পরনে লাল টুকটুকে কিমোনো। আর সব চুপচাপ অন্য প্রান্তে কন্ডাক্টর ছোট্ট চেয়ারে বসে একরাশ কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে আছে।
যতসব উল্টোপাল্টা শব্দ শুনছি–ভাবলেন পোয়ারো, সত্যিই আমার ভীমরতি হয়েছে।
তিনি আবার বিছানায় এসে শুলেন, ঘুমটা অবশ্য এবার ভালোই হল।
যখন ঘুম ভাঙল জানালার শার্সি খুলে মুখ বাড়ালেন পোয়ারো, তখনো ট্রেনটা থেমে রয়েছে। ঘড়িতে নটা বেজে গেছে। বাইরে চাপ চাপ বরফ। খানাকামরায় ফুলবাবুটি হয়ে ঠিক পৌনে দশটায় গেলেন তখন সেখানে জমজমাট অবস্থা। প্রথম পরিচয়ের বাধাটা কেটে যাওয়ার পর তিনি দেখলেন সবাই নিজেদের মধ্যে জোর কথাবার্তা চালাচ্ছেন। এই তুষার ঝড়ের কল্যাণে একটা কথা সকলের মুখে। অবশ্য শ্রীমতী হার্বাডের গলাই কানে ভেসে আসে সব কিছু ছাপিয়ে। আমার নাকি কিছু অসুবিধা হবে না বলে আমার মেয়ে আমাকে পই পই করে এই ট্রেনেই শুয়ে বসে চলে আসতে পারব বলল। দেখুন কাণ্ডটা। কিন্তু এখন। কাল বাদে পরশু স্টীমার ছাড়বে। কদিন এমন দুর্ভোগ কপালে আছে কে জানে। সেটা ধরতে পারব কি না তাই বা কে জানে।
একই অবস্থা ইতালিয়ানটিরও। মিলানে তার জরুরী ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। ঘন্টা কয়েক পর ট্রেন চলতে শুরু করবে সকলেই এমন আশা করছে। আমার বোন আর তার ছেলে মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে বলে সুইডিশ মহিলাটি কুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। নিশ্চয়ই ভাববে কোনো গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদেরও তো কোনো উপায় নেই জানবার। আচ্ছা, আর কতক্ষণ আমরা এখানে আটকা পড়ে থাকব। কেউ কি উত্তরটা দিতে পারবে না? মেরী ডেবেনহ্যাম জিজ্ঞাসা করলেন। অধৈর্য তার গলার স্বর। কিন্তু লক্ষ্য করলেন পোয়ারো আগের মতো তাতে আর উৎকণ্ঠা নেই। আবার শ্রীমতী হার্বাড মুখ খুললেন।
কারও আর উৎসাহ নেই কেউ কোনো খবরই রাখে না। কেন একটু গতর নাড়তে কি হয়, তেমনি হয়েছে এই ট্রেনটাও। এক দঙ্গল নিষ্কর্মা বিদেশী।
আপনি বোধহয় রেল কোম্পানির ডিরেক্টরের পদে আছেন যদি এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে পারেন, বললেন আবাথনট ফরাসীতে পোয়ারোর দিকে ফিরে।
পোয়ারো তাঁকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন।
আপনি বোধহয় আমাকে মঁসিয়ে কুক ভেবে ভুল করছেন।
ওঃ হো, আমি দুঃখিত।
না, তাতে কি হয়েছে। এ রকম ভুল তো হয়েই থাকে। আমি আবার ওর জন্য বরাদ্দ কামরাটাতেই এখন আস্তানা গেড়েছি।
খানাকামরায় অনুপস্থিত কিন্তু মঁসিয়ে কুক। কে কে আসেননি আর?
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, হাঙ্গেরিয়ান দম্পতি, রাশেট তাঁর পরিচালক, রাজকুমারীর জার্মান পরিচারকটি। চোখ মুছলেন সুইডিশ মহিলাটি।
এভাবে পাঁচজনের সামনে কেউ কান্নাকাটি করে! ইস কি বোকামিটাই না করলাম। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।
তবে এইভাবে কদিন থাকতে হবে কে জানে। তা ঠিক, অধৈর্য গলায় ম্যাককুইন বলল।
কোনো মুলুকে আছি তাই বা কে জানে! সজল চোখে মিসেস হার্বাড বললেন।
তিনি শুনে বললেন, যুগোশ্লাভিয়া। ওঃ বলকান অঞ্চল তাই বলুন।
সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার মানুষ দেখছি আপনিই মাদমোয়াজেল। মিস ডেবেনহ্যামকে বললেন পোয়ারো।
মেরী কাঁধ ঝাঁকালেন।
মিথ্যে চেঁচামেচিই তো সার হবে। কিই বা করা যাবে বলুন।
আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী।
অকারণ আবেগ আমার আসে না। তবে অবস্থার সঙ্গে মানুষকে মানিয়ে চলতেই হবে। তা নয়। বাইরের বরফের স্তূপের দিকে উদাস চোখে মেরী তাকালেন। সব থেকে মনের জোর বেশি আমাদের মধ্যে আপনার। চারিত্রিক দৃঢ়তাও খুব আপনার।
না না। আমার থেকে অনেক মনের জোর রাখেন অন্ততঃ আমি একজনকে জানি।
কে তিনি?
মেরী ডেবেনহ্যামের হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল। তার মুখে হাসি ফিরল মনে পড়ল এতক্ষণ সে একজন অচেনা বিদেশীর সঙ্গে কথা বলছিল। ঐ যে কুশ্রী মহিলাটি শুধুমাত্র নিঃশব্দ তর্জনী হেলানই কেমন বিশ্বচরাচর শাসন করছেন বরং ঐ বয়স্কা মহিলাটির কথাই ধরুন না কেন। সমস্তই যেন ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি।
আমার বন্ধু কিন্তু ট্রেনের সব কর্মচারী মঁসিয়ে কুকেরও বংশব্দ। অবশ্য তিনি একজন ওপরওয়ালা বলে। তার চরিত্রের অনমনীয়তার জন্য নয়।
মেরী ডেবেনহ্যাম হাসলেন।
এইভাবে সকালটা কেটে গেল। দুশ্চিন্তা অনেক কমে যায় সবাই মিলে একসঙ্গে কথাবার্তা বললে, খানাকামরায় পোয়ারো কেন অনেকেই বসেছিলেন। তাঁর মেয়ের কথা, মৃত স্বামীর খুঁটিনাটি অভ্যাস, স্ত্রীর বোনা মোজা না পরলে ভদ্রলোক নাকি শান্তি পেতেন না। এইরকম গল্পে মিসেস হার্বাড একাই আসরের মধ্যমণি ছিলেন। তার কথার স্রোত যেন থামতেই চায় না।
বেশ খানিকক্ষণ পর সুইডিশ ভদ্রমহিলার সঙ্গে পোয়ারো যখন ব্যস্ত তখন একজন কন্ডাক্টর এসে দাঁড়ালো।
আমি সত্যিই দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, মাপ করবেন মঁসিয়ে।
কি ব্যাপার?
আপনাকে একবার মঁসিয়ে কুক দেখা করতে বলেছেন। সুইডিশ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পোয়ারোকে নিয়ে এল কন্ডাক্টর।
মঁসিয়ে কুকের নয় এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরাটা। এই কামরাটাকে পছন্দ করা হয়েছে কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবার জায়গা এবং আলাপ আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত। আরও কয়েকজন আছেন ঘরে উঁসিয়ে কুক ছাড়াও। মঁসিয়ে কুক একটা ছোট সীটে বসে আছেন। একজন ছোটোখাটো চেহারার গাঢ় বাদামী চামড়ার মানুষ উল্টোদিকের জানালার ধারে। বাইরে বরফের স্তূপের দিকে তাঁর চোখ। নীল পোশাক পরা একজন মানুষ দরজার ঠিক সামনে। এ ছাড়াও আছে পূর্ব পরিচিত পোয়ারোর কন্ডাক্টরটি।