
পুরোপুরিই স্বাভাবিক হয়ে গেছে মুসা, কথাতেই বোঝা গেল। হাসল রবিন। মুসাকে হতাশ করার জন্যেই যেন বলল, না, ওই জিনিস এখানে পাবে না। খেতে হবে মোষের কাবাব আর কালো কফি, ওয়েস্টার্ন কাউবয়দের মত।
মুখ বাঁকাল মুসা। আরে না, কি যে বলো। তার চেয়ে ভাল জিনিস নিশ্চয় বানাবেন কেরোলিন আন্টি। মেহমানরা কি আর অত বাজে খাবার খেতে পারে নাকি।
কিশোরও হাসল। তোমার জন্যে একলা যদি বানায়। আন্টির সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছ এসেই, খেয়াল করেছি।
ও, রান্নাঘরে কাজ করেছি দেখে? তা তো করতেই হবে। আমাদেরকে তো বলাই হয়েছে, যতদিন থাকব, র্যাঞ্চের কাজ করতে হবে। তাহলে থাকা-খাওয়া ফ্রি…তোমরা দুজন বেরিয়ে গেলে, আমিই তোমাদের হয়ে…
কেন যে রাজি হলাম, গুঙিয়ে উঠল রবিন। ওসব রান্না-ফান্না এখন ভাল লাগে না আমার…।
কেন রাজি হয়েছি, খুব ভাল করেই জান তুমি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তুমিই তো অনুরোধ করলে আমাদেরকে আসতে…
করলাম তোমার কথায়। আমি কি আর জানি নাকি এতটা খারাপ অবস্থা। বেহমার বাল্যবন্ধুর অনুরোধ রাখতে এসে শেষে কোন্ হেনস্তা হতে হয়। কে জানে!
চোখ মিটমিট করল কিশোর। তা বোধহয় হব না। আর অবস্থা অতটা। খারাপও বোধহয় নয়, খালি রান্নাঘরেই বসে থাকতে হবে না।
ভুরু কুঁচকে তাকাল রবিন, কেন, রহস্য পেয়ে গেলে নাকি এরই মধ্যে?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দুজনকে বলল কিশোর, এক কাজ করো, তোমরা চলে যাও। আমি আসছি।
কি করবে? মুসা জানতে চাইল।
কাজ আছে। তোমরা যাও। পরে বলব সব।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল রবিন আর মুসা।
কোরালের বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল কিশোর। তার দিকে কড়া চোখে তাকাল একবার লুক। কেয়ারই করল না কিশোর, তাকিয়েই রয়েছে। খেপা ঘোড়াটাকে কিভাবে সামলাচ্ছে লিলি, দেখছে। কিছুতেই দড়ির বাঁধনে আটকা পড়তে চাইছে না ইউনিকর্ন, লাথি মারছে মাটিতে, মাথা ঝাড়ছে, ফোঁস ফোঁস। করছে। মোলায়েম গলায় কথা বলছে লিলি।
অবশেষে ধরা দিতেই হলো ঘোড়াটাকে।
কিশোরের দিকে এগিয়ে এল লুক। সাংঘাতিক বোকামি করে ফেলেছিল তোমার বন্ধু। ওটা ঘোড়া তো না, একটা শয়তান। খুনী।
খুনী? মানে?
লুক জবাব দেয়ার আগেই ঘোড়ার দড়ি ধরে ফিরে তাকিয়ে লিলি বলল, অহেতুক দোষ দিচ্ছ কেন? ইউনিক কাউকে খুন করেনি।
নাকি সুরে ডেকে উঠল ঘোড়াটা।
সরু হয়ে এল লুকের চোখের পাতা। কিশোরকে বলল, একটা কথা বিশ্বাস, করতে পারো, ভয়ানক বদমেজাজী জানোয়ার ওটা। একটু আগে নিজের চোখেই। তো দেখলে। ওটার কাছ থেকে দূরে থাকবে। লিলির দিকে এগিয়ে গেল সে। ওর হাত থেকে দড়িটা নিয়ে বলল, এই শয়তানটাকে আমি সামলাচ্ছি। তুমি যাও। কিশোর তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
দড়ি হাতবদল হতেই দ্বিধায় পড়ে গেল ইউনিকর্ন। নেচে উঠল। দড়ি ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ওকে শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করল লুক। টেনে নিয়ে চলল।
বেড়ার বাইরে এসে কিশোরের কাছে দাঁড়াল লিলি। মুসার কিছু হয়নি তো?
না। ভয় পেয়েছিল, সেরে গেছে।
পাবেই। বড় বড় র্যাঞ্চ হ্যাণ্ডদের ভয় পাইয়ে দেয় ইউনিক, আর মুসা তো… কথা শেষ না করেই কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল লিলি। তবে খুনী নয়। ঘোড়াটা, একথা বিশ্বাস করতে পার। লুক বাড়িয়ে বলেছে। এটা ওর স্বভাব। কিছু গড়বড় হয়ে গেলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, অযথা দোষ দিতে থাকে একে ওকে। তাছাড়া ইউনিককে ও দেখতে পারে না।
দেখতে পারে না কেন?
আব্বার মৃত্যুর জন্যে ও ইউনিককে দায়ী করে। কিশোরের মতই লিলিও বেড়ায় হেলান দিয়ে তাকাল লুকের দিকে, জোর করে টেনে টেনে ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কেন? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।
সে অনেক কথা। ভীষণ বদমেজাজ ঘোড়াটার। কয়েক বছর আগে, রোডিও খেলার জন্যে নেয়া হয়েছিল ওটাকে। প্রচুর বদনাম কামিয়ে বিদেয় হতে হয়েছে। কারোরই চড়ার সাধ্য হয় না ওটার পিঠে। আব্বা তো ঘোষণা করে দিয়েছিল, যে। এক মিনিট ইউনিকনের পিঠে চেপে থাকতে পারবে, তাকে মোটা টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। অনেক কাউবয় চেষ্টা করেছে, কেউ পারেনি। উড়তে শুরু করে ঘোড়াটা। ধোয়াটে হয়ে এল লিলির চেহারা। শেষে আব্বা নিজেই একদিন চেষ্টা করল। ছুঁড়ে ফেলে দিল ওকে ইউনিক। জন্মের মত পঙ্গু হয়ে গেল আব্বা।
তাই? বিড়বিড় করল কিশোর। তারপরই বুঝি আপনাকে রোডিও ছাড়তে হল?
মাথা ঝাঁকাল লিলি। আমাকে আসতে বাধ্য করেছে আসলে লুক। ওকে এমনি দেখে যাই মনে হয়, মনটা ওর খুবই ভাল।
এ ব্যাপারে একমত হতে পারল না কিশোর। তাহলে অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে ইউনিককেই দায়ী করে লুক?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘোড়াটাকেও দোষ দেয়া যায় না পুরোপুরি। আব্বা তো জানতই ওটা বদমেজাজী, কাউকে পিঠে চড়তে দেয় না, তারপরেও বোকামি করতে গেল কেন? লুকের তো একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্বা শুনল না ওর কথা। অ্যাক্সিডেন্টের পর লুক চেয়েছিল ওরকম একটা বাজে জানোয়ারকে মেরেই ফেলা হোক। খামাখা বিপদ পুষে রেখে লাভ কি। যুক্তি আছে অবশ্য ওর কথায়। এই যেমন আজ আরেকটু হলেই মারা পড়েছিল মুসা। বাতাসে উড়ে এসে পড়া চুল। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল লিলি। আব্বা লুকের কথায় কানই দেয়নি। তার ধারণা ছিল, ইউনিক এই র্যাঞ্চের জন্যে একটা অ্যাসেট। চড়তে না দিলে না দিল, প্রজনন তো করতে পারবে। ওর যেসব বাচ্চা হবে, একেকটা সোনার টুকরো।
হয়েছে নাকি?
নিশ্চয়ই। ওর কয়েকটা বাচ্চার বয়েস তিন বছর হয়ে গেছে। ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওগুলোকে। ঘোড়া যারা চেনে তাদের ধারণা রোডিও খেলার জন্যে খুবই ভাল জানোয়ার হবে ওগুলো। আব্বার আশা ছিল, ইউনিকের বাচ্চা বিক্রি করেই র্যাঞ্চের ধার শোধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু তার আশা পূরণ হওয়ার আগেই চলে গেল অন্য দুনিয়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিলি।
সরি, সহানুভূতি জানাল কিশোর।
র্যাঞ্চিং ব্যবসা খুব ভাল বুঝত আব্বা। তার কাছেই কাজ শিখেছে লুক। সে ও ভাল বোঝে। হঠাৎ কি মনে হতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল, লিলি। চলো, তোমাকে। একটা জিনিস দেখাব। রেসের ঘোড়া
লিলির পিছু পিছু আস্তাবলে ঢুকল কিশোর। আলো জ্বালল লিলি। নাক দিয়ে শব্দ করল কয়েকটা ঘোড়া। স্টলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় গলা বাড়িয়ে দিতে লাগল ওগুলো, ওদের নাম ধরে ডাকল সে, আদর করে হাত বুলিয়ে দিল। মাথায়। কিশোরও কোন কোনটাকে আদর করল, দেখল ওগুলোর টলটলে বাদামী চোখ।
স্টলের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল ওরা। খড়ের বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল ইউনিকর্নের মত দেখতে আরেকটা ঘোড়া। শান্ত সুবোধ, চোখে আগুন নেই। ওর নাম হারিকেন, ঘোড়াটার গলায় হাত বোলাতে লাগল লিলি। ইনডিপেনডেন্স ডে রেডিওতে এটার পিঠেই চড়ব আমি। হারিকেন নামটা ওর জন্যে ঠিকই হয়েছে, ঝড়ের মতই গতি। ওকে ছাড়া জেতার আশা কমই আমার।
দেখতে তো একেবারে…
ইউনিকের মত।
যমজ।
রেয়ার, তবে হয়। মেজাজ একেবারে বিপরীত দুটোর। এমনিতে খুব চুপচাপ থাকে হারিকেন, কিন্তু খেলার সময়… ওরিব্বাপরে, না দেখলে বিশ্বাসই করবে না। পকেট থেকে একটা আপেল বের করে ঘোড়াটাকে খেতে দিল লিলি।
আলাদা করে চেনেন কি করে দুটোকে?
চেনা খুবই কঠিন, তবে আমি পারি। সামনের ডান পায়ের খুরটা দেখো। সামান্য ওপরে একটুখানি জায়গার নোম সাদা দেখতে পাচ্ছ না? শুধু এটারই আছে, ইউনিকের নেই।
গলা বাড়িয়ে দেখল কিশোর। খুব ভাল করে না তাকালে চোখেই পড়ে না, সাদা অংশটা। হারিকেন নিশ্চয় খুব দামি?
তা তো বটেই। কিন্তু আমার মতে ইউনিকের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত। ওর একেকটা বাচ্চা যা হয় না, আগুন।
এক পা এগিয়ে এসে রেইলের ওপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিল হারিকেন। কুচকুচে কালো রঙ, অনেক উঁচু, একটা দেখার মত জানোয়ার। ওর মসৃণ গলায় হাত বোলাতে লাগল কিশোর। ঘোড়াটাও বাহুতে নাক ঠেকিয়ে দিয়ে আদর নিতে লাগল।
লিলি হাসল। ও তোমাকে পছন্দ করেছে।…চলো, আর দেরি করব না। আলো নিভিয়ে দিল সে।
চত্বর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, গেটটা কে খুলে রাখল, বলুন তো?
কি জানি, মাথা নাড়ল লিলি।
এরকম আর হয়েছে?
হয়েছে, দুএকবার। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেহমানরা ঢোকে, তারপর লাগাতে ভুলে যায়। ব্যাপারটা নিছকই অ্যাক্সিডেন্ট। বলল বটে লিলি, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে মনে হল না একথা বিশ্বাস করে সে। যত যাই বলো, আমার ভাই সাহস হচ্ছে না, ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে। রয়েছে মুসা। আগের সন্ধ্যার কথা ভুলতে পারছে না।
ভয় নেই, হেসে বলল কিশোর। ভাল ঘোড়াই দেয়া হবে তোমাকে। শয়তানী করবে না।
পরদিন সকালে আস্তাবলের কাছের বড় কোরালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। অন্য মেহমানরাও রয়েছে কাছাকাছি।
যার যার দায়িত্বে চড়বেন, ব্রড বলল। কি করে জিন পরাতে হয়, লাগাম লাগাতে হয় শিখিয়ে দেব। কারও চড়ার অভ্যেস আছে?
চড়েছে, জানাল তিন গোয়েন্দা। ওদেরকে সরিয়ে দেয়া হল বোসটনের ডক্টর কাপলিঙের পাশে। ডক্টরের স্ত্রী এবং কন্যাকে সরিয়ে আনা হলো কানসাসের একটা পরিবার আর শিকাগোর দম্পতি মাইক ও জেনি এজটারের পাশে, এরা কেউই চড়তে জানে না।
সবাইকেই একটা করে ঘোড়া আর জিন দিল ব্রড। কিশোরকে দেয়া হলো। একটা জেলডিং ঘোড়া। হরিণের চামড়ার মত ফুটফুটে চামড়া। নামটা বিচিত্র, জেনারেল উইলি। সবচেয়ে ভাল ঘোড়াগুলোর একটা দিলাম তোমাকে, ব্রড বলল। দেখো চড়ে, মজা পাবে। লিলি বলছিল ঘোড়ারা নাকি তোমাকে পছন্দ করে।
ব্রডকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘোড়াটার মণ চামড়ায় হাত বোলাতে লাগল কিশোর।
জিন পরাতে শুরু করল সে। রবিন, মুসা আর ডক্টর কাপলিংও যার যার ঘোড়ায় জিন পরাতে লাগলেন।
রবিনকে দেয়া হয়েছে একটা মাদী ঘোড়া, কিছুটা চঞ্চল স্বভাবের, জিন। পরাতে গেলে কেবলই পাশে সরে যেতে চায়। নাম, স্যাণ্ডি। মুসার ঘোড়াটাও একটা প্যালোমিনো মাদী ঘোড়া, শান্ত, নাম ক্যাকটাস।
নিজের ঘোড়ায় পিঠ সোজা করে বসল ব্রড। পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে চলল ধুলোঢাকা একটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে। দুধারে পাইনের ঘন জঙ্গল। কিছুদূর। এগিয়ে একপাশে দেখা গেল একটা পাহাড়ী নালা বয়ে চলেছে। পানি বেশি না। পরিচিত পথ ধরে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে ঘোড়ার মিছিল।
ফেরার পথে যার যেভাবে ইচ্ছে ঘোড়া চালানর অনুমতি দিল ব্রড।
লাফ দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের জেনারেল উইলি। মসৃণ গতি। সামনের দিকে ঝুঁকে রইল কিশোর। বাতাসে উড়ছে ঘোড়ার ঘাড়ের লালচে চুল। অন্যদের, এমনকি ব্রডেরও অনেক আগেই কোরালের কাছে পৌঁছে গেল ঘোড়াটা। গর্ব হতে লাগল কিশোরের।
ভাল চালাতে পার তো তুমি, পাশে এসে ওর প্রশংসা করল ব্রড।
আসলেই ঘোড়াটা ভাল, জেনারেলের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বলল কিশোর।
কোরালের ভেতরে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল তার। ভেতরে ছোটাছুটি করছে ইউনিকর্ন। পিঠে আরোহী নেই। এই দিনের আলোয়ও ভয়ঙ্কর লাগছে। ঘোড়াটাকে। ব্রডকে জিজ্ঞেস করল, কাল কে গেট খোলা রেখেছিল জানেন?
হাসি মলিন হয়ে গেল ব্রডের। আমি কি করে জানব? আমি তো ডিনারে বসেছিলাম।
সব মেহমানরাই বসেছিল।
নতুন কয়েকটা ছেলেকে আনা হয়েছে কাজ করতে, ওদের কেউ হতে পারে। কিংবা তোমার বন্ধুও খুলতে পারে।
পাশে এসে দাঁড়াল রবিনের ঘোড়া, স্যাণ্ডি। লাফিয়ে নামল রবিন। নাচতে লাগল চঞ্চল ঘোড়াটা, কিছুতেই যেন স্থির থাকতে পারে না।
মুসা কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
থাবা দিয়ে কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে রবিন বলল, পেছনে। মুসা আর ডক্টর, দুজনকেই পেছনে ফেলে এসেছে স্যাণ্ডি। ধুলো খাচ্ছে ওরা।
কপালে হাত রেখে শুকনো মাঠের ওপর দিয়ে তাকাল ব্রড। হলোটা কি? ওদের তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। যাই, দেখি কি হলো? তোমরা তোমাদের ঘোড়াগুলোকে ঠাণ্ডা করতে পারবে?
তা পারব। আমরা আসব, দরকার হবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না। লিলি জিজ্ঞেস করলে বল কোথায় গেছি। এখনই চলে আসব। ঘোড়া চালিয়ে রওনা হয়ে গেল ব্রড।
ঘোড়ার লাগাম ধরে টানতে টানতে ওগুলোকে গোলাঘরের কাছে নিয়ে চলল দুই গোয়েন্দা। কিশোর বলল, রবিন, বলো তো কাল কে কোরালের গেট খুলে রেখেছিল? এ ব্যাপারটা কি? কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, সত্যিই রহস্য পেয়ে গেলে মনে হচ্ছে?
হচ্ছে, যদিও নিশ্চিত হতে পারছে না কিশোর। সোনালি চুল, লম্বা, বেনিরই বয়েসী একটা মেয়েকে আসতে দেখল। পরনে জিন্স, গায়ে সিলভার-ট্রিম ওয়েস্টার্ন শার্ট, গলায় লাল রুমাল, মাথায় সাদা হ্যাট।
হাই, আরেকটু কাছে এসে ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল মেয়েটা, ব্রডকে দেখেছ? আমি বেনি কুপার, ওর বন্ধু।
নিজের আর রবিনের পরিচয় দিল কিশোর। তারপর বলল, এই একটু ওদিকে গেছে। এখুনি চলে আসবে।
গামলার কাছে এনে জেনারেলকে পানি খেতে দিল সে। খাওয়া হয়ে গেলে কোরালে ঢুকিয়ে দিয়ে এল অন্যান্য ঘোড়ার সঙ্গে।
অপেক্ষা করছে বেনি। ঘড়ি দেখল। সময় নেই আমার। আব্বাকে বলে এসেছি, শিগগিরই গিয়ে প্র্যাকটিস করব। মাঠের ওপাশে তাকাল ব্রডকে দেখার আশায়।
স্যাণ্ডিকে ঢোকানর জন্যে গেট খুলছে রবিন। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিওতে আপনিও খেলবেন নাকি?
খেলব। কোমরের বেল্টের রূপার বাকলসের মতই চকচক করল বেনির হাসিটা। এই সময় লিলিকে আসতে দেখা গেল।
হাই, বেনিকে বলে কিশোর আর রবিনের দিকে ফিরল লিলি। আর সবাই কোথায়?
আসছে। কিশোর তাকিয়ে রয়েছে বেনির দিকে, লক্ষ্য করল, কি করে দ্রুত মিলিয়ে গেল মেয়েটার হাসি। ব্রড চলে এসেছিল আমার সঙ্গে। আবার গেছে দেখতে কোন গোলমাল হলো কিনা।
তাই নাকি?
কি শুনছি, লিলি? বেনি জিজ্ঞেস করল, আবার নাকি ব্লেডিওতে ঢুকবে?
আর কোন উপায় নেই, উদ্বিগ্ন হয়ে দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে লিলি। বয়েসের ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিও দিয়েই শুরু করব আবার। বিকেলের উজ্জ্বল রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে চোখের পাতা মিটমিট করছে সে। যাই। দেখা দরকার, কি হলো।
আবার ঘড়ি দেখল বেনি। ওকে বল আমি এসে খুঁজে গেছি। গুডবাই না বলেই ঘুরে দাঁড়াল বেনি, গটগট করে হাঁটতে লাগল তার পিকআপের দিকে।
আপনি আবার খেলবেন শুনে খুশি হতে পারেনি ও, কিশোর বলল।
হবে কি করে? আমার কাছে হেরে যাওয়ার ভয় আছে না। ছোটবেলা থেকেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী। নাকের ডগা চুলকাল লিলি। ব্রডের সাথে বেশ ভাব মনে হয়! ও আসার পর থেকে প্রায়ই আসে আমাদের এখানে।
ওই যে, আসছে, চিৎকার করে বলল রবিন।
মাথা ঘুরিয়ে কিশোরও দেখতে পেল। আসছে দলটা।
এগিয়ে এল মুসা। চোখ বড় বড়। মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ছে। উত্তেজিত লাগছে তাকে।
কি ব্যাপার? জানতে চাইল রবিন।
ডক্টরের জিন ঢিল হয়ে গিয়েছিল, কাছে এসে বলল মুসা। ক্যাকটাসের পিঠ থেকে নেমে ডলে দিতে শুরু করল ওর চামড়া। তার জন্যে থামতেই হলো আমাদের।
চড়লে কেমন? জিজ্ঞেস করল।
দারুণ! ক্যাকটাসের জিন খোলায় ব্যস্ত হল মুসা। ঘোড়াটাও খুব ভাল। জিন খুলে নিয়ে ওটার পেছনে চাপড় দিয়ে বলল সে, যা, যা। কোরালের দিকে দুলকি চালে এগিয়ে গেল প্যালেমিনো।
.
আগের দিনের চেয়ে আধঘন্টা পরে ডিনারের ঘন্টা পরল এদিন। টেবিলে রবিন আর মুসার পাশে বসল কিশোর। দেখল, লিলির চেয়ারটা খালি। নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে কয়েকজন শ্রমিক। স্পষ্ট শোনা যায় না সব। কান। খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল কিশোর।
এখনও আসছে না কেন? ফোরম্যান লুক বোলান বলল।
আসবে, বলল ব্রড। ও তো আর শিশু নয়, ঠিকই চলে আসবে। কাজেটাজে গেছে হয়তো কোথাও।
বড় বেশি উল্টোপাল্টা ব্যাপার ঘটছে ইদানীং র্যাঞ্চে, বলল আরেকজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল।
গোলমাল হয়েছে, ফিসফিস করে বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। দেখতে যাচ্ছি।
বেশি চিন্তা করছ, মুসা বলল। দেখগে, কোথায় কি কাজ করছে।
ডিনারের পরও করতে পারত। কেরোলিনকে জিজ্ঞেস করব। তোমরা এখানে থাক, আর কিছু বলে কিনা ওরা শোন।
রান্নাঘরে চলে এল কিশোর। অস্থির লাগছে কেরোলিনকে। কিছু করতে হবে নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারবে? সত্যিই সাহায্য চান মহিলা। বার বার জানালা দিয়ে তাকাচ্ছেন। বাইরে। রাতের অন্ধকার নামছে। এভাবে এতক্ষণ তো দেরি করে না কখনও লিলি?
শহরে যায়নি তো? বড় একটা ট্রেতে চকলেট কেকের প্লেট সাজাতে সাজাতে বলল কিশোর।
না, গেলে বলে যেত। ঘণ্টা দুই আগে হারিকেনকে নিয়ে বেরিয়েছে। এক্সারসাইজ করাতে। বলেছে, খাওয়ার আগেই চলে আসবে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল মহিলার মুখে। কি যে করবে বুঝতে পারছি না… থেমে গেলেন আচমকা। এ কি হয়েছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল কিশোর। সাদা হয়ে গেছে কেরোলিনের মুখ। জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। কি দেখেছে দেখার জন্যে ছুটে এল সে জানালার কাছে। ধক করে উঠল বুক। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে হাত-পা।
একটা গাড়ি আসছে। পেছনে আসছে কালো একটা ঘোড়া। পিঠে জিন বাঁধা, অথচ আরোহী নেই।
০৩.
একটানে পেছনের দরজাটা খুলেই লাফিয়ে বাইরে নামল কিশোর। ছুটল চতুর ধরে, ভয় খাওয়া ঘোড়াটার দিকে। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল গাড়িটা।
ঘোড়াটার কাছে চলে এল কিশোর। জিন আঁকড়ে ধরতে গেল। মাথা ঝাড়া দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ওটা, চাবুকের মত শপাং করে এসে ওর মুখে বাড়ি লাগতে যাচ্ছিল ঘোড়ার মুখের লাগাম। সময়মত হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ওটা। লুক বোলান। ধমকে উঠল কিশোরের উদ্দেশ্যে, সরো! সরে যাও!
তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ল হারিকেন। লাফিয়ে উঠল পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। চোখে বন্য দৃষ্টি।
দৌড়ে আসছে ব্রড জেসন। লিলি কোথায়, লিলি? যেন ঘোড়াটাকেই জিজ্ঞেস করছে সে। কাছে এসে হারিকেনকে সামলাতে লুককে সাহায্য করল সে।
কে জানে, কোথায়! লুক বলল।
আরেকবার সাদা গাড়িটার দিকে তাকাল কিশোর। দুজন লোক বেরিয়ে এল। একজনকে চিনতে পারল, খাট ফিলিপ নিরেক। লম্বা অন্য লোকটাকে চিনল না।
দৌড়ে আসছেন কেরোলিন। এই, লিলিকে খুঁজতে যাও না কেউ! কিশোরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এমন ভঙ্গিতে তাকালেন, যেন চাইছেন কিশোরই যাক। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এরকম করে তো কখনও বাইরে থাকে না মেয়েটা! র্যাঞ্চে ইদানীং বড়ই গোলমাল চলছে। কিশোর, রবিনের আম্মা তোমাদের কথা সবই বলেছে আমাকে। সে জন্যেই তোমাদেরকে পাঠাতে বলে দিয়েছিলাম ওকে। প্লীজ, লিলিকে খুঁজে আন!
চেষ্টা করব। হারিকেনকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিল লিলি, আন্দাজ করতে পারেন?
মাথা নাড়লেন কেরোলিন। জোরে জোরে হাত ডলতে লাগলেন। জানলে তো ভালই হত। অনেক জায়গা আছে এখানে যাওয়ার, ডজনখানেক পথ আছে। কোনটা দিয়ে কোথায় গেছে কে বলবে?
বেশ, তাহলে এক কাজ করি, ঝড়ের গতিতে চলছে কিশোরের মগজ। একটার পর একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। টর্চ আর ঘোড়া নিয়ে কয়েকজন চলে যাই আমরা। বনের ভেতরে খুঁজব। কয়েকজন যাক গাড়ি নিয়ে। মাঠ আর অন্যান্য খোলা জায়গাগুলোতে খুঁজবে। কোথাও হয়তো পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে এসেছে তাকে ঘোড়াটা। হাত-পা ভেঙে পড়ে আছে, আসতে পারছে না।
ওহ, গড! প্রায় কেঁদে ফেললেন কেরোলিন।
আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসে কিশোরের শেষ কথাগুলো শুনেছে লুক। বারান্দায় জমায়েত হওয়া মেহমানদের দিকে তাকাল একবার। কিশোরকে বলল, তোমরা মেহমান। এসব তোমাদের কাজ নয়। আমরাই যাচ্ছি খুঁজতে। ফিলিপ নিরেকের ওপর চোখ পড়তে উদ্বিগ্ন হল সে।
আমি সাহায্য করতে চাই, কিশোর বলল।
দেখো, শোনো আমার কথা! কর্কশ হয়ে উঠল লুকের কণ্ঠ। এদিককার পাহাড়গুলো ভীষণ খারাপ। তোমরা আমাদের দায়িত্বে রয়েছ। কিছু একটা হয়ে গেলে জবাব আমাদেরকেই দিতে হবে। এই রিস্ক নিতে পারি না। আমরা এখানে অনেক লোক, আমরাই পারব। মেহমানদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলল, আপনারা সব ভেতরে যান। দাবা আছে, তাস আছে, খেলুনগে। ব্রড ভাল গিটার বাজাতে পারে। বাজিয়ে শোনাবে আপনাদের।
মেহমানদের যাবার ইচ্ছে নেই, তবু এক এক করে ঢুকে গেল ভেতরে।
কিশোর দাঁড়িয়েই রইল। আমি সত্যিই সাহায্য করতে পারব।
এগিয়ে আসছে নিরেক। তার সঙ্গের লম্বা লোকটার চেহারাটা রুক্ষ। মাথায় রুপালি চুল।
আরেকটু হলেই গাড়ির ওপরই এসে পড়েছিল ঘোড়াটা! এখনও গলা কাঁপছে নিরেকের। লুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?
নেই।
ঝুলে পড়ল ব্যাংকারের চোয়াল। নেই মানে? আমি আর পাইক তো ওর সঙ্গেই দেখা করতে এলাম…
লম্বা, কঠিন চেহারার লোকটার দিকে আবার তাকাল কিশোর। এই তাহলে হারনি পাইক। লিলির সম্পত্তি যে কেড়ে নিতে চায়।
আজ বিকেলেও ফোন করেছি, নিরেক বলল। ওকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে।
বারান্দার রেলিঙে হেলান দিল লুক। অন্য সময় আসতে হবে তাহলে। খাট লোকটার ওপর থেকে লম্বাজনের ওপর সরে গেল তার নজর। লিলি নিখোঁজ।
নিখোঁজ! রেগে গেল নিরেক। আমাকে বিশ্বাস করতে বল একথা?
করলে করবেন না করলে নেই, আপনার ইচ্ছে।
আমাদের ফাঁকি দেয়ার জন্যেই লুকিয়েছে।
কেন করবে একাজ? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
কিশোরের কথায় কানই দিল না নিরেক, তাকিয়ে রয়েছে লুকের দিকে। র্যাঞ্চটা যে শেষ, একথা আমার মতই তুমিও জানো৷ মিস্টার পাইক একটা লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
পরেও লোভটা দেখাতে পারবেন তিনি, ভোঁতা গলায় বলল লুক। মেয়েটার সঙ্গে গণ্ডগোল করবেন না আপনারা, বলে দিলাম। ভাল হবে না।
রাগ ঝিলিক দিল পাইকের চোখে, দরজা দিয়ে আসা আলোয় সেটা দেখতে পেল কিশোর। ভ্রূকুটি করল। অস্বস্তিভরে আঙুল বোলাল তার ওয়েস্টার্ন টাইতে। বলল, চল, ফিলিপ। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।
এই তো, ভাল কথা, লুক বলল। নিরেক কিছু বলার আগেই কিশোরের দিকে ফিরে বলল, যাও, ঘরে যাও। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলগে বসে। আমি লিলিকে খুঁজতে যাচ্ছি। লম্বা লম্বা পায়ে বাঙ্কহাউসের দিকে রওনা হয়ে গেল সে।
বনের ভেতর কোথায় কোন বিপদে পড়ে আছে লিলি, কে জানে! ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠেই কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল।
গাড়িতে উঠছে নিরেক আর পাইক। পাইকের খসখসে কণ্ঠ শুনতে পেল, ভেব না, ফিলিপ। নিজের কষ্টই কেবল বাড়াচ্ছে লিলি। কাজ হবে না এতে। র্যাঞ্চটা আমি দখল করবই।
ডাইনিং রুমেই রবিন আর মুসাকে বসে থাকতে দেখল কিশোর। এখন ওদের সঙ্গে রয়েছেন কেরোলিন।
লিলি ফেরেনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর। না। আমাদের এভাবে বসে থাকাটা বোধহয় উচিত হচ্ছে না।
আমারও তাই মনে হয়, কেরোলিন বললেন। মেহমানদেরকে বলিগে। যারা যেতে রাজি হয়, যাবে।
আমি তো যাবই, মুসা বলল।
আমিও, বলল রবিন।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সুইং ডোরের পাল্লা। ভেতরে ঢুকল লুক। চোখে। উল্কণ্ঠার ছায়া। কেরোলিনকে বলল, আমরা লিলিকে খুঁজতে যাচ্ছি। মেহমানরা যেন কেউ ঘর থেকে না বেরোয়। এরাও।
তিন গোয়েন্দাকে দেখাল সে। এমনিতেই যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছি। আবার কেউ কিছু করে বসুক…
কিন্তু এরা গোয়েন্দা…
গোয়েন্দা-ফোয়েন্দা আমাদের দরকার নেই! রেগে উঠল লুক। এখানে খুন হয়েছে নাকি, যে তদন্ত করবে? এখন আমাদের দরকার ভাল ট্র্যাকার, যে বনের ভেতরে চিহ্ন দেখেই হারান মানুষকে খুঁজে বের করতে পারবে, গোয়েন্দা লাগবে না। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর কেরোলিনকে। বলল, জন কয়েকজনকে নিয়ে দক্ষিণের পাহাড়ে চলে যাবে। আমি আর ব্রড বেরোব গাড়িতে করে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব। কিশোরের দিকে আঙুল তুলল সে। তোমরা ঘরে থাক। সাহায্য যদি করতেই হয়, বসে থাক ফোনের কাছে। বলা যায় না, লিলির ফোনও আসতে পারে। বেরিয়ে গেল সে।
কয়েক মিনিট পরে একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শোনা গেল।
লুক যা-ই বলে যাক, মানতে রাজি নয় কিশোর। ওই লোকটার আদেশ শুনবে কেন সে? এখানে বসে বসে আঙুল চুষতে একেবারেই ভাল লাগছে না তার। দুই সহকারীর দিকে তাকাল।
বসেই থাকবে? রবিনের প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল কিশোর। না। জেনারেলকে নিয়ে বেরিয়ে যাব পাহাড়ে খুঁজতে।
জানতাম, হাসি ফুটল রবিনের মুখে।
কিশোরও হাসল। বলল, তবে লুক একটা কথা ঠিকই বলেছে, ফোনের কাছে কাউকে থাকতে হবে।
কে থাকবে? হাসি মিলিয়ে গেল রবিনের।
তুমিই থাকো না?
হ্যাঁ, থাক, প্লীজ! অনুরোধ করলেন কেরোলিন। মেহমানদেরকেও সঙ্গ দেয়া। দরকার, মাতিয়ে রাখা দরকার, যাতে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে। একাজটা তোমার চেয়ে ভাল আর কেউ পারবে না।
কাঁধ ঝুলে পড়ল রবিনের। হতাশ হয়েছে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছাহ!
গুড বয়। উঠে গিয়ে প্যানট্রিতে ড্রয়ার ঘাটাঘাটি শুরু করলেন কেরোলিন। কয়েকটা পুরানো ম্যাপ এনে টেবিলে বিছালেন। আঙুল রেখে রেখে দেখিয়ে দিতে লাগলেন কোন কোন রাস্তা লিলির পছন্দ। শেষে বললেন, যে পথ ধরেই যাক, হট ম্প্রিঙের দিকেই যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ওদিকটাতেই যায়। গরম পানির ঝর্নাটার কথা বললেন তিনি।
দেখেছি ওটা আজকে, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। ভাবছে, ঠিক কোন জায়গাটায় হারিকেনকে নিয়ে গিয়েছিল লিলি?
ধরো ফোন এল, কিংবা লিলি ফিরে এল, কি করব তখন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
একজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ডকে বলবে ফাঁকা গুলি করতে। তাহলেই আমি আর মুসা বুঝব, লিলি নিরাপদে আছে। ফ্লেয়ার থাকলে ভাল হত, জ্বালতে পারতে।
আছে তো, কেরোলিন বললেন। এখানে ওঁসক জিনিসের দরকার হয়। তাই রাখি। ট্যাক রুমে আছে। ফাঁকা গুলি করার জন্যে অন্য কাউকে দরকার নেই, আমিই পারব।
হাসল কিশোর। তাহলে খুবই ভাল। হট স্প্রিঙের দিকেই যাব আমরা। চল, মুসা। চেয়ারের হেলানে ঝোলান জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলল সে।
চাঁদ উঠেছে। হলুদ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। র্যাঞ্চের এখানে ওখানে বিচিত্র নীল আর ধূসর ছায়ার খেলা। দূরে লাল আলো নেচে নেচে এগিয়ে যেতে দেখা। গেল, নিশ্চয় লুকের গাড়ির। দক্ষিণের মাঠের দিকে চলেছে ও।
কয়েক মিনিটেই ঘোড়া বের করে জিন পরিয়ে ফেলল কিশোর আর মুসা, সকালে যে দুটো নিয়েছিল ওরা সেগুলোকেই নিল। ক্যাকটাসের পিঠে চড়ল মুসা। জিজ্ঞেস করল, ওরাতো গেছে দক্ষিণে। আমরা?
উত্তরে, জবাব দিল কিশোর।
জেনারেলের পিঠে চড়ল সে। রাশ টেনে ইঙ্গিত দিতেই ছুটতে শুরু করল ঘোড়া। পিছু নিল ক্যাকটাস।
সকালে যে পথে গিয়েছিল ওরা সেপথেই এগোল।
ঠিক পথেই যাচ্ছি তো? মুসার প্রশ্ন। গাছপালার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। রাতের বেলা এসব জায়গা ভাল না, শুনেছি…
দোহাই তোমার, মুসা, ভূতের কথা শুরু করো না আবার!
চুপ হয়ে গেল মুসা।
তবে রাতের বেলা বনের চেহারাটা কিশোরেরও ভাল লাগছে না। টর্চের আলোয় কেমন ভূতুড়ে লাগছে পাইন গাছগুলোকে। ঠিক পথেই যাচ্ছি। সকালে এদিক দিয়েই গিয়েছিলাম।
ভাবতে ভাবতে চলেছে কিশোর। একসময় আনমনেই বলল, আশ্চর্য!
কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
এখানে আসার পর থেকেই একটার পর একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কাল রাতে ইউনিকর্নের কোরালের গেট কেউ খুলে রেখেছিল। এখন হারিয়ে গেল লিলি। হারনি পাইক এসে হুমকি দিয়ে গেল। লুক বোলান, এমনকি ব্রডও এমন আচরণ করছে, মনে হচ্ছে যেন কিছু লুকাতে চায়।
কিছু সন্দেহ করছ নাকি?
এই, কি হলো তোর? জেনারেলের ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কোন কারণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা।
কর্কশ একটা ডাক শোনা গেল। ডানা ঝাঁপটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বিরাট এক পেঁচা। মাথা ঝাড়ল জেনারেল, নাক দিয়ে শব্দ করল, লাফ দিল। সামনের দুপা তুলে। এক হাতে লাগাম ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল কিশোর, আরেক হাতে টর্চ। হাত নড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও সামনের পথের ওপর নড়তে লাগল।
কি হলো? মুসার ক্যাকটাসও অস্থির হয়ে উঠেছে।
বলতে গিয়েও বলতে পারল না কিশোর, গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন, এরকম একটা শব্দ করল। সামনের পথের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মূর্তি। নড়ছে না।
.
০৪.
লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে গেল কিশোর। বসে পড়ল পড়ে থাকা দেহটার পাশে। প্রথমেই নাড়ি দেখল। তারপর মুসাকে বলল, লিলি!
লিলির ওপর ঝুঁকল মুসা। বেঁচে আছে?
আছে। কাঁধ ধরে ঠেলা দিতে দিতে কিলোর ডাকল, লিলি, শুনতে পাচ্ছেন? এই লিলি?
উ! গোঙাল লিলি। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে খুলে গেল চোখের পাতা, আবার বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর? শুকনো ঠোঁটের ভেতর দিয়ে কোনমতে ফিসফিস করে বলল সে। আবার চোখ মেলল। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে… হাত চেপে ধরল কপালে।
নড়বেন না, কিশোর বলল। হাড়টাড় কিছু ভেঙে থাকতে পারে।
না, ভাঙেনি। টর্চের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে ওর চেহারা। ইস্, মনে হচ্ছে গায়ের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। নড়াতে পারছি না। নড়লেই ব্যথা লাগে… চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে।
বাড়িটাড়ি লাগিয়েছেন বোধহয় কোথাও। শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার কাপলিংকে নিয়ে আসি।
লাগবে না। এই প্রথম যেন অন্ধকার লক্ষ্য করল। অনেকক্ষণ ধরে এখানে আছি মনে হচ্ছে? ধরো, আমাকে, তোলো, তাহলেই হবে।
কিশোর আর মুসার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল লিলি। পা কাঁপছে। ওরা ছেড়ে দিলেই টলে পড়ে যাবে।
যেতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারব না কেন? কোনমতে উঠে বসতে পারলেই হয় ঘোড়ায়, কাঁপা গলায় বলল লিলি।
ক্যাকটাস শান্ত, তাই ওটার পিঠেই ওকে তুলে দিল মুসা আর কিশোর মিলে। ওরা উঠল জেনারেলের পিঠে। টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে এগোল পাহাড়ী পথ ধরে।
হারিকেন কোথায়? জিজ্ঞেস করল লিলি।
র্যাঞ্চে। একেবারে খেপে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে শান্ত করেছে লুক আর ব্রড।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল লিলি। সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদানীং ঘোড়াগুলো কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কিছু বুঝতে পারছি না।
কি করছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অদ্ভুত সব কাণ্ড। গত হপ্তায় খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল হারিকেন। মনে হচ্ছিল, ভয়ে ভয়ে আছে। সাধারণত ওরকম থাকে না। আজকে করল এই কাণ্ড… থেমে গেল লিলি।
আপনার কি হয়েছিল কিছু মনে আছে?
হারিকেনকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম। শুরু থেকেই কেমন নার্ভাস হয়ে ছিল ও, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিল। মনে হল, কোন কারণে লাগাম সহ্য করতে পারছে না। খুলে দিলাম। তারপরই মাঠের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এল আমাকে এখানে। বনের ভেতরে ঢুকে আরও অস্থির হয়ে গেল। কিছু শুনেছিল বোধহয়, বিপদ-টি পদ আঁচ করেছিল। একটা পাইনের জটলার কাছে গিয়ে লাথি মারতে শুরু করল মাটিতে, পিঠ বাকা করে আমাকে ফেলে দিতে চাইল। শেষে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠল। মাথায় বোধহয় ডালের বাড়িটাড়ি লেগেছিল আমার। তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম তোমাদেরকে। দুজনের দিকে তাকাল সে। থ্যাঙ্কস।
র্যাঞ্চের আলো চোখে পড়ল। খানিক পরে অনেকগুলো কণ্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে। একজন শ্রমিকের চোখে পড়ে গেল লিলি। ফ্লেয়ার জ্বালল লোকটা। হাউই বাজির মত আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেল ফ্লেয়ার, তীব্র নীল আলো। লিলিকে নিয়ে কিশোর আর মুসা চত্বরে ঢুকতে অনেকে এগিয়ে এল স্বাগত জানাতে।
কয়েক মিনিট পরে লিলি যখন ঘোড়া থেকে নামছে, চত্বরে এসে ঢুকল লুকের গাড়ি। দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে এল সে। লিলিকে দেখে স্বস্তির হাসি হাসল। এসেছ! কি ভয়টাই না পাইয়েছিলে…! সব ঠিক আছে তো?
মনে হয়, জবাব দিল লিলি।
কিশোরের দিকে তাকাল লুক। মনে হচ্ছে তোমার ব্যাপারে ভুল ধারণা করেছিলাম আমি, কিশোর পাশা। বেরিয়ে ভালই করেছ। তবে, এর পরের বার আমি যা বলব, শুনবে। যা করেছ, করেছ, পরের বার আর করবে না। মারাত্মক বিপদে পড়তে পারতে, তখন?
জবাব দিল না কিশোর।
হাঁ হয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। দুহাতে অ্যাপ্রন তুলে সিঁড়ি বেয়ে। দৌড়ে নেমে এলেন কেরোলিন। পেয়েছে! যাক! লিলিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর ঠেলে সরিয়ে মুখ দেখতে লাগলেন। ইসসি, এক্কেবারেই তো সাদা হয়ে গেছে! যাও, সোজা ঘরে…আমি ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।… কি ভয়টাই না দেখালে
যার যার ঘোড়ার জিন খুলে ঘোড়াগুলোকে আগের জায়গায় রেখে এল কিশোর আর মুসা। লিভিং রুমে ঢুকে দেখল, পুরানো একটা কাউচে বসে ডক্টর কাপলিঙের মেয়ের সঙ্গে মিউজিক নিয়ে আলোচনা করছে রবিন। ওদেরকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, পেয়েছ?
পেয়েছি। দোতলায় চলে গেছে। ভালই আছে, জানাল কিশোর। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন। চলো। শুনব।
কিশোর আর মুসাকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল সে। কাপে গরম কোকা নিয়ে একটা নিজে নিল, অন্য দুটোর একটা দিল কিশোরকে, একটা মুসাকে। বলো, কোথায় পেলে?
সব শোনার পর জিজ্ঞেস করল, হারিকেন এই শয়তানীটা কেন করল বলো। তো?
জানি না, কোকার কাপে চুমুক দিল কিশোর।
কিশোর এতে রহস্যের গন্ধ পেয়েছে, রবিনকে বলল মুসা।
সে আমি আগেই জানি, রবিন বলল। কাল রাতেই বুঝতে পেরেছি।
শ্রাগ করল কিশোর। দেখো, একটা কথা কি অস্বীকার করতে পারবে, কাল। থেকে কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে? লিলিও তাই বলছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিরেক আর পাইকের কথা আগের দিন যা যা শুনেছিল, সব দুই সহকারীকে খুলে বলল সে।
কোকা শেষ করে ওপরতলায় চলল তিন গোয়েন্দা। নিজেদের ঘরে যাওয়ার আগে লিলিকে দেখতে গেল। আস্তে করে ওর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে পাল্লা ঠেলে খুলল কিশোর। নাইটগাউন পরে বিছানায় বসে আছে লিলি।
ডাক্তার কি বললেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ইঙ্গিতে ওদেরকে চেয়ারে বসতে বলে লিলি বলল, ডাক্তাররা আর কি বলে? রেস্ট নিতে হবে কয়েক দিন। কিছু হলেই এছাড়া আর যেন কিছুই করার থাকে না মানুষের। আমি থাকব বসে? অসম্ভব! রোডিওর জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে। র্যাঞ্চটাকে বাঁচানর এটাই শেষ সুযোগ।
রবিন হেসে বলল, অত ভাবছেন কেন? আপনি যা এক্সপার্ট, কয়েকদিন প্র্যাকটিস করলেই আবার চালু হয়ে যাবেন।
হাসি ফুটল লিলির মুখে। তা পারব।
হারিকেনকে নিয়ে খেলতে গেলে, মুসা বলল, কার এমন ক্ষমতা, আপনাকে হারায়?
চুপ! আস্তে বলল, কৃত্রিম ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল লিলি, বেনি শুনতে পেলে মূৰ্ছা যাবে।
বাইরে মচ করে একটা শব্দ হলো। কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে ঘুরে তাকাল কিশোর। না, কেউ দরজা খুলছে না। আবার লিলির দিকে ফিরল সে। এই সময় বুটের শব্দ কানে এল, হালকা পায়ে হাঁটছে কেউ। কে? আড়ি পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল নাকি কেউ?
রবিন আর মুসাও শুনেছে শব্দটা। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদেরকে চুপ থাকতে ইশারা করে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল কিশোর। একটানে খুলে ফেলল পাল্লা। বাইরে উঁকি দিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লিলি।
সেটাই তো জানতে চাই আমি, মনে মনে বলল কিশোর। সন্দেহের কথাটা লিলিকে জানাল না। বলল, কিছু না। মনে হলো কেউ এসেছিল। দরজার কাছ থেকে সরছে না কিশোর। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অন্যান্য ঘরে মেহমানদের কথা শোনা যাচ্ছে, চলাফেরার শব্দ হচ্ছে। লিলির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, সব ঘরেই লোক আছে নাকি?
ভাবল লিলি। বেশির ভাগ ঘরেই আছে। কেন?
রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইল লিলি। তারপর বলল, কেরোলিন তোমাদের কথা সবই বলেছে আমাকে। অনেক জটিল রহস্যের। সমাধান নাকি করেছ তোমরা।
তা করেছি, ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল কিশোর।
রহস্যের গন্ধ যখন পেয়েই গেছ, সাহায্য করো না আমাকে।
কিভাবে?
এই যে অদ্ভুত কাণ্ডগুলো ঘটল, এগুলোর জবাব চাই আমি।
আমিও চাই। আপনি বলাতে আরও সুবিধে হলো আমাদের। দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিলোর। কি বলো?
একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন আর মুসা।
হয়তো দেখা যাবে কোন রহস্যই নেই, সব কাকতালীয় ঘটনা, লিলি বলল। তবে জানা দরকার, মন থেকে খুঁতখুতানি তো দূর হবে।
তা হবে, মাথা কাত করল কিশোর।
আচ্ছা, র্যাঞ্চটাকে স্যাবটাজ করতে চাইছে না তো কেউ?
অসম্ভব কি? চাইতেই পারে, শত্রু যখন আছে… কথাটা শেষ করল না। কিশোর। তাকাল লিলির দিকে। হারিকেনের কথা বলুন। এরকম আচরণ কেন করল কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?
আবার মচমচ শব্দ হলো। তারপর টোকা পড়ল দরজায়। খুলে গেল পাল্লা। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লুক বোলান। মুখে কাদা লেগে আছে। কাপড় ছেঁড়া। রাগে জ্বলছে চোখ।
কেন ওরকম করছে, আমাকে জিজ্ঞেস করো, আমি জবাব দিচ্ছি, রাগে প্রায় চিৎকার করে বলল লুক, সমস্ত ভদ্রতা দূর হয়ে গেছে কণ্ঠ থেকে, ওটা শয়তান! ভাইয়ের মত! সে জন্যেই করেছে! দুটোই শয়তান! আস্তাবলটাকে তছনছ করে। দিয়েছে! হ্যাঁ, যা বলতে এসেছি। ইউনিক শয়তানটা বেরিয়ে গেছে। ধরতে যাচ্ছি, সে কথাই বলতে এলাম।
লিলি কিছু বলার আগেই দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল সে। বুটের শব্দ ও তুলে চলে যেতে লাগল।
দুই লাফে দরজার কাছে চলে এল কিশোর। পাল্লা খুলে দেখল সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ফোরম্যান। পেছনে এসে দাঁড়াল রবিন আর মুসা। রবিন জিজ্ঞেস করল, ও ওরকম করল কেন?
ঘোড়াদুটোর ওপর ভীষণ খেপে গেছে, কিশোর বলল। শুনলে না, আস্তাবল তছনছ করে দিয়েছে বলল।
কি করবে এখন? মুসার প্রশ্ন।
তোমরা গিয়ে লিলির কাছে বসো, কিশোর বলল, আমি আসছি।
র্যাঞ্চ হাউসের বাইরে চতুরে যেন পাগল হয়ে উঠেছে সবাই। বাঙ্কহাউস, আস্তাবল আর গোলাঘরে ছোটাছুটি করছে শ্রমিকরা।
এগিয়ে গেল কিশোর। একটা পিকআপে উঠতে দেখল লুককে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে গেল গাড়িটা।
কি হয়েছে? একজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ডকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্রড। শার্টের একটা হাতা গুটিয়ে ওপরে তুলে রেখেছে। কনুইয়ের কাছে নীল একটা দাগ, ব্যথা পেয়েছে। জায়গাটা ডলছে সে। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানাল, ইউনিক পালিয়েছে! মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে ঘোড়ার খুরের শব্দ চলে যেতে শুনলাম।
আর শোনার অপেক্ষা করল না জনি আর আরেকজন তরুণ শ্রমিক। লাফ দিয়ে গিয়ে উঠল একটা জীপে। লুকের গাড়ির পিছু নিল। কিশোরও দেরি করল না। ছুটে এসে ঢুকল ট্যাক রুমে। টান দিয়ে একটা জিন নামিয়ে নিয়েই দৌড় দিল বেড়ার দিকে। ওকের জটলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ঘোড়া, গোলমাল শুনে কান খাড়া করে রেখেছে।
চাঁদের আলোয় জেনারেলকে চিনতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না কিশোরের। হাত নেড়ে ডাকল, এই জেনারেল, আয়, আয়। মুখ ফিরিয়ে কিশোরের দিকে তাকাল ঘোড়াটা। তারপর দুলকি চালে এগিয়ে এল। ওটার পিঠে জিন পরাল কিশোর। লাগামটা বেড়ার সঙ্গে বেধে আবার ছুটল ট্যাক রুমে। একটা টর্চ নিয়ে এল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, চলো, জলদি চলো। ওদেরকে ধরা চাই।
মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছোটাল কিলোর। অনেকটা এগিয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে ইউনিকর্ন। কিন্তু সে যাচ্ছে কোণাকুণি, পথ বাঁচবে, ধরে ফেলতে পারবে হয়ত ঘোড়াটাকে। দূরত্ব আর জেনারেলের গতির ওপরই নির্ভর করছে এখন সে।
জীপের হেডলাইট দেখতে পাচ্ছে। আরও আগে সামনের অন্ধকারকে চিরে দিয়েছে লুকের পিকআপের আলো।
ছুটে চলেছে জেনারেল। এদিক ওদিক ঘুরছে কিশোরের চঞ্চল দৃষ্টি। হঠাৎ চোখে পড়ল ওটাকে। একটা বিশাল ঘোড়ার অবয়ব, ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের পটভূমিতে কেমন ভূতুড়ে লাগছে ইউনিকর্নের চকচকে কালো শরীর।
চল, জেনারেল, চল, তাড়া দিল কিশোর। আরও জোরে। নইলে ধরতে পারবি না।
তীর বেগে ছুটল জেনারেল।
গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ইউনিকর্ন।
বনের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল লুকের পিকআপ।
জনও ব্রেক কষল।
পেছনে আরও ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডেকে বলল লুকের খসখসে কণ্ঠ, এই কিশোর, যেও না! আর যেও না! ওদিকে পথ ভাল না! খানাখন্দে ভরা। যেও না…
শুনল না কিশোর। জেনারেলের পিঠে প্রায় শুয়ে পড়ে হাঁটু দিয়ে চাপ দিতে লাগল আরও জোরে ছোটার জন্যে। ঢুকে পড়ল বনের ভেতরে। চাঁদের আলো এখানে ঠিকমত পৌঁছতে পারছে না। গিলে নিল যেন তাকে রাতের অন্ধকার।
টর্চ জ্বেলে ইউনিকর্নকে খুঁজতে শুরু করল সে। পলকের জন্যে দেখতে পেল। ঘোড়াটাকে, মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের আড়ালে। পিছু নিল জেনারেল। এরপর যতবারই ঘোড়াটার ওপর আলো ফেলে কিশোর, ততবারই দেখে মিলিয়ে যাচ্ছে ওটা। কিছুতেই কাছে আর যেতে পারছে না। খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে রেখে যাচ্ছে ইউনিকর্ন। নাকমুখ দিয়ে সেই ধুলো গলায় ঢুকে আটকে যাচ্ছে। কিশোরের, দম নেয়াটাই অস্বস্তিকর করে তুলেছে।
জেনারেল ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। একই দিনে তিন তিনবার এভাবে ছুটতে হয়েছে তাকে। ওর ঘামে ভেজা গলা চাপড়ে দিল কিশোর। সামনে অনেকটা ফাঁকা হয়ে এসেছে গাছপালা। আবার খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। পাহাড়ের গায়ে এখন কেবল শুকনো ঘাস।
হালকা ছায়া পড়েছে এখানে চাঁদের আলোয়, আশপাশের পাহাড় আর বনের জন্যেই বোধহয় হয়েছে এরকমটা। পাহাড়ী অঞ্চলে নানা রকম অদ্ভুত কাণ্ড করে আলো আর বাতাস, অনেক দেখেছে কিশোর, খোলা জায়গায় যেটা হয় না। সামনে দেখতে পেল এখন ইউনিকর্নকে। থমকে দাঁড়াল একবার ঘোড়াটা। বাতাস। উকে কিছু বোঝার চেষ্টা করল যেন। লাফিয়ে উঠল পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে। আবার ছুটল তীব্র গতিতে।
আগে বাড়ার জন্যে লাফ দিল জেনারেলও। দম আটকে গেল যেন কিশোরের। তার মনে হলো, ইউনিকনের পিঠে চড়ে বসে আছে একজন মানুষ। মানুষটাকে দেখতে পায়নি। আন্দাজ করেছে চাঁদের আলোয় কোন ধাতব জিনিস ঝিক করে উঠতে দেখে। ওই একবারই। আর দেখা গেল না।
আবার মনে পড়ল পাহাড়ী অঞ্চলে আলোর বিচিত্র কারসাজির কথা। চোখের ভুল না তো? ইউনিকনের পিঠে আরোহী? অসম্ভব।
কিশোরের মুখ ছুঁয়ে দামাল বেগে ছুটছে রাতের বাতাস। কোন দিকেই খেয়াল নেই ওর, তাকিয়ে রয়েছে ইউনিকনের পিঠের দিকে। আবার যদি দেখতে পায়। লোকটাকে? শিওর হতে পারবে তাহলে, সত্যিই আছে।
কিন্তু গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটছে ইউনিৰ্কন। হোঁচট খেল জেনারেল। হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আরেকটু হলেই, অনেক কষ্টে সামলে নিল। শেষ মুহূর্তে জিনের একটা শিং খামচে ধরে উড়ে গিয়ে পড়া থেকে বাঁচল কিশোর। পড়লে আর রক্ষা ছিল না। এত গতিতে এরকম উঁচুনিচু শক্ত জায়গায় পড়লে ঘাড় কিংবা। কোমর ভাঙা থেকে কোন অলৌকিক কারণে রক্ষা পেলেও, হাত-পা বাঁচাতে পারত না। ভয় পেয়ে গেল সে। আর ঝুঁকি নিল না। রাশ টেনে গতি কমাল ঘোড়ার।
পাহাড়ের ঢালের পথ ধরে ছুটছেই ইউনিকর্ন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিশোর। কোনমতে, শুধু একবার যদি কোন ভাবে দেখতে পেত আরোহীটাকে…
আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল কিশোরের। আরোহী দেখার জন্যে মনযোগ সেদিকে দিয়ে না রাখলে এটা আরও আগেই চোখে পড়ত। ইউনিকনের কিছুটা সামনে বেশ অন্ধকার, ঘাসে ঢাকা জমি থাকলে যেমন দেখায় তেমন নয়। কেমন একটা শূন্যতা।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝে ফেলল, ওখানে কিছু নেই! হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে পাহাড়, তারপরে বিশাল খাদ! এবং সেদিকেই ছুটে চলেছে ইউনিকর্ন!
গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা উঠে চলে এল যেন কিশোরের। জেনারেলের গায়ে। হাঁটু দিয়ে গুতো মারল জলদি ছোটার জন্যে। লাফ দিয়ে ছুটল ঘোড়াটা। চিত্তার করে উঠল কিশোর, থাম! থাম! বাতাসে হারিয়ে গেল তার চিৎকার। কানে ঢুকল না যেন ইউনিকনের।
খাদের কাছে পৌঁছে ব্রেক কষে দাঁড়ানর চেষ্টা করল ঘোড়াটা। পিছলে গেল পা। এত গতি এভাবে থামানো সম্ভব হলো না বোধহয়।
আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখল কিশোর, অন্ধকারে হারিয়ে গেল ইউনিকর্ন।
.
০৫.
খাদের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল জেনারেল। নিচে তাকাল কিশোর। খাদটা তেমন গভীর নয় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে ওইটুকু লাফিয়ে পড়েও আহত হতে পারে ইউনিকর্ন। খাদের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রুপালি সাপের মত চলে গেছে নদী।
জেনারেলের পিঠ থেকে নেমে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধল ওকে কিশোর। টর্চ জ্বেলে নামতে লাগল খাদের ঢাল বেয়ে। নদীর পারে এসে ইউনিকর্নের চিহ্ন খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুই পেল না।
কান পেতে খুরের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। শুনতে পেল না। ইউনিকর্ন কি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? তারপর ভাটি অথবা উজানে গিয়ে উঠে পড়েছে ডাঙায়? ওর পিঠের আরোহী ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে?
দুই দিকেই টর্চের আলো ফেলে দেখল সে। শেষে হতাশ হয়ে উঠে এল। আবার ওপরে। জেনারেলকে খুলে নিয়ে ফিরে চলল র্যাঞ্চে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর কথা ভাবছে।
বনের কিনারে যেখানে রেখে এসেছিল লুক বোলানকে, সেখানেই রয়েছে। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ব্রড় জেসন। কিশোরকে দেখে এগিয়ে এল। যাক, এসেছ। তোমার পিছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ধরতে পারলাম না। ইউনিক কোথায়?
হারিয়ে ফেলেছি। কি করে খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে। ইউনিকর্ন, খুলে বলল কিশোর।
হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল লুক। আজ আর কিছু করার নেই। অন্ধকারে পাব না। কাল দিনের বেলা খুঁজতে বেরোতে হবে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, পরের বার এসব ব্যাপারে তুমি নাক গলাতে আসবে না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দেবে।
লিলি আমাকে সাহায্য করতে বলেছে, গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিল কিশোর।
বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে গিয়ে গাড়িতে উঠল লুক। মোটামুটি যা বুঝতে পারল কিশোর তা হলো, এসব অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমস্যা। এদেরকে কিছু বোঝানো যায় না। নিজের ভালমন্দ বোঝে না।
ব্রডের পাশাপাশি র্যাঞ্চে ফিরে চলল কিশোর।
একসময় জিজ্ঞেস করল ব্রঙকে, আপনার সামনেই আস্তাবল থেকে পালিয়েছে ঘোড়াটা?
না।
আমি মনে করলাম…
বাধা দিয়ে ব্রড বলল, লাথি মেরে ফেলে দিল আমাকে। জখমটা দেখার জন্যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। আমি ওখানে থাকতেই পালাল ওটা।
তার মানে আপনি পালাতে দেখেননি?
কৌতূহল ফুটল ব্রডের চোখে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, না, তা দেখিনি।
অন্য কেউ দেখেছে?
বলতে পারব না। কেন?
না, ভাবছি, কেউ ওটাকে চালিয়ে নিয়ে গেল কিনা।
ইউনিকর্নকে? হেসে ফেলল ব্রড। অসম্ভব। ওর পিঠে কোন মানুষ চড়তে পারে না।
সে কথা আমিও শুনেছি। আবার ভাবনায় ডুবে গেল কিশোর।
চত্বরে ঢুকে ব্রড় বলল, দাও, জেনারেলকে আমিই রেখে আসি।
লাগবে না, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। ও এখন আমার দায়িত্বে আছে। আমিই দেখাশোনা করতে পারব। বহুবার বহু র্যাঞ্চে বেড়াতে গেছি। ঘোড়া। আমার অপরিচিত নয়।
শ্রাগ করল ব্রড। বেশ, যা ভাল বোঝে। মেহমানদের কথা আমাদেরকে রাখতেই হয়। তবে লুক যা বলেছে, মনে রেখ… উত্তেজিত ঘোড়ার পদশব্দ শুনে চুপ হয়ে গেল সে। আস্তাবলের দিকে তাকাল। আবার কি হল?
ব্রডের পিছু পিছু এগোল কিশোর। আস্তাবলে ঢুকল। আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরানো বাড়ির ভেতরটা। হারিকেনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কয়েকজন। শ্রমিক।
কি হয়েছে ওর? জিজ্ঞেস করল ব্রড।
বুঝতে পারছি না, বলল একজন চোয়াড়ে চেহারার ব্র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। মনে হচ্ছে। লুকের কথাই ঠিক। বদ রক্ত বেটাদের শরীরে।
কথাটা মানতে পারল না কিশোর। কিছু বলল না।
এই থাম, থাম, চুপ কর, মোলায়েম গলায় ঘোড়াটাকে বলল ব্রড়। ধীরে ধীরে ঢুকল স্টলের ভেতর।
সেই যে খেপেছে আর থামছে না, জানাল র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড।
এরকম করছে কেন বুঝতে পারছি না! অবাকই হয়েছে ব্রড।
লাথি মেরে মেরে খড় ছিটাচ্ছে হারিকেন।
খারাপ কিছু খেয়ে ফেলেছে বোধহয়, বলল কিশোর। ক্ষতি হয় এরকম কিছু।
ঝট করে তিনজোড়া চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। হতেই পারে না! বলল একজন, ঘোড়াকে খাওয়ানো হয় সব চেয়ে ভাল আর দামি খাবার, ঘোড়ার জন্যে যা পাওয়া যায়। নিজের হাতে খাওয়াই আমরা।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু হারিকেনের এই মেজাজের তো একটা ব্যাখ্যা থাকবে?
আছে, আরেকজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড বলল, বরক্ত। আর কোন কারণ নেই।
রাতারাতি ঘোড়ার স্বভাব বদলে যেতে পারে না।
তা পারে না, ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে ব্রড। তবে। একেবারেই ঘটে না এটা ঠিক নয়।
হয়ত ওর খাবারে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়েছে, বলল আবার কিশোর।
এই র্যাঞ্চের কেউই কোন ঘোড়ার সামান্যতম ক্ষতি করবে না, জোর দিয়ে কথাটা বলল ব্রড। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, লাথি মেরে থামিয়ে দিল হারিকেন।– ঠিকমত লাগেনি, সামান্য একটু ছুঁয়ে চলে গেল লাথিটা। সরে গেল সে। পরিষ্কার দেখতে পেল এবার কিশোর ঘোড়ার ডান খুরের ওপরে সাদা লোম।
ও যে একেবারে ইউনিকর্নের মত আচরণ করছে! বলল আরেকজন শ্রমিক।
আরে দূর, কি যে বলো, হাত নেড়ে বলল অন্য আরেকজন। ইউনিকর্ন। হ। ইউনিকর্ন যখন শান্ত থাকে তখনই এরকম শয়তানী করে।
এই, অত বকর বকর করো না, ধমক দিয়ে বলল ব্রড। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কাজ করতে হবে। লুক তোমাকে বলল না ঘোড়াটোড়া নিয়ে অত মাথা ঘামাবে না? আমাদের কাজ আমাদের করতে দাও।
কথা কানেই তুলল না কিশোর। রহস্যময় ঘটনাই ঘটছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই তার।
এর সমাধান করতেই হবে। সোজা এগিয়ে গেল ইউনিকর্নের স্টলের দিকে। ওটা খালি। লাথি মেরে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে খড়। ভেঙে ফেলা হয়েছে একটা স্টলের দরজা। ভাঙা কাঠে লেগে রয়েছে কালো কয়েকটা লোম, ঘোড়ার লোম। নাল পরান খুরের দাগ পড়েছে কয়েক জায়গায়। তবে যে বাক্সটায় খাবার। দেয়া হয় সেটা ঠিকই আছে দেখা যাচ্ছে। খড়, একটা ফিড ব্যাগ, একটা পানির বালতি, আর অর্ধেক খাওয়া একটা আপেল।
সব কিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। তাড়াতাড়ি রওনা হলো জেনারেল উইলি কেমন আছে দেখার জন্যে।
দিগন্তের দিকে হেলে পড়ছে চাঁদ। ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে মুখে। অবাক হয়ে ভাবছে, কেন ওরকম খারাপ হয়ে গেল একটা ঘোড়া? কি কারণে হতে পারে? অসুখ-টসুখ করেছে? নাকি কেউ আতঙ্কিত করে দিয়েছে হারিকেনকে।
ভালই আছে জেনারেল। ঘরে চলল কিশোর।
রান্নাঘরের দরজা ঠেলে খুলে দেখল টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে রবিন, মুসা, লিলি আর কেরোলিন। ওকে দেখে হাসল সবাই। রবিন বলল, এতক্ষণে এলে।
লিলিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার তো এখন শুয়ে থাকার কথা?
ঠিক বলেছ, সুর মেলালেন কেরোলিন। ডাক্তার কাপলিং জানলে রেগে। যাবেন।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। সবই বুঝি, কিন্তু বিছানায় থাকতে যে ইচ্ছে করে না!ইউনিকর্নকে ছাড়া রেখে কি ঘুম আসে? উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকাল সে। টেবিলে রাখা চায়ের কাপটা তুলল, হাত কাঁপছে। কিশোরকে বলল, এইমাত্র এসেছিল লুক। বলল, তুমি নাকি ইউনিকের। পিছু নিয়ে বনে ঢুকেছিলে। খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে ও।
সে রকমই মনে হলো, একটা চেয়ার টেনে বসল কিশোর। কি কি করে। এসেছে বলতে লাগল। বলা শেষে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করল লিলিকে। নিজেও গেল সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে কম্বলে গা ঢেকে লিলি বলল, কি বলে যে ধন্যবাদ দেব। তোমাকে…
শেষ করতে দিল না ওকে কিশোর, কি আর দেবেন? ধন্যবাদ পাওয়ার কাজ এখনও তো করতেই পারলাম না। ইউনিককে হারানো উচিত হয়নি আমার।
ওকে খুঁজে বের করবই আমরা, ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বলল লিলি। করতেই হবে।
নিজের ঘরে ফিরে এল কিশোর। অনেকক্ষণ ধরে গরম পানি দিয়ে গোসল করে ক্লান্তি অনেকটা দূর করে এসে ঢুকল রবিন আর মুসার ঘরে।
ওরা তখনও ঘুমায়নি।
কি ব্যাপার? ঘুম আসছে না? জিজ্ঞেস করল রবিন।
তোমরাও তো জেগে আছ।
তা আছি, হাই তুলল মুসা। আর বেশিক্ষণ থাকব না। তা কি ভেবে আবার এলে?,
এলাম। মনে উত্তেজনা থাকলে ঘুম আসতে চায় না তো, তাই…
তা বটে। ও, হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম, রবিন বলল, তুমি যাওয়ার পর ফিলিপ নিরেক ফোন করেছিল। লিলিকে চেয়েছিল। ওকে কি বলল সে জানি না, তবে মুখ কালো হয়ে যেতে দেখলাম লিলির। কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করেছি, বলল না। বলল, ও কিছু না। শুধু বলল, আগামী দিন পাইককে নিয়ে নিরেক এখানে আসবে কথা বলতে।
আরও খবর আছে, চোখ নাচিয়ে বলল মুসা।
তার মানে তোমরাও বসে থাকোনি, খুশি হয়ে বলল কিশোর। কি খবর?
কেরোলিনের আন্টির সঙ্গে অনেক কথা বলেছি আমি, রান্নাঘরে, মুসা বলল। ব্রড জেসন নাকি মহিলার বোনের ছেলে।
তাতে কি? রবিনের প্রশ্ন।
গাল চুলকাল মুসা। হয়তো কিছুই না। কিন্তু ডবসি কুপারের ওখানে কাজ করে এসে যদি আবার এখানে ঢোকে, খটকা লাগে না মনে? শুরু থেকেই তো ওর খালা ছিল এখানে, তখন ঢুকল না কেন?
হ্যাঁ, সত্যি খটকা লাগে, মুসার সঙ্গে একমত হয়ে বলল কিশোর।
কেরোলিনের আন্টি আরও বলেছেন, নিজের আঙুলের নখ দেখতে দেখতে বলল মুসা, কিছু দিন ধরেই নাকি অদ্ভুত আচরণ করছে ঘোড়াগুলো।
শুধু ঘোড়াই না, কিছু কিছু শ্রমিকও করছে, হাই তুলল কিশোর। এমন ভাব করছে, বোঝানর চেষ্টা করছে, যেন এক রাতেই নষ্ট হয়ে গেছে হারিকেন। ওদের এই কথা মানতে রাজি নই আমি। এবং ওরা যে ভুল করছে এটা প্রমাণ করে ছাড়ব।
.
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। কোরালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দেখতে লাগল ব্রডের কাজ। একটা ঘোড়ার বাচ্চাকে আরোহী নিতে শেখাচ্ছে। পিঠ বাঁকিয়ে, নেচেকুদে, ঝাড়া দিয়ে অনেক চেষ্টা করছে ঘোড়াটা ওকে পিঠ থেকে ফেলার, পারছে না।
কয়েক বছর আগে ব্রড ব্রংকো রাইডার ছিল, মুসা বলল। কিছু কিছু লোকাল রোডিওতে ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছে। কেরোলিন আন্টি বলেছেন আমাকে।
ছেড়ে এল কেন? জানতে চাইল কিশোর।
বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। জানার চেষ্টা করব নাকি?
কর। আস্তাবলের দিকে তাকাল কিশোর। ওখানে ঢুকে তদন্ত করে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন গিয়ে সুবিধে করতে পারবে না। অনেক লোক কাজ করছে ভেতরে বাইরে। ইউনিকনের স্টলে তদন্ত করতে হলে একা একা গিয়ে করতে হবে। কাউকে দেখান চলবে না। লুক আর জন গিয়ে ইউনিককে পেল কিনা কে জানে।
এই সময় দেখল লম্বা পাওয়ালা একটা মাদী ঘোড়ার পিঠে চেপে আসছে বেনি কুপার।
ব্রডের দিকে হাত নেড়ে ঘোড়া থেকে নামল বেনি। লাগামটা বাঁধল বেড়ায়। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?
ঘরে।
গিয়ে ওকে বলা দরকার, ইউনিকর্নকে দেখেছে আব্ব।
কোথায়? একসাথে জিজ্ঞেস করল তিন গোয়েন্দা।
আজ সকালে, আমাদের র্যাঞ্চের পশ্চিম ধারে। পাহাড়ে চলেছিল আব্বা তখন।
ও পালিয়েছে জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ব্রডের দিকে তাকাল বেনি। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, লুক বোলান ফোন করেছিল। ইউনিকর্নই কিনা শিওর না আব্বা, তবে ওরকমই, কালো, বিরাট একটা ঘোড়া।
চলো, রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।
গিয়ে কি করবে? ব্রড বলল, কয়েকজনকে নিয়ে লুক চলে গেছে অনেক আগেই।
আরও কয়েকজন গিয়ে খুঁজলে ক্ষতি হবে না।
কপালের ঘাম মুছল ব্রড। চলো, আমিও যাব।
তুমি থাক না? বেনি অনুরোধ করল।
দ্বিধায় পড়ে গেল ব্রড। ইতস্তত করে বলল, না, যাওয়াই উচিত। হাজার হলেও এই র্যাঞ্চে চাকরি করি আমি, যাওয়াটা আমার দায়িত্ব।
মিনিট বিশেক পরে পশ্চিমে কুপারদের র্যাঞ্চের দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর, মুসা আর ব্রড। কুপার র্যাঞ্চের পশ্চিমের পাহাড়ে কয়েক ঘন্টা ধরে খুঁজেও পেল না ঘোড়াটাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে ব্রড বলল, বুঝতে পারছি না। গেল কোথায়?
সীমাহীন পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। যে দিকেই তাকায়। সেদিকেই ঘন বন। এরকম জায়গায় সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে একটা ঘোড়া। মিস্টার কুপারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ওসব করতে যেও না, তাড়াতাড়ি বলল ব্রড। যা করার লিলিই করবে।
কেন, আমি করলে দোষ কি?
অস্বস্তিতে পড়ে গেছে যেন ব্রড। চোয়াল ডলল। তারপর বলল, কয়েক বছর ধরেই দুটো র্যাঞ্চের সম্পর্ক খারাপ। ডাবল সির কোন মেহমান গিয়ে কথা বলবে, এটা নিশ্চয় ভাল চোখে দেখবেন না মিস্টার কুপার। পারলে লিলি কিংবা লুক গিয়ে বলুকগে, তোমার দরকার নেই।
র্যাঞ্চে ফিরে এল ওরা। লুক ফিরছে। ইউনিকর্নকে আনতে পারেনি। কুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে আগেই, বেনি যা বলেছে মিস্টার কুপারও একই কথা বলেছে।
লুককে বলল ব্রড, কিশোর মিস্টার কুপারের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
শক্ত হয়ে গেল লুকের ঠোঁট। দেখো, কিশোর, তুমি সাহায্য করতে চাইছ বুঝতে পারছি, কিন্তু এটা তোমার কাজ নয়। আমার। কাজেই যা কিছু করার দায়িত্ব আমারই। লিলির আব্বা মরার সময় আমাকে এ-দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আরেকটা কথা, আমি চাই না, এখানে যে গোলমাল হচ্ছে এটা কুপার জেনে ফেলুক।
কেন?
তাহলে পেয়ে বসবে। আমাদের এখানে গোলমাল আছে শুনলে ঘাবড়ে যাবে মেহমানরা, থাকতে চাইবে না। কুপারের র্যাঞ্চে গিয়ে উঠবে। এটা হতে দিতে পারি না আমরা।
কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে বাঙ্কহাউসের দিকে রওনা হয়ে গেল লুক।
.
সেদিন বিকেলে ডাক্তারের আদেশ অমান্য করে নিচে নেমে এল লিলি। ঠিকমত পা ফেলতে পারে না, শক্ত হয়ে গেছে যেন জোড়াগুলো। ক্লান্তি আর উল্কণ্ঠায় চেহারা ফেকাসে। তবে আগের রাতের তুলনায় ভালই মনে হচ্ছে তাকে।
চলো, বারান্দায় বসে লেমোনেড খাই, তিন গোয়েন্দাকে প্রস্তাব দিল সে। বিছানায় আর যেতে পারব না।
বারান্দায় চেয়ার পেতে বসল চারজনে। গ্লাসে কয়েকবার চুমুক দিয়ে মুখ ফেরাল লিলি। বলল, শেরিফকে ফোন করে ইউনিকের কথা বলতে হবে। কারও চোখে পড়লেই তাহলে খোঁজ পেয়ে যাব আমরা।
যদি সেই লোকটা গিয়ে শেরিফকে বলে, কিশোর বলল। ডবসি কুপারের সঙ্গে কথা বলেছেন?
বলেছি। তবে আমার মনে হয় না ইউনিককে দেখেছ। কিশোরের চোখ দেখেই যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলল লিলি, মাথা নেড়ে বলল, না না, যা ভাবছ তা নয়। মিথ্যে বলেনি। তবে যেটাকে দেখেছে সেটা ইউনিক নয়, হয়তো কোন বুনো মাসট্যাংকে দেখেছে।
নাহ, কোন আলো দেখতে পাচ্ছি না, বিড়বিড় করে বলল রবিন। ইঞ্জিনের শব্দ শুনে তাকাল রাস্তার দিকে। ওইযে আসছে, আরও গোলমাল!
লম্বা সাদা একটা গাড়িকে আসতে দেখা গেল। ছুটে এসে বারান্দার কয়েক ফুট দূরে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। গাড়িটা দেখেই লিলির চেহারা আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
দরজা খুলে নামল ফিলিপ নিরেক আর হারনি পাইক। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল একজনের পেছনে আরেকজন।
লিলির সঙ্গে কথা বলার আগে কিশোরদের দিকে তাকিয়ে নিল একবার নিরেক, সুস্থ হয়ে গেছ নাকি।
অনেকটা, লিলি বলল।
নিরেকের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাইক। স্টেটসন হ্যাঁটের কানাটা যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর তার বন্ধুদের দিকে, চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। কত হলে জায়গাটা কিনতে পারব, শোনা যাক, জ্যাকেটের পকেট থেকে চেক বই বের করল সে। একলা কোথাও কথা বলা যাবে?
লিলিকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে সে, বুঝতে পারল লিলি। বলল, দরকার হবে না। আমার কোন আগ্রহ নেই।
কঠিন হয়ে গেল পাইকের চোয়াল। কিন্তু দামটা এখনও শোনইনি।
শুনতে চাইও না, চাঁছাছোলা জবাব দিল লিলি। এটা আমার বাপ-দাদার জায়গা, কোন কিছুর বিনিময়েই কারও কাছে বেচব না, যত দামই দিক না কেন।
কাজটা কিন্তু ঠিক করছ না, হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে বলল নিরেক।
উঠে দাঁড়াল লিলি। আপনাকে আমি বলেছি, ব্যাংকের ধার আমি শোধ করে দেব। সময় শেষ হয়নি, এখনই চাপাচাপি করছেন কেন? যান, জুলাইর পাঁচ তারিখে দিয়ে দেব।
কি করে দেবে? ঘোড়ায় চড়ার অবস্থা আছে নাকি তোমার?
আজ নেই, তবে যেদিন দরকার সেদিন ঠিকই থাকবে, সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, রেগে গেল লিলি। চোখ থাকলেই দেখতে পাবেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে। কঠোর কণ্ঠে নিতান্ত অভদ্র ভাবেই বলল, যান, বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে! এক্ষুণি!
০৬.
গটমট করে ঘরে ঢুকে গেল লিলি। পেছনে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা।
এটাই তোমার শেষ সুযোগ! চিৎকার করে বলল পাইক।
বোকা মেয়ে! শুয়োরের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল নিরেক। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে বোঝাও গে। তোমাদের তো বন্ধুই মনে হয়। বলো, পাইকের প্রস্তাব মেনে নিতে। এরকম একটা জায়গা থেকে এর বেশি আর কি আশা করে ও? শুনলাম, ঘোড়াটাও নাকি হারিয়েছে?
খারাপ কথা বাতাসের আগে চলে, আনমনেই বলল রবিন।
রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চাপল নিরেক। দামি যেটা ছিল সেটাও গেল। শুকনো কয়েকটা গর্ত আর ধসে পড়া বাড়ি ছাড়া শেষে আর কিছুই থাকবে না। ব্যাংক আর একটা কানাকড়িও দেবে না। সময় ফুরিয়েছে ওর।
ইউনিকর্নের কথা ভাবল কিশোর। সাংঘাতিক দামি একটা জানোয়ার।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে থামল নিরেক, ঘুরে তাকাল কিশোরের দিকে। শীতল এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেল। আরেকটা কথা, ঘোড়াটা পালিয়েছে একথা আমি বিশ্বাস করি না। লিলি নিজেই চালাকি করে এ কাজটা করেছে, যাতে ওটা পালাতে পারে।
কেন একাজ করবে? প্রশ্ন করল মুসা।
পাইকের দিকে তাকাল একবার নিরেক। বীমার টাকার জন্যে। অনেক টাকা বীমা করান হয়েছে ঘোড়াটার। কিন্তু লাভ হবে না। আমি নিজে চেষ্টা করব, যাতে সমস্ত শয়তানী ফাঁস হয়ে যায়, টাকা আদায় করতে না পারে কোম্পানির কাছ থেকে। জালিয়াতিটা ব্রা পড়লে জায়গা-সম্পত্তি তো যাবেই, জেলেও যেতে হবে। ওকে।
স্থির দৃষ্টিতে লোকদুটোর নেমে যাওয়া দেখল কিশোর।
ওগুলো মানুষ না কি! ঘৃণায় মুখ বাঁকাল রবিন।
জায়গাটা ওর এত দরকার কেন? নিজেকে প্রশ্ন করল যেন কিশোর। র্যাঞ্চের কি অভাব পড়ল নাকি এই এলাকায়? জায়গা তো আরও আছে।
হয়ত এরকম আর নেই, মুসা বলল।
হু! দুজনের দিকে তাকাল কিশোর। ইউনিকর্ন যেখানে লাফিয়ে পড়েছিল সে জায়গাটা দেখতে যাচ্ছি আমি। আসতে চাও?
নিশ্চয়, বলতে এক মুহূর্ত দেরি করল না রবিন।
মুসা মাথা নাড়ল। যাওয়ার তো খুবই ইচ্ছে। কিন্তু কেরোলিন আন্টিকে যে কথা দিয়ে ফেলেছি, বিকেলে রান্নাঘরে তাকে সাহায্য করব। পরে গেলে হয় না?
দেরি করা উচিত না, কিশোর বলল।
তাহলে আর কি করা, নিরাশ ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল মুসা। তোমরাই যাও।
রওনা হলো কিশোর আর রবিন। গোলাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রবিন বলল, লুক যদি দেখে ফেলে কি বলব?
জানি না। তবে ওর কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমরা।
.
ঘোড়ায় করে সেই শৈলশিরায় চলে এল ওরা, যেখান থেকে হারিয়েছে ইউনিকর্ন। মাটিতে নিজের বুটের আর ঘোড়াটার খুরের ছাপ দেখা গেল। গর্তের কিনারে যেখান থেকে লাফ দিয়েছে সেখানেও রয়েছে, কিন্তু তার পরে আর নেই। একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
মুসা হলে এখন জিনভূতের কাজ বলেই চালিয়ে দিত, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল রবিন।
নদীটা না থাকলে সত্যিই অবাক হতাম। নদীর কিনার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। পানি খুব কম। এটাতে লাফিয়ে পড়ে পানিতে পানিতে হেঁটে চলে যাওয়াটা ওর মত ঘোড়ার পক্ষে একেবারে অসম্ভব নয়।
এই চালাকি একটা ঘোড়া করল? প্রশ্ন তুলল রবিন। তীরে উঠে আবার মুছে দিয়ে গেল সব চিহ্ন?
হোঁচট খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। তাই তো! ভাল কথা বলেছ! এই কাজ মানুষ ছাড়া আর কারও পক্ষেই সম্ভব না!
এরপর ভালমত খুঁজতে শুরু করল ওরা। ঘোড়ার চিহ্ন যতটা না খুঁজল তার চেয়ে বেশি খুঁজল মানুষের চিহ্ন। নদীর পাড়ে উজান ভাটিতে বহুদূর পর্যন্ত দেখল। আশপাশের ঝোপ দেখল। কিছুই পাওয়া গেল না। কিছু না। কাপড়ের একটা ছেঁড়া টুকরোও না। কাটা ঝোপে লেগে নেই ঘোড়ার লোম। নদীর পাড়ের নরম মাটিতেও নেই কোন চিহ্ন।
ইউনিকর্নকে বোধহয় এতক্ষণে পেয়ে গেছে লুক, যেন কথার কথা বলল রবিন, গলায় জোর নেই।
কিছুই পেল না ওরা। হতাশ হয়ে ফিরে এল র্যাঞ্চে। রান্নাঘরে মুসা তো আছেই, লিলিও আছে। গলা শুকিয়ে গেছে। দুই গ্লাস সোডা নিয়ে বসল কিশোর আর রবিন। লিলিও সঙ্গ দিল ওদেরকে। একথা সেকথা থেকে চলে এল রোডিও খেলার কথায়। রোডিও রাইডিঙের আশ্চর্য রোমাঞ্চকর সব গল্প লিলির মুখে শুনতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
খাইছে! দারুণ খেলা তো! মুসা বলল, আমারও খেলতে ইচ্ছে করছে!
শুনতে যতটা মজা লাগছে, রবিন বলল, নিশ্চয়ই ততটা নয়। খুব কঠিন খেলা।
আসলে এগুলো একেক জনের কাছে একেক রকম। নেশার মত। নইলে এর চেয়ে বিপজ্জনক খেলা খেলে না লোকে? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও খেলে।
জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আস্তাবলের কাছে দেখা যাচ্ছে লুক। আর জনকে। ইউনিকর্ন নেই ওদের সঙ্গে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লিলিও তাকাল। তার ঘোড়ার লাগামটা জনের হাতে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল লুক।
রান্নাঘরের দরজা ঠেলে ফোরম্যান ঢুকতেই লিলি বলল, তাহলে পাওয়া যায়নি ওকে? রেসের ঘোড়া
নাহ! বুঝতেই পারছি না কোথায় গেল! রুমাল বের করে ভুরুতে লেগে থাকা ঘাম আর ধুলো মুছল লুক। রোদে শুকিয়ে গেছে চামড়া। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর তো খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা করবে না, নাকি? বুঝতেই পারছ এসব তোমাদের কাজ নয়। নদীর পাড়ে তোমার বুটের ছাপই মনে হয় দেখেছি, কাল রাতের…
ও আমাদের সাহায্য করতে চাইছে লুক, লিলি বলল। আমি সাহায্য। চেয়েছি। শেরিফের অফিসে গিয়েছিলে?
না। ফোনও করিনি।
ভুরু কুঁচকে ফেলল লিলি। কেন?
করে কোন লাভ হত না। বরং খারাপ হত। গুজব ছড়াত বেশি, অনেক বেশি লোকে জানত, বদনাম বেশি হত র্যাঞ্চের।
কিন্তু কারও চোখে পড়লে…।
আশপাশের সব র্যাঞ্চারদের খবর দিয়ে দিয়েছি। কাজ হলে ওদেরকে দিয়েই হবে। লিলির দিকে তাকিয়ে কোমল হলো লুকের দৃষ্টি। ভেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে পাবই আমরা।
পেলেই ভাল। কোলের ওপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল লিলি।
.
ডিনার শেষে সেদিন ক্যানু রেসের জন্যে তৈরি হতে লাগল মেহমানেরা। এই সুযোগে আস্তাবলে গিয়ে একবার তদন্ত চালিয়ে আসা যায়, ভেবে খুশি হয়ে উঠল। কিশোর। সুর্য তখনও ডোবেনি। ইতিমধ্যেই কাজের গতি কমে এসেছে। শ্রমিকদের। কয়েকজন ছুটি নিয়ে শহরেও চলে গেছে। শান্ত হয়ে গেছে র্যাঞ্চ। মুসার কানে কানে বলল কিশোর, আমাকে কভার দাও।
কি করবে?
পাহারা দাও তুমি। কয়েক মিনিট লাগবে আমার। ইউনিকর্নের স্টলটায় ভাল করে দেখতে চাই একবার।
ছায়ার মত এসে নিঃশব্দে আস্তাবলটাতে ঢুকল কিশোর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কয়েকটা ঘোড়া। ভেতরে আলো কম, কিন্তু বাতি জ্বালল না সে। বরং পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালল।
আগের বার যেমন দেখেছিল তেমনি রয়েছে ইউনিকর্নের স্টল। কোন সূত্র নেই। সাবধানে সিমেন্টের মেঝেতে আলো ফেলে দেখতে লাগল সে। আলো ফেলল দেয়ালে, ঘরের আড়ায়। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। বেরিয়ে এসে পাশের অন্য স্টলগুলোতে অনুসন্ধান চালাল। নাকি স্বরে ডাকল কয়েকটা ঘোড়া, নাল লাগান খুর ঠকল কঠিন মেঝেতে।
ঘড়ি দেখল কিশোর। পনের মিনিট পার করে দিয়েছে। বেরিয়ে যাওয়া দরকার, নইলে সে কোথায় গেল ভেবে সন্দেহ করে বসতে পারে কেউ।
ফেরার জন্যে ঘুরল কিশোর। হারিকেনের স্টলটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির হয়ে আছে ঘোড়াটা। মাটিতে পা ঠুকছে রাগত ভঙ্গিতে।
ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করে উঠল কিশোরের। রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। এরকম করছে কেন ঘোড়াটা? ওকে দেখে? নাকি অন্য কেউ আছে ভেতরে? টর্চ নিভিয়ে দিয়ে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল সে। কান খাড়া করে রেখেছে।
বাঙ্কহাউসে হাসছে কেউ। খুর দিয়ে খড় সরাচ্ছে হারিকেন, মাঝে মাঝে নাকি ডাক ছাড়ছে মৃদু স্বরে। এছাড়া আর কিছু নেই। কাউকে দেখা গেল না আস্তাবলে।
কয়েক সেকেণ্ড পরে টর্চ জ্বালল কিশোর। আলো ফেলে তাকাল হারিকেনের স্টলের ভেতর। মাথার সঙ্গে কান লেপ্টে ফেলেছে ঘোড়াটা, বড় বড় করে ফেলেছে। নাকের ফুটো, পেছনে সরে গেছে যতটা সম্ভব। ওর মুখে আলো ফেলল কিশোর, তারপর পায়ে, আরও সরে যাওয়ার চেষ্টা করল হারিকেন।
পেছনে একটা শব্দ হলো। ধক করে উঠল কিশোরের বুক। ফিরে তাকাতে গেল। প্রচণ্ড আঘাত লাগল মাথায়। একই সময়ে খুলে যেতে লাগল স্টলের দরজা। চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠল যেন তার।
ফিরে তাকাল সে। মুখে এসে লাগল রুপার বালসওয়ালা একটা বেল্টের বাড়ি। লাফিয়ে পাশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও আঘাতটা এড়াতে পারল না।
বেহুশ হয়ে স্টলের ভোলা দরজা দিয়ে ভেতরে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দেখতে পেল, পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠছে ঘোড়াটা। প্রবল। বেগে সামনের দুই পা নামিয়ে আনবে হয়ত তার ওপর, খুর দিয়ে গেঁথে ফেলবে পেট, বুক। কিন্তু কিছুই করার নেই তার।
.
০৭.
কিশোর! কিশোর! বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল মুসার কণ্ঠ।
চোখ মেলার চেষ্টা করল কিশোর। তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল মাথার একপাশে। দুর্বল কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল, মুসা, আমি এখানে! স্বর বেরোল না। চোখ মেলল। আস্তাবলের একধারে উজ্জ্বল আলোর নিচে পড়ে আছে সে, মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মুসা আর রবিন।
যাক, খুলেছে, মুসা বলল। কি হয়েছিল, কিশোর?
মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে কিশোর বলল, কে জানি বাড়ি মেরেছে।
কে? জানতে চাইল রবিন।
চোখ কুঁচকাল কিশোর। মাথা ঝাঁকাল। জানি না। কেবল একটা রুপার বাস দেখেছি। হারিকেনের স্টলের সামনে ছিলাম। দরজা খুলে গেল। ভেতরে পড়ে গেলাম।
মুসা বলল, দরজাটা এখন লাগানো। ঘোড়াটাও ভেতরেই রয়েছে।
যে মেরেছে তাহলে সেই টেনে সরিয়ে এনেছে।
তার মানে খুন করার ইচ্ছে ছিল না, বিড়বিড় করল রবিন। ঠিক আছে, থাক, আমি ডাক্তার কাপলিংকে ডেকে আনি।
না, লাগবে না। আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি। মিথ্যে বলেনি কিশোর। চোখে। আলো সয়ে আসতেই মাথার দপদপানিটা কমতে লাগল। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল। আরও পরিষ্কার হয়ে এল মাথার ভেতরটা।
সত্যি লাগবে না? ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
না। মাথার ব্যথাটা থাকবে কিছুক্ষণ, বুঝতে পারছি। এক-আধটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলেই সেরে যাবে।
ডাক্তারে দেখলে অসুবিধে তো কিছু নেই? জোর করতে লাগল রবিন। কিছুতেই কিশোরকে রাজি করাতে না পেরে উঠে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। তিনজনে বেরিয়ে এল আস্তাবল থেকে। বিকেলের বাতাস একগোছা কোঁকড়া চুল উড়িয়ে এনে ফেলল কিশোরের মুখে। সরানর চেষ্টা করল না সে। বাতাসটা ভাল লাগছে। বলল, কেন মারা হলো আমাকে বুঝতে পারছ তো? কেউ একজন চাইছে না, আমরা তদন্ত করি। হয়ত সূত্রটুত্র রয়ে গেছিল, সরিয়ে ফেলতে এসেছে।
কে? মুসার প্রশ্ন।
সেটা তো আমারও জিজ্ঞাসা। ব্রড জেসন নয়। ক্যানু রেসের জোগাড় করতে লেকে চলে গেছে সে।
কিন্তু গেছে যে দশ মিনিটও হয়নি, রবিন জানাল। আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলে গেছে।
কেন? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোর।
বাঙ্কহাউসে গিয়েছিল কিছু সেফটি ইকু্যইমেন্ট আনার জন্যে। কেউ পানিতে পড়লে নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বাড়তি লাইফ প্রিজারভার আর প্লেয়ারও নিয়েছে। সাথে গিয়েছিল বেনি আর ওর বাবা। ওরা অবশ্য এখন চলে গেছে।
চমৎকার, দাঁড়িয়ে গেছে কিশোর। লুকের খবর কি?
মাথা নাড়ল মুসা। কেরোলিনের আন্টির সঙ্গে বসে তাড়াহুড়ো করে এক কাপ কফি খেয়ে বেরিয়ে গেল, জরুরী কাজ নাকি আছে। এক প্লেট পাই সাধাসাধি। করলাম, নিল না। তাকালই না বলতে গেলে।
আরও চমৎকার। ওরকম করে দেখতে গেলে সবাইকেই সন্দেহ করতে হবে। কাউকে বাদ দেয়া চলবে না। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তারমানে অনেক বেশি জটিল করে তুলছে রহস্যটা সবাই মিলে।
কিশোর, হেসে বলল রবিন, গোয়েন্দাগিরি যে কঠিন কাজ তোমার চেয়ে বেশি তো কেউ আর জানে না। আর যত জটিল হয় রহস্য ততই মজা, তুমিই বল?
.
পরদিন সকাল সকাল বিছানা ছাড়ল কিশোর। গোসল সেরে নিয়ে এসে নীল জিনস পরল, গায়ে চড়াল টি-শার্ট, পায়ে রানিং শু। নাস্তা করতে চলেছে, এই সময় দেখা হয়ে গেল লিলির সঙ্গে।
আমাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার, লিলি জানাল। আর বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে না।
ভাল খবর।
আবার প্র্যাকটিস শুরু করতে পারব, উজ্জ্বল হাসিতে বেরিয়ে পড়ল ওর ঝকঝকে সাদা দাঁত।
একসাথে নিচে নামল দুজনে। সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল লিলি, বলল, যাবে নাকি? শ্রমিকদের কাজ দেখবে।
যাব।
গোলাঘরের কাছে এল ওরা। গরুঘোড়াগুলোকে ঠিকমত খাওয়ানো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে জেনে নিল লিলি। আরেক দিকে চলল। চোখেমুখে রোদ লাগছে, আপনাআপনি কুঁচকে গেল কিশোরের চোখ। ইতিমধ্যেই গরম হয়ে। উঠেছে সকালটা। ঘোড়ার ওষুধপত্র কোথায় রাখেন? জিজ্ঞেস করল সে।
বেশির ভাগই ট্যাক রুমে, লিলি বলল। এককোণে একটা আলমারি আছে।
কি কি রাখেন?
সব ধরনের ওষুধ, জন্তু জানোয়ারের জন্যে যা যা লাগে–ভিটামিন, অয়েন্টমেন্ট, লিনিমেন্ট, ব্যাণ্ডেজ, আরও অনেক জিনিস। জখম হলে যা দরকার, সবই আছে। সবুজ চোখের তারা স্থির হল কিশোরের মুখে। কেন বলো তো?
ভাবছি, হারিকেনের এই যে মেজাজ বদলে গেল, ওষুধের জন্যে নয় তো? ড্রাগ?
হেসে উঠল লিলি। আমার তা মনে হয় না। একাজ করতে যাবে কেন?
যাবে আপনি যাতে রোডিও খেলায় যোগ না দিতে পারেন।
আমার তা মনে হয় না। এতবড় পাষণ্ড হবে না কেউ, আমাকে ঠেকানোর জন্যে ঘোড়ার সর্বনাশ করবে।
মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। আর সেই লোকই হয়তো চুরি করে নিয়ে গেছে ইউনিকর্নকে।
চুরি? কে বলল? সে তো পালিয়েছে। ব্রড নিজের চোখে দেখেছে।
না দেখেনি, শব্দ শুনেছে। আমি যখন পিছু নিলাম, বনের মধ্যে ওর পিঠে মানুষ দেখলাম বলে মনে হলো।
অন্ধকার ছিল। তোমার ভুলও হতে পারে।
সেজন্যেই তো জোর দিয়ে বলতে পারছি না কিছু।
মাথা ঝাঁকি দিল লিলি। ছড়িয়ে পড়ল লাল চুল। রোদে ঝিকমিক করে উঠল। এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না, কিশোর। ইউনিকের পিঠে কোন। মানুষ চড়তে পারে না। চল, নাস্তাটা সেরে নিই। তারপর পাহাড়ে যাব। কোন জায়গায় হারিয়েছে ঘোড়াটা, দেখব।
.
শৈলশিরার নিচে দিয়ে বয়ে যাওয়া, নদীটাকে এই দিনের বেলাতেও রুপালিই লাগছে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা।
তুমি বলছ, গোল গোল হয়ে গেছে রবিনের চোখ, ঘোড়াটা এখান থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়েছে? জখম হয়নি?
তা হতে পারে, জবাবটা দিল লিলি। স্টেটসন হ্যাট মাথায় দিয়েছে। কানার নিচে কাছাকাছি হল ভুরুজোড়া। তবে ওর আন্দাজ খুব ভাল। হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলে। আজ পর্যন্ত ওকে উল্টোপাল্টা পা ফেলতে দেখিনি। কিন্তু গেল কোথায়? মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পর তো ফিরে আসার কথা। যত বদমেজাজীই হোক, বাড়ি ছেড়ে থাকার কথা নয়।
ফিরত, যদি চুরি না হত, কিশোর বলল।
কিন্তু কেন চুরি করবে?
আপনি না বললেন, ও আপনার র্যাঞ্চের সব চেয়ে দামি সম্পদ?
লিলির চোখের পাতা সরু হয়ে এল। তাতে কি? নাহয় নিয়ে যাওয়ার কুমতলব হলই কারও, কিন্তু নিয়ে গিয়ে তো সামলাতে পারবে না। ডাবল সির হাতে গোনা কয়েকজন মানাতে পারে ওকে। তাছাড়া ইউনিকের মত একটা জানোয়ারকে চুরি করে নিয়ে বেশিদিন লুকিয়ে রাখাও অসম্ভব।
নতুন কিছু দেখার নেই। লাঞ্চের জন্যে ফিরল ওরা।
দুপুরের খাওয়ার পর ঠিক করল কিশোর, কুপারের সাথে দেখা করতে যাবে। লুকের নিষেধ মানবে না। তাকে জিজ্ঞেস করবে, সত্যিই ঘোড়াটাকে দেখছে। কিনা। দুই সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, যেতে চাও?
মুসা বলল, পরে গেলে হয় না? আমি আর রবিন ভাবছিলাম লেকে গিয়ে সাঁতার কাটব।
প্রস্তাবটা কিশোরের কাছেও লোভনীয় মনে হলো। এই গরমে লেকের ঠাণ্ডা পানিতে বেশ আরাম লাগবে। কিন্তু কাজটা আগে করা দরকার। একাই কুপারের র্যাঞ্চে চলল।
চত্বর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল গটমট করে দুজন মেহমান এগিয়ে যাচ্ছে একটা কোরালের দিকে, যেখানে একটা ঘোড়া নিয়ে প্র্যাকটিস করছে লিলি। লাল হয়ে গেছে ওদের মুখ। হাত নাড়ল রাগত ভঙ্গিতে।
হলটা কি, ভাবল কিশোর। জানার জন্যে এগোল কোরালের দিকে।
বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াল লিলি, সে রয়েছে ভেতরে, বাইরের দিকে দাঁড়াল মেহমানরা। একজন বলল, তুমি কি করবে না করবে জানি না। তবে এই চুরির কথা পুলিশকে জানাবই আমরা।
চুরি?
হ্যাঁ, বলল আরেক মেহমান, সে মহিলা, আমার পার্স চুরি হয়েছে, আমার স্বামীর মানিব্যাগ চুরি হয়েছে।
সত্যি?
তো কি মিথ্যে বলছি নাকি! জ্বলে উঠল মহিলার চোখ। আজ সকালেও আলমারির ড্রয়ারে দেখেছি। নিশ্চয় তোমার কোন কাউবয় ঢুকে চুরি করে নিয়ে গেছে।
ছাই হয়ে গেল লিলির মুখ। মিসেস ব্যানার, একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। এখানকার সবাই খুব ভাল মানুষ।
তাহলে কে নিল? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মহিলা।
দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছেন কেরোলিন। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। এগিয়ে এসে হাতের জিনিসগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো খুঁজছেন তো আপনারা?
হ্যাঁ, কেরোলিনের বাড়ান হাত থেকে ছোঁ মেরে পার্স আর মানিব্যাগটা নিয়ে নিল মিসেস ব্যানার। কোথায় পেলেন?
দ্বিধা করলেন কেরোলিন। অস্বস্তিভরে তাকালেন প্রথমে কিশোরের দিকে, তারপর লিলির দিকে। কিশোরের ঘরটা পরিষ্কার করছিলাম। বিছানায় রাখা ছিল ওর ব্যাগটা। সরাতে যেতেই কাত হয়ে গেল, আর ওটার ভেতর থেকে পড়ল এদুটো।
বলেন কি? চমকে গেল কিশোর।
শয়তানটা তাহলে তুমিই! কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখে আগুন জ্বলে উঠল মিসেস ব্যানারের। এসব করে পার পাবে ভেবেছ? পুলিশকে অবশ্যই জানাব, যাতে তোমাকে ধরে নিয়ে যায়।
.
০৮.
এতটাই অবাক হয়েছে কিশোর, কথাই সরল না কয়েক সেকেণ্ড। তারপর কোনমতে বলল, আ-আমি কিছু জানি না….আপনার জিনিস আমার ঘরে গেল কি করে?…আশ্চর্য!
দুর থেকে দেখেই কিছু সন্দেহ করেছিল রবিন আর মুসা, এগিয়ে এল শোনার জন্যে। সব শুনে রেগে গিয়ে রবিন বলল, কিশোর চোর না! ওকে যে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মিসেস ব্যানার। তারপর পার্স আর মানিব্যাগের টাকা আর জিনিসপত্র দেখে নিয়ে বলল, সব ঠিকই আছে মনে হয়। যাই হোক, একথা আমি ভুলব না। মানিব্যাগটা স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেখ, ঠিক আছে কিনা।
টাকা গুনে নিয়ে মাথা কাত করল মিস্টার ব্যানার, ঠিকই আছে।
ওরা দুজন চলে গেলে লিলি বলল, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কে ঘটাচ্ছে এসব ধরতেই হবে। পিঠ সোজা করে হেঁটে চলেছে মিস্টার আর মিসেস ব্যানার, সেদিকে তাকিয়ে বলল, এমন কাণ্ড এই র্যাঞ্চে কোনদিন হয়নি। কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি পারছি, মুসা বলল। নিশ্চয় সত্যের খুব কাছাকাছি চলে গেছে কিশোর, তাই তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা চলছে।
কিশোরের বাহুতে হাত রাখলেন কেরোলিন, বিশ্বাস করো, তোমাকে দোষ দিইনি আমি। আমিও বিশ্বাস করি না তুমি একাজ করেছ।
হাসল কিশোর। আমি কিছু মনে করিনি। তবে যে একাজ করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। ধরবই।
তাই কর, লিলি বলল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন কেরোলিন, সর্বনাশ! এখুনি গিয়ে রান্না বসাতে হবে, নইলে রাতে ঠিকমত খাবারই দিতে পারব না।
সাহায্য-টাহায্য লাগবে আজকে? কেরোলিনকে জিজ্ঞেস করল রবিন। তাহলে আমি আর মুসা করতে পারি…
বাধা দিয়ে মুসা বলল, আসলে, আমার আজ…
করতে ভাল লাগছে না তো? মুসার ইচ্ছে বুঝতে পেরে হাসলেন কেরোলিন। কিন্তু বাবা, আজকে যে আমার সাহায্য দরকার। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বেতার ওপর স্পেশাল একটা ডিশ করতে যাচ্ছি। একা সামলাতে পারব না। একজন অন্তত এসো।
এই অনুরোধের পর আর কথা চলে না। রবিন, মুসা দুজনেই চলল কেরোলিনের সঙ্গে। ওরা রওনা হয়ে গেলে ডেকে বলল কিশোর, যাও তোমরা। আমিও আসছি।
লিলি বলল, মিসেস ব্যানারের ব্যবহারটা দেখলে? কিশোর বলল, ওরকম চুরি হলে আমিও করতাম। তাকে দোষ দিতে পারছি না। আমার কথা ভেবে যদি লজ্জা পেয়ে থাকেন, ভুলে যান। এসব অভ্যাস আছে আমার। এর চেয়ে বেশি অপমানও হয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত জবাব দিয়ে তারপর ছেড়েছি। এবারেও তাই করব। আসলে, কারও বিপদের কারণ হয়ে উঠেছি আমি। সেজন্যেই চাইছে না আমি তদন্ত করি। ভয় পেয়ে গেছে। থামাতে চাইছে। ইউনিকর্নকে কে পালাতে সাহায্য করে থাকতে পারে কিছু আন্দাজ করতে পারেন?
ও একা একা পালিয়েছে এটা মেনে নিতে পারছ না?
আপনি পারছেন?
শ্রাগ করল লিলি। না, আমিও অবশ্য পারছি না। তবে পুরো ব্যাপারটাই যেন কেমন! কোন চিহ্ন নেই, কিছু নেই…একেবারে হাওয়া!
বনবন করে ঘুরছে যেন কিশোরের মগজের চাকাগুলো। দুটো ব্যাপার হতে পারে। হয় আপনাআপনিই পালিয়েছিল ইউনিকর্ন, সেটাকে কাজে লাগিয়েছে যে ওকে চুরি করেছে। পালানর পর কোনভাবে ধরে তার পিঠে চেপেছে। নয়তো পালাতে সাহায্য করেছে প্ল্যান করেই।
কাকে সন্দেহ করছ? ব্রড জেসন? নিচের ঠোঁটে কামড় দিল লিলি।
হতে পারে। কিংবা এমন কেউ হতে পারে, যে আপনাকে ইনডিপেনডেন্স ডের রোডিওতে শরিক হতে দিতে চায় না। আমার ধারণা, ইউনিকর্নের পালান আর হারিকেনের খেপে যাওয়ার পেছনে একই কারণ। দুটো ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক। আছে।
কি?
এখনও জানি না। কিন্তু ইউনিক আর হারিকেনকে ছাড়া আপনি না পারবেন ঘোড়ার বাচ্চা বিক্রি করে টাকা দিতে, না পারবেন রেডিওতে জিতে টাকা জোগাড় করতে। ধার আর শোধ করা হবে না আপনার। ধার যাতে শোধ করতে না পারেন তার জন্যেও এসব করা হয়ে থাকতে পারে।
হু, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি।
বেড়ায় হেলান দিল কিশোর। পাইককে বলতে শুনেছি, যেভাবেই হোক, র্যাঞ্চটা আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেবেই। নিরেকের কাছে বলেছে।
সে-ই এর পেছনে নয় তো?
সরাসরি হ্যাঁ না বলে কিশোর বলল, ওর সম্পর্কে আরও জানতে হবে আমাকে।
মুখ বাঁকাল লিলি। আমি আর জানতে চাই না। যত কম জানি ততই ভাল। আমার জন্যে। ওই লোকটাকে দেখলেই ভয় লাগে আমার। কেঁপে উঠল সে। কোনদিনই র্যাঞ্চ আমি ওর কাছে বেচব না। আকাশের দিকে তাকাল। এক রত্তি মেঘ নেই কোথাও। আজ রাতেই আমি ঘোষণা করে দেব, আবার রোডিও খেলব। আমি। এখন কেবল ইউনিকর্নকে দরকার আমার। ওকে পেতেই হবে।
পাব। খুঁজে বের করব, কথা দিল ওকে কিশোর। ডবসি কুপারের র্যাঞ্চে যাব। আমি। তাকে জিজ্ঞেস করব সত্যিই ইউনিকর্নকে দেখেছে কিনা।
আমার বিশ্বাস হয় না, লিলি বলল। অন্য কোন ঘোড়া দেখেছে কুপার। ইউনিককে নয়।
তবু, কথা আমি বলতে যাবই।
যাওয়ার দরকার নেই। আজ রাতে বারবিকিউ পার্টিতে দাওয়াত করেছি, আসবে। বেড়ার ওপরের রেইলে চাপড় মারল লিলি। যাই, কাজ করিগে। পরে কথা হবে।
বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। কিছুদূর যাওয়ার পর আস্তাবলের দিক থেকে ব্রডকে যেতে দেখে সেদিকে এগোল। কাঁধের ওপর দিয়ে একবার ঘুরে তাকিয়ে গিয়ে একটা স্টেশন ওয়াগনে উঠে চালিয়ে নিয়ে চলে গেল লোকটা। আরেকবার আস্তাবলের ভেতরে দেখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।
আস্তাবলের ভেতরে অন্ধকার, শান্ত, কেমন একটা তেলতেলে গন্ধ। ঘোড়াগুলো সব বাইরে। সোজা ইউনিকনের স্টলের দিকে এগোল কিশোর। সব আগের মতই রয়েছে, কিছুই বদল হয়নি। খড় ছড়ানো, খাবারের বাক্সটা অর্ধেক ভরা, হুকে ঝোলান পানির বালতি, দরজার পাল্লা ভাঙা। মেরামত করা হয়নি। একবার দেখে। ঘুরতে যাবে এই সময় মনে হলো কি যেন একটা বাদ পড়েছে। কিংবা কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, সব ঠিকঠাক নেই। ভাল করে আরেকবার দেখল সে। কই, সবই তো ঠিক আছে? সত্যিই আছে তো?
আনমনেই একবার ভ্রূকুটি করে হারিকেনের স্টলের দিকে তাকাল সে। ওটাও একই রকম রয়েছে, কেবল খড়ের রঙটা অন্য রকম লাগছে। বদলানো হয়েছে। বোধহয়।
কিশোরের মন বলছে, মূল্যবান একটা সূত্র রয়েছে আস্তাবলের ভেতরে। নজরে পড়ছে না। গভীর ভাবনায় ডুবে থেকেই আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল সে, রওনা হল বাড়ির দিকে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল কাজ করছে মুসা আর রবিন।
ময়দা মাখাচ্ছে মুসা। রবিন পেঁয়াজ কুচি করছে। সসপ্যানে মাংস ভাজছেন। কেরোলিন।
আমি কোন সাহায্য করতে পারি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নিশ্চয়, জবাব দিল রবিন। বাকি পেঁয়াজগুলো যদি কেটে দিতে… চোখ ডলতে লাগল সে। লাল হয়ে গেছে। পানি বেরোচ্ছে পেঁয়াজের ঝাঁজে।
মাংসে টমেটো সস আর বীন মেশাতে মেশাতে কেরোলিন অনুরোধ করলেন, কনগুলো যদি পরিষ্কার করে আন, খুব ভাল হয়।
যাচ্ছি। প্যানট্রিতে এসে ঢুকল কিশোর। কর্ন বের করার জন্যে হাত বাড়াতেই ঠেলা লেগে ছড়িয়ে পড়ল একগাদা খবরের কাগজ। পুরানো হতে হতে হলদে হয়ে গেছে।
দূর! কাগজগুলো আবার তুলে ঠিক করে রাখতে লাগল সে।
আধ ঘন্টা পরে ডিনার তৈরি হয়ে গেল। রান্নাঘরে এসে ঢুকল লুক বোলান। থমথমে চেহারা। জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?
মনে হয় দোতলায়, কেরোলিন বললেন।
না, এই তো, দরজার কাছ থেকে বলল লিলি। পরনে কালো জিনস, গায়ে লাল-সাদা চেক শার্ট, মাথায় টকটকে লাল হ্যাট।
খারাপ খবর আছে, লুক বলল। ইউনিককে পাইনি। মনে হয়, চিরকালের জন্যেই গেল।
ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল লিলি। বিড়বিড় করে বলল, বিশ্বাসই করতে পারি না!
বিশ্বাস তো আমিও করতে পারছি না, লুক বলল। শেষ পর্যন্ত শেরিফকে জানাতে বাধ্য হয়েছি। দশ মাইলের মধ্যে পাড়াপ্রতিবেশী যত আছে, সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ কিছু বলতে পারল না। কেউ দেখেনি ওকে।
লুকিয়ে রয়েছে হয়তো কোথাও, কিশোর বলল।
কোথায়? ভুরু কোঁচকাল লুক। কোনখানে?
এখনও জানি না। তবে কেউ ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখেছে ওকে।
পাগল! ফেটে পড়ল লুক, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ছেলে! শহরে তোমরা কিভাবে গোয়েন্দাগিরি কর, জানি না, তবে এখানে আমরা কোন কিছু চুরি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তারপর চোরকে ধরার চেষ্টা করি।
কিশোর তো সেটাই করতে চাইছে, লিলি বলল। ওর ধারণা, ইউনিককে চুরি করা হয়েছে।
হায় হায়, বলে কি! চোখ বড় বড় হয়ে গেল কেরোলিনের।
লুকের চোখে অবিশ্বাস ফুটল। এসব অতি কল্পনা। ঘোড়াটা পালিয়েছে, এটাই সহজ জবাব।
তাহলে পাচ্ছি না কেন ওকে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। আটকে রাখা না হলে ও এতক্ষণে চলে আসত। গৃহপালিত কোন জানোয়ারই বাড়ি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে না।
পাগল হয়ে গেছে! মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল লুক।
এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন কেরোলিন। তারপর বললেন, এখানে আমিই সামলাতে পারব। তোমরা গিয়ে ঘরটর গোছগাছ কর।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। অ্যাপ্রন খুলতে একটা মুহূর্ত দেরি করল না। তবে রবিন বলল, তোমরা যাও। আমি আসছি।
ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল কিশোর। এসে বসল মুসার বিছানায়। বলল, সেই অনুভূতিটা হচ্ছে আবার আমার। কোন কিছু মিস করলে, ধরি ধরি করেও ধরতে না পারলে যেটা হয়। জরুরী কোন একটা সূত্র।
কি? মুসা জিজ্ঞেস করল।
সেটাই তো বুঝতে পারছি না। হাতের তালুতে থুতনি রাখল কিশোর। যদি খালি বুঝতে পারতাম কে ইউনিকর্নকে চুরি করেছে আর ব্যানারদের জিনিসগুলো। আমার ব্যাগে রেখেছে…।
এবং কে হারিকেনকে ওষুধ খাইয়েছে,মুসা বলল। এই তো?
যদি খাইয়ে থাকে। যাই হোক, এই মুহূর্তে এটাও প্রমাণ করতে পারছি না। আমরা।
তারমানে যেখানে ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি, এগোতে পারিনি একটুও?
আলমারির আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আনমনে মাথা দোলাল, অনেকটা সেই রকমই।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল রবিন। চকচক করছে। চোখ। চিৎকার করে বলল, পেয়ে গেছি। ধরে ফেলেছি ব্যাটাকে!
সতর্ক হল কিশোর। আহ, আস্তে! দরজা লাগাও!
দরজাটা লাগিয়ে দিল রবিন। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, কে সব কিছুর পেছনে বুঝে ফেলেছি!
.
০৯.
কে? একসাথে জিজ্ঞেস করল কিশোর আর মুসা।
ব্রড জেসন! অ্যাপ্রনের পকেট থেকে হলদে হয়ে আসা একটা খবরের কাগজ বের করল রবিন। স্থানীয় কাগজ, নাম ক্রনিকল। বাড়িয়ে ধরল সেটা কিশোরের দিকে।
গল্পটা ছয় মাসের পুরানো। কুপার র্যাঞ্চের মেহমানদের টাকা আর জিনিসপত্র চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ব্রডকে। র্যাঞ্চ থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাকে কুপার। কুপার র্যাঞ্চের কথাও বিশদ লেখা রয়েছে স্টোরিটায়। অনেক বড় জমজমাট র্যাঞ্চ। ওটার মালিক বিখ্যাত রোডিও খেলোয়াড় বেনি কুপারের বাবা ডবসি কুপার। টুরিস্ট জায়গা দেয়া ছাড়াও রোডিও খেলার উপযোগী ঘোড়ার প্রজনন করেন। বিচিত্র সব সরীসৃপের ছোটখাট একটা চিড়িয়াখানাও আছে র্যাঞ্চে।
বের করলে কি করে ওটা? জিজ্ঞেস করল মুসা।
বিছানার পাশে বসল রবিন। হাসল। প্যানট্রিতে একগাদা কাগজ দেখে কৌতূহল হল। গিয়ে দেখতে লাগলাম কাগজগুলো। কিছু পেয়ে যাব ভাবিনি, এমনিই দেখছিলাম। চোখে পড়ে গেল হেডলাইনটা।
ব্রড কেন ইউনিকর্নকে ছেড়ে দেবে? তার কি লাভ?
যেহেতু বেনি কুপার তার গার্লফ্রেণ্ড।
উজ্জ্বল হলো কিশোরের মুখ। ঠিক। লিলি প্রতিযোগিতায় নামলে বেনির সর্বনাশ। জিততে পারবে না।
কেরোলিন আন্টির কাছে শুনলাম প্রতিযোগিতাটা টেলিভিশনে দেখাবে, রবিন জানাল। যে জিতবে, তাকে নাকি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হবে।
বাপরে! গাল ফুলিয়ে ফেলল মুসা, বিরাট টাকার ব্যাপার!
সেই সঙ্গে সম্মান এবং খ্যাতি, কিশোর বলল।
সহজেই ধরে নেয়া যায়, রবিন বলল, বান্ধবীর জন্যে এসব অকাজ করছে। ব্রড। স্যাবোটাজ করে চলেছে ডাবল সিকে।
ওরকম জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না অবশ্য, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কারণ কিছুই প্রমাণ করতে পারিনি আমরা এখনও।
রহস্যময় হাসি হাসল রবিন। পারিনি, করে ফেলব। ধবধবে সাদা একটা স্টেটসন হ্যাট খাঁটি কাউবয় কায়দায় মাথায় বসিয়ে দিয়ে বলল, চলো।
কোথায়? মুসার প্রশ্ন। পার্টিতে?
উঠে দাঁড়াল কিশোর। আমি যাচ্ছি ব্রড জেসন আর ডবসি কুপারের সঙ্গে কথা বলতে।
.
এক ঘণ্টা পরে বারবিকিউ সস, সদ্য বেক করা কর্নব্রেড আর স্ট্রবেরি পাইয়ের সুবাস ভুর ভুর করতে লাগল বাতাসে। খোলা একটা নিচু জায়গায় হাজির হল মেহমানেরা, যেখানে এই বিশেষ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বারবিকিউ হয়। খোলা জায়গায়। মূল খাবার হয় আস্ত গরু, ভেড়া কিংবা শুয়োরের ঝলসান মাংস। গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে চামড়া ছাড়ানো, নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে দেয়া আস্ত এক গরু। নিচে আগুন জ্বলছে। সেই আঁচে সেদ্ধ হচ্ছে মাংস, চর্বি গলছে চড়চড় শব্দ করে, কাবাবের জিভে-পানি-আসা গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে ঝুলছে অনেকগুলো লণ্ঠন। সেই সাথে অনেক মানুষের কথাবার্তার গুঞ্জন এক বিচিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
ওখানে হাজির হলো তিন গোয়েন্দা। ডাবল সির মেহমানরা তো রয়েছেই, আশেপাশের অনেক র্যাঞ্চ থেকেও অনেকে এসেছে। নিয়ম হলো যার যার খাবার। প্লেটে তুলে নিয়ে খেতে হবে। কিশোরও নিল। চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে পরিচিতি অপরিচিত মানুষের ওপর। বেনিকে দেখতে পেল। লণ্ঠনের আলোতেও ঝলমল করছে চুল। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন লম্বা, বলিষ্ঠ একজন মানুষ। চুল সাদা। ভারি কণ্ঠস্বর, হাসিটাও তেমনি ভারি।
আমি যাচ্ছি, রবিনের কানে কানে বলল কিশোর। লোকজনের ভেতর দিয়ে এগোল বেনির দিকে। কাছে গিয়ে হেসে হাত নেড়ে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বলল, হাই।
হাই। কিশোর পাশা না? এমন ভঙ্গিতে তাকাল, বেনি, যেন চিনতে পারছে না কিশোরকে।
হ্যাঁ, জবাব দিয়ে পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকাল কিশোর।
আমি ডবসি কুপার, বেনির বাবা, গমগম করে উঠল ভদ্রলোকের গলা। হাত বাড়িয়ে কিশোরের হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকি দিলেন। ওয়েলকাম টু মনটানা।
থ্যাঙ্ক ইউ।
শুনলাম, তুমি ডিটেকটিভ?
ঝট করে বাবার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল আবার বেনি।
ঠিকই শুনেছেন, দরাজ হাসি হাসল কিশোর। ইউনিকর্নকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি আপাতত। রাতের বেলা আস্তাবল থেকে পালিয়েছে।
শুনেছি, কুপার বললেন। বেনির কাছেই শুনলাম। পরে আমার র্যাঞ্চের পশ্চিম ধারে ওরকম কালো একটা ঘোড়াকে দেখেছিও। এখন মনে হচ্ছে ওটা ইউনিকর্ন নয়। অন্য ঘোড়া। ভুলটা কিভাবে করলাম বুঝতে পারছি না। ঘোড়ার ব্যাপারে তো এরকম ভুল আমি করি না। তবে, ইউনিকর্ন আর হারিকেনকে আলাদা করে চিনতে পারব না, এটা ঠিক। দুটো ঘোড়াই অবিকল এক রকম। এত মিল কমই দেখা যায়।
আপনি কেন, বাইরের কেউই পারবে না, কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ব্রড, কিশোর কিংবা কুপার কেউই টের পাননি। ঘুরে তাকাল কিশোর। ব্রডকে যেন আর এখন চেনাই যায় না। পরিষ্কার জিনস, প্রেইড শার্ট আর রুপার বাক্স ওয়ালা বেল্ট পরেছে। ঠিক এরকম বাকলসওয়ালা বেল্টের বাড়িই সেদিন আস্তাবলে খেয়েছিল কিশোর, মনে আছে। তাহলে কি ব্রডই তাকে মেরেছিল? নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এখানে অনেকেই বেল্টে রুপার বাস লাগায়। ইউনিকনের চুরির দায়টা ওর ওপর চাপানর মতও কোন প্রমাণ তার হাতে নেই।
ব্রডকে দেখেই কঠিন হয়ে গেল কুপারের চেহারা। কিন্তু তোয়াক্কা করল না ব্রড।
মুসা তোমাকে খুঁজছে, কিশোরকে বলল সে। বেনির দিকে তাকিয়ে কোমল হল দৃষ্টি। দ্রুত হেঁটে চলে গেল আরেক দিকে।
কিশোরও সরে গেল ওখান থেকে। তবে মুসার কাছে না গিয়ে পিছু নিল ব্রডের। আস্তাবলের দিকে চলেছে লোকটা। ডাক দিল সে, এই যে, শুনুন।
থেমে গেল ব্রড। বুটের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ঘুরল। কর্কশ গলায় বলল, এখানে নয়, তোমার বন্ধু পার্টিতে।
জানি। আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাইছি।
কথা বলার মোটেও ইচ্ছে নেই ব্রডের। কি কথা?
সেদিন রাতে, আমি যখন আস্তাবলে..
মনে আছে। অনেক প্রশ্ন করেছিলে। আমি তখন হারিকেনকে ঠাণ্ডা করছিলাম।
না না, তার পরে। আমি যখন আবার একা গেলাম…
ভয়ানক বোকামি করেছ! এবারেও কথা শেষ করতে দিল না কিশোরকে ব্রড। হারিকেনের মেজাজ তখন চরমে!
হাল ছাড়ল না কিশোর, সেদিন রাতে ওই সময় আপনার লেকে থাকার কথা, ক্যানু রেস হচ্ছিল।
শক্ত হয়ে গেল ব্রডের চোয়াল। সরু হয়ে এল চোখের পাতা। তুমি তখন। আস্তাবলে কি করছিলে?
সূত্র খুঁজছিলাম।
অ্যাঁ! ও, শুনেছি, তোমার নাকি ধারণা ইউনিক চুরি হয়েছে, কে করেছে সেটা জানার জন্যে তদন্ত চালাচ্ছ। হেসে উঠল ব্রড। বড়ই যেন মজা পাচ্ছে এরকম। একটা ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এখানে কোনই রহস্য নেই কিশোর পাশা, কাজেই রহস্যভেদের চেষ্টা বৃথা। আমার পরামর্শ শুনলে, বাদ দাও এসব…
ব্রডের বেশি কথাও ভাল লাগছে না কিশোরের, বলল, মেরে আমাকে বেশ করে ফেলা হয়েছিল। পেছন থেকে কে জানি এসে মাথায় বাড়ি মারল।
এতক্ষণে হাসি বন্ধ হল ব্রডের। বলো কি? কই, আমি তো কিছু শুনিনি?
কার কাছে শুনবেন? কাউকে বলিনি তো।
এরকম কিছু ঘটতে পারে না, এটাই বোধহয় বলার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল ব্রড। জিজ্ঞেস করল, তারপর?
আমার বন্ধুরা গিয়ে বেহুশ দেখতে পেল আমাকে।
লোকটাকে দেখেছ?
না। তবে রুপার বাল্সওয়ালা বেল্ট দিয়ে বাড়ি মেরেছিল, দেখেছি, আপনি যেটা পরেছেন সে রকম।
রেগে গেল ব্রড, তুমি বোঝাতে চাইছ আমি মেরেছি? নিজের বেল্টের দিকে আঙুল তুলে বলল, এটা আমি পুরস্কার পেয়েছি কয়েক বছর আগে রোডিও খেলায়। অনেকেই পেয়েছে। আজ রাতে পাটিতেই অন্তত দশবারোজনের কোমরে দেখতে পাবে।
কার কার?
লিলি, জন, লুক, ভাবছে ব্রড, এই র্যাঞ্চের দুজন শ্রমিক। বাইরের তো আছেই।
কুপার র্যাঞ্চের?
আছে।
বেনি কুপারের?
কয়েকটা আছে। বেনির কথা বলার সময় কোমল হল ব্রডের কণ্ঠ, পরের কথাটা বলতে গিয়েই নিমের তেতো ঝরল যেন, ওর বাবারও আছে।
চমৎকার, ভাবল কিশোর। ব্রডের কথা ঠিক হলে এ এলাকার অর্ধেক মানুষেরই আছে রুপার বাক্স। ওটাকে সূত্র হিসেবে ধরে তদন্ত করতে যাওয়া আর খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা একই কথা।
আস্তাবলের দিকে আবার পা বাড়িয়ে ব্রড বলল, দেখো, আমার সত্যিই কাজ আছে। ঘোড়াগুলোকে খাবার দিতে হবে…
আর একটা কথা, তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর, আপনি কুপারের ওখানে চাকরি করতেন, তাই না?
থমকে গেল ব্রড। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি করে জানলে?
কাগজে পড়েছি।
পুরানো ইতিহাস! বিড়বিড় করল ব্রড। তাহলে নিশ্চয় জানো, চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল আমাকে?
বড় শাস্তি দিতে পারেননি বলে নিশ্চয় হতাশ হয়েছিলেন মিস্টার কুপার?
আঙুল মুঠো করে ফেলল ব্রড। ওর সঙ্গে আমার কোনদিনই বনিবনা ছিল না। আমাকে পছন্দ করেনি। বেনির সঙ্গে নাকি আমাকে একেবারেই মানাবে না। মেহমানদের জিনিস চুরি করি আমি, একথাটা যেই জানল, সুযোগ পেয়ে গেল। বের করে দিল আমাকে র্যাঞ্চ থেকে। শাসিয়ে বলল; আর যেন কখনও বেনির। সঙ্গে দেখা না করি।
রাগটা ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছে ব্রডের।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, তারপর এখানে চাকরি নিলেন?
দেখ, উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে বসো না। লিলির সঙ্গে আমার কোন মন। দেয়ানেয়ার ব্যাপার নেই। আমাকে আর দশজন কর্মচারীর মতই কাজে নিয়েছে। কেরোলিন আন্টি বলেকয়ে রাজি করিয়েছে তাকে। তারপর থেকে আমি সৎ হয়ে গেছি। ঠিকমত কাজ করছি। সবাইকে বোঝানোর জন্যে যে, যা করেছি তার জন্যে আমি অনুতপ্ত, আর কোনদিন করব না ওরকম কাজ।
লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। তাহলে আপনি বলতে পারবেন না ব্যানারদের জিনিস চুরি করে কে আমার ব্যাগে রেখে গেল?
তোমার ধারণা আমি করেছি? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার? এখানেও ওরকম কোন বদনাম হলে র্যাঞ্চে চাকরির আশা আমার শেষ। কেউ আর আমাকে কাজ দেবে না। তাছাড়া এই চাকরিটা খুব ভাল। বোকামি করে মরার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। ইয়ে, ওদের ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা চুরি গেছে নাকি কিছু?
প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল।
আমি নই, এটুকু বলতে পারি। আর দাঁড়াল না ব্রড। দুপদাপ পা ফেলে আস্তাবলের দিকে রওনা হয়ে গেল।
দরজা দিয়ে ওকে ঢুকে যেতে দেখল কিশোর। ভাবছে, সত্যি বলেছে লোকটা? চুরির অভ্যাস ছিল একসময়। ইউনিকর্নকে ও-ই চুরি করল? তাহলে হারিকেনের ব্যাপারটা কি? ঘোড়াকে সত্যিই ভালবাসে ব্রড, এরকম একজন লোক ওষুধ খাইয়ে ক্ষতি করবে একটা ঘোড়ার, আতঙ্কিত করে তুলতে চাইবে? নাকি লুক বোলানের কথাই ঠিক, বদ রক্ত রয়েছে শরীরে তাই খারাপ হয়ে গেছে। হারিকেন? ইউনিকর্ন এখন কোথায়? পাহাড়ে, বনের ভেতরে লুকিয়ে আছে, নাকি কোথাও আটকে রাখা হয়েছে তাকে?
কি ব্যাপার, পার্টিতে ফিরে আসার পর মুসা জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, মনে হয় এই দুনিয়ায় নেই?
না, আছি। ভাবছিলাম, আশপাশের র্যাঞ্চ মালিকদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ওর কথার শেষ অংশটা শুনে ফেলল লিলি। বলল, যাওয়ার আর দরকার কি? এখানেই অনেকে আছে। বলে ফেললেই পারো।
কয়েকজনের সাথে কথা বলল কিশোর, লাভ হলো না, জানতে পারল না। নতুন কিছু। পালিয়ে যাওয়ার পর ইউনিকর্নকে দেখেইনি কেউ। তবে এলসা কারমল নামে এক বিধবা মহিলা একটা মূল্যবান কথা বললেন। স্বামীর রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তির মালিক। কুপার র্যাঞ্চের পশ্চিমে তাঁর জমি। বললেন, দেখো, ইউনিকর্নের মত শয়তানেরও দিনে দুবেলা খাবার দরকার পড়ে। বড় জানোয়ার, বেশি খাবার দরকার। ওদিকে, যেদিকে ঘোড়াটা লুকিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেদিকে হাত তুলে তিনি বললেন, খাবার খুবই কম। ঘোড়ারা বুদ্ধিমান জানোয়ার, লুকিয়ে পড়ার ওস্তাদ, কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে, কে জানে। ওই যে, ব্যাণ্ড শুরু হলো।
একটা কাঠের মঞ্চে উঠে বাজনা শুরু করেছে তিনজন স্থানীয় বাজনদার। সেদিকে এগিয়ে গেল কিশোর। বেনির সঙ্গে কথা বলছে ওখানে লিলি। বেনি বলছে, সত্যিই আবার রোডিওতে ফেরত যাবে?
চাইছি তো। ভাবছি, ইনডিপেনডেন্স ডে থেকে শুরু করব।
বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না? এক বছর ধরে প্র্যাকটিস নেই, পারবে?
পারতে হবে। টাকা দরকার আমার।
বড় বেশি ঝুঁকি নিতে যাচ্ছ। একটা পাগলা ঘোড়ার পিঠে চড়ে…
হারিকেন পাগল নয়।
আব্বাকে লুক বলেছে ঘোড়াটা পাগল হয়ে গেছে। ব্রডও বলেছে। আমি হলে ওরকম একটা বদমেজাজী ঘোড়ার পিঠে কখনই চড়তাম না।
আর কোন কথা হল না। চলে গেল বেনি।
কিশোরের ওপর চোখ পড়ল লিলির। বলল, দেখলে, কেমন করে চলে গেল?
দেখলাম। বেনির ওপর নজর কিশোরের। ব্রডের হাত ধরেছে গিয়ে মেয়েটা। কাছেই রয়েছেন তার বাবা, পরোয়াই করল না। গম্ভীর হয়ে গেছেন কুপার, ভূতপূর্ব কর্মচারীর সঙ্গে নিজের মেয়ের এই আচরণ সহ্য করতে পারছেন না। তিনি। লিলির দিকে ফিরল কিশোর। শুনলাম, কুপার র্যাঞ্চে নাকি কাজ করত ব্রড।
মাথা ঝাঁকাল লিলি। কেন বের করে দিয়েছে জানো?
জানি।
ও, জান। আমি আরও ভাবলাম, তোমাকে বলব, ওর চুরির স্বভাব ছিল। তবে এখন ও ভাল হয়ে গেছে। ব্যানারদের জিনিস ও চুরি করেনি। ইউনিকের নিখোঁজ হওয়ার পেছনেও তার হাত নেই। অহেতুক আর এখন ওর অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা ঠিক হবে না।
পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে বাজনা। আঞ্চলিক গানের সুর বাজাচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ শুনে আবার বলল লিলি, এই বাজনার পরেই আমি রেডিওতে যোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করব।
গুড লাক, শুভেচ্ছা জানাল কিশোর। হঠাৎ বলে উঠল, আরি!
কি? কিশোরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে লিলিও দেখতে পেল লম্বা সাদা সেডান গাড়িটা, র্যাঞ্চে ঢুকছে। আবার এল!
আরও খানিকটা এগিয়ে থামল গাড়িটা। বেরিয়ে এল ফিলিপ নিরেক। অন্য পাশের জানালা দিয়ে মুখ বের করে রেখেছে পাইক, নামল না। সোজা লিলির দিকে এগিয়ে এল নিরেক। কাছে এসে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলল, যা বলেছিলাম। এটাই ঘটবে।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লিলি।
কি আর? ব্যাংক সময় দিতে পারবে না। এক মাসের সময় আছে আর। এর। মধ্যে হয় সব টাকা শোধ করবে, নয়ত জায়গা ছাড়বে। এই যে, চিঠি।
এসব আপনি করেছেন! সব আপনার শয়তানী! লিলির চিল্কারে বাজনা থামিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল বাদর্কেরা। মেহমানদের চোখও ঘুরে গেল এদিকে।
বেশ, আমি করেছি, তাতে কি? নির্লজ্জের মত বলল নিরেক। ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গেও কথা বলেছি। ওরা বলেছে, ইউনিকনের জন্যে পয়সা দেবে না। যে যে কারণে টাকা দেয়ার কথা তার কোনটাই ঘটেনি বলে তাদের বিশ্বাস। মরেনি, জখম হয়নি, চুরি যায়নি। ওদের ধারণা, তুমিই কোথাও নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছ।
শক্ত হয়ে গেছে লিলির কাঁধ। টাকা কি চাইতে গেছি নাকি আমি ওদের কাছে? কথাই বলিনি।
বললেও দেবে না। ঘুরে গাড়ির দিকে রওনা হলো নিরেক।
তাড়াহুড়া করে লিলির কাছে এসে দাঁড়ালেন কেরোলিন। একটা গোলমাল হয়ে গেছে। বিকেলে দোকান থেকে সোডা আনতে ভুলে গেছে ব্রড। চা-ও নেই। ডেরিককে ফোন করেছিলাম। দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিল, বলেছে আমাদের জন্যেই খোলা রাখবে।
মেহমানদের ওপর চোখ বোলাল লিলি। বেশ, যাচ্ছি।
যেতে আসতে কতক্ষণ লাগে? জানতে চাইল কিশোর।
এই মিনিট বিশেক।
তাহলে আমিই যাই। আপনার বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছে, আপনার। এখানে থাকা দরকার।
তুমি যাবে?
যাই না, অসুবিধে কি?
বেশ। দোকানদারের নাম ডেরিক লংম্যান। শহরের ধারেই দেখতে পাবে। মার্কেটটা। জিনসের পকেট থেকে চাবি বের করে দিয়ে লিলি বলল, আমার স্টেশন ওয়াগনটা নিয়ে যাও। ফিরে তাকিয়ে বাদকদেরকে ইশারা করল। মাথা ঝকাল দলপতি। আবার শুরু হল বাজনা।
রবিনকে কাছাকাছি দেখে সেদিকে এগোল কিশোর। তোমরা থাকো, আমি আসছি।
কোথায় যাচ্ছ?
দোকানে। কয়েকটা জিনিস ফুরিয়ে গেছে।
চলো, আমিও যাব।
যাবে? ঠিক আছে। মুসাকে বলে এসো। নইলে আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করবে। আর আসতে চাইলে আসুক। আমি গাড়ি বের করিগে।
মুসা এল না। খেতে ব্যস্ত। রবিন আর কিশোরই চলল। পার্টির জায়গা থেকে বেশ অনেকটা দূরে রাখা হয়েছে গাড়িটা। পুরানো ঝরঝরে একটা স্টেশন ওয়াগন। গায়ে আঁকা রয়েছে ডাবল সি র্যাঞ্চের নাম আর মনোগ্রাম–একটা কালো ঘোড়ার ছবি।
ভাবছি, কিশোর বলল, ইচ্ছে করে ভুল করেনি তো ব্রড? সোডা আনতে ভুলে যায়নি তো?
তা কেন করবে?
জানি না, গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল কিশোর। হয়তো গোলমাল আরও বাড়ানর জন্যেই। ইগনিশনে মোচড় দিল সে।
কেশে উঠে চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। গিয়ার দিল কিশোর। একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এল। মাথার ভেতর বেজে উঠল ওয়ার্নিং বেল। খপ করে রবিনের হাত চেপে ধরে আরেক হাত বাড়াল দরজা খোলার জন্যে। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি বেরোও…!
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বোমা ফাটার মত আওয়াজ হলো।
১০.
গাড়ির দরজা খুলে মাটিতে লাফিয়ে নেমেই আবার চেঁচাল কিশোর, পালাও!
একপাশে আগুন ধরেছে গাড়ির, ভাগ্য ভাল, ওদের কিছু হয়নি। মথা নিচু করে ছুটে পালিয়ে যেতে লাগল দুজনে গাড়িটার কাছ থেকে। ছুটতে ছুটতেই একবার ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, লাল আর কমলা রঙের আগুন দাউ দাউ করে উঠছে ওপরে। কুণ্ডলী পাকিয়ে রাতের আকাশে উঠছে কাল ধোয়া। আতঙ্কিত মেহমানরা এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে।
গেছিলাম আরেকটু হলেই! গলা কাঁপছে রবিনের।
ট্যাক রুম থেকে দৌড়ে বেরোল লুক বোলান, হাতে একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার। পথ থেকে চিৎকার করে লোকজনকে সরিয়ে দিতে লাগল, সরুন, সরে যান! গাড়ির কাছে গিয়ে যন্ত্র থেকে রাসায়নিক পদার্থ ছিটাতে লাগল আগুনের ওপর। চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল কয়েকজন শ্রমিককে। জ্বলন্ত গাড়িটার কাছে এগিয়ে আসছিল ওরা।
কিশোর! রবিন! চিৎকার করতে করতে ছুটে এল মুসা। তোমরা ভাল আছ?
আছি, জবাব দিল রবিন।
কি হয়েছিল? উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইল মুসা।
বলতে পারব না, বিহুলের মত মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। আরেকটা আগুন নেভানর যন্ত্র নিয়ে দৌড়ে আসতে দেখল ব্রডকে। বাগানে পানি দেয়ার মোটা একটা হোসপাইপ এনে পানি ছিটাতে শুরু করল জন।..
গ্যাস পেডালে চাপ দিতেই কি যেন গড়বড় হয়ে গেল, আবার বলল কিশোর। বোমাটোমাই হবে!
তিন গোয়েন্দার দিকে দৌড়ে এল লিলি। পেছনে রয়েছেন কেরোলিন।
তোমরা…ভাল আছ? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল লিলি।
আছি, জবাব দিল কিশোর।
কপাল ভাল আরকি তোমাদের। কেন এমন হলো কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। বিকেলে যখন গাড়িটা নিয়ে দোকানে গিয়েছিল ব্রড তখনও তো ভাল ছিল।
তারপর আর কেউ চালিয়েছে?
মাথা নাড়ল লিলি। না। চাবি আমার কাছেই এনে দিয়েছিল সে।
কমে এসেছে আগুন। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। মনে হয় কেউ বোমা লাগিয়ে রেখেছিল।
সর্বনাশ! কে তোমাকে মারতে চাইল?
আমাকে নয়, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, তাকে, যে সব সময় গাড়িটা চালায়।
চালাই তো আমি, চমকে গেছে লিলি, কিন্তু…
তাহলে আপনাকেই মারতে চেয়েছে।
ও মাই গড! চোখ বন্ধ করে ফেলল লিলি।
পোড়া গাড়িটার দিকে হাত তুলে রবিন বলল, মারতে যে চেয়েছে ওটাই তার প্রমাণ।
মুসা বলল, বেপরোয়া হয়ে গেছে লোকটা।
পুলিশকে ফোন করা দরকার, কিশোর বলল।
গাড়িটাকে জ্বলতে দেখেই করে দিয়েছি আমি, কেরোলিন বললেন। দমকলকেও করেছি। এসে যাবে।
কয়েক মিনিট পর সাইরেন শোনা গেল। দমকলের একটা ট্রাক আর শেরিফের একটা গাড়ি ঢুকল চত্বরে। লাফিয়ে মাটিতে নেমে পোড়া গাড়িটার দিকে ছুটল দমকল কর্মীরা। শেরিফের গাড়ি থেকে নামল গোয়েন্দারা। যাকে সামনে পেল তাকেই প্রশ্ন করতে লাগল।
হ্যারিসন ফোর্ড নামে একজন লালমুখো ডেপুটি জিজ্ঞেস করলেন লিলিকে, গাড়িটার কাছে কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ?
না…ব্রডকে দেখে থেমে গেল লিলি।
ব্রড এসে বলল, গাড়িটা নিয়ে বিকেলে শহরে গিয়েছিলাম। আসার পর ওখানেই রেখেছিলাম।
চালানর সময় কোন গোলমাল করেনি? জিজ্ঞেস করলেন ফোর্ড। টের পাওনি?
না, একটুও না, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ব্রডের মুখ।
বাজি দিয়ে একাজ করা হয়েছে, ডেপুটির কাছে এসে দাঁড়াল একজন দমকল কর্মী। হাতে একটা কালো খোসা। গাড়ির নিচে লম্বা ফিউজ লাগিয়ে মাথায় জুড়ে দেয়া হয়েছিল বাজিটা। ইঞ্জিনের গড়িয়ে পড়া তেলে লেগে আগুনটা ধরেছে।
তার মানে অ্যাক্সিডেন্ট নয়? আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল লিলি।
মাথা নাড়ল লোকটা। না। আমার তা মনে হয় না। ওখানে এভাবে বাজি যাবে কি করতে?
কিশোরের দিকে তাকাল লিলি, কিশোর, আর দরকার নেই। তদন্ত বাদ দাও। আর কোন ঝুঁকি নিতে দেব না তোমাদের।
তদন্ত? ভুরু কোঁচকালেন ডেপুটি। কিসের তদন্ত?
হারানো ঘোড়াটার কথা বলল লিলি।
নাক দিয়ে শব্দ করলেন ফোর্ড। ওটা এমন কোন ব্যাপার নয়। মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে পালায় ঘোড়ারা।
কিশোর বলল, আমার ধারণা ওটা চুরি হয়েছে।
ভোতা গলায় ব্রড বলল, সেটা প্রমাণ করতে পারবে না।
পারব। মিলির দিকে তাকাল কিশোর। এখন থেকে খুব সাবধানে। থাকবেন। ভয়ানক শত্রু আছে এখানে আপনার। ওরা আপনাকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করবে না।
না, কি যে বলো? আমাকে কেউ মারবে না।
সব কথা লিখে নিচ্ছেন ডেপুটি। নোটবুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, একজন। মেহমানের কাছে শুনলাম, একটু আগে ব্যাংকের একজন লোক এসে হুমকি দিয়ে গেছে তোমাকে?
ফিলিপ নিরেক আর হারনি পাইকের কথা বলল লিলি। লিখে নিলেন ডেপুটি। কয়েক মিনিট পর চলে গেলেন অন্যদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আরেকজন ডেপুটি গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে আস্তাবল আর বাড়িতে।
তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে লিলি বলল, তোমাদেরকে এতে জড়িত করে ভাল করিনি আমি। তোমরা আমার মেহমান। মেহমানের মতই থাকো এখন। থেকে। ওসব তদন্ত-ফদন্ত বাদ দাও।
অসম্ভব! জোর গলায় বলল কিশোর। এত কিছুর পর আর চুপ থাকতে পারব না আমি। এর একটা সুরাহা করেই ছাড়ব। বুঝতে পারছেন না কেন মরিয়া হয়ে উঠেছে শয়তানটা? আমরা অনেক এগিয়ে গেছি, বুঝে ফেলেছে সে। তার। জারিজুরি ফাঁস হওয়ার পথে।
কিন্তু ভয়ঙ্কর লোক ও, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। আমার জন্যে তোমরা কেন মরতে যাবে? সমস্যাটা আমার, তোমাদের নয়। তোমরা ছুটি কাটাতে এসেছ, ছুটি কাটাও।
বললামই তো, এর পর আর থেমে থাকতে পারব না আমি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে ইউনিকর্নের চোর। যেভাবেই হোক ঠেকাতে চাইছে এখন, যাতে ধরা না, পড়তে হয়। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
পোড়া গাড়িটার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে একজন ডেপুটি। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিলি বলল, বেশ। বাধা দেব না। তবে খুব সাবধান। দয়া করে আর বদনাম করো না আমার!
***
পরদিন সকালে এসে ভাল করে পোড়া গাড়িটাকে দেখল কিশোর, যদি কোন সূত্রটুত্র পেয়ে যায় এই আশায়। পেল না। সেরাতে মেহমানদের ক্যাম্পিঙে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কাজেই সারাটা দিন জিনিসপত্র গোছগাছ আর পশ্চিমের পাহাড়ে ইউনিকর্নকে খুঁজে বেড়াল তিন গোয়েন্দা।
কোন চিহ্ন পেল না।
বিকেলে বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার বেরোনোর জন্যে তৈরি হলো ওরা।
দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ল মেহমানেরা। পাহাড়ের ভেতরে নদীর ধারে ছোট এক চিলতে খোলা জায়গায় ক্যাম্পিঙের ব্যবস্থা হয়েছে।
উফ, এক্কেবারে ব্যথা হয়ে গেছে শরীর, ঘোড়ার পিঠ থেকে বেডরোল নামাতে নামাতে বলল রবিন। টেনে নামাল জিনটা। সারাটা দিন ঘোড়ার পিঠে থেকে থেকে একেবারে শেষ হয়ে গেছি।
হাসল মুসা। বাড়ি গিয়ে একবারে ঘুমিও। এখানে মজার জন্যে এসেছ মজা। লোট। রাতে পাহাড়ে কাটানর মজাই আলাদা। আগুনের ধারে বসে সাওয়ারডো বিস্কুট খাওয়া, গল্প করা, তারপর কম্বলের তলায় গুটিসুটি হয়ে পড়ে থেকে নানারকম শব্দ শোনা, নিশাচর পাখি আর জন্তু জানোয়ারের ডাক, বাতাসের। ফিসফিসানি, নদীর কূলকুল….
বাপরে! একেবারে কবি হয়ে গেলে দেখি?
মালপত্রগুলো নিয়ে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা পাইন নীডলের ওপর রাখল দুজনে। কিশোরও তারটা নিয়ে গিয়ে রাখল ওদেরগুলোর পাশে। আশেপাশে জটলা করে রয়েছে পাইন গাছ।
এজটার পরিবার আর কয়েকজন মেহমানকে নিয়ে ক্যাম্প সাজায় লাগল ব্রড। কাপলিংকে নিয়ে তিন গোয়েন্দা আগুন জ্বালানোর জন্যে শুকনো কাঠ জড় করতে লাগল।
মিসেস ব্যানার সাফ মানা করে দিল, কোন কাজ করতে পারবে না। একটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে বসে বলল, আমি এখানে এসেছি আরাম করতে, কাজ করতে নয়।
এটা কাজ নয়, ঘোড়া বাধতে বাঁধতে বলল লুক, মজা।
থাকো, হাত উল্টে জবাব দিল মিসেস ব্যানার, ওরকম মজার আমার দরকার নেই।
মুচকি হাসল রবিন। নিচু গলায় বলল, স্বামী বেচারাকে নিশ্চয় জ্বালিয়ে খায় মহিলা।
মাথা থেকে চাপড় মেরে একটা মাছি তাড়াল মুসা। বলল, মহিলা ঠিকই। করছে। কে যায় অত কাজ করতে?
তাহলে গিয়ে বসে থাক মহিলার সঙ্গে..
মিসেস ব্যানার বলছে, জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটান! দূর! ভাল লাগবে বলে মনে হয় না। আছে তো যত হতচ্ছাড়া জিনিস, বোলতা, মাছি, মশা, কয়োট! ঈশ্বরই জানে, আরও কি কি আছে!
মুখ তুলে রবিন বলল, অনেক কিছু আছে। কুগার, ভালুক, নেকড়ে।
মুসা বলল, যা খুশি থাকুক। হাতি-গুণ্ডার থাকলেও আপত্তি নেই আমার, ভূত না থাকলেই হল…
বলে কি! আঁতকে উঠল মহিলা, ভূতও আছে নাকি! বাপরে! তাহলে বাপু আমি এখানে নেই! সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারব না!
হেসে আবার নিচু গলায় মুসাকে বলল রবিন, যাও, একজন দোসর পেলে।
তাড়াতাড়ি কিশোর বলল, আরে না না, ভূত বলে কিছু নেই। অহেতুক ভয় পাচ্ছেন…
তুমি কিচ্ছু জান না, রেগে গেল মহিলা। কিশোর যে ওদের মানিব্যাগ চুরি করেছে, কথাটা ভুলতে পারেনি মিসেস ব্যানার। সেই যে সেবার, গিয়েছিলাম আমাদের বাড়ির কাছের এক বনে, রাতে থাকতে। তারপর…
হয়েছে কাজ! বলল কিশোর, শুরু হল এবার ভূতের গল্প। চলো, পালাই।
সবাই মিলে কাজ করল, মিসেস ব্যানার ছাড়া। ক্যাম্প করল, আগুন জ্বালল, রান্না করল। ডিনারের পর বাসনপেয়ালা কে ধোবে এটা নিয়ে কথা উঠল। সমাধান করে দিলেন মিস্টার এজটার। টস করা হোক। টসে তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়ল ধোয়ার। কিছুই মনে করলেন না তিনি। শার্টের হাতা গুটিয়ে কাজে লেগে গেলেন। নিজের ইচ্ছেতেই স্বামীকে সাহায্য করতে গেলেন জেনি এজটার।
থালাবাসন ধুতে ভালই লাগে আমার, কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই হেসে বললেন মহিলা।
খাওয়ার পরেও কাজ আছে অনেক। সেগুলো করতে লাগল সবাই। বলা বাহুল্য এবারেও মিসেস ব্যানার কিছু করলেন না। রেগে গিয়ে মুসা বলল, বেটিকে খেতেই দেয়া উচিত হয়নি।
চুপ! শুনবে! থামিয়ে দিল ওকে রবিন।
বনের ভেতর লম্বা হতে লাগল ছায়া। গিটার বের করল ব্রড। সাঁঝের গান ধরল ঘরেফেরা পাখিরা, শান্ত একটানা সুরে কুলকুল করে চলেছে পাহাড়ী নদী। গাছের ডালে ডালে ফিসফিস করে গেল একঝলক হাওয়া। গোধূলির আকাশে প্রথম তারাটা মিটমিট করতে দেখল কিশোর।
রাত নামল। আগুনের লাল আলো বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করল। চাঁদ উঠল একটু পরেই। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার বন্যায় ভেসে গেল যেন বন, পাহাড়, নদী। মুসার মনে হতে লাগল, ডালপাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গলে পড়ছে হলুদ আলো।
আরেক কাপ করে কফি সরবরাহ করা হল, আর কেরোলিনের তৈরি চমৎকার ওটমিল কুকির একটা করে প্যাকেট।
যাই বল, রাতটা বড় সুন্দর, কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল মুসা। আসনপিড়ি হয়ে বসেছে আগুনের ধারে।
কয়েক মিনিট পরে হাতমুখ ধোয়ার জন্যে আঁকাবাকা বুনো পথ ধরে নদীতে চলল কিশোর আর মুসা। সাথে টর্চ নিয়েছে কিশোর। আগে আগে নেচে নেচে চলেছে তার টর্চের আলো।
হঠাৎ আলো নিভিয়ে দিয়ে মুসার বাহুতে হাত রাখল সে। চুপ থাকার ইঙ্গিতটা। বুঝতে পারল গোয়েন্দা সহকারী। দাঁড়িয়ে গেল দুজনেই। শব্দ করল না।
গাছের ফাঁক দিয়ে দেখল ওরা, একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে ব্রড জেসন। ডালের ফাঁক দিয়ে এসে পড়া জ্যোৎস্নায় মেয়েটার চুল রুপালি লাগছে। বেনি কুপারকে চিনতে অসুবিধে হলো না ওদের। এখানে কি করছে সে? তাকে আসতে দাওয়াত করা হয়নি।
মুসার হাতে আলতো চাপ দিয়ে পা টিপে টিপে এগোল কিশোর। পাইন। নীডল ঢেকে দিল তার জুতোর শব্দ। কান খাড়া করে আছে। কিন্তু ক্যাম্পের কথাবার্তা আর নদীর গুঞ্জনে দুজনের কথা ঠিকমত শুনতে পেল না। বেনির বলা কয়েকটা শব্দ বুঝতে পারল, হারিকেন, রোডিও।
বেশি ভাবছ, ব্রড বলল। বেনির কাঁধ চাপড়ে দিল।
দম বন্ধ করে রেখে আরও কয়েক পা এগোল কিশোর। গাছের আড়াল থেকে সামনে মাথা বের করে দিল। …আমার খারাপ লাগতে শুরু করার আগেই চলে যাও, ব্রডের কথা শোনা গেল। আর দাঁড়াল না সে। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটে চলে গেল।
বেনির পিছু নিল কিশোর। আশা করল, ইউনিকনের কাছে তাকে নিয়ে যাবে। মেয়েটা। ওটার পিঠে চড়েই এল নাকি?
নদীর সরু অংশে একটা গাছ পড়ে আছে আড়াআড়ি, সাঁকো তৈরি করে দিয়েছে। সেটা দিয়ে নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেল বেনি। ইউনিকর্ন নয়, অন্য একটা ঘোড়া নিয়ে এসেছে সে। সেটার পিঠে চেপে রওনা হয়ে গেল ওদের র্যাঞ্চটার দিকে।
আবার মুসার কাছে ফিরে এল কিশোর।
কিছু দেখলে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছে মুসা।
তেমন কিছু না। কথাও ঠিকমত শুনতে পারলাম না। তবে যা মনে হল, অনেক কথা চেপে রেখেছে ব্রড আর বেনি। রোডিও খেলা আর হারিকেনকে নিয়ে। আলোচনা করছিল ওরা।
জানতাম! যত শয়তানী ওদেরই।
প্রমাণটমাণ থাকলে এখন ধরতে পারতাম, নিজেকেই যেন বলল কিশোর।
ক্যাম্পে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল রবিনের সঙ্গে। ওদের দেরি দেখেই দেখতে আসছিল কিছু হলো কিনা। বলল, লুক আমাকে পাঠিয়েছে দেখার জন্যে।
চলতে চলতে সব কথা তাকে জানাল কিশোর।
পাইক আর নিরেকের ব্যাপারটা কি তাহলে? রবিনের প্রশ্ন। ওরাও কি ব্রড আর বেনির সঙ্গে জড়িত? নাকি ওদের সঙ্গে এরা দুজন গিয়ে হাত মিলিয়েছে?
জানি না, আসলেই কিছু বুঝতে পারছে না কিশোর। ওই ঘোড়া চুরির ব্যাপারে হয়ত কিছুই জানে না পাইকেরা। ব্রড আর বেনিই করেছে।
তবে মোটিভ দুই দলেরই আছে। হতে পারে, না জেনেই একদল আরেক। দলের সাহায্য করে চলেছে।
এর মানে, মুসা বলল, ব্রড আর বেনি দুজনেই চাইছে লিলি রোডিওতে যোগ দিতে না পারুক, যাতে বেনির জেতাটা নিশ্চিত হয়…
কিংবা নিরেক আর পাইক চাইছে, রবিন বলল, গোলমাল বাধিয়ে দিয়ে লিলিকে সরাতে, যাতে র্যাঞ্চটা ওরা দখল করতে পারে।
কিশোর কিছু বলছে না। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে।
ওদেরকে দেখে লুক বলল, অনেক দেরি করে ফেললে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল চোখে সন্দেহ নিয়ে। তারপর বলল, রাত হয়েছে। এবার শুতে যাও।
স্লীপিং ব্যাগটা যেখানে রেখেছিল সেখানে পেল না কিশোর। টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে খানিক দূরে, গাছের জটলার ভেতরে। আশ্চর্য! বিড়বিড় করল,
কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আমার স্লীপিং ব্যাগ। মালপত্র থেকে খুলে নিয়ে গিয়ে ওখানে ফেলে রেখেছে।
ভুলে নিজের মনে করে কেউ খুলেছিল হয়ত। চলো, নিয়ে আসি।
চলো।
ব্যাগ তোলার জন্যে হাত বাড়িয়েই থমকে গেল কিশোর। পরিচিত একটা শব্দ। তবে কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। ছোট ছোট নুড়ি থলেতে রেখে ঝাঁকালে যেমন শব্দ হয় অনেকটা তেমনি।
ধুকধুক করছে তার বুক। কি আছে ব্যাগের ভেতরে? খুব সাবধানে ব্যাগটা খুলে দুই কোণ ধরে উপুড় করল, ঝাঁকি দিল জোরে জোরে।
ভেতর থেকে পড়ল একটা সাপ। মাটিতে পড়েই হিসহিস করে ফণা তুলল। ছোবল মারার জন্যে। মারাত্মক বিষাক্ত র্যাটল স্নেক।
.
১১.
চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ছুটে এল ব্রড। কি হয়েছে? চেঁচাও কেন?
ব্যাগটা সাপটার ওপর ছুঁড়ে মারল কিশোর। বলল, সাপ!
কি?
সাপ ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার ব্যাগে।
ঝনঝন আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছে ব্রড। তাড়াতাড়ি একটা লাঠি কুড়িয়ে এনে ব্যাগ তুলে সাপটাকে মারতে লাগল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ঢুকল কি করে?
কি হয়েছে? এত চেঁচামেচি কিসের? ঘোড়াগুলোকে যেখানে বাঁধা হয়েছে, সেখানে শুয়েছিল লুক, পাহারা দেয়ার জন্যে। দৌড়ে এল।
কিশোরের স্লীপিং ব্যাগে সাপ।
অবাক মনে হলো লুককে। সাপ? কে ঢোকাল? এটা কি ধরনের রসিকতা?
যেন দোষটা কিশোরেরই, সে-ই ঢুকিয়েছে। কে ঢুকিয়েছে কি করে বলব? ব্যাগটা সরিয়ে নিয়েছে, তারপর সাপ ঢুকিয়ে ওখানে ফেলে রেখেছে।
অসম্ভব…
আর একটা মিনিটও আমি থাকছি না এখানে! পেছন থেকে বলে উঠল মিসেস ব্যানার। র্যাঞ্চে ফিরে যাব।
এত রাতে? লুক বলল, কে নিয়ে যাবে?
তার আমি কি জানি? আমি থাকব না। তুমি র্যাঞ্চের ফোরম্যান, মেহমানদের দেখাশোনা করা তোমার দায়িত্ব। আমি কোন কথা শুনতে চাই না, এই জঙ্গল। থেকে বেরোতে চাই।
বেশ, লুক বলল, যেতে আপত্তি নেই আমার। তবে যে ভয়ে আপনি যেতে চাইছেন, বনের ভেতর দিয়ে এখন যাওয়ার সময় এরকম ভয় অনেক পড়বে পথে। আরও বড় বড় ভয়ও আছে। পুরো দুটো ঘণ্টা লাগবে বন থেকে বেরোতেই। ভেবে দেখুন, থাকবেন, না যাবেন?
ঢোক গিলল মিসেস ব্যানার। ভয়ে ভয়ে তাকাল চারপাশের বনের দিকে। চাঁদের আলো আছে বটে, কিন্তু গাছপালার ভেতরে প্রচুর ছায়া। বোধহয় ভূতের ভয়েই গায়ে কাটা দিল তার। কাঁপা গলায় বলল, ঠিক আছে, কষ্ট আর দিলাম না তোমাকে। থেকেই যাই।
অনেকেই উঠে এসেছে। সবাইকে বলল লুক, আবার ব্যাগে ঢোকার আগে। ভাল করে দেখে নেবেন। একটা যখন ঢুকছে আরও ঢুকতে পারে।
টর্চ জ্বেলে ভাল করে যার যার ব্যাগ দেখে নিতে লাগল সবাই। কারও ব্যাগেই কিছু নেই। থাকবে কি, এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে ওরা ভেতর থেকে।
রবিন আর কিশোরের মাঝখানে শুয়ে চোখ মুদল কিশোর। ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আসতে চাইছে না ঘুম। মাথার মধ্যে ঘুরছে অসংখ্য প্রশ্ন। কে রাখল সাপটা? ব্রড? নাকি বেনি? এত লোকের চোখ এড়িয়ে কিভাবে রাখল? কখন?
.
পরদিন সকালে আর নতুন কিছু ঘটল না। নাস্তা সেরে র্যাঞ্চে ফিরে চলল দলটা।
মুসা, রবিন আর কিশোর ঘোড়া নিয়ে কাছাকাছি রইল। মুসা বলল, নদীটায় গোসল করার ইচ্ছে ছিল। চলো না, ফিরেই যাই। একাই র্যাঞ্চে ফিরতে পারব। আমরা।
কিশোর বলল, পরে। অনেক সময় পাবে গোসলের। আগে ইউনিকর্নকে খুঁজে বের করতে হবে। মনে হচ্ছে, সমস্ত চাবিকাঠি রয়েছে ব্রডের কাছে।
র্যাঞ্চে ফিরে ঘোড়া রেখে ঘরে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা, গোসল করে পরিষ্কার হওয়ার জন্যে। হারনি পাইকের ব্যাপারে খোঁজ নিতে যেতে চায় কিশোর, বলল সেকথা। রবিন বলল, তাহলে সে-ও যাবে শহরে। লাইব্রেরিটা দেখার জন্যে।
মুসাও ওদের সঙ্গে যেতে চাইল। কিন্তু কেরোলিনের অনুরোধে তাকে সাহায্য করার জন্যে থেকে যেতে হল ওকে।
লিলির পিকআপটা চেয়ে নিল কিশোর। ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠল সে আর রবিন। তবে এবার আর কোন অসুবিধে হলো না। গাড়িটাকে নষ্ট করার জন্যে কোন কৌশল করে রাখেনি কেউ।
ছোট শহরের প্রধান রাস্তাটার পাশেই পাকা বাড়িটা। সামনের পার্কিং লটে গাড়ি রাখল কিশোর।
রবিন বলল, আমি ভেবেছিলাম হারনি পাইকের ওপর থেকে সন্দেহ চলে গেছে তোমার।
শিওর হয়ে নিতে তো আপত্তি নেই, গাড়ির চাবি পকেটে রাখতে রাখতে বলল কিশোর। আমার ধারণা, ব্রড কোনভাবে জড়িত আছেই। আরও অনেকে থাকতে পারে, আর পাইকের যেহেতু মোটিভ আছে, তারও থাকার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। লুকের ভাবসাব দেখে তো তাকেও সন্দেহ হয়। তবে তার কোন মোটিভ খুঁজে পাই না।
এয়ার কণ্ডিশন করা লাইব্রেরি। পুরানো সংবাদপত্র আর মাইক্রোফিল্ম করা খবর ঘেঁটে ঘেঁটে পাইকের সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারল ওরা। বেশ কয়েকটা আর্টিকেল করা হয়েছে তাকে নিয়ে। মনটানার উন্নতি কিভাবে করতে চায় সে, সে কথা ফলাও করে লেখা হয়েছে যতভাবে সম্ভব। তবে পড়েটড়ে মনে হল লোকটা মোটামুটি পরিষ্কার। বদনাম নেই। কিছু লোকে অবশ্য পছন্দ করে না, এটা ঠিক।
আবার সেই দেয়াল, চোখের নিচে ডলতে ডলতে বলল রবিন। এগোনোর পথ বন্ধ।
মনে তো হচ্ছে, কিশোর বলল। তবে নিজে গিয়ে কিছু না করলেও টাকা খাইয়ে অন্যকে দিয়ে করাতে পারে। ইউনিকর্নকে চুরি করাতে পারে, গাড়িটা উড়িয়ে দিতে পারে, আমার ব্যাগে সাপ ঢুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে।
ব্রডকে দিয়ে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিংবা ওরকম অন্য কেউ। তবে দুজনকে একসাথে দেখিনি একবারও, সেজন্যেই ঠিক মেলাতে পারছি না। ধাতব ফাইল কেবিনেটে মাইক্রোফিলুগুলো আবার রেখে দিল সে। চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে রয়েছে মাথায়, ছাড়াতে পারছে না। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। পাইককে বাদ দিয়ে দিলে নিরেককেও দিতে হয়। তাহলে বাকি থাকে ব্রড আর বেনি।
ওরা দুজন একসাথে করছে এসব ভাবছ?
করতেই পারে। দুটো বইয়ের তাকের মাঝখান দিয়ে এগোতে এগোতে থমকে দাঁড়াল কিশোর। এক মিনিট, বলে এস লেখা একটা ভলিউম টেনে বের করল।
কি চাইছ?
কাল রাতের সাপটার কথা মনে নেই? পাতা ওল্টাতে লাগল কিশোর।
সে কি আর ভুলি নাকি?
ওটার ব্যাপারেই খচখচ করছে মনে।
রবিনও তাকাল বইটার দিকে।
র্যাটল স্নেক খুঁজে বের করল কিশোর। অনেক জাতের রয়েছে, বিড়বিড় করে পড়ল সে, ডায়মণ্ড ব্যাক, টিম্বার স্নেক, সাইডউইণ্ডার। একই প্রজাতির সাপের মধ্যেও আবার পুব অঞ্চল আর পশ্চিম অঞ্চলের সাপে তফাত রয়েছে।
যাই হোক, রবিন বলল, আমাদের ইনি এসেছিলেন একটা রাজ পরিবার থেকে।
চকচক করছে কিশোরের চোখের তারা। দুদিকে চাপ দিয়ে ঝটাৎ করে বন্ধ করল বইটা। বুঝলাম!
বলে ফেলো, শুনি?
আমাদের সাপটা এই অঞ্চলের নয়, রবিন। মনে পড়ে, কিভাবে পাশে লাফ দিয়ে দিয়ে চলছিল? ওটা মরুভূমির সাপ! রবিনের চোখে চোখে তাকাল কিশোর, মিস্টি ক্যানিয়নে মরুভূমি নেই।
ভুরু ওপরে উঠে গেল রবিনের। বেশ, ধরলাম এটা একটা সূত্র। কিন্তু তাতে কি?
এখুনি কিছু বলতে পারছি না। তবে জবাবটা বের করতে হবে। লাইব্রেরির শীতল পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতেই গায়ে ঝাঁপটা মারল যেন গরম। গাড়িতে উঠল ওরা। ঠিক মিলছে না, বুঝলে। ঘোড়ার ওপর যথেষ্ট মায়া ব্রডের। সে জেনেশুনে ইউনিকর্ন কিংবা হারিকেনের ক্ষতি করবে, এটা বিশ্বাস হয় না।
ফিরে চলল দুজনে। একটা মোড়ের কাছে এসে ডাবল সির দিকে না গিয়ে আরেক দিকে ঘুরল কিশোর।
এই, কোথায় যাচ্ছ? রবিনের প্রশ্ন।
বেনি কুপারের সঙ্গে কথা বলতে।
বলবে?
দেখাই যাক না। না গেলে জানব কি করে?
ডাবল সির সঙ্গে কুপার র্যাঞ্চের অনেক পার্থক্য। প্রথমটা রাত হলে এটা দিন, এতটাই অন্য রকম। সমস্ত বাড়ি নতুন রঙ করা। মূল বাড়িটা ধবধবে সাদা, অন্যগুলো রেডউড কাঠের রঙ। বিকেলের রোদে ঝলমল করছে। থাম আর জানালার খড়খড়ি সব সবুজ রঙের।
জায়গা বটে, মৃদু শিস দিতে লাগল রবিন।
চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক গাছ। ওগুলোর ছায়ায় কাজ করছে। শ্রমিকেরা। মেহমানরা ঘোরাফেরা করছে। বাচ্চারা খেলছে, হাসছে। মুরগীর রোস্টের গন্ধে খিদের কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের।
বাপরে বাপ! গাড়ি থেকে নামতে নামতে রবিন বলল, এরকম জায়গা ছেড়ে লিলির ফকিরা র্যাঞ্চে কেন থাকতে যাবে লোকে?
মূল বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে বেল বাজাল কিশোর। খুলে দিল রুক্ষ হচেহারার ধূসরচুল এক পঞ্চাশ বছর বয়েসী মহিলা। নিজের পরিচয় দিল এলিনা কুপার বলে, বেনির ফুফু। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কি চাই?
বেনির সঙ্গে কথা বলব, কিশোর বলল।
ওর বন্ধু, নাকি ভক্ত?
আসলে, আমরা ডাবল সির মেহমান। ইউনিকর্নকে খুঁজে বের করতে আমাদের অনুরোধ করেছে লিলি।
ঘোড়াটা পালিয়েছে শুনছি, ঠোঁট বাঁকাল মহিলা। হবেই এরকম। ওরকম একটা পাগলা ঘোড়া কি আর আটকে থাকে বেশিদিন। কিন্তু বেনিকে কেন? ও তো কিছু জানে না। ঘড়ি দেখল এলিনা। চলে আসবে।
কোথায় গেছে?
তীক্ষ দৃষ্টিতে কিশোরের মুখের দিকে তাকাল মহিলা। প্র্যাকটিস করতে। আলাদা নিরালা জায়গায় গিয়ে করে সে। র্যাঞ্চের গণ্ডগোল পছন্দ করে না। ইচ্ছে নেই তবু যেন জোর করেই বলল, চাইলে ভেতরে বসতে পারো?
বেনির আব্বার সঙ্গে কথা বলা যাবে?
ভ্রূকুটি করল এলিনা। শহরে গিয়েছিল, এল কিনা বলতে পারছি না। এক কাজ কর। অনেক হ্যাণ্ড আছে, ওদের কারও কাছে খোঁজ নাও।
থ্যাংকস, বলে কিশোর সরে আসার আগেই তার মুখের ওপর দরজাটা লাগিয়ে দিল মহিলা।
অল্প বয়েসী একটা স্ট্যাবল বয়কে ধরল দুই গোয়েন্দা। বেড়া মেরামত করছে। বেনির আব্বার কথা কিশোর জিজ্ঞেস করলে সে হাত তুলে লম্বা, নিচু চালাওয়ালা। একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, চিড়িয়াখানায় আছে।
চিড়িয়াখানা? রবিনের প্রশ্ন।
হ্যাঁ, সাপখোপ পোষে তো, ছেলেটা বলল। তোমরা শোনোনি? যেতে চাইলে যাও, তবে বাইরে থাকবে। আজ যেন কেউ না ঢোকে মানা করে দিয়েছেন। মিস্টার কুপার।
চট করে রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। আবার ছেলেটার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কেন?
হাত ওল্টাল ছেলেটা, জানি না। ফোরম্যান আমাদেরকে জানিয়ে দিল, শুনলাম, ব্যস। তোমরা ঘরে গিয়ে বস। মিস্টার কুপার বেরোলে আমি বলব।
আচ্ছা।
রবিনকে নিয়ে র্যাঞ্চ হাউসে ফিরে যাওয়ার ভান করল কিশোর। যেই ছেলেটা আরেক দিকে ফিরল অমনি লুকিয়ে পড়ল একটা বাড়ির আড়ালে। তারপর বেড়ার আড়ালে আড়ালে দুজনে এগিয়ে চলল চিড়িয়াখানার দিকে।
মরুভূমির র্যাটলম্নেক নিশ্চয় রাখে না এখানে, কি বলো? রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল বটে কিশোর, কিন্তু প্রশ্নটা করেছে নিজেকেই।
চলো, গেলেই দেখতে পাব।
আস্তে করে ঠেলা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। পেছনে রবিন। এগিয়ে চলল কাচের বাক্সগুলোর পাশ দিয়ে। বিচিত্র সব প্রাণী ওগুলোর ভেতরে। সাপ, শিংওয়ালা ব্যাঙ, গিরগিটি, কচ্ছপ আর মরুভূমির কয়েক ধরনের ইঁদুর জাতীয় জীব। পেছনে আচমকা হিসহিস শব্দ হতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। দেখল, ছোট একটা গিলা মনস্টার তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
এই, দেখে যাও, হাত তুলে ডাকল রবিন। একটা কাচের বাক্স দেখাল। খালি। ভেতরে কে বাস করত নেমপ্লেট দেখেই বোঝা যায়। মরুভূমির একটা র্যাটলম্নেক।
খুলে গেল দরজা। দড়াম করে গিয়ে বাড়ি লাগল দেয়ালে। রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন কুপার, যাও, ভাগ! লাল হয়ে গেছে মুখ। কে ঢুকতে বলেছে? একটা সাপ ছুটে গেছে, কখন কামড়ে দেয়…
আমি জানি, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। কাল রাতে আমার স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে পেয়েছি ওটাকে।
হাঁ হয়ে গেলেন কুপার। এই সময় কিশোরের নজরে পড়ল তার কোমরের বেল্টে রূপার বাকলস, হারিকেনের স্টলের বাইরে যে জিনিস দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছিল তাকে, সে রকম। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পেয়েছ?
ক্যাম্পিঙে গিয়ে কিভাবে সাপটাকে পেয়েছে কিশোর, সব খুলে বলল, কেবল বাদ রাখল ব্রডের সঙ্গে বেনির গোপন সাক্ষাৎকারের কথাটা।
চুপ করে সব শুনলেন কুপার। সন্দেহ যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই পেয়েছ? রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি।
পেয়েছি।
ঘাড় লাল হয়ে গেছে কুপারের। তোমার ব্যাগে গেল কি করে?
নিশ্চয় কেউ নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এমন কেউ, সাপ নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে যার।
দ্বিধায় পড়ে গেলেন কুপার। জবাব দিতে অস্বস্তি বোধ করছেন। তাহলে আর কে হবে? আমার র্যাঞ্চের অনেকেই সাপ নাড়াচাড়া করে। কিন্তু প্রতিটা লোককে চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারি আমি। ব্রড় যাওয়ার পর থেকে সামান্যতম গোলমালও হয়নি আর।
ব্রড জেসনের কথা বলছেন?
শক্ত হয়ে গেল কুপারের চোয়াল। ওটা একটা ক্রিমিন্যাল। চাকরি থেকে বের করে দিয়েছিলাম তো, প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজছে। আমার যাতে দোষ হয়, সেজন্যে নিয়ে গিয়ে সাপ ঢুকিয়ে দিয়েছে ডাবল সির মেহমানের ব্যাগে।
অনেকেই তাহলে সাপ নাড়াচাড়া করে এখানে? কুপারের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
করেই তো। সাপে কামড়ালে কি করতে হয় তা-ও জানে। জানতে হয়, কারণ র্যাটলের বিষ মারাত্মক।
কয়েক দিনের মধ্যে এখানে ঢুকেছিল ব্রড? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা খারাপ! কালো হয়ে গেল কুপারের মুখ। এখানে আর তাকে পা রাখতে দিই আমি। নিলে চুরি করে নিয়েছে।
শুনেছি আপনার মেয়ে বেনির সঙ্গে তার খাতির ছিল। এখনও আছে?
আরে দূর! যখনই বুঝে গেছে ব্যাটা একটা চোর, অমনি সরে এসেছে। ব্রডটা। তো ওর সঙ্গে খাতির করেছে সম্পত্তির লোভে, জানে তো, সবই একদিন বেনির হবে। লাভ হল না। ওরকম একটা চোরের জন্যে কোন দুর্বলতা থাকতে পারে না। বেনির। তাছাড়া এখন ওসব মন দেয়ানেয়ার সময়ও নেই ওর। রোডিও নিয়ে। ব্যস্ত। জিততে পারলে অনেক সুবিধে। বিজ্ঞাপন এমনকি ছবিতে অভিনয় করারও সুযোগ পাবে, একটা জাতীয় রোডিও সফরে যেতে পারবে।
তার মানে জেতাটা তার জন্যে খুব জরুরী, বিড়বিড় করল কিশোর।
খুবই। ওর জীবনই বদলে দেবে এটা, গর্বের সাথে বললেন কুপার। রবিন আর কিশোরকে নিয়ে চললেন বাইরে। পশ্চিমের পাহাড়ের ওপরে যেন ঝুলে রয়েছে সূর্যটা, তাকালেন সেদিকে। ভাবছি, এখনই যাব ডাবল সিতে। সাপের দাম চাইতে। দেখি, লুক বোলান কি বলে?
কিছু বলল না রবিন কিংবা কিশোর। সাপের দাম চাইবেন কি চাইবেন না সেটা কুপারের সমস্যা। ওরা এগোল পিকআপের দিকে।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে ব্রডই আমাদের লোক, নিচু স্বরে বলল রবিন।
হয়তো।
গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো কিশোর। খোয়া বিছানো পথ থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, এক বোতল কোক খেলে কেমন হয়?
চমৎকার।
গলা শুকিয়ে গেছে দুজনেরই। কাজেই ডেরিক লংম্যানের দোকানে এসে দুই বোতল কোক কিনল। গলা ভিজিয়ে নিয়ে ফিরে চলল ডাবল সিতে।
কিশোর বলল, ব্রড যদি সত্যিই বেনিকে চায়, তাহলে জিততে সাহায্য করবে। কেন? জিতলে তো চলে যাবে বেনি, হারাবে তাকে ব্রড।
তাতে কি? মনের মিল থাকলেই হয়। ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়বে ব্রডও, চলে যাবে বেনির সাথে। ভালই হবে। কুপারের আওতা থেকে সরে যেতে পারবে। এমনও হতে পারে, বেনি গিয়ে তার সাহায্য চেয়েছে। ব্যস, সাহায্য করছে সে। কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, হয় না এরকম?
হাসল কিশোর, হয়।
ডাবল সিতে ঢোকার মুখে কুপারের গাড়িটা বেরোতে দেখল ওরা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত নাড়লেন তিনি। তবে হাসি নেই, মুখ কাল করে রেখেছেন।
নিশ্চয় ভাল কিছু হয়নি? রবিনের প্রশ্ন।
মনে তো হচ্ছে না, সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল কিশোর। সে ও গাড়িটা পার্ক করল, ডিনারের ঘন্টাও বাজল।
উফ, খিদে যে পেয়েছে বুঝতেই পারিনি, রবিন বলল।
আমিও না। র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোল দুজনে। সিঁড়ি দিয়ে উঠছে এই সময় দরজা খুলে ছুটে বেরোল মুসা। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। চেঁচিয়ে উঠল, তোমরা এলে! ইউনিকর্ন! ইউনিকর্ন!
১২.
ইউনিকর্ন? জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি হয়েছে ওর?
রান্নাঘরের দরজার নিচে একটা নোট পেয়েছে লিলি। তাতে লেখা হয়েছে…
লিলি কোথায়?
ওপরে। ঘরে।
একটা মুহর্ত আর দেরি করল না কিশোর। দৌড় দিল। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে লাগল। পেছনে রয়েছে রবিন আর মুসা। জানালার চৌকাঠে লিলিকে বসে থাকতে দেখল ওরা। তাকিয়ে রয়েছে মাঠের দিকে। কাঁধ ঝুলে পড়েছে। হাতে একটুকরো সাদা কাগজ।
তিন গোয়েন্দার সাড়া পেয়ে মুখ ফেরাল সে। কিশোরের চোখে পড়তে বলল, তুমি ঠিকই অনুমান করেছ। চুরিই করেছে। হাতের কাগজটা দলামোচড়া করে ফেলল। কিন্তু আমার এত বড় সর্বনাশ করলটা কে?
কিছুটা আন্দাজ করতে পারি আমি, জবাব দিল কিশোর।
কাগজটা কিশোরের হাতে দিল লিলি।
খুলল কিশোর। টাইপ করে লেখা রয়েছে, লিলি, ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিওতে তুমি যোগ দিতে গেলে মারা যাবে ইউনিকর্ন। তোমার ঘোড়া আমিই চুরি করেছি, গাড়িতে বাজি রেখে পুড়িয়ে দিয়েছি। তারমানে ঘোড়াটাকে মারতে যে আমার হাত কাঁপবে না বুঝতেই পারছ।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। লিলি, ব্রড জেসনের ব্যাপারে কতখানি জানেন আপনি?
বড় বড় হয়ে গেল লিলির সবুজ চোখ। ব্রড এতে জড়িত নয়।
সেটা জোর দিয়ে বলতে পারেন না। এমন কেউ ইউনিকর্নকে চুরি করেছে যে এই র্যাঞ্চের সব কিছুই চেনে। যে আপনার গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পায়।
সে রকম তো অনেকেই আছে এই র্যাঞ্চে।
সেই অনেকে কি জ্যান্ত ব্যাটলম্নেক নাড়াচাড়া করতে পারে? বাজি বিশেষজ্ঞ? আমার ব্যাগে যে সাপটা পাওয়া গেছে ওটা বনের সাপ নয়, মরুভূমির। নিয়ে আসা হয়েছে কুপারের চিড়িয়াখানা থেকে। কুপারের ধারণা, ব্রডই চুরি করেছে।
দাঁতে দাঁতে ঘষল লিলি। এইমাত্র গেল কুপার। সাপের দাম চাইতে এসেছিল। সোজা ভাগিয়ে দিয়েছে তাকে লুক। কুপারকে দুচোখে দেখতে পারে না। অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে লিলি। ওর ধারণা, ডাবল সিতে গোলমাল লাগানর মূলে ওই কুপার র্যাঞ্চ।
আপনার কি ধারণা?
কাকে দায়ী করব বুঝতে পারছি না। তবে ইউনিক আব্বাকে ফেলে দেয়ার পর অনেকগুলো অঘটন ঘটেছে এই র্যাঞ্চে।
আরেকবার নোটটা পড়ল কিশোর। ব্রডকে চাকরি দেয়ার পর থেকে অঘটনগুলো ঘটতে শুরু করেনি তো? ভাল করে ভেবে দেখুন।
না। ব্রডকে আমার সন্দেহ হয় না।
কিন্তু ওর ক্রিমিন্যাল রেকর্ড রয়েছে, রবিন বলল। চুরি করত।
এখন করে না। ইউনিকের ক্ষতিও করবে না। এই র্যাঞ্চের জন্যে ও একটা বিরাট সাহায্য। ভাল হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে।
কিন্তু ঘোড়াটাকে নিয়ে প্রচুর আজেবাজে কথা বলেছে সে, রবিন বলল।
ও কিছু না। বাবাকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছে বলে রাগ। তাই বলে পছন্দ করে না এটা ঠিক নয়। উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরের হাত থেকে নোটটা নিল লিলি। আরেকবার পড়ল। আমাকে খুন করার চেষ্টা সে কেন করবে?
গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন তো? কিশোর বলল, করেছেহয়তো বেনিকে সাহায্য করার জন্যে। আপনাকে ঠেকাতে চাইছে যাতে রোডিওতে যোগ দিতে না পারেন, যাতে বেনির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারেন। আপনি গেলে তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মাথা নাড়ল লিলি, বুঝতে পারছি না কি করব?
আর, যাই করেন, রোডিওতে যোগ না দেয়ার চিন্তা করবেন না। এখন বলুন, র্যাঞ্চে টাইপরাইটার আছে?
একটা। তবে নোটের লেখা আর ওটার লেখা এক নয়। হরফ মেলে না।
নোটটা নিয়ে গিয়ে ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ডকে দেখান। ইউনিকর্নের চুরির ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিতে পারে এবার।
আবার বাজল ডিনারের ঘণ্টা। মুসা বলল, চলো, আমার খিদে পেয়েছে।
আমার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে, লিলি বলল। তোমরা যাও। একটু পরেই আসছি। কেরোলিন আন্টিকে চিন্তা করতে মানা করো।
করিডরে বেরিয়ে রবিন বলল, করতে মানা করলেই কি আর চিন্তা করা বন্ধ করে দেবেন। উদ্বেগ নিয়েই যেন জন্মেছেন মহিলা, সবার জন্যেই খালি চিন্তা।
বোনপোর কথা শুনুক আগে, মুসা বলল, তারপর দেখবে চিন্তা কাকে বলে। সত্যি, ব্রডটা যে কেন একাজ করতে গেল। ভীষণ কষ্ট পাবেন মহিলা। আরও বেশি কষ্ট লাগবে চাকরিটা তিনিই দিয়েছেন বলে।
কিশোর কিছু বলল না। চুপচাপ এসে ঢুকল ঘরে। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এল। কাপড় পাল্টাল। চুল আঁচড়াল। কি যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না ওর। ঠিক করল, খাওয়ার পর ভাবতে বসবে। প্রথম থেকে যা যা ঘটেছে সব খতিয়ে দেখবে। বোঝার চেষ্টা করবে কোন ব্যাপারটা মিস করেছে। যদি তা-ও বুঝতে না পারে, সরাসরিই গিয়ে ব্রডকে বলবে তার সন্দেহের কথা।
.
খাওয়ার পরে সবাইকে শান্ত দেখা গেল। কেউ আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিল, কেউ ঢেকুর তুলল, কেউ বা খিলাল দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগল। কেবল কিশোরই অস্থির। উসখুস করছে আর বারবার জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে মিস্টি ক্যানিয়নের দিকে। ওখানে, ওখানেই কোথাও নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ইউনিককে। ব্রড হয়ত জানে, কোথায়।
এমন কিছু কি আছে বাঙ্কহাউসে কিংবা ট্যাক রুমে যা ওর চোখ এড়িয়ে গেছে? থাকলে, গিয়ে খুঁজে বের করার এটাই সুযোগ। রবিনকে একধারে নিয়ে। গিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলল। তারপর উঠে এল ওপরে। একটা স্টেটসন হ্যাট মাথায় বসিয়ে, টর্চ হাতে বেরিয়ে এল। নিঃশব্দে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে চলে এল চত্বরে।
আকাশে মেঘ জমেছে। গায়ে লাগল ঠাণ্ডা বাতাস। দ্রুতপায়ে বাঙ্কহাউসের দিকে এগোল সে। কাছে এসে টোকা দিল দরজায়, ভেতরে কেউ আছে কিনা জানার জন্যে। সাড়া পেল না।
দম বন্ধ করে আস্তে ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা।
বড় একটা স্লিপিং রুম, একটা বাথরুম আর লকার রয়েছে বাঙ্কহাউসে। লকারগুলোতে আলো ফেলল। কাগজে নাম লিখে লিখে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ওগুলোর পাল্লায়, কার কোনটা বোঝানোর জন্যে। একটাতে দেখা গেল ব্রড জেসনের নাম। হ্যাঁণ্ডেল ধরে টান দিল কিশোর। জোরে ক্যাচকোচ করে খুলে গেল পাল্লা।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকটার জিনিসপত্র দেখতে লাগল সে। সন্দেহজনক আর কিছুই পেল না, একটা রূপার বাকলসওয়ালা বেল্ট বাদে। এক বাণ্ডিল চিঠিপত্র আর কাগজ দেখে সেগুলোতে চোখ বোলাল। এমনকি বুটের ভেতরেও খুঁজল। কিছু পেল না।
লকারের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। বাড়ির দিকে তাকাল, চত্বরে চোখ বোলাল। কাউকে দেখতে পেল না। তাকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি চলছে এরকম কোন লক্ষণও নেই। লিভিং রুমের জানালা দিয়ে মেহমানদের দেখা যাচ্ছে। পাতাবাহারের একটা বেড়ার আড়ালে চলে এল সে। বেড়াটা চলে গেছে ট্যাক রুমের কাছে। আড়ালে থেকে এগিয়ে চলল।
জানালা নেই ট্যাক রুমের। বাতাসে চামড়া আর তেলের গন্ধ। ঝুলিয়ে রাখা। জিনিসগুলোর ওপর আলো ফেলল সে। কোন কিছু অস্বাভাবিক লাগছে না, কিছু খোয়া গেছে বলেও মনে হচ্ছে না। ব্রডের ঘোড়ায় চড়ার সরঞ্জামগুলো খুঁজে কিছু পেল না।
হতাশ হল কিশোর। ঘড়ি দেখল। আধ ঘন্টা হয়েছে বেরিয়েছে। আর বেশি দেরি করা যাবে না, তাহলে কেউ লক্ষ্য করে বসবে যে অনেকক্ষণ ধরে সে নেই ওদের মাঝে। খোঁজ পড়তে পারে।
ভাবতে ভাবতেই গিয়ে মেডিক্যাল কেবিনেট খুলল সে। প্রতিটি টিউব আর শিশি-বোতলের লেবেল পড়তে লাগল। যদি কিছু পেয়ে যায়, এই আশায়। কিন্তু এখানেও নিরাশ হতে হলো তাকে।
কিন্তু আছেই, নিজেকে বোঝাল সে, থাকতেই হবে। না থেকে পারে না। নইলে হারিকেন অস্বাভাবিক আচরণ করল কেন? আরেকবার ভাল করে দেখতে গিয়ে একটা শিশির গায়ে চোখ আটকে গেল। আগের বার খেয়াল করেনি। একটা পারঅক্সাইডের বোতলের ওপাশে রাখা হয়েছে। লেবেল দেখার জন্যে বের করতে গেল ওটা, এই সময় পেছনে শোনা গেল বুটের শব্দ।
আরেকটু হলেই হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল শিশিটা। লেবেল দেখার সময় নেই। পকেটে রেখে দিল। সাথে করে নিয়ে যাবে। টর্চ নিভিয়ে দিল সে। দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল, চোখে না পড়ার জন্যে। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। আওয়াজটা কোথায় হলো? ট্যাক রুমের ভেতরে, না বাইরে?
ধক ধক করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। কি মনে হতে আস্তে করে ঘুরে তাকাল দরজার দিকে। বিশালদেহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, ছায়ামূর্তির মত। হাত তুলল লোকটা।
দম আটকে গেল যেন কিশোরের। লোকটার হাতে একটা চাবুক। এগিয়ে আসতে শুরু করল, যেন জানে কোথায় লুকিয়ে আছে কিশোর।
ঝট করে বসে পড়ল সে। শপাং করে উঠল লোকটার হাতের চাবুক। বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল কিশোরের মুখের কাছ দিয়ে।
.
১৩.
লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। ব্রড জেসন।
কে তুমি? বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল ব্রড। কিশোর? সত্যি সত্যি অবাক মনে হলো তাকে। এখানে কি করছ?
হারিকেনের মেজাজ যে খারাপ করানো হয়েছে তার প্রমাণ খুঁজছি।
আবার? তা তো খুঁজবেই। গোয়েন্দা যে তুমি একথাটা ভুলেই যাই।
টিটকারিটা গায়ে মাখল না কিশোর। চাবুকটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস কর, এটা নিয়ে এখানে কি কাজে এলেন?
রাগ কিছুটা গলে গেল ব্রডের। তুমি ঢুকেছ, বুঝতে পারিনি। ভাবলাম, ব্যানারদের চোরটা ঢুকেছে। চুপি চুপি ঢুকতে দেখলাম তো। তবে, বাড়ি লাগাতে চাইলে ঠিকই লাগাতে পারতাম। মিস করেছি ইচ্ছে করেই। সেটা প্রমাণ করার জন্যেই আলোটা নিভিয়ে দিল সে। আরেকবার হিসিয়ে উঠল চাবুক। বন্ধ হয়ে গেল মেডিসিন কেবিনেটের দরজা।
আবার আলো জ্বেলে বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়াল মাইক। তুমি জানলে আসতাম না। কিন্তু অযথা খুঁতখুঁত করছ। ঘোড়াটা চুরি হয়নি।
হয়নি? লোকটার চোখে চোখে তাকিয়ে এক কদম আগে বাড়ল কিশোর, তাহলে ইউনিকর্নের কি হয়েছে বলে আপনার ধারণা?
পালিয়েছে।
আপনি কিছু করেননি?
শক্ত হয়ে গেল ব্রডের চোয়াল। তার মানে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না তুমি। ভাবছ, যেহেতু একসময় চুরি করতাম, স্বভাবটা এখনও ভাল হয়নি। অকাজ। কুকাজ এখনও করে বেড়াই। ভুল করছ। আর দশজন সৎ কর্মীর মতই কাজ করি। আমি এখানে। ইউনিককেও চুরি করিনি, হারিকেনকেও ওষুধ খাওয়াইনি। কেনই বা করব এসব কাজ?
লিলি যাতে রোডিও জিততে না পারে, সেজন্যে।
কিসের জন্যে? ভুরু কুঁচকে গেল ব্রডের। তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। আমি তো চাই লিলি জিতুক।
তাতে যদি বেনি হেরে যায় তাহলেও?
জ্বলে উঠল ব্রডের চোখ। আঙুল শক্ত হলো চাবুকের হাতলে। তুমি ভাবছ লিলিকে স্যাবটাজ করছি আমি?
করছেন না? বেনির জন্যে?
দেখো, অনেক ভুল করেছি জীবনে, আর করতে চাই না। বেনির জন্যে দুর্বলতা আছে আমার, অস্বীকার করছি না। কিন্তু জিততে হলে বেনিকে নিজের ক্ষমতায় জিততে হবে। নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল ব্রড, আমিও রোডিও রাইডার। আমি বিশ্বাস করি, ষড়যন্ত্র করে এসব খেলায় কিছু হয় না। যদি ক্ষমতা থাকে, লিলিকে হারাতে পারবেই বেনি।
বেনিও কি তাই মনে করে?
ওকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই না আমি। আরেক দিকে তাকিয়ে বলল ব্রড।
দরজার কাছে চলে এল কিশোর। বেনির জন্যে ইনডিপেনডেন্স ডের রোডিও কতটা জরুরী?
ঢোক গিলল ব্রড। অনেক।
কেন?
সেটা তোমার জানার দরকার নেই।
আছে। একটা নোট এসেছে লিলির কাছে। তাতে লেখা হয়েছে সে ওই দিন। রোডিওতে যোগ দিলে ইউনিকর্ন মারা যাবে।
নিরেকের কাজ হতে পারে। কিংবা পাইকের। দুটো শয়তানই তো মেয়েটাকে জ্বালিয়ে মারছে, বলতে সামান্যতম দ্বিধা করল না ব্রড।
মাথা নাড়ল কিশোর। ওরা আমার ব্যাগে সাপ রাখতে যায়নি। সাপ। নাড়াচাড়া করতে পারে কিনা ওরা সে ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। গাড়ির নিচে বাজি রাখার সুযোগও ওরা পায়নি।
কিন্তু বেনিই বা কি ভাবে…? থেমে গেল ব্রড। কাঁধ ঝুলে পড়ল। তুমি হভাবছ আমি করেছি? তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছি?
বেনিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।
অবাক কথা শোনালে।
তাহলে বোঝান, বেনির জন্যে এই রোডিও কেন এত জরুরী?
বড় বড় হয়ে গেল ব্রডের নাকের ফুটো। বেশ। তাহলে বাপের থাবা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে, মুক্তি পাবে। বিজ্ঞাপনে, সিনেমায় অভিনয় করতে পারবে। রোডিও পুরস্কার হিসেবেই পাবে অনেক টাকা। কেন জরুরী, সেটা বোঝা কি এতই শক্ত?
বাবার সঙ্গে বেনির সম্পর্ক খারাপ নয়, কিশোর অন্তত সে রকম কিছু দেখেনি, সে কথা ভেবেই বলল, টাকার কি দরকার? বাপের তো অনেক টাকা আছে। একমাত্র সন্তান হিসেবে বেনিই সব পাবে।
পাবে তো ঠিক, পুতুল হয়েও থাকতে হবে। যা করতে বলবে কুপার, তাই করতে হবে ওকে। নিজের কোন ইচ্ছে থাকবে না, ভালমন্দের বিচার থাকবে না। এভাবে কি গোলামি করা যায় নাকি?
আপনাকে নিয়েও নিশ্চয় বেনির নিজস্ব ইচ্ছে আছে?
অবশ্যই আছে।
বাপের থাবা থেকে বেরোতে নিশ্চয় সব করতে রাজি বেনি? রেসের ঘোড়া
সব নয়, কিশোর, ভুল করছ। নিজের এবং বাপের সুনাম নষ্ট হয় এরকম কিছুই করবে না সে। তুমি কি ইঙ্গিত করছ বুঝতে পারছি। বিশ্বাস না হলে বেনিকেই গিয়ে জিজ্ঞেস কর। এই তো, মিনিট দশেক আগেও আমার সাথে ছিল।
অবাক হলো কিশোর। উদ্বিগ্নও। যত বার বেনি ডাবল সিতে ঢুকেছে, একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। কোথায়?
লেকের ধারে। চুরি করে আমার সাথে দেখা করতে আসে। আমার সাথে ওর মেলামেশা কুপারের পছন্দ নয়। অনেক বলা হয়েছে, আর বলার ইচ্ছে নেই, একথা ভেবেই যেন গটমট করে কিশোরের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ব্রড। বাইরের খোয়ায় তার বুটের চাপে খচমচ শব্দ হলো।
আলো নিভিয়ে দিয়ে এল কিশোর। দরজা দিয়ে বাইরে তাকাতে চোখে পড়ল। আকাশ ঢেকে গেছে মেঘে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জ্যাকেটের কলার তুলে দিয়ে দৌড় দিল সে, লেকের দিকে। ওখানে পৌঁছে বেনিকে পেল না।
ফিরে এল আবার। বাড়ির পেছনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে, লিলির ঘরে। বালিশে পিঠ দিয়ে বসে আছে লিলি। পকেট থেকে ছোট শিশিটা বের করল কিশোর। অর্ধেক ভরা। এটা হারিকেনকে খাওয়ালে কি ঘটবে বলুন তো?
লেবেল পড়ে লিলি বলল, ঘুমিয়ে পড়বে। এটা ডিপ্রেসেন্ট। খুব কমই। ব্যবহার করতে হয়। কোন কারণে ঘোড়া খেপে গেলে কিংবা ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠলে খাইয়ে দেয়া হয়। শান্ত হয়ে যায় তখন।
বোধহয় কিশোরের সাড়া পেয়েই ঘরে ঢুকল মুসা। এত দেরি করলে। আমি আর রবিন তো ভাবনায়ই পড়ে গিয়েছিলাম। আর পাঁচ মিনিট দেখতাম, তারপর খুঁজতে বেরোতাম। ওর হাতে একটা আপেল। গেঞ্জিতে সেটা মুছে নিয়ে কামড় বসাল।
উজ্জ্বল হয়ে গেল কিশোরের চোখ। চিৎকার করে বলল, মুসা, এক্কেবারে ঠিক সময়ে আপেলটা নিয়ে হাজির হলে!
বোকা হয়ে গেল মুসা। মানে?
আপেলে করেই ওষুধ খাওয়ান হয়েছে ইউনিকর্নকে। আধ খাওয়া একটা আপেল দেখেছি ওর স্টলে। পরদিন গিয়ে দেখি ওটা নেই।
আরে বুঝিয়ে বল না! হাত তুলল মুসা। চোখের কোণ দিয়ে দেখল রবিনও ঢুকছে। বলছ তো উল্টো কথা। ইউনিকনের মেজাজ খারাপ হয়নি, হয়েছে। হারিকেনের। ইউনিকর্ন চুরি হয়েছে।
প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপছে তখন কিশোর। একটা ভুল করেছি আমি। ইউনিকর্ন চুরি হয়নি, হয়েছে হারিকেন। কেউ একজন বেরোতে সাহায্য করেছে। ঘোড়াটাকে। তারপর তার পিঠে চেপে চালিয়ে নিয়ে গেছে। ইউনিকর্নের পিঠে কেউ চাপতে পারে না, কিন্তু হারিকেনের পারে। সে রাতে এই ওষুধ খাওয়ানো। হয়েছিল ইউনিকর্নকে, শিশিটা দুই সহকারীকে দেখাল কিশোর।
কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে যেন লিলির চোখ। তারমানে আমি সে রাতে। ইউনিকর্নের পিঠে চড়েছিলাম! এই জন্যেই ফেলে দিয়েছিল ঝাড়া মেরে!
হ্যাঁ, হঠাৎ করে হারিকেনের মেজাজ খারাপ দেখা যাওয়ার জবাবও এটাই, মাথা দুলিয়ে বলল রবিন।
কিশোর বলল, আমার বিশ্বাস বেনিই একাজ করেছে, লিলির দিকে তাকাল সে, আপনাকে থামানোর জন্যে অদলবদল করে রেখেছিল ঘোড়াদুটোকে, একটার স্টলে আরেকটাকে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
বেনি? বিড়বিড় করল লিলি, বিশ্বাস করতে পারছি না!
ওর মোটিভ আছে, সুযোগও ছিল। ক্যাম্পিং করেছি যে রাতে সে রাতে বনের মধ্যে ব্রডের সঙ্গে দেখেছি ওকে। সাপটা নিশ্চয় সে-ই এনে ছেড়ে দিয়েছিল আমার। ব্যাগে। ব্যানারদের জিনিস যেদিন চুরি হয় সেদিনও বেনি এখানে এসেছিল।
বারবিকিউতেও ছিল, মুসা বলল।
আজও ব্রডের সাথে দেখা করতে এসেছিল। দরজার নিচে নোটটা ফেলে রেখে যেতে পারে সে, রবিন বলল।
কিন্তু বাজি রেখে গাড়ি পোড়াতে পারে না, প্রশ্ন তুলল লিলি।
ব্রড তাকে সাহায্য করে থাকতে পারে, মুসা বলল। আর বেনিরও না পারার কোন কারণ তো দেখি না।
তোমরা তাহলে এখনও সন্দেহ করো তাকে?
না করার কোন কারণ নেই, কিশোর বলল। বরং করার পক্ষেই যথেষ্ট কারণ আছে।
ঠিক, রবিন বলল। কিশোর, একটা ব্যাপার বুঝলাম না। তুমি বলছ, হারিকেন আর ইউনিকর্নকে বদল করে ফেলা হয়েছে। তাহলে তফাতটা বুঝলাম না কেন আমরা? হারিকেনের খুরের কাছে না সাদা লোম আছে?
ওরকম সাদা সহজেই করে দেয়া যায়, হাসল কিশোর। পারঅক্সাইড ওষুধ। খাইয়ে ইউনিকর্নকে শান্ত করেছে বেনি, তারপর তার পায়ের লোম সাদা করেছে। সেজন্যেই ঘোড়াটার স্টলের কিছু কিছু খড় সাদাটে লেগেছে। ঘোড়ার পায়ে ঢালতে গিয়ে খড়ে পড়ে গিয়েছিল পারঅক্সাইড।
তার পর, কিশোরের মনের কথাগুলোই যেন পড়ছে রবিন, হারিকেনকে বের করে নিয়ে গিয়ে ওর স্টলে ঢোকানো হয়েছে ইউনিকর্নকে।
এবং সবাই মনে করেছে, যোগ করল কিশোর, হারিকেনেরই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
বেশ, চলো, বালিশ সরিয়ে বিছানা থেকে নামল লিলি। আমি দেখলেই বুঝব, সত্যিই আসল সাদা, না পারঅক্সাইড দিয়ে করা হয়েছে।
চলুন, কিশোর বলল। শিওর হয়ে নিয়ে বেনির সঙ্গে গিয়ে কথা বলব। আমার ধারণা, ডাবল সির আশেপাশেই কোথাও আছে সে।
চলো। এসব সত্যি হলে বেনিকে আমি ছাড়ব না। জ্বলে উঠল লিলির সবুজ চোখ।
পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে চত্বরে বেরোল চারজনে। বাতাস বেড়েছে। ফোঁটা, ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে।
আকাশের এক প্রান্ত চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। বিকট শব্দে বাজ পড়ল। পাহাড়ের মাথায়। আস্তাবলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিলি। সুইচ টিপে আলো জ্বালল। হারিকেনের স্টলের দিকে তাকিয়েই থমকে গেল। অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল মুখ থেকে।
স্টলটা খালি!
পাক দিয়ে উঠল কিশোরের পেট।
এবার? রবিনের জিজ্ঞাসা।
স্টলের কাছে দৌড়ে গেল কিশোর। তার ওপাশের আস্তাবল থেকে বেরোনোর দরজাটা খোলা। জোর বাতাসে দড়াম করে বাড়ি খেল পাল্লা। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আবার। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল কংক্রীটের মেঝে।
এই দরজা দিয়েই ইউনিকর্নকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও।
.
১৪.
এটাও গেল? বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালে হেলান দিল লিলি। দাঁড়িয়ে থাকার জোর পাচ্ছে না যেন।
বেশিক্ষণ হয়নি, কিশোর বলল। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল আরেকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্রড় জেসন। ওকে বলল সে, ইউনিকর্ন আর হারিকেন দুটোকেই চুরি করেছে বেনি।
হারিকেনের খালি স্টলটার দিকে তাকাল ব্রড়। কি বলছ?
লিলি বলল, কিশোরের ধারণা, ঘোড়াদুটোকে অদলবদল করা হয়েছিল। হারিকেনকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, বেনি, ইউনিকর্নকে হারিকেনের স্টলে ঢুকিয়ে রেখে। যেটাকে হারিকেন ভাবা হয়েছে আসলে সেটা ছিল ইউনিকর্ন।
অসম্ভব! দুটো ঘোড়ার স্বভাবই আলাদা!
কিশোর যা বলেছে সব ব্রডকে খুলে বলল লিলি। শেষে বলল, কিশোর বলছে, এসবে তুমিও জড়িত আছ।
ওকে আগেই বলেছি আমি এসবে নেই, জোর গলায় বলল ব্রড়। বেনিও নেই।
বেশ, তাহলে প্রমাণ করুন, এগিয়ে এল কিশোর। কোথায় ঘোড়া লুকিয়ে রেখেছে বেনি, আন্দাজ করার চেষ্টা করছে সে। চলুন, ঘোড়াগুলোকে বের করে আনি।
বলতে দ্বিধা করল না ব্ৰড়, চলো।
গুড। এবার বলুন তো, বেনির প্রাইভেট কোরালটা কোথায়? যেখানে সে প্র্যাকটিস করে?
কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে এই বার দ্বিধা করল ব্ৰভ। বেনি রাগ করবে। আমি ওকে ঘোড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও বলেছে দেখেনি।
প্র্যাকটিস কোথায় করে? ব্রডের কথার গুরুত্বই দিল না কিশোর।
আবার দ্বিধা করল ব্রড। মিস্টি ক্যানিয়নের পশ্চিম ধারে। পাহাড়ের ভেতরে। একটা প্রাকৃতিক ঘের রয়েছে, একেবারে বেড়া দেয়া কোরালের মতই।
ওদিকটায় তো গিয়ে খুঁজে এসেছে লুক, কিশোরকে জানাল লিলি, পায়নি। বেনির সাথেও কথা বলেছে…
শুনল না কিশোর। ব্রডকে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়া রাখার কোন জায়গা আছে ওখানে? ঘরটর?
খড়ের একটা ছাউনি শুধু, ব্রড জবাব দিল। তবে দুটো ঘোড়া সহজেই জায়গা হয়ে যাবে।
রবিন বলল, হয়তো ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল হারিকেনকে বেনি। লুকের লোকেরা খেয়াল করেনি। কিংবা কল্পনাই করতে পারেনি বেনি নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখবে। অনুমতি ছাড়া প্রাইভেট এলাকায় ঢুকে বিপদে পড়তে চায়নি।
শোনো… বলতে গিয়ে বাধা পেল ব্রড।
কিশোর তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেখানে কি করে যেতে হয়?
তুমি পারবে না। রাস্তা নেই। ঝড়বাদলার রাত। খুঁজেই পাবে না।
ও ঠিকই বলেছে, লিলি বলল কিশোরকে। পাহাড়গুলো তো আমি চিনি। এমন রাতে যাওয়াই মুশকিল। বনের ভেতর দিয়ে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, নদীর ধার দিয়ে যেতে হয়।
কোন নদী? জানতে চাইল কিশোর, যেটার কাছে গিয়ে হারিকেনকে হারিয়ে যেতে দেখেছি?
হ্যাঁ। ওটার কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা খড়িমত আছে, ওখানেই।
আর কিছু জানার নেই আমার। বলেই রবিনের দিকে ঘুরল কিশোর, শেরিফের অফিসে ফোন করো। বলবে এখানে আর কুপার র্যাঞ্চে যেন অফিসার পাঠান।
তুমি কি করবে? জিজ্ঞেস করল ব্রড।
আমি যাচ্ছি বমাল চোর ধরতে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, মুসা, চলো জলদি।
ওদের পিছে পিছে এল লিলি। কিশোর, দাঁড়াও। এখন যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ওই পাহাড়গুলোকে তোমরা চেনো না। সাংঘাতিক বিপদে পড়বে।
বিপদকে ভয় করলে চোর ধরতে পারব না। তাছাড়া এরকম কাজ করে অভ্যাস আছে আমাদের। আকাশ চিরে দিল বিদ্যুৎ শিখা। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কিশোর বলল, এমনিতেই হয়ত দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়াসহ চোর ধরতে না পারলে আর তাকে ধরা যাবে না। প্রমাণও করতে পারব না কিছু। এই একটাই সুযোগ আমাদের।
আস্তাবলে ঢুকল কিশোর আর মুসা। যার যার ঘোড়ায় জিন পরাতে লাগল। আগেরগুলোই নিল, কিশোরের জেনারেল উইলি, মুসার ক্যাকটাস। বেল্টের বাকলস আঁটতে আঁটতে কিশোর বলল, তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের। একটাই ভরসা, ইউনিকনের পিঠে চড়তে পারবে না চোর। যতই ওষুধ খাওয়ানো হোক।
ইউনিকর্নকে মেরেটেরে ফেলবে না তো?
কিছুই বলা যায় না। রাশ ধরে টেনে জেনারেলকে বাইরে নিয়ে এল। কিশোর। পিঠে চেপে বসল।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ছুটল দুই ঘোড়সওয়ার। আগে আগে চলেছে কিশোর, হাতে টর্চ। মুসার কাছেও টর্চ আছে, কিন্তু জ্বালছে না। তেমন প্রয়োজন না পড়লে জ্বালবে না। অহেতুক ব্যাটারি খরচ করতে চায় না।
বৃষ্টি ভেজা মাঠ পেরিয়ে বনে ঢুকল দুটো ঘোড়া। বনের ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চেনা পথ, তবুও ভুল হয়ে যেতে চায়। এসব কাজে মুসা কিশোরের চেয়ে পারদর্শী। কাজেই এখন আগে আগে চলল সে।
গাছের ডালে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। পাহাড়ের ঢালে উঠে কয়েকবার করে। পা পিছলাল দুটো ঘোড়াই। বন পেরিয়ে খোলা জায়গা। চলে এল ওরা সেই শৈলশিরাটায়, যেখানে অদৃশ্য হয়েছিল হারিকেন। ঢাল বেয়ে নদীর পাড়ে নামাটাই হল সবচেয়ে কঠিন। জেনারেল উইলির মত ভাল ঘোড়াও নামতে রাজি হতে চাইল না। জোরজার করেই নামাতে হলো।
তবে নামল নিরাপদেই।
নদীর পাড়ে ঘোড়ার পায়ের তাজা ছাপ দেখে আশা বাড়ল কিশোরের। তবে পাশে মানুষের পায়ের ছাপ নেই। অবাক কাণ্ড! তাহলে কি ইউনিকনের পিঠে চড়েই গেছে? সেটা করে থাকলে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে। যেভাবেই যাক, তার অনুমান। ঠিক, বেনির কোরালের দিকেই গেছে চোর।
নদীর পাড় ধরে পশ্চিমে এগোল দুজনে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে পাহাড়ের মাথায়। মুষল ধারে ঝরছে বৃষ্টি। কিশোরের মনে হলো হাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। ঠাণ্ডা।
নদীর কাছ থেকে সরে এল পথ। তবে চিহ্ন দেখে এগোতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে গেছে মাটি। তাতে স্পষ্ট বসে আছে খুরের তাজা দাগ।
ঘন বনের ভেতরে ঢুকল আবার ওরা।
হঠাৎ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাকটাস। জেনারেল উইলি থামল তার পেছনে। নিশ্চয় কিছু আঁচ করেছে। টর্চের আলোয় কিছু দেখা গেল না। ঘোড়া। দুটোকে আবার আগে বাড়ার নির্দেশ দিল দুজনে।
তবে বেশি দূর আর যেতে হলো না। গিরিখাতের ভেতরে বেড়া আর গেট দেখা গেল। তিনপাশে পাহাড়ের দেয়াল, আরেক পাশে বেড়া দিয়ে ঘিরে কোরাল তৈরি করা হয়েছে। গাছপালা নেই ভেতরে। জানা না থাকলে জায়গাটা সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কল্পনাই করবে না কেউ এখানে এরকম একটা কোরাল রয়েছে।
আরও কাছে গিয়ে র্যাসিংট্রাক দেখা গেল। কিছু তেলের খালি ড্রাম রয়েছে, ব্যারেল রেসিঙে ব্যবহারের জন্যে। আর একধারে পাহাড়ের গা ঘেষে ঘন গাছের জটলার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়ল খড়ের ছাউনির চালার সামান্য একটুখানি।
ফোঁস ফোঁস করছে জেনারেল। ঘোড়াটাকে আর এগোতে বলল না কিশোর। নেমে পড়ে লাগাম বাধল বেড়ার একটা খুঁটিতে। মুসাও নামল।
পা টিপে টিপে এগোল দুজনে কাদা মাড়িয়ে।
গাছগুলোর কাছাকাছি আসতেই ভেতরে শোনা গেল ঘোড়ার ডাক। আর। কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের, ঠিক জায়গাতেই এসেছে। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল সে। তেলচিটে গন্ধ এসে লাগল নাকে।
প্রথমেই টর্চের আলো পড়ল একটা কালো ঘোড়ার ওপর। ভেজা শরীর। টপটপ করে পানি ঝরে পড়ছে গা থেকে। ইউনিকর্ন। মুসার টর্চের আলো পড়ল আরেকটা ঘোড়ার ওপর। ওটার গা শুকনো। হারিকেন। আরও একটা ঘোড়া দেখা গেল, ওটাও পরিচিত, ওটারও গা ভেজা।
একটা ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল একজন মানুষ।
ডেকে বলল কিশোর, আর লুকিয়ে লাভ নেই, বেনি, বেরিয়ে আসুন।
বেরিয়ে এল বেনি। পরনে সাধারণ জিন্স আর শার্ট। ঘোড়সওয়ারের পোশাক নয়, যাতে লোকের সন্দেহ হতে পারে। তবে কোমরের বেল্টটা নজর এড়াল না। কিশোরের। রুপার বাকলসওয়ালাটাই পরেছে।
মুখের পানি মুছে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এটা দিয়েই আমাকে বাড়ি মেরেছিলেন, তাই না?
জবাব দিল না বেনি। বিমূঢ় হয়ে গেছে। চোখে ভয়। কল্পনাই করতে পারেনি এই বাদলার রাতে তার পিছু নেবে দুই গোয়েন্দা।
.
পালানর চেষ্টা করেনি বেনি। বুঝতে পেরেছে, পালিয়ে লাভ নেই। দুর্ভাগ্যটা মেনে নিল। তাকে আর চোরাই ঘোড়াদুটোকে নিয়ে ফিরে চলেছে কিশোর আর রবিন। নদীর পাড় থেকে ওপরে উঠতেই চোখেমুখে এসে পড়ল উজ্জ্বল আলো। দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল ঘোড়সওয়ার।
রবিন এসেছে স্যাণ্ডির পিঠে চড়ে, অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে পা ঠুকছে ঘোড়াটা। বড় একটা ঘোড়ায় চড়ে এসেছে লিলি। ব্রড আর লুকও এসেছে ওদের সাথে। আরও একজন আছেন, ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড।
ব্রড বলল, বেনি, আমি কল্পনাই করতে পারিনি… কথা আটকে গেল তার।
জবাব দিল না বেনি। পাথর হয়ে গেছে যেন। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
লিলি বলল ব্রডকে, থাক, এখন আর কথা বলে লাভ নেই। বাড়ি চলো।
.
পরদিন ডাবল সিতে আবার এলেন ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড। আকাশে মেঘ আছে এখনও, তবে আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। মাটি ভেজা। বাতাস খুবই তাজা আর পরিষ্কার। সামনের বারান্দায় বসে আছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা। লেমোনেড খাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিলেন ফোর্ড। ভাবলাম, তোমাদেরকে খবরটা দিয়েই যাই। শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছ হয়তো। বেনিকে ধরা হয়েছে। সব কথা স্বীকার করেছে সে। ব্রড জেসন এতে জড়িত নেই।
আমি জানতাম, খুশি হলো লিলি। ও আমাকে সত্যি কথাই বলেছে।
ঘোড়াগুলোকে অদলবদল লিলি একাই করেছে, হারিকেনের পিঠে চড়ে নিয়ে গেছে, ঠিক কিশোর যা সন্দেহ করেছিল। গাড়ির নিচে বাজিও সে-ই রেখেছে, কিশোরের ব্যাগে সাপ ঢুকিয়েছে। রোজই এখানে আসত ব্রডের সাথে দেখা করতে, ওই সময়ই করেছে অকাজগুলো। ঘোড়াকে ওষুধ খাওয়ার সময় আরেকটু হলেই ওকে ধরে ফেলেছিল কিশোর, বেল্ট দিয়ে বাড়ি মেরে যদি তোমাকে বেহুশ করে না ফেলত সে।
ব্যানারদের জিনিসগুলো কে চুরি করেছিল? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ও-ই। তোমরা সবাই তখন বাইরে ছিলে। নোটটাও সে-ই টাইপ করেছে। তার বাবার টাইপরাইটার দিয়ে। স্বীকার করেছে।
ফিলিপ নিরেক আর ডবসি কুপার তার মানে কিছুই করেনি?
গ্লাসে লেমোনেড ঢেলে বাড়িয়ে দিল লিলি। হাত বাড়িয়ে সেটা নিলেন। ফোর্ড। করেনি কথাটা ঠিক না। শয়তানী তো কিছু করেছেই লিলির সঙ্গে। তবে ঘোড়া চুরির ব্যাপারে ওদের কোন হাত ছিল না। নিরেকের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন ব্যাংকের ম্যানেজার। সে যেভাবে যা করছিল পছন্দ হচ্ছিল না তার। আরও অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, কানে এসেছে ম্যানেজারের। দুএকজন গিয়ে রিপোর্টও করেছে। এমনিতেই নিরেকের ওপর একটা অ্যাকশন নিতেন ম্যানেজার, এখন তো কথাই নেই। পাইকও অনেক শত্রু তৈরি করে। ফেলেছে এই এলাকায়। শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা সন্দেহ। এক চুমুকে প্রায় অর্ধেক, গ্লাস খালি করে ফেললেন ডেপুটি। লিলির দিকে ফিরলেন। বেনি কুপারের বিরুদ্ধে নালিশ করতে চাও?
কাল রাতে ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে, লিলি বলল। নালিশ করলেই তাকে জেলে ভরবেন। প্রতিযোগিতায় আর নামতে পারবে না। আমি চাই, ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হোক। জিততে পারলে জিতবে।
হাসলেন ডেপুটি। বড় বেশি আত্মবিশ্বাস মনে হয় তোমার?
কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিল লিলি। ওর সাথে একটা বোঝাঁপড়া করার ইচ্ছে আছে আমার। সেটা রোডিওতেই ভাল হবে। হারিকেনকে ফিরে পেয়েছি যখন, আমার বিশ্বাস ভালমতই একটা মার দিয়ে দিতে পারব। সুযোগটা করে দেয়ার জন্যে কিশোরের কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকলাম।