এইসব সমস্যার কথা বলতে বলতে দুজনে চলতে লাগল।
লিউইস অবশ্য এসব নিয়ে বিশেষ ভাবে না। কেউ কেউ আছে যারা প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে মানুষের উন্নতি করবেই। যেমন লিউইস।
মিঃ লোমন স্টেশনের সেই ছেলেটা সত্যিই সেরোকোল্ডের সহকারী কিনা মারপল জিনার কাছ থেকে জানতে চাইল।
জিনা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললো এই বোকাটা নাকি হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াতো, বড় বড় কথা বলে নিজেকে জাহির করাই তার কাজ। একেবারে বাজে লোক। এমন ভাব দেখায় যেন বাড়িরই একজন। ওই হয়ত একদিন তাদের সবাইকে খুন করে বসে থাকবে। বলে জিনা জোরে হেসে উঠল। মিস মারপল কিন্তু গম্ভীর হয়ে গেল।
মস্ত ফটক পেরিয়ে গাড়ি ভেতরে ঢুকলো। গেটের বাইরে জোরালো পাহারা। রাস্তার আশেপাশে অযত্নের ছাপ। জিনা মারপলের মনের কথা বুঝেই বলল, যুদ্ধের সময় মালী পাওয়া যায় না বলে তারা রাখেনি। তাই সব খারাপ হয়ে গেছে।
একটু বাঁক নিয়েই ভিক্টোরিয় গথিক ধরনের বাড়ির সামনে জিনা গাড়িটা দাঁড় করাল।
মারপল নেমে বারান্দায় উঠল। তারপর জেন মারপল আর ক্যারি লুইজি দুজনে একেবারে মুখোমুখি। ক্যারি বিশেষ বদলায়নি। এখনো বিনা প্রসাধনে তারুণ্য ধরে রাখতে পেরেছে। হাতে লাঠি মাথায় রূপালী ছাপ থাকলেও চোখে স্বপ্ন, মুখে সরলতা কত বছর বাদে জেনের সঙ্গে তার দেখা! এতদিন লুইজি আসতে বলেনি বলে ভুল স্বীকার করলো। সত্যিই সে এর জন্য দুঃখিত। বারান্দার অন্য প্রান্ত থেকে জিনা চেঁচিয়ে তার দিদাকে ঘরে আসতে বললো, নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
ক্যারি লুইজি মিষ্টি হেসে বললো, এইভাবে তার স্বাস্থ্য নিয়ে এরা সব সময় হৈ হৈ করে। তারও যে বয়স হয়েছে একথা কিছুতেই ভুলতে দেবে না। তাও মন মানতে চায় না বয়স হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা আলোচনা করে এই দুই পুরোনো বন্ধু খুব হাসতে লাগল।
দুজনে পাশাপাশি দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার মুখে এক বয়স্কা মুখে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে। খাড়া নাক, ছোট চুল।
কড়া গলায় মহিলাটি লুইজিকে এতক্ষণ ঠান্ডায় থাকার জন্য খুব বকাঝকা করলো।
লুইজি জলিকে না বকতে অনুনয় করল তারপর মিস মারপলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
এর নাম মিস বেলভার। লুইজির পাহারাদার বন্ধু সব।
জুলিয়েট বেলভার ভারী গলায় বললো, তার সাধ্যে যতটুকু কুলোয় ততটুকুইসে করে। এখানে কোনো নিয়মের বালাই নেই।
বড় বড় আবলুশ কাঠের আসবাবপত্রে ঘরটি সাজানো। জানলায় ভারী পর্দা, রঙটা কিছুটা ফিকে। মস্ত বড় বিছানা। এরই পাশাপাশি অত্যন্ত আধুনিক স্নানঘর।
মিস বেলভার তার ভার গলায় জানালো জন রেস্টারিক বাড়িতে দশটা স্নানঘর তৈরি করে ছিল কারাকে বিয়ে করার পর। বেলভার মারপলের কাছে জানতে চাইল, সে তাকে চেনে কিনা। উত্তরে মারপল জানাল মিসেস সেরাকোন্ডের সঙ্গে চিঠিতেই তাদের যোগাযোগ বেশি ছিল।
হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে মিস মারপল বেলভারকে দেখতে পেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বিশাল হলঘর পেরিয়ে তারা যেখানে এসে পৌঁছল সেখানে প্রচুর বই। জানলার বাইরে একটি হ্রদও চোখে পড়ল।
জানলার কাছে লুইজি দাঁড়িয়ে ছিল।
জেন তাকে বিস্ময় ভরা গলায় বলল, এই এত বড় বাড়িতে তার তো রীতিমত ভয় করছে, যদি হারিয়ে যায়।
লুইজি জানাল এক মস্ত বড় লৌহ ব্যবসায়ী বাড়িটা তৈরি করেছিল। একটা বাড়িতেই চোদ্দটা বসবার ঘর। প্রত্যেকটাই বিশাল বড়। লুইজি এই বাড়ির কোনও পরিবর্তন করেনি। এরিকের সঙ্গে এখানে আসবার পর থেকে প্রায় সব একই আছে। যেটুকু বদলানো হয়েছে তা বাড়ির বড় অংশটা-বড় হলঘর আর উপরের ঘরগুলো ভালো বলে ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছে।
গাছের ফাঁক দিয়ে লাল ইটের তৈরি মস্ত একটা দালান দিয়ে জিনাকে হেঁটে আসতে দেখে মারপল হেসে বললো, জিনাকে দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে।
লুইজি বললো, যুদ্ধ শুরু হবার আগে ওকে সে আমেরিকায় রুথের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। জিনার বিয়ের ব্যাপারে রুথ খুব মুষড়ে পড়েছিল। রুথ বলেছিল ছেলেটি জিনার উপযুক্ত পাত্র নয়। যাইহোক জিনা এই বাড়িতে চলে আসার পর লুইজির ভালোই লাগে। কারণ এত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা মেয়ে বাড়িতে থাকলে বাড়ির চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়।
জানলার বাইরে সুপুরুষ যুবকটির সঙ্গে জিনাকে দেখতে পেয়ে মারপলের খুব ভালো লাগল। মারপলের ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়ে লুইজি বললো, ও হচ্ছে স্টিভ, জন রেস্টারিকের ছোট ছেলে। ও এখানেই থাকে। নাটক, থিয়েটারের সব দেখাশোনা করে।
জেন কিন্তু এত দূর থেকেও ওদের দুজনের হাবভাবের মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষ্য করল। লুইজিকে তার আভাস দিতেই সে একেবারে উড়িয়ে দিল কথাটা। কিন্তু মারপলের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই, সে স্থির নিশ্চিত স্টিভেন জিনার প্রেমে পড়েছে। মারপলের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা সবসময় প্রশংসা পেয়ে এসেছে। সে জানে যা একবার তার চোখে ধরা পড়ে তা ভুল হয় না।
.
০৪.
মিসেস সেরাকোল্ডের স্বামী হাতে কয়েকটা চিঠি নিয়ে হলঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
লিউইস সেরাকোল্ড ব্যক্তিত্বময় ছোটখাটো মানুষ। রুথের মতে সে একটা ডাইনামো ছাড়া আর কিছু নয়।
লিউইস লুইজিকে কিছুটা বিমর্ষ ভাবে বললেন, ওরা যা ভেবেছিলেন কিন্তু তা হয়নি, আবার দুষ্টুমী শুরু করেছে। আবার চুরি করতে আরম্ভ করেছে।