ক্ষতচিহ্নগুলোর কথা ধরলে প্রত্যেকেই একবার করে আঘাত করেছিলেন রাশেটকে। সেইজন্যই কোনো আঘাত সমান নয়। ছোরাকেই অস্ত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে সকলেই ব্যবহার করতে পারেন। অনেকে মিলে চিঠিগুলোও লিখে ছিলেন তবে ম্যাককুইন যে চিঠিগুলো আমাকে দেখান ওগুলো সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং ধোঁকা দেবার জন্যই লেখা হয়েছিল। ম্যাককুইন আসল চিঠিগুলি নষ্ট করে ফেলেছিলেন। সম্পূর্ণ আকস্মিক ভাবেই সেই চিঠির আধপোড়া অংশ আমি পাই। হার্ডম্যানের আততায়ীর বর্ণনাটিও আজগুবি গল্প, যা কারোর ক্ষেত্রেই খাটে না আর ছদ্মবেশে থাকলে সকলের সম্বন্ধেই খাটে।
আমার অনুমান রাশেট গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হবার পর শ্রীমতী হার্বাড আর রাশেটের মাঝের কামরার দরজা দিয়ে যাত্রীরা একে একে মেরে আসে, তবে–কার আঘাতে মৃত্যু হয় সেটা বলা শক্ত।
সবই পরিকল্পনা মাফিক হবার পর নিজেরা আলোচনা করে নিয়ে এই হত্যার ব্যাপারটা জটিল করার জন্য কর্নেলের পাইপ ক্লিনার এবং রাজকুমারীর রুমাল ফেলে রেখে আসা হয় অকুস্থলে। কারণ এতে কোনো ক্ষতি নেই যেহেতু এদের সাথে আর্মস্ট্রং পরিবারের সাথে কোনো মতোই সম্পর্ক থাকতে পারে না। রাজকুমারীর শারীরিক অক্ষমতা নিয়েও দুবার ভাবতে হবে পুলিশের। এক রহস্যময়ী লাল কিমানো পরা নারীকেও হাজির করা হল এবং সেটা দেখতে কণ্ডাক্টর, মিস ডেবেনহ্যাম আর ম্যাককুইন ছাড়া আমাকেও দেখতে বাধ্য করা হল। আমারই বাক্সে কিমানোটা পাওয়া গেল। তবে সঠিক ভাবে বলতে পারছি না কিমানোটা কার। তবে মনে হয় কাউন্টেস আন্দ্রেনীর। তার জিনিষপত্রে গাউন আছে বটে তবে ড্রেসিং গাউন নেই।
আর্মষ্ট্রং পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমি জেনে যাবার ফলে ম্যাককুইন সবাইকে সতর্ক করে দেন এবং খুব বিচলিত হয়ে পড়েন কাউন্টেস আন্দ্ৰেনী। তিনি ব্যাগ লেভেল এবং পাসপোর্টে নাম বদল করলেন হেলেনা থেকে এলেনা। আপনারা বোধহয় আশাও করতে পারেননি সকলকে একসঙ্গে এইভাবে অভিযুক্ত করব। কণ্ডাক্টর মিশেল ছাড়া এই কাজ আপনাদের পক্ষে কখনই সম্ভব হত না। রাশেটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা সংখ্যায় বারো। কর্নেল জবানবন্দীতে বলেছিলেন আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়াই ভালো। অর্থাৎ জুরিপ্রথার গুণকীর্তন করেন। ইংল্যাণ্ডে সাধারণত বারোজন সদস্য নিয়ে জুরি গঠিত হয়। মামলার রায়দানের জন্য আমাকে আর রাশেটকে বাদ দিয়ে, মিশেলকে নিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়ায় তেরো। কিন্তু তেরো সংখ্যাটা অপয়া ভাবার জন্য একজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি হলেন কাউন্টেস আন্দ্রেনী। কাউন্ট বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী সারারাত কামরায় ছিলেন এ কথায় অবিশ্বাস করিনি। স্ত্রীর বদলে তিনিই আঘাত করে আসেন।
দীর্ঘদিন সুনামের সাথে চাকরী করার পরও এ কাজ মিশেল করল কেন? তাকে তো ঘুষ দিয়েও বশ করা যায় না তাহলে কি মিশেল আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে যুক্ত? যদি তা হয় তবে কিভাবে? যে মেয়েটি অন্যায় ভাবে পুলিশের কাছে সন্দেহজনকভাবে মনোকষ্টে আত্মহত্যা করেছিল তখনই মনে পড়লে যে মিশেল হয়ত সেই হতভাগিনীর পিতা এবং তখনই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল। এবং ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসকেই খুনের সম্ভাব্য জায়গা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং কিভাবে? মনে হয় কর্নেল আবাথনট আর্মষ্ট্রং-এর বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে যুদ্ধের সময় হয়ত কাজ করে থাকবেন। ইল্ডগ্রেদ স্মিটকে ভালো রাঁধুনি হিসাবে মনে হয়েছিল আমার, তবে কি আর্মষ্ট্রং-এর বাড়িতে রান্নার কাজ করত?
কথার ছলে তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনি খুব ভালো রান্না জানেন তাই না। শ্রীমতী স্মিট এ কথায় সায় দেন। যাদের কাছেই তিনি রান্না করেছেন সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। সুতরাং পরিচারিকার কাজ তাতে রান্নার প্রশংসা পাবার সুযোগ তার থাকার কথা নয়।
মিঃ হার্ডম্যানের প্রেমিকা ছিল সেই ফরাসী মেয়েটি। শুধু এটুকু ছাড়া কোনো যোগাযোগ ছিলনা আর্মষ্ট্রং পরিবারের সাথে। ওঁর কাছে বিদেশিনীর কথা তোলায় ওর চোখ জলে ভরে যায়। তবে উনি এমন ভান করেছিলেন যে বরফের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যময় নাটকে শ্রীমতী হার্বাডের ভূমিকা সবচেয়ে কঠিন। এই ভূমিকায় তিনি অতুলনীয় তিনিই রাশেটের পাশের কামরায় ছিলেন। তিনি এও জানতেন যে রাশেট খুন হলে সন্দেহ তার দিকেই পড়বে তাতে তিনি পিছু না হঠে আগাগোড়া চমৎকার অভিনয় করে গেছেন। কারণ তিনি প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী শ্রীমতী আর্মষ্ট্রং-এর মা।
সত্যিই আপনি বুদ্ধিমান। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন শ্রীমতী হার্বাড। আমার আরো ভালো করে খেয়াল করা উচিত ছিল। আপনি তো সবই বোঝেন। কিন্তু এটা নিশ্চয় বোঝেন নিউইয়র্কের একটি সকাল কি ভয়ঙ্কর হয়েই না ধরা দিয়েছিল কয়েকজন নিরাপরাধ মানুষের জীবনে। আমি দুঃখ যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম মঁসিয়ে, শুধু আমি নই সমস্ত আর্মস্ট্রং পরিবারে যারা ওই সময় যুক্ত ছিল তারা সকলেই। কর্নেল আবাথনট-জনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন যুদ্ধের সময়। স্বৰ্গতজন আমরা বড় দুঃখে শপথ নিয়েছিলাম, বললেন শ্রীমতী হার্বাড। যে কাসেট্টিকে চরম দণ্ড দেব। বারোজন ছিলাম আমরা দলে, না না এগারোজন, ফ্রান্সে তখন সুশানের বাবা মিশেল। আমরা প্রথমে ঠিক করি লটারিতে যার নাম প্রথমে উঠবে সেই যাবে কাসেটিকে চরমদণ্ড দিতে। শেষে মত বদল হয়। আন্তেলিও প্রথম এই প্রস্তাব করে। মেরী সেটাকে ছকে ফেলে। ম্যাককুইনের সাহায্যে, ম্যাককুইন আমার মেয়ের বন্ধু স্থানীয় ছিল।