সারাদিন মেয়েটি একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই রাঁধুনী মিসেস ক্রাম্প অনুমান করেন, সে তার কোন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যাটা কাটাতে গেছে। তার এমন মনে করার কারণ হল মিসেস ক্রাম্প দেখেছিলেন, গ্ল্যাডিস সুন্দর একজোড়া নাইলন মোজা আর সবচেয়ে দামী জুতো পরেছিল।
অবশ্য মিসেস ক্রাম্পের অনুমান ঠিক হয়নি। মেয়েটির হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, বাইরে জামাকাপড় শুকোতে দেওয়া ছিল, তুলে আনা হয়নি। সে খাবারের ট্রে হলঘরে ফেলে রেখে ছুটে যায় দেয়ালের কাছে–অর্ধেক জামাকাপড়ও তুলেছিল–ঠিক সেই সময়েই কেউ লুকিয়ে তার গলায় মোজা জড়িয়ে টানে। গ্ল্যাডিসের ঘটনা এই।
-বাইরে থেকে কেউ এসেছিল মনে হয়?
–অসম্ভব কিছু নয়, ভেতরের কেউ হতে পারে। পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই হোক, ওকে পাওয়ার জন্যই অলক্ষিতে অপেক্ষা করছিল।
যখন আমরা মেয়েটিকে জেরা করি, খুবই নার্ভাস মনে হয়েছিল তাকে। তার মধ্যে কোন গোপন উদ্বেগ বা অপরাধবোধ ছিল–আমরা সেটা ধরতে পারিনি।
–পুলিসের জেরায় বেশির ভাগ মানুষই ভীত বিব্রত হয়ে পড়ে–স্বাভাবিক ভাবেই।
–এক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মিস মারপল। আমার ধারণা গ্ল্যাডিস এমন কাউকে কিছু একটা করতে দেখেছিল, যার গুরুত্ব সে বুঝতে পারেনি। তেমন মনে হলে সে অবশ্যই জানাত আমাদের। আমার মনে হয়, সেই অজ্ঞাত আততায়ী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেয়েটিকে বিপজ্জনক মনে করেছিল।
-কিন্তু কেবল এই কারণে তাকে খুন করে নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকে দিয়েছিল? সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন মিস মারপল।
-ওটা একটা হীন বীরত্ব দেখানো ছাড়া কি হতে পারে?
–না, ইনসপেক্টর–এটাকে অকারণ মনে করতে পারছি না। এর মধ্যে একটা ছক ধরা পড়ছে।
–ছক? অবাক হলেন ইনসপেক্টর। তিনি ইঙ্গিতটা ধরতে পারছিলেন না।
–হ্যাঁ, ঘটনাটাকে আমার একটা নির্দিষ্ট ছকের পরম্পরা বলেই মনে হয়।
–ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিস মারপল।
–দৃশ্যপটটা কল্পনায় আনার চেষ্টা করুন। মিঃ ফর্টেস্কু–কোথায় খুন হলেন? না, তার অফিসে। তারপরেই মিসেস ফর্টেস্কু–লাইব্রেরীতে বসে চা পানরত অবস্থায়। চায়ের সঙ্গে খাবার ছিল কেক আর মধু।
এরপর হতভাগ্য গ্ল্যাডিস, তাকে পাওয়া গেল নাকে কাপড়ের ক্লিপ লাগানো অবস্থায়।
পর পর ঘটনাগুলো খুবই অর্থবহ মনে হচ্ছে আমার কাছে। নির্দিষ্ট একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। আমি।
–কিন্তু, আমি তো
বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন ইনসপেক্টর নীল।
–ছেলেবেলায় মাদার গুজ ছড়াটা নিশ্চয় পড়া ছিল আপনার ইনসপেক্টর নীল? ছড়ার কথাগুলো মনে করলে একটা পরিচিত চিত্র পাবেন আপনি।
–আপনি খুলে বলুন দয়া করে, মিস মারপল।
–আপনি আশ্চর্য মানুষ–চমৎকার সরলতা। আমি আপনাকে মনে করাবার চেষ্টা করছি। ব্ল্যাকবার্ডস বা কালো পাখির কথা।
নিদারুণ এক হেঁয়ালির গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন ইনসপেক্টর নীল। তিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিস মারপলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। বৃদ্ধা মহিলাটির মাথায় গোলমাল আছে এমন কথা ভাবা ঠিক হবে কিনা কেবল এই কথাই তিনি ভাবতে লাগলেন।
–ব্ল্যাকবার্ডস-ব্ল্যাকবার্ডস
অনেক পরে বিহ্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন নীল।
–হ্যাঁ, মিস মারপল বললেন, ছড়ার কথাগুলো ছিল…
গান তোক ছয় পেনি একমুঠো রাই
কালোপাখি চার ও কুড়ি ভাজা হল পাই
খোলা হলো পাই যেই গায় গান পাখি
রাজার জবর খানা কেউ বলে নাকি?
মোহর গোণেন রাজা রাজকোষে বসি
মধু খান মহারানি দিনভর খুশি।
তার দাসী শাড়ি মেলে বাগানের ফাঁকে
উড়ে এসে পাখি এক ঠোকরালো নাকে।
–যাব্বাবা। ইনসপেক্টর নীল যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
–অবাক হবার কিছু নেই মনে হয়; বললেন মিস মারপল। মিলটা বড় অদ্ভুত। দেখুন, রাই পাওয়া গেল মিঃ ফর্টের পকেটে। নানান কাগজে অবশ্য নানান ধরনের শস্যদানার কথা। বলেছে। তবে ছিল ভুট্টার দানাটানা নয়, রাই, তাই না?
হ্যাঁ, মাদাম।
–তাহলে মিলিয়ে নিন, তাঁর নামের প্রথম শব্দটা হল রেক্স–মানে হল, রাজা। তিনি তার কর্মক্ষেত্রে খাসকামরায় ছিলেন–বলা চলে কোষাগারে ছিলেন।
ওদিকে মিসেস ফর্টেন্ডু অর্থাৎ রানি লাইব্রেরীতে কেক মধু খাচ্ছিলেন। খুনীকে তাই পার্লারমেইড গ্ল্যাডিসের নাকে কাপড়ের ক্লিপ আটকাতেই হল।
–আপনার ওই উদ্ভট ছড়ার সঙ্গে যখন এভাবে মিলে যাচ্ছে তাহলে তো মানতে হয় সব কিছুই অর্থহীন–অকারণ–
-ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে ওই কালোপাখি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
আমার বিশ্বাস কালোপাখির একটা যোগাযোগ এর মধ্যে কোথাও না কোথাও ঠিক পাওয়া যাবে। কাজেই ব্ল্যাকবার্ডস বা কালোপাখির কথাটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।
স্যর, স্যর ।
ঠিক সেই মুহূর্তে সার্জেন্ট হে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। কিছু বলার জন্যই সে এসেছিল। কিন্তু মিস মারপলকে লক্ষ করে থেমে গেল।
–আমি মনে রাখব মিস মারপল, অবস্থাটা সামাল দিতে চেষ্টা করলেন নীল আপনি যখন এভাবে বলছেন। আপনিও ওই মেয়েটির বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে থাকুন।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে মিস মারপল ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
-বুঝলে কালোপাখি—ব্ল্যাকবার্ডস
সার্জেন্ট হে-র দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে আওড়ালেন নীল।
–আঁ স্যর—
না..কিছু না..কি বলতে চাইছিলে তুমি?
রুমালে জড়ানো হাতের জিনিসটা এগিয়ে ধরে হে বলল, এই জিনিসটা স্যর…ঝোপের মধ্যে পড়েছিল। মনে হল পেছনের জানালা দিয়ে কেউ ছুঁড়ে ফেলেছিল।