কন্ডাক্টর নিপুণ ভঙ্গিতে মাল তুলতে লাগলেন।
পোয়ারো মনে মনে হাসলেন তার এই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি দেখে। লোকটি নির্ঘাত ভালো বকশিসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কামরাটা একলাই দখল করবে সেই আশায়। কিন্তু সে আশায় বাদ সাদলেন মঁসিয়ে কুক। একদিকে জাঁদরেল ওপরওয়ালা অন্যদিকে কাঁচা পয়সা; কণ্ডাক্টরের অবস্থা শোচনীয়।
সব মালপত্র গোছগাছ করে কন্ডাক্টর বলল, দেখুন সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম মঁসিয়ে। আপনার বার্থ ওপরে সাত নম্বরে। আর মিনিট খানেক বাদেই ট্রেন ছাড়বে।
কামরা ছেড়ে চলে গেল কন্ডাক্টর ব্যস্ত পায়ে। আবার নিজের কামরায় ঢুকে পোয়ারো স্বগতোক্তি করলেন, কি কাণ্ড? কন্ডাক্টর নিজেই মালপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে এমনটা তো দেখাই যায় না।
হাসল তার সঙ্গীটি। তার রাগ পড়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে, অবশ্য রাগ করেই বা উপায় কি?
ট্রেন তো একদম ভর্তি।
এইবার ট্রেন চলতে শুরু করবে। তীক্ষ্ণ শীসের শব্দ। করিডরে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলেন দুজনেই।
আমরা তাহলে চললাম, ম্যাককুইন বলল।
নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ সুরে আবার ইঞ্জিনটা জানান দিল কিন্তু ট্রেন চলল না।
পোয়ারোকে ম্যাককুইন বলল, স্যার নিচের বার্থটা আপনি ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না উপরে শুতে।
যুবকটি চমৎকার, দেখলেই পছন্দ হয়।
প্রতিবাদ করলেন পোয়ারো।
না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
আরে না আমার কষ্ট হবে না।
বেলগ্রেডে এক রাতের মামলা, অবশ্য খুব অমায়িক লোক আপনি।
ওঃ আপনি বেলগ্রেডে নেমে যাচ্ছেন।
মানে তা নয়। আমি…।
ট্রেনটা হঠাৎ দুলে উঠল। চমকে উঠলেন দুজনে ঝাঁকুনি খেয়ে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে আলোকিত প্ল্যাটফর্ম সরে যাচ্ছে।
তার তিনদিনের যাত্রা শুরু করল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস।
.
০৩.
পোয়ারো প্রত্যাখ্যান করলেন
মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর কিচেন কামরায় ঢুকতে একটু দেরিই হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে ছিল অবশ্য সকালেই, প্রাতঃরাশও একলাই প্রায় সেরেছেন। লন্ডনের সেই মামলাটার নথিপত্র নাড়াচাড়া করতে সারা সকালটা কেটেছে। দেখাই হয়নি মঁসিয়ে কুকের সঙ্গে।
মঁসিয়ে কুক পোয়ারোকে ডাকলেন। ইশারায় তার মুখোমুখি বসবার জন্য তিনি আগেভাগেই টেবিল দখল করে বসে আছেন। আর টেবিলটাও এমন জায়গায় যে, সব থেকে আগে বেয়ারারা ওখানে আসে।
চমৎকার খাওয়ার ব্যবস্থা। কয়েকটা পদ শেষ করে যখন দুজনে ক্রীম চীজে এসে পৌঁছেছেন, আহা আমার যদি কলকুকের মতো প্রতিভা থাকত। মঁসিয়ে কুক ভাবুক ভাবুক গলায় বললেন, তবে এই চমৎকার নিসর্গদৃশ্য কলমের আঁচড়ে ধরে রাখতাম।
কিছু বললেন না পোয়ারো। দু চারটে ভালো-মন্দ পদ পেটে পড়লে লোকে অমন কবি কবি হয়ে যায় এ তার বেশ ভালোই জানা আছে। ঠিক বলেছি কিনা বলুন, মঁসিয়ে কুক তার মৌনতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললেন। এই তো আমাদের চারপাশেই দেখুন না কত দেশ কত জাতি মানুষের মিলনতীর্থ। কত রকমফের চরিত্রেরই। একসঙ্গে মিলিত হয়েছে সবাই এই তিনদিন। একই ছাদের নিচে খাচ্ছে-শুচ্ছে আবার বিদায় নিয়ে চলে যাবে নানাদিকে। কোনোদিন দেখাই হবে না হয়তো।
যদি কোনো দুর্ঘটনা-পোয়ারো বললেন।
আঃ মশাই থামুন তো? এমন বাগড়া দেন না।
না না, ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সেইরকমই। এই চলমান পান্থশালার প্রতিটি অতিথি এক ও অদ্বিতীয় এক বন্ধনে আবদ্ধ তা হল মৃত্যুর। এরকম কিন্তু ভাবতে পারেন।
নিন তো একটু মদ খান। মাঝে মাঝে এমন উল্টোপাল্টা কথা বলেন না, আপনার নির্ঘাৎ হজমের গণ্ডগোল হয়েছে।
সায় দিলেন পোয়ারো। হতেও পারে। সিরিয়ার রান্নার ধাঁচটা মনে হয় ঠিক পোয় না আমার।
পোয়ারো আস্তে আস্তে সুরাপাত্রে চুমুক দিতে থাকলেন। তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সমস্ত পরিবেশটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে জরীপ করতে লাগলেন।
সত্যিই কি বিচিত্র সব মানুষের সমাবেশ।
তিনটি পুরুষ বসে তাদের ঠিক বিপরীত দিকের টেবিলে। এককভাবে ভ্রমণ করছে বোধহয় তিনজনই। নিবিষ্ট মনে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে একজন ইতালিয়ান। একজন বিরসবদন ইংরেজ তার ঠিক উল্টোদিকে যার হাবভাব দেখে মনে হয় খুব দক্ষ পরিচারক। আমেরিকান পোশাক পরা একজন হোমরাচোমড়া চেহারার ঠিক পাশের ইংরেজটা ব্যবসাদার নির্ঘাত। নিছক দায়সারাভাবে নিজেদের মধ্যে তিনজন টুকটাক কথাবার্তা চালাচ্ছে।
এবার অন্যদিকে চোখ ঘুরে গেল পোয়ারোর। এক মহিলা একটি ছোট টেবিলে সোজা হয়ে বসে আছেন। জীবনে কমই দেখেছেন তার মতো কুদর্শনা নারী। এঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে মনকে কিন্তু কুশ্রীতাও টানে। তার গলায় বড় বড় মুক্তোর কলার, আসল মুক্তো। হাতভর্তি আংটি, দামী ফারের কোট পরনে।
বেয়ারার সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রমহিলা খুব কর্তৃত্বের সুরে।
এক বোতল জল আর গ্লাস ভর্তি কমলালেবুর রস দিয়ে আসবে আমার কামরায়, ভুল যেন না হয় খবরদার। একদম ভালোমশলা বাদে আমি মুরগীর মাংস খাবো আজ রাতে। আর হা শোনো কিছু মাছ সেদ্ধও করো। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছিল বেয়ারাটি। দৃপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। পোয়ারোর মুখের ওপর দিয়ে তার নিরুৎসুক উন্নাসিক দৃষ্টি ঘুরে গেল।
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, মঁসিয়ে কুক ফিসফিস করে বললেন। রাশিয়ান। ওঁর স্বামী পশ্চিম ইউরোপে ব্যবসার ধান্দায় চলে আসেন প্রচুর সম্পত্তি নিয়ে ঠিক বিপ্লবের আগে। এখন তো টাকার পাহাড়। কি ব্যক্তিত্ব তবে দেখতে ভালো নয়।