যখন দুজনে দাঁড়িয়েছিলেন, শীর্ণ চেহারার পরিচারকটা বেরিয়ে এল পাশের কামরার দরজাটা খুলে। মিঃ রাশেট বিছানায় বসে আছেন পোয়ারো ভেতরে এক ঝলক দেখলেন। তার চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠল পোয়ারোর চোখে চোখ পড়তেই। বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।
ছি ছি, কি অভদ্র দেখছেন! ফিস ফিস করে বললেন শ্রীমতী হার্বাড। একটি ভদ্রবেশী শয়তান নির্ঘাৎ! আমি মানুষ চিনতে পারি মুখ দেখলেই। যার যা মনে হয় সেটাই ঠিক আমার মেয়ে বলে। এইরকম একটা অভদ্র লোকের পাশের কামরায় জায়গা পেয়েছি ভাবতেই তো আমার বাজে লাগছে। মনে হয় কাল রাতে লোকটা হাতল ঘোরাতে চেষ্টা করেছিল আমার কামরায়। আমি একটুও অবাক হব না ও যদি একজন মারাত্মক খুনীও হয়। ভয়ে তো আমার বুক কাঁপছে। এই লোকটার পাল্লায় পড়ে ওই যে সুন্দর দেখতে ছোকরাটা হাসি মুখে কাজ করছে তাই ভাবি।
ম্যাককুইনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কর্নেল আবাথনট। আমার কামরায় আসুন, ম্যাককুইনকে বলতে শোনা গেল। আড্ডা মারা যাবে খানিক। রাত হয়নি এখনো তেমন। তার পর হা কি বলছিলেন যেন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে। ম্যাককুইনের কামরার দিকে এগিয়ে গেলেন দুজনে। আমিও যাই বুঝলেন, বললেন শ্রীমতী হার্বাড, রাতে একটু বই না। পড়লে ঘুমই আসে না আবার।
আচ্ছা শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি ম্যাডাম।
নিজের কামরার দিকে এগোলেন পোয়ারো। ঠিক পরের খুপরিটা রাশেটের। তিনি জামা কাপড় বদলিয়ে আধ ঘণ্টাটাক বিছানায় শুয়ে বই পড়লেন। হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিলেন তারপর।
পোয়ারোর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। কেন? একি কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল। সজোরে একটা ডাকঘণ্টা বেজে উঠল।
পোয়ারো চমকে উঠলেন আর্তনাদ শুনে। পোয়ারো লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন। তার ঠিক পাশের কামরাটি রাশেটের। দেখা গেল সেই মুহর্তে রাশেটের দরজায় এসে কণ্ডাক্টরও টোকা দিল। করিডরের ঠিক পাশের কামরা থেকেও ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ ভেসে এল এর মধ্যে। না না দরকার নেই সব ঠিক আছে (জ মে স্যুই এঁপে) সেই ঠিক সময়। রাশেটের বন্ধ কামরা থেকে ফরাসী ভাষায় জবাব পাওয়া গেল চোখ তুলে তাকালো কণ্ডাক্টর।
ধন্যবাদ সিয়ে, কণ্ডাক্টর বলল।
পাশের কামরার দিকে তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। বিছানায় ফিরে এলেন পোয়ারো। একটা বাজতে তেইশ মিনিট আলো নেভানোর আগে ঘড়ি দেখলেন, তার মন থেকে দুশ্চিন্তার ভার নেমে গেছে।
.
০৫.
হত্যাকাণ্ড ঘুম আসছে না পোয়ারোর চোখে। থেমে আছে কেন ট্রেনটা। এটা যদি কোনো স্টেশনেও হয় লোকজনের চেঁচামেচি তাহলে তো কানে আসতো। অনেক বেশি লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে ট্রেনের মধ্যে। ঐ তো বেসিনে কল খোলার আওয়াজ হলো। জল পড়ছে কলকল করে। বন্ধ হল হল। রাশেটের চলাফেরার শব্দ পরিষ্কার পাশের কামরায়। কেউ যেন ঘরেপরার চটি পরে হেঁটে যাচ্ছে, বাইরে পায়ের শব্দ।
কামরার ছাদের দিকে চেয়ে চুপটি করে শুয়ে রইলেন এরকুল পোয়ারো। শুতে যাবার আগে জল চেয়ে নেওয়া হয়নি, ইস্ বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এত চুপচাপ কেন বাইরের স্টেশনটা। পোয়ারো ঘড়ি দেখলেন রাত সওয়া একটা। জল চাইবেন কি কণ্ডাক্টরকে ডেকে? ঘন্টা বাজবার বোতামে আঙুলটা রেখে সবে চাপ দিতে যাবেন হঠাৎ পাশের কোনো কামরা থেকে অর্ধেক ঘণ্টা ধ্বনি বেজে উঠল টিং টিং টিং এক মুহূর্ত লোকটার যেন সবুর সইছে না।
শ্ৰীমতী হার্বাডের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর, বাইরে ব্যস্ত পায়ের শব্দ। কে যেন হাতটা বোতামে রেখেই দিয়েছে। অন্য কামরার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কন্ডাক্টর।
ও শ্রীমতী হার্বাড। ভদ্রমহিলাটি নব্বইভাগ কথা বলেছেন আর দশভাগ কন্ডাক্টর, পোয়ারো হাসলেন নিজের মনেই। সন্ধি স্থাপন হলো খানিকক্ষণ বাদানুবাদ হবার পর। শুভরাত্রি মাদাম, পোয়ারো পরিষ্কার শুনলেন।
বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
এইবার ঘণ্টা বাজালেন পোয়ারো। কন্ডাক্টরটি সঙ্গে সঙ্গেই এসে হাজির হল। তাকে চিন্তিত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
আমাকে একটু জল দেবে।
হা নিশ্চয় মঁসিয়ে।
সে নিশ্চিন্ত হল পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বরে, ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলাটি বুঝলেন।
তার কি হলো?
কন্ডাক্টর কপালের ঘাম মুছল।
কি অদ্ভুত উনি, ভাবতে পারবেন না–একই কথা বারবার, লোক ঢুকেছিল নাকি ওর কামরায়। বুঝুন কাণ্ড। আর সে নাকি মোটাসোটা চেহারার। লোকটা কি বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল নাকি। আমি তো সেই নিয়ে ওঁর সঙ্গে তর্ক করতে বাধ্য হলাম। ওঃ কি সাংঘাতিক মহিলা, নিশ্চয় ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছেন। নিশ্চিত নাকি তোক ঢুকেছিল। আপনিই বলুন তাহলে কি সে আবার বাইরে বেরিয়ে ভেতরে হাত গলিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে? দরজায় তো ফঁকফোকর নেই। এমনিতে বরফের ঝড়ে…।
বরফ?
হা। যা বরফ পড়েছে এগোনোই দায়। এরকম অবস্থা কদিন চলবে কে জানে। আপনি কি খেয়াল করেননি যে ট্রেন থেমে আছে? আমরা আটকা পড়েছি? একবার তো সাতদিন ট্রেন অচল ছিল।
এখন কোথায় আমরা?
ভিনভোকি আর ব্রডের মাঝামাঝি।
ইস কি কাণ্ড!
কন্ডাক্টরর দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে এল।
শুভরাত্রি মঁসিয়ে।
জল খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা কলেন পোয়ারো। চোখের পাতাটা সবেমাত্র বুজে এসেছে দরজার কাছে একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল এমন সময়।
পোয়ারো লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন। কই কিছু নাতো! তার নজরে পড়ল এক ভদ্রমহিলা ডানদিকে করিডোর ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন ধীর লয়ে।