একটি বিশেষ শত্রু?
আপনি কি বলতে চান রাশেট, তীক্ষ্ণস্বরে বললেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে ধনী মানুষদের একাধিক শত্রু থাকে, মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন।
রাশেট যেন নিশ্চিন্ত হলেন পোয়ারোর কথায়।
হা হা তা তো বটেই, তাড়াতাড়ি বললেন।
আমার নিরাপত্তা প্রয়োজন। একজনই থাক তার দশজন, অবস্থা তো একই বুঝলেন মশাই। নিরাপত্তা।
হা। খুন করবার হুমকি দেওয়া হয়েছে আমায়, অবশ্য আমি প্রস্তুত শত্ৰু মোকাবিলা করতে। একটা ছোট ঝকঝকে স্বয়ংক্রিয় রিভলবার রাশেটের হাতে। তবে কি জানেন, সাবধানের মার নেই। তিনি বলে চললেন, আমি কিন্তু এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চাই যিনি নিরাপত্তার ঠিকঠিক ব্যবস্থা করবেন আমার। প্রচুর টাকা খরচ করতে রাজী আছি সেই জন্য। আপনার চেয়ে সে যোগ্য ব্যক্তি আমি পাবো না আর এও জানি।
রাশেটের মুখের দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালেন পোয়ারো। তার মুখে ভাবলেশহীন এত কথার পরও। রাশেট কেন স্বয়ং ভগবানেরও সাধ্য নেই তা বোঝার। শেষ পর্যন্ত পোয়ারো বললেন ধীর স্বরে, মঁসিয়ে আমি দুঃখিত আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপনার অনুরোধ রাখা।
রাশেট ক্রুর চোখে তার দিকে তাকালেন।
আপনি কত চান?
মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
মঁসিয়ে আপনি বুঝতে পারছেন না আমারও টাকার অভাব নেই। আমাকে কম প্রাচুর্য দেয়নি আমার জীবিকা। যেগুলোত আমি নিজে উৎসাহ বোধ করি সেইসব কেসই হাতে নিই, কিন্তু আজকাল।
বেশ বেশ, আগাম কুড়ি হাজার ডলা পেলে আপনি কি কাজ শুরু করতে রাজী? রাশেট বললেন।
না।
যদি আমাকে ভেবে থাকেন টাকা আদায় চাপ দিয়ে করবেন তবে ভুল করছেন, আমি ব্যবসাটা ভালোই বুঝি।
আমিও…মঁসিয়ে রাশেট।
কিন্তু কি আশ্চর্য আপনার আপত্তিটা কোথায়?
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো।
আশাকরি সত্যি কথাটা বলার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করবেন কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার মুখ যে আমি অত্যন্ত অপছন্দ করছি।
মঁসিয়ে পোয়ারো বড় বড় পা ফেলে খানাকামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
০৪.
মধ্যরাতে আর্তনাদ
রাত পৌনে নটায় ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস বেলগ্রেডে পৌঁছালো। এখানে আধঘণ্টা থামবে। প্ল্যাটফর্মে নামলেন পোয়ারো। বাইরে বেশিক্ষণ থাকা কিন্তু গেল না। হাত, পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। যথেষ্ট সুরক্ষিত অবশ্য প্ল্যাটফর্ম কিন্তু দারুণ বরফ পড়া শুরু হয়েছে। তিনি অগত্যা আবার ট্রেনের দিকে পা বাড়ালেন। তাকে দেখে রীতিমাফিক অভিবাদন জানিয়ে কণ্ডাক্টর বলল, এক নম্বরে আপনার সব জিনিসপত্র অর্থাৎ মঁসিয়ে কুকের কামরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কোথায় তাহলে গেলেন মঁসিয়ে কুক?
নতুন যে কোচটা এক্ষুনি দেওয়া হল, তিনি তারই একটা কামরায় গিয়েছেন। কুকের নতুন কামরায় গেলেন পোয়ারো।
ছি ছি, খুব খারাপ লাগছে আমার। শুধু শুধু ঝামেলা হল আমার জন্য। কিছু ঝামেলা হয়নি রাখুন তো মশাই, কুক বললেন। সোজা ইংল্যান্ডে যাবেন তো আপনি। ব্যালে পর্যন্ত যাবে আপনার কোচটা তাই সুবিধাই হল ওখানে আপনার। মশাই এখানে দিব্যি নিরিবিলিতে আরামে আছি। একজন গ্রীক ডাক্তার আর আমি ব্যাস। দেখছেন কি ঠান্ডা পড়েছে। আর তেমনি বরফ পড়া। আমরা নিরাপদে ঠিক সময়মতো যেন পৌঁছে যাই ভগবানকে ডাকুন।
ট্রেন ছাড়লো ঠিক নটা পনেরোয়। পোয়ারো বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিডোর ধরে নিজের কামরায় চলে এলেন তার একটু পরেই।
মোটামুটি পরিচয় হয়ে গিয়েছে বোঝা যায় যাত্রীদের নিজেদের মধ্যে। ম্যাককুইনের সঙ্গে কর্নেল আবাথনট দরজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। পোয়ারোকে দেখে ম্যাককুইন অবাক হলেন।
একি বেলগ্রেড নেমে যাবেন যে বললেন আপনি? হেসে ফেললেন পোয়ারো।
আমার কথাটা আপনি ঠিক ধরতে পারেননি। ট্রেনটাও তখন আসলে ছেড়ে দিল তো বেলগ্রেডের যখন কথা উঠল।
কিন্তু আপনার মালপত্র কই কামরায়?
অন্য কামরায় গেছে সেগুলো।
ওঃ তাই বলুন।
এগিয়ে গেলেন পোয়ারো।
কন্যাগতপ্রাণা প্রৌঢ়া আমেরিকানটির সঙ্গে একটু এগিয়েই দেখা হল। সুইডিশ মহিলাটির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত তিনি এখনও। একটা পত্রিকা সুইডিশ মহিলাটির হাতে গুঁজে দিতে দিতে বললেন শ্রীমতী হার্বাড, একটা পত্রিকা তো ভারী পড়তে নেবেন এত সঙ্কোচের কি আছে তাতে। আমার তো কত বই আছে সঙ্গে। কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে।
সুইডিশ মহিলাটি ধন্যবাদ জানিয়ে বইটি নিলেন। বেশি রাত জেগে বই পড়বেন না কিন্তু তা বলে, শ্রীমতী হার্বাড বললেন। মাথা ধরেছে বললেন। তা আপনি ভালো করে ঘুমোবেন আজ রাতে। দেখবেন কাল সকালে উঠে শরীর দিব্যি ঝরঝরে হয়ে গেছে।
আগে এক কাপ চা খাব।
হা ঠান্ডা যা। আমার কাছে একটা অ্যাসপিরিন আছে দেব?
না না থাক। হয়তো আমার কাছেও আছে। আচ্ছা শুভরাত্রি।
নিজের কামরার দিকে সুইডিশ মহিলাটি পা বাড়াতেই এবার পোয়ারোকে নিয়ে পড়লেন শ্ৰীমতী হার্বাড। কাণ্ড দেখেছেন সুইডিশ মহিলাটির। এত কিন্তু কিন্তু ভাব। কোনো মঠ বা ধর্মীয় সংস্থায় মনে হয় কাজকর্ম করেন। এত ভালো মহিলাটি কিন্তু ইংরেজিতে কথাবার্তা চালাতে পারেন না বেশিক্ষণ। বারবার আমার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
ভদ্রমহিলার কন্যারত্ন সম্পর্কে শুনে শুনে পোয়ারোরও বোধ করি একটা বিশদ ধারণা হয়ে গেছে। শুধু পোয়ারো কেন? ইংরেজি যারাই বোঝেন ট্রেনে তাদের সকলের। শ্রীমতী হার্বাডের মেয়ে জামাই দুজনেই নামী কলেজে অধ্যাপনা করে। ভদ্রমহিলা প্রাচ্যভ্রমণ এই প্রথম। তিনি কি ভাবেন তুর্কীদের সম্বন্ধে। কি দারুণ অবস্থা রাস্তাঘাটের। নানা প্রসঙ্গেই ভদ্রমহিলার দৌলতে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এখন পোয়ারো।