রাজকুমারীর নাম তিনিও শুনেছেন, পোয়ারো মাথা নাড়ালেন।
মেরী ডেবেনহ্যাম বসে আছেন অন্য আর একটা বড় টেবিলে। সঙ্গে আরও দুজন মহিলা। মাঝ বয়েসী লম্বা একজন সাদামাটা স্কার্ট আর ব্লাউজ পরা। বিরাট খোঁপার আড়ালে শোভা পাচ্ছে এক মাথা হলুদ চুল, চোখে চশমা, ভালো চেহারার মানুষ। মনে হয় দেখলেই সকলের • কথা মন দিয়ে শোনেন আর সায় দেন। তৃতীয় মহিলাটির বাক্যবাণে বিধ্বস্ত দুজনেই। একটানা বকরবকর করেই যাচ্ছেন। এই তৃতীয়জন মোটাসোটা ভারিক্কি চেহারার।
তারপর বুঝলেন আমাদের কলেজে কি চমৎকার পড়াশুনা হয়। মাগো তুমি ভাবতেই পারবে না আমার মেয়েটা তাই বলে। শিক্ষার মতো কি জিনিস আছে, কি সুন্দর পড়ান অধ্যাপকরা। আমার মেয়ে বলে পাশ্চাত্য দেশ থেকে কত ভালো-ভালো জিনিস প্রাচ্যে শিক্ষার বিষয় হতে পারে। একটা সুড়ঙ্গে সশব্দে ট্রেনটা ঢোকায় গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল ভদ্রমহিলার।
কর্নেল আবাথনট একলা বসে পাশের ছোট টেবিলটায়। মেরী ডেবেনহ্যামের দিকে করুণ সতৃষ্ণ নয়নে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। যা চিনে জোঁকের পাল্লায় পড়েছেন মেরীর কিন্তু উঠে আসার উপায় নেই। ওরা দুজনে এক সঙ্গেই কিন্তু বসতে পারতো প্রথম থেকেই বসলো না কেন?
পোয়ারো হয়ত ভাবলেন মেরী একটু সতর্ক প্রকৃতির মেয়ে, নিজেকে জড়াতে চায় না চট করে। এতে সুনামও নষ্ট হতে পারে তার চাকরীর। পোয়ারোর চোখ এবার কামরার অন্যদিকে চলে গেল। মাঝ বয়েসী জার্মান কালো পোশাক পরা সাধারণ চেহারার একজন স্ত্রী লোক একদম কোণে, রাজকুমারীর পরিচারিকা বোধহয়। একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক নিচুস্বরে অন্তরঙ্গ তার ঠিক পরের টেবিলে আলাপরত। ভদ্রলোকের বয়স তিরিশের কোঠায়, চমৎকার এক জোড়া গোঁফের মালিক, সুবেশ ও সুদর্শন। তিনি এপাশে তাকালেন কথা বলতে বলতে। তরুণটি যে ইংরেজ নয় পোয়ারো নিশ্চিত। তার সঙ্গে ভদ্রমহিলাটি সুন্দরী বললে কম বলা হবে, মেয়ে বলাই ভালো তাকে, যেন ডানাকাটা পরী। বছর কুড়ি বয়স, চমৎকার ছাঁটকাটের পোশাক পরা। সাদা মসৃণ চামড়া হাতির দাঁতের মতো, মায়াবী বাদামী চোখ বড় বড়, কুঁচকুচে কালো চুল একমাথা চাপার কলির মতো আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট। প্লাটিনামের ওপর পান্না বসানো গয়না পরেছে, চকচকে লাল রঞ্জনী নখে, চোখের দৃষ্টি আর গলার স্বর মদির স্বপ্নলু।
মেয়েটি কি সুন্দর, বোধহয় ওরা দম্পতি না?
হ্যাঁ, পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে কুক বললেন। হাঙ্গেরীর দূতাবাসে কাজ করেন সম্ভবতঃ, দুজনকে দারুণ মানিয়েছে তাই না?
কুক তার দৃষ্টি অনুসরন করলেন পোয়ারোকে নিরুত্তর দেখে। কঠিন দৃষ্টি পোয়ারোর। ম্যাককুইন আর রাশেট তার লক্ষ্য। রাশেট সেই শয়তানি মাখানো-ধূর্ত চাউনি পোয়ারোর দিকে মুখ করে বসে আছেন।
কি হল, বন্যপ্রাণীটিকে পর্যবেক্ষন করছেন, কুক বললেন। কুক কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ঘাড় নাড়লেন পোয়ারো।
আপনি তাহলে বসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি আমার কামরায় যাচ্ছি একটু কাজ আছে, একটু পরে আড্ডা মারা যাবে আপনিও আসুন না।
বেশ তো।
ধীরে ধীরে কফি খেতে লাগলেন পোয়ারো। আরও পানীয় আনতে বেয়ারাকে আদেশ করলেন। অনেকেই উঠে যাচ্ছেন একে একে।
এখন বলে চলেছেন সেই প্রৌঢ়া আমেরিকানটি।
আমার মেয়ে বলে মা সঙ্গে একটা নামের তালিকা রেখো সব দেশের খাবারের। কোনো অসুবিধেই হবে না দেশে-বিদেশে বেড়াতে, কিন্তু এখানে দেখ পছন্দসই পানীয়টি পর্যন্ত ঠিকভাবে মেলে না আর জলটারও এত বাজে স্বাদ যে তেষ্টা মেটে না…।
যা বলেছেন, তার টেবিলে নিরীহ মহিলাটি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
আমার মেয়ে বলে একরাশ খুচরো দীনার না কি যেন বলে আবার দেখুন, যত্তোসব ঝামেলা। চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মেরী ডেবেনহ্যাম তার সঙ্গে আর্বানটও। আমেরিকান প্রৌঢ়াটি ও অন্য মহিলাটি পিছু পিছু খুচরো টাকা ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ালেন। এখন খানাকামরায় রাশেট আর ম্যাককুইন, হাঙ্গেরিয়ান দম্পতিও চলে গেছেন।
কি যেন বললেন নিচুস্বরে রাশেট ম্যাককুইনকে। খানা কামরা ছেড়ে ম্যাককুইন বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই রাশেট উঠে এগিয়ে এলেন পোয়ারোর টেবিলের দিকে। রাশেট বললেন নরম ভাঙা ভাঙা নাকি সুরে, মাপ করবেন আপনার কাছে কি দেশলাই আছে? আমার নাম রাশেট।
পোয়ারো অভিবাদনের ভঙ্গি করে ঈষৎ ঝুঁকে দেশলাই বার করে আনলেন পকেটে হাত দিয়ে। রাশেট কাঠি জ্বালালেন না সেটা হাতে নিয়েও।
আজ আমার পরম সৌভাগ্য, বললেন, মনে হয় আমি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলছি।
আপনি ঠিকই ধরেছেন মাসিয়ে। আমি এরকুল পোয়ারো।
বড় তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আসে আমার দেশের মানুষেরা। আপনি আমার জন্য একটি কাজ হাতে নিন আমি চাই।
ভ্রূ তুললেন পোয়ারো।
আজকাল আমি খুব কম সেই হাতে নিই মঁসিয়ে রাশেট।
মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি যে খুব ব্যস্ত মানুষ তা আমার অজানা নয়। নিশ্চয় আমি আপনাকে এর জন্য কিন্তু ভালো পারিশ্রমিক দেব। ভালো পারিশ্রমিক সত্যিই।
পোয়ারো দু-এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে আপনি কি কাজের ভার দিতে চান মঁসিয়ে রাশেট?
আমি অত্যন্ত ধনী লোক মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার শত্রুর অভাব নেই। কাজেই বুঝতে পারছেন আমার একটি বিশেষ শত্রু আছে।