গলার স্বরটা ফ্যাসফ্যাসে। নিষ্ঠুরতা আর খলতা-মেশানো।
মঁসিয়ে কুকের সাথে পোয়ারো যখন হোটেলের বাইরে বারান্দায় মিলিত হলেন, এই দুজন তখন হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে মালপত্র। সবকিছু তদারক করছে যুবকটি। মিঃ র্যাফোট সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে বলল। কাঁচের দরজাটা সে ঠেলে ধরে।
বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
মৃদুস্বরে পোয়ারো বললেন, মঁসিয়ে কুক, আপনার কি মনে হয় এই দুজন যাত্রী সম্বন্ধে?
নিঃসন্দেহে আমেরিকান।
তাতো বটেই কিন্তু মানুষ হিসাবে যুবকটি তত দিব্যি চমৎকার।
আর অন্যজন?
সত্যি কথা বলব? দেখলেই কেমন গা জ্বলে যায়, আমার মোটেই ভালো লাগেনি। পোয়ারো এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমার কি মনে হয় জানেন? আমার পাশ কাটিয়ে একটা বুনো হিংস্র জন্তু বেরিয়ে গেল।
ষোল আনার উপর আঠারো আনা কিন্তু কেতা আছে।
যা বলেছেন, ওর মধ্যে যেন ভেতরের পশুটা ঘাপটি মেরে বসে আছে। এই জামাকাপড় মানে বাইরের চটকটা যেন খাঁচার মতো।
এঃ এটা আমার বড্ড কষ্টকল্পনা হয়ে গেল না?
হতেও তো পারে। মনে হল পাশ দিয়ে সাক্ষাৎ শয়তান হেঁটে গেল।
ওই আমেরিকান বুড়ো ভদ্রলোকটি?
হা, ওই আমেরিকান বুড়ো ভদ্রলোকটি।
হেসে ফেললেন মঁসিয়ে কুক।
জগৎটাই যে শয়তানের কুক্ষিগত কি আর করবেন বলুন, ঘোর কলিকাল।
ম্যানেজার এগিয়ে এলেন দরজা খুলে।
আমি সত্যিই লজ্জিত মঁসিয়ে পোয়ারো কোনো ফার্স্ট ক্লাস বার্থ খালি নেই।
মঁসিয়ে কুক চেঁচিয়ে উঠলেন।
কি? এমন অবস্থা বছরের এই সময়েও। সাংবাদিকরা নির্ঘাত কোথাও যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে নাকি দলের রাজনৈতিক নেতারা? কিন্তু অবস্থা তো শোচনীয়।
জানি না স্যার। পোয়ারোর দিকে ফিরলেন মঁসিয়ে কুক।
আমি তো আছি কিছু ভাববেন না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেব। ষোল নম্বরটা খালি যায়। কণ্ডাক্টরকে বলছি। সময় হয়ে এসেছে আসুন রওনা হওয়া যাক।
কণ্ডাক্টর গার্ড স্টেশনে মঁসিয়ে কুককে বিনীত নমস্কার জানালেন। হাজার হোক ওপরওয়ালা তো বটে।
শুভ সন্ধ্যা মঁসিয়ে। আপনার কামরা এক নম্বর।
কুলিকে ডেকে গার্ডটি মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠল, পিছু পিছু কুক আর পোয়ারো। আজ নাকি সব জায়গা ভর্তি হয়ে গেছে তোমাদের শুনলাম।
হা মঁসিয়ে। কি কাণ্ড দেখুন যেন সারা দুনিয়ার লোক একই জায়গায় যাচ্ছে।
আমার সেসব জানার দরকার নেই। একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে আমার এই বন্ধু ভদ্রলোকটির জন্য, ষোল নাম্বার কামরায় বন্দোবস্ত করে দাও।
উপায় নেই মঁসিয়ে। ওখানেও জায়গা নেই।
সেকি। ষোল নম্বরেও?
কণ্ডাক্টর ও গার্ডের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মঁসিয়ে কুক তাকালেন। লম্বা ফ্যাকাসে চেহারার মাঝ বয়েসি লোকটি। কণ্ডাক্টর হাসল।
আজ সব ভর্তি হ্যাঁ আমরা তো বলছি মঁসিয়ে।
কিন্তু হলটা কি? মঁসিয়ে কুক রাগী গলায় বললেন। কোথাও সভা-সমিতি আছে নাকি কোনো?
না, মঁসিয়ে, হঠাৎই আজ রাতে যাত্রা করতে যেন সব লোকই মনস্থ করেছেন।
বেলগ্রেডে এথেন্সের কোচটা জোড়া হবে। বুখারেস্টে প্যারিস কোচটাও জোড়া হবে। কিন্তু সেও আগামীকাল সন্ধের আগে নয়। কোনো সেকেন্ড ক্লাস বার্থও খালি নেই। আজ রাতের ব্যবস্থাটা কি হবে?
একটা সেকেন্ড ক্লাস বার্থ অবশ্য খালি আছে।
তাহলে?
মানে ওই কামরায় একজন মহিলা আছেন। একজন জার্মান সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলার পরিচারিকা। মঁসিয়ে কুক মাথা নাড়লেন।
ওঃ হো ওখানে তো অসুবিধা হবে।
আমি এমনি যেভাবে হোক চলে যেতে পারব। না, না অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই বললেন পোয়ারো।
মঁসিয়ে কুক ধমক দিলেন।
আপনি থামুন তো। কি কন্ডাক্টর যাত্রীরা কি সবাই এসে গেছেন?
একজন যাত্রী এখনও এসে পৌঁছাননি, কণ্ডাক্টর দ্বিধার সুরে বলল। সেকেণ্ড ক্লাস! সাত নম্বর বার্থ, উনি তো এখনও এলেন না। এখন নটা বাজতে চার মিনিট।
বুকের মালপত্র রদেরি হচ্ছে দাবিস তিনি যত
যাত্রীটি কে?
একজন ইংরেজ মিঃ হ্যারিস। কণ্ডাক্টর হাতের তালিকা দেখে বলল।
মিঃ হ্যারিস? ডিকেন্সের বইয়ের এক চরিত্রের নাম। পোয়ারো বললেন, মিঃ হ্যারিস হয়তো এখানে এসে পৌঁছবেন না।
সাত নম্বরে এই ভদ্রলোকের মালপত্র রেখে দাও, মঁসিয়ে কুক বললেন। যদি মিঃ হ্যারিস এসেও যায় ওঁকে বলে দেবে ওনার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে এই ভদ্রলোককে বার্থটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে যা হোক করে বোঝানো যাবে, মিঃ হ্যারিস তিনি যত লাটসাহেবই হোন না কেন আমার কিছু এসে যায় না।
তাহলে সেই ব্যবস্থাই করি, বলল কণ্ডাক্টর।
কণ্ডাক্টরর পোয়ারোর কুলিকে নির্দেশ দেবার পর বলল, একেবারে শেষের ঠিক আগের কামরাটা আপনার মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো মন্থর গতিতে এগিয়ে চললেন। বেশির ভাগ কামরার দরজায় যাত্রী বা যাত্রিনীরা দাঁড়িয়ে। তিনি যাকে তোকাতালিয়ান হোটেলে দেখেছিলেন পোয়ারোর কামরার ঠিক ভেতরে লম্বা সুদর্শন যুবকটি, পোয়ারোকে দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল। কামরা চিনতে মনে হয় আপনার ভুল হয়েছে। রীতিমতো কষ্ট করে ভাঙা-ভাঙা ফরাসী ভাষায় সে পোয়ারোকে বলল।
পোয়ারো ইংরেজিতে উত্তর দিলেন।
আপনিই কি মিঃ হ্যারিস?
না, আমার নাম ম্যাককুইন, আমি…।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কণ্ডাক্টরের গলা শোনা গেল। ক্ষমা প্রার্থনার সুরে সে বলছে, উপায় নেই মঁসিয়ে এই ভদ্রলোককে এখানেই ব্যবস্থা করে দিতে হল অন্য কোথাও জায়গা খালি না থাকায়।