শ্ৰীমতী হার্বাড শুনে সম্মতি জানালেন।
পোয়ারো বলে চললেন, আততায়ী এর পর হাতের কাছে শ্রীমতী হার্বাডের ভোলোটা পেয়ে তার মধ্যেই ছোরাটা ফেলে দেয় এবং তার পোশাকের একটি বোতামও খোয়া যায় মুহূর্তের অসতর্কতার ফলে। তারপর অন্য একটি খালি কামরায় পোশাকটা ছেড়ে ঐ কামরার মহিলা যাত্রীর বাক্সে ঢুকিয়ে দেয় এবং ট্রেন ছাড়বার আগের মুহূর্তে চট করে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে। হ্যাঁ, যে পথে সে কোচে প্রবেশ করে সেই পথেই।
কিন্তু ঘড়ির ব্যাপারটা! মিঃ হার্ডম্যান বললেন।
রাশেটের ঘড়িতে পূর্ব ইউরোপের সময় নির্দেশ করা আছে যার ফলে সব সময় সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে থাকে। রাশেট জারব্রেডে এসে ঘড়ির কাটা পিছিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিল। সুতরাং সে খুন হয় সওয়া একটায় নয় সওয়া বারোটায়।
রাশেটের কামরা থেকে একটা বাজতে তেইশ মিনিটে যে স্বর শোনা গিয়েছিল তার ব্যাখ্যাটি কি?
সে স্বর হয় রাশেটের নয় হত্যাকারীর।
সেটা নাও হতে পারে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হয়ত তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন। যখন তিনি দেখলেন রাশেট মৃত তৎক্ষণাৎ কণ্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে ডাক ঘণ্টা বাজান। পরে তার নিজের ভুল বুঝতে পারেন। কণ্ডাক্টর যদি এসে তাকেই হত্যাকারী বলে সন্দেহ করে এই কারণেই তিনি রাশেটের জবানীতে বলেছিলেন কামরার ভেতর থেকে। কণ্ডাক্টর বুঝেছিলেন তাকে প্রয়োজন নেই বলেই ফিরে গিয়েছিলেন।
মাদাম আপনি মনে হয় কিছু বলবেন?
হা নিজের ঘড়ির কাঁটা তো আর ঘোরাতে ভুলে যাইনি?
না মাদাম, আপনার কামরায় লোকটি যখন ঢোকে আপনি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। আপনি আধ ঘুমে তার উপস্থিতি অনুভব করেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর দুঃস্বপ্ন চোখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এবং আপনি তখন ঘন্টা বাজান। কোনো হিসাব ছিল না চেতনায় ঘুম, স্বপ্ন এসবের।
রাজকুমারী বললেন, আমার পরিচারিকাটি সে বলেছে আমার কামরায় গভীর রাতে আসার সময় সে দেখেছিল লোকটিকে।
আপনার একটা রুমাল রাশেটের কামরায় পাওয়ার ফলে যে আপনাকে সন্দেহ মুক্ত করতে উল্টোপাল্টা বলেছিল তার আনুগত্যের তারিফ করতে হয়। সে লোকটিকে দেখেছিল ঠিকই ট্রেনে তবে চলার পরে নয়, গভীর রাতে গাড়িটা যখন ভিনভোকিতে দাঁড়িয়েছিল তখনই।
সত্যিই আপনার বিচারবুদ্ধি প্রশংসনীয় মঁসিয়ে, রাজকুমারী বললেন।
না না এটা কোনো প্রকৃত রহস্যের সমাধান নয়। এই ব্যাখ্যা পুলিশ হয়ত মেনে নেবে কিন্তু এতে আমার সায় নেই, বললেন ডাক্তার।
বেশ তাহলে আমি অন্য সম্ভাব্য সমাধানটা জানিয়ে দিচ্ছি, তবে প্রথম সমাধানটি ভুললে চলবে না। বলা যায় না শেষ পর্যন্ত প্রথমটাই হয়ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবেন আপনারা, বললেন পোয়ারো।
প্রথম দিন কুক খানাকামরায় বসে বলেছিলেন যে নানা দেশ নানা ভাষা আর নানা জাতের মানুষ আছেন এই যাত্রীদের মধ্যে। তখনই আমার মনে হয় একমাত্র ট্রেন বা জাহাজ ছাড়া কোথায় এমনভাবে বিভিন্ন দেশের মানুষ জমায়েত হতে পারেন। শুধুমাত্র আমেরিকাতে একটা সংসার হতে পারে নানা দেশের লোক নিয়ে। একই বাড়িতে থাকতে পারে ইতালিয়ান ড্রাইভার। ইংরেজ গভর্নেস, সুইডিস নার্স, ফরাসী পরিচারিকা ইত্যাদি। বিষয়টি একটু ভাবতেই আর্মষ্ট্রং পরিবারে কোনো ভুমিকা কাকে দেওয়া যায় সেই বিষয়ে নির্ভুল অনুমান করতে পেরেছি।
প্রত্যেক যাত্রীরই সমস্ত অদ্ভুত তথ্য পেলাম ম্যাককুইনের সাথে দ্বিতীয় বার যখন মিলিত হলাম। উনি অদ্ভুত একটি মন্তব্য করলেন, রাশেটের কামরায় একটুকরো আধপোড়া কাগজ পাওয়া গেছে। উনি সেটা শুনে বিস্মিত হলে বললেন কিন্তু সেটা তো…মানে তার পক্ষে খুবই বোকামীর কাজ হয়েছিল। ম্যাককুইন তার কথাটা ঘোরাতে গিয়ে প্রায় বলেই ফেলেছিলেন যে সেটা তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল তার মানে তিনি চিঠিটা সম্পর্কে জানতেন। অর্থাৎ হয় তিনি বা তার সহযোগী হত্যাকারী।
মাস্টারম্যান বলেছিল যে তার মনিব ট্রেনে যাতায়াতের সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে থাকেন। অন্যান্যবার সত্যি হলেও গত রাত্রে যে প্রাণহানির আশঙ্কায় ঘুমের ওষুধ না খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা তার বালিশের তলায় গুলিভরা পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল। তবে রাশেট গতরাত্রে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল অজান্তে। ঘুমের ওষুধ কে তাকে খাওয়াতে পারে? যে কোনো একজন হয় মাস্টারম্যান নয়ত ম্যাককুইন।
মিঃ হার্ডম্যানের পরিচয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না কিন্তু রাশেটকে বাঁচাতে তার অন্তরিকতা সম্বন্ধে। যদিও রাশেটকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন তবে নিশ্চয় তিনি তার কামরাতেই থাকতেন অথবা এমন কোনো জায়গায় থাকতেন যাতে তীক্ষ্ণ নজর রাখা যায় বা মঁসিয়ে কুককে বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন। তবে তার সাক্ষ্য থেকে এটুকু প্রমাণ হয় যে হত্যাকারী কোচের বাইরের কেউ নয়।
কর্নেল আর মেরী ডেবেনহ্যাম যে পরস্পর পরস্পরের খুব কাছাকাছি এবং ওদের অন্তরঙ্গতা আমার চোখে ধরা পড়ে যায়। তা সত্ত্বেও ওরা না চেনার ভান করে ছিলেন, দুজনে। দুজনকে সেটা বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হয়নি। রাশেট পুলিশকে ফাঁকি দিলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা আর্মষ্ট্রং পরিবারে যুক্ত ছিলেন তারা রাশেটকে চরম শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং চমৎকার ভাবে ছকে ফেলেন তারা।