এর কদিন বাদে মিলড্রেডের বিয়ে হল। তারপর জনির সঙ্গে বিচ্ছেদ। তার ছেলেরা অবশ্য ছুটিতে স্টোনিগেটসে আসত। তারপর ১৯৩৮ সাল নাগাদ ক্যারি বিয়ে করল লিউইসকে। প্রকাণ্ড বড় এক চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট কোম্পানীর বড়কর্তা সে। তবে ঐ পরোপকারের বিদঘুঁটে নেশা তার। প্রথমে শিশু অপরাধীদের ধরে এনে পুষ্টির ব্যবস্থা করা তারপর তাদের পড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগা। লিউইস ভেবেছিল অপরাধীরা বুদ্ধিমান জীব। ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে তাদের দিয়ে অনেক ভালো কাজ করানো যায়। মিস মারপল রুথের এই কথায় সম্মতি জানায়। তবে তার মতে কথাটা একেবারে সত্যি হয় না সবসময়।
রুথ আবার মারপলের কাছে ভালোভাবে জেনে নিল, লুইজি ডাকলে সে তাহলে অবশ্যই যাচ্ছে তো। মারপল কথা দিল।
.
০৩.
মিস মারপল ট্রেন থেকে যে স্টেশনে নামল তার নাম মার্কেট কিম্বল। যাত্রীদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
বেশ হাওয়া বইছিল। পরিধানে সাধারণ পোশাক মারপলের। জিনিসপত্র সামলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এমন সময় একজন যুবক তার দিকে এগিয়ে এল।
নিজের পরিচয় জানিয়ে ছেলেটি বলল, যে সে স্টোনিগেটস থেকে মারপলকে নিতে এসেছে। ছেলেটি কেমন যেন মুখস্থের মত করে কথা বলল। কথাবার্তায় কৃত্রিমতার ছাপ।
মিস মারপলের চেহারার মধ্যে অসহায় বৃদ্ধার ছাপ। কথাবার্তায় স্যুটকেশটা নিতে বলাতে সে একটা কুলিকে ডেকে স্যুটকেশটা গাড়িতে তুলে দিতে বলল। কুলিটি খুব একটা গুরুত্ব না দেওয়ায় ছেলেটি তার ওপর একটু চটে গেল।
মিস মারপলকে নিয়ে যেতে যেতে আত্মপরিচয় দিয়ে ছেলেটি বলল, তার নাম এডগার লোমন। মিসেস সোরাকোল্ড তাকে পাঠিয়েছে। সে তার সহকারী।
তার কথাবার্তার মধ্যে আত্মতুষ্টির ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নিজের কথা বেশি করে বলতে ভালোবাসে। তবে তার কথা শুনে মিস মারপল বুঝতে পারল তার সুরটা খাঁটি নয়। কোথায় যেন বেসুরো বাজছে। মারপল একটু চিন্তিত হল। স্টেশনের বাইরে ফোর্ড গাড়ির দিকে এডগার এগিয়ে গিয়ে মারপলের কাছে জানতে চাইল কোন দিকে সে বসবে, সামনে না পিছনে।
উত্তর দেবার আগেই একটা ঘটনা ঘটল। ঝকঝকে একটা রোলস্-বেল্টলে গাড়ি গর্জন করে স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। অতুলনীয় সুন্দরী একটি মেয়ে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল। পরনে কর্ডবয় স্ন্যাস আর গলাখোলা পার্ট।
হৈ হৈ করে সে এডগারের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। মিস মারপলকে নিয়ে যেতে সে এসেছে। ঝকমকে হেসে বলল তার নাম জিনা। ক্যারি লুইজি তার দিদা। মারপলের জলের ব্যাগের খুব প্রশংসা করল। তারপর তার কোট ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করল।
জিনার হঠাৎ আগমনে এডগার বেশ বিরক্ত। কিন্তু, জিনা তার রাগকে গুরুত্ব না দিয়েই মারপলের বাক্সটাক্সগুলো সব নিয়ে আসতে বলল তাকে।
মিস মারপলকে গাড়িতে বসিয়ে জিনা দ্রুত ড্রাইভ করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল।
মিস মারপল এডগারের কথা তুলতেই জিনা হেসে তার মাতব্বরি হাবভাবের কথা সম্বন্ধে বলতে লাগল।
মিস মারপল এডগারের সম্পর্কে জানতে চাইল কিন্তু জিনার মতে ওর কোনও দায়িত্ব নেই, সে একটা আস্ত পাগল। জিনার হাসিতে ঠাট্টার সঙ্গে নিষ্ঠুরতার ছোঁয়াও প্রকাশ পেল।
এডগার সম্বন্ধে পাগল কথাটা শুনে মিস মারপল বিস্মিত হল। জিনা বলে চলল, স্টোনিগেটসে প্রায় সকলেই পাগল। সে তার দিদা লিউইস বা বেলভাবকে বাদ দিয়ে আর যারা আছে তারা সবাই অস্বাভাবিক। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে জিনার নিজেরও কখনো কখনো পাগল পাগল লাগে নিজেকে। মিলড্রেড মাসিমা পর্যন্ত বেড়াতে বেড়াতে আপন মনে বকবক করেন।
গাড়ি খালি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। মারপলের দিকে তাকিয়ে জিনা বলে তার ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে, যে দিদার সঙ্গে ইনি এক স্কুলে পড়েছেন। আসলে মারপল জিনার মনের অবস্থাটা অনুমান করতে পারে। অল্পবয়সীদের পক্ষে ভাবা খুব মুস্কিল হয় যে বৃদ্ধরাও একদিন জোয়ান ছিল। ইস্কুল আর পড়াশুনো নিয়ে নাজেহাল হত।
জিনা সেই সূদুর অতীতের ছবি কল্পনা করতে চাইল। মারপল বলল, তাকে সেই বহুদিন আগেকার মানুষ বলে ভাবা গেলেও দিদার সম্পর্কে ভাবাটি কঠিন।
জিনা তার সঙ্গে একমত হয়ে বলল, সত্যিই তার দিদার বয়স একটা সময়ের পর আর বাড়েনি।
মারপল বলল, তার দিদার সঙ্গে বহু দিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না। হয়ত পরিবর্তন হয়েছে অনেক।
জিনা তার শরীরের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে লাগল। কোমরে বাতের যন্ত্রণার জন্য তাকে এখন লাঠি ব্যবহার করতে হয়। চুলে পাক ধরেছে।
স্টোনিগেটস সম্বন্ধে জিনার মন বিরূপ। পুরনো আমলের সব ঘরবাড়ি। হৈ চৈ করে দিন কেটে যায় অবশ্য। সবাই এখানে কাজ পাগল। ডাক্তারেরা সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চা অপরাধীগুলো খুব ভালো। একজন জিনাকে শিখিয়েছে কিভাবে টুকরো তার দিয়ে তালা খোলা যায়। আর একজন, দেবদূতের মত চেহারা যার সে শিখিয়েছে কিভাবে মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতে হয়।
এইসব খবর মিস মারপল মন দিয়ে শুনে নিল।
জিনা এইসব দস্যিগুলোকে খুব পছন্দ করে। তবে লিউইস বা ডঃ ম্যাডরিক মনে করে সকলে অস্বাভাবিক। কোনো না কোনও কারণে ছেলেগুলো বিগড়ে গেছে। একথা জিনা বিশ্বাস করে না। অনেক গণ্ডগোলওয়ালা বাড়ির ছেলেরাও তো ভবিষ্যতে নামটাম করে।